আম্বেদকর এবং সংবিধান প্রণয়ন – সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
ডক্টর ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, একজন জ্যুরিস্ট, রাজনৈতিক নেতা, বৌদ্ধ আন্দোলনকারী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, বাগ্মী, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবী ও বৌদ্ধ পুনর্জাগরণবাদী। ইনি বাবাসাহেব নামেও পরিচিত ছিলেন। ভারতের সংবিধানের খসড়া কার্যনির্বাহক সমিতির সভাপতি ছিলেন তিনি। ড. আম্বেদকর জাতীয়তাবাদী এবং ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ইনি ভারতের সংবিধানের মুখ্য স্থাপক। ২০১২ সালে হিস্ট্রি টি. ভি.১৮ আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা তিনি “শ্রেষ্ঠ ভারতীয়” হিসেবে নির্বাচিত হন।
ড. আম্বেদকর প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশে ইকোনোমিকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের প্রথম ইকোনোমিকে পিএইচডি ডিগ্রি, এবং প্রথম দুবার ইকোনোমিক্সে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ভারতবর্ষের প্রথম আইন মন্ত্রী। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় পৃথিবীর ১০০ পণ্ডিতের মধ্যে ইনি আছেন। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে প্রথম এবং শুধুমাত্র ইনিই লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস থেকে সমস্ত বিজ্ঞান বিষয়ের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
১৯৩৬ সালে আম্বেদকর স্বনির্ভর শ্রমিক দল প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি ১৯৩৭ সালের কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়ন পরিষদ বা বিধানসভার নির্বাচনে ১৫টি আসন লাভ করে। নিউইওর্কে লিখিত গবেষণালব্ধ উপাত্তের ভিত্তিতে একই বছর তিনি তার বই ‘দ্য এন্নিহিলেশন অব কাস্ট’ প্রকাশ করেন। ব্যাপক জনপ্রিয় সাফল্য অর্জনের পর, আম্বেদকর গোঁড়াবাদী ধর্মীয় নেতাদের এবং নিম্ন সাধারণের জন্য অস্পৃশ্য, বর্ণ প্রথার তীব্র সমালোচনা করেন। আম্বেদকর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা সমিতির এবং রাজপ্রতিনিধির নির্বাহী সভায় শ্রম মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন।
সংবিধানের প্রণেতা ডক্টর বাবাসাহেব আম্বেদকর সংবিধান প্রণয়ন করার পর সংবিধান মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কতটা কার্যকরী ভূমিকা নেবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। অর্থাৎ সংবিধান তো তৈরী হল, এবারে যাদের জন্য সংবিধান অর্থাৎ মানুষ, তাদের জীবনে এর গ্রহণযোগ্যতা কতটা হবে। যে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের খসড়া তৈরী করার সময় সেগুলি যথাক্রমে—স্বাধীনতা, সমানতা আর ভাতৃত্ববোধ। এই তিনটির সম্মিলনের মাধ্যমে সংবিধান বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ সম্ভব বলেই অনেকাংশে মনে করতেন আম্বেদকর। আম্বেদকর আরেকটি বিষয় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, সেটা হল জাতিভেদ প্রথা ও ধর্মীয় বিভেদ। এগুলো যে সংবিধানের মূল চালিকাশক্তি অর্থাৎ জাতীয় একতায় আঘাত করবে এবং এর ফলে সংবিধান মানুষের জীবনের প্রাত্যহিকতায় প্রাসঙ্গিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে, সে বিষয়ে তিনি একদম নিশ্চিত ছিলেন। যদিও এরপরে বিয়াল্লিশতম সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-কে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে, যদিও বাস্তবে তার প্রভাব নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়।
বাবাসাহেবের এই শঙ্কা আসলে কতটা যুক্তিসঙ্গত তা কিছু তথ্যের মাধম্যে বোঝা যেতে পারে। তথ্য বলছে, এক লক্ষ পয়তাল্লিশ হাজার শব্দ নিয়ে গঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও তথ্যবহুল সংবিধান হওয়া সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক সূচক অনুযায়ী সংবিধান প্রণয়নের দিক থেকে ভারতের অবস্থান বিশ্বে ৫১ তম। অর্থাৎ বাবাসাহেবের অনুমান অনেকাংশে একেবারে ঠিক। কোনো সংবিধান কতটা ফলপ্রসূ হবে সেটা নির্ভর করে সংবিধান যারা পালন করে তাদের ওপর। সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা হওয়ায় ভারতে সেটা নির্ভর করে সরাসরি জনগণের ওপর। অর্থাৎ সংবিধান কার্যকর হবার প্রায় সত্তর বছর পরেও আমরা ভারতীয়রা সংবিধানকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারিনি। আপনি মুখে যাই বলুন না কেন ওপরের তথ্যগুলো তাই বলছে।
এই তো হল সংবিধানের কথা। এবারে আসি রাজনৈতিক নেতাদের দল বদল প্রসঙ্গে। সংবিধানে কিছু মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে, যদিও সব মৌলিক অধিকারগুলো অবশ্য চরম বা শর্তহীন নয়। সেই মৌলিক অধিকারের বলেই, কোনো ব্যক্তি যে-কোনো রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাস রাখতে পারেন এবং আবার পরমুহূর্তেই সেই রাজনৈতিক বা তাত্ত্বিক মতবাদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে অন্য মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠতেই পারেন। ভারতবর্ষের মতো একটা বৈচিত্র্যময় দেশে, হরেক রকমের মতাদর্শ থাকাটাই স্বাভাবিক, এবং এর ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো গড়ে উঠেছে। এবারে প্রসঙ্গটা এখানে অনেকটা এরকম, ধরুন কোনো বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি দলের নেতা বা নেত্রী, জনাদেশ পেয়ে জনতার প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন। এবারে হঠাৎ করেই সেই ব্যাক্তি তার রাজনৈতিক দল বদল করে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মতবাদে বিশ্বাস করা অপর একটি রাজনৈতিক দলে চলে গেলেন। এক্ষেত্রে এক বা একাধিক কারণ থাকতেই পারে, আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। কিন্তু ভাববার বিষয় এটাই যে সেই ব্যক্তি নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ তো পরিবর্তন করলেনই আর সেই সঙ্গে নিজের নতুন মতাদর্শ চাপিয়ে দিলেন তার আগের রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর বিশ্বাস করা বিপুল সংখ্যক মানুষের ওপর। ঠিক এখানেই নৈতিক অবক্ষয়। অর্থাৎ কোনো এক ব্যাক্তির মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা। এখানেই মৌলিক অধিকারের যথার্থ অপব্যবহার করা হল আর এক্ষেত্রে সমস্যার বিষয়টা হল এটা যাদের সাথে হল তারা সেটা বুঝলোই না।