বদগন্ধ – রাজর্ষি বর্ধন
গন্ধটা গত কয়েকদিন ধরেই গুঁতো দিচ্ছে রামহরিবাবুর নাকে। নস্যি নিলে, রুমালে সুগন্ধি মাখালেও যাচ্ছে না– ঠ্যাঁটা কুকুরের মতো এক জায়গায় পড়েই রয়েছে – হুড়ো দিলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই! ভারি মুস্কিলে পড়েছেন রামহরিবাবু!
বউমা নীতা ভারী শান্ত, সুশ্রী ও আধুনিকা মেয়ে, সেও রোজ এসে বলে, “ঘরে ধুপকাঠি জ্বালিয়ে রাখি বাবা, দেখবেন সব বদগন্ধ কেটে যাবে!”
তাই জ্বালাতে বলেন রামহরি, কিন্তু কোথায় কি? বদ্ধ ঘরে ধূপের ধোঁয়ায় কুণ্ডলী পাকিয়ে যায়! দমবন্ধ হয়ে আসলে শেষে ধূপ নিবিয়ে দিতে হয়, তবু সেই ভেষজ ধূপের কড়া গন্ধের চাইতে বদগন্ধটাই প্রবল হয়!
কতরকম বাজে গন্ধই তো নাকে টের পেয়েছেন এ জীবনে – সেগুলোকে ঝালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি? পচা খাবারের দুর্গন্ধ, পেচ্ছাপ-বিস্তার গন্ধ, নর্দমার গন্ধ, ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারিও করেছেন একটা সময় লোকের ঘেমো গন্ধ শুকতে শুকতে! বলা যেতে পারে, তাঁর নাক সুগন্ধের চাইতে দুর্গন্ধই নিয়েছে বেশি! তবু যেন এই গন্ধটা সেসব গন্ধকে ছাপিয়ে যাচ্ছে! সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে তাঁর নাকে লেগে রয়েছে। বাজারে, চায়ের দোকানে, মায় গতকাল কাঁচরাপাড়ায় বোনের বাড়িতে গেছিলেন, সেখানেও এই গন্ধ তাঁকে তাড়া করে বেরিয়েছে!
রামহরিবাবু চিন্তা করলেন, বয়স তো তাঁর কম হল না – এই বয়সে রোগব্যাধি শরীরে বসবাস করবে পাকাপাকিভাবে এটাই তো স্বাভাবিক! এমনটাও কি হতে পারে যে তাঁর শরীরের ভেতরে কোন অঙ্গ পচে-টচে গেছে যার জেরে এই গন্ধের সূত্রপাত!
পাড়ার ক্ষিতীশ ডাক্তার বহুদিনের পুরনো। তিনি রামহরিবাবুকে দেখেটেখে নিয়ে বললেন, “নাকের অলফ্যাক্টরি লোবে তো অসুবিধা দেখতে পাচ্ছি না, শরীরেও কোন প্রবলেম নেই! আপনি বরং কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে নিন, এটা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হলেও হতে পারে!”
শুনেই দমে গেলেন রামহরিবাবু। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা? তাঁর? তিনি কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছেন? হতে পারে বয়সের কারণে, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর একাকীত্বে, দুবছর আগে নিজের দীর্ঘ আটত্রিশ বছরের সঙ্গী বীণাকে হারিয়ে একটু অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন – তাই বলে মাথার গণ্ডগোল হওয়ার তো কোন কারন হয়নি!
সেটা শুনে ক্ষিতীশ ডাক্তার একরকম চটে গিয়েই বলেছিলেন, “সবই যদি আপনারাই বুঝে যাবেন তো আমরা আমাদের পসার গুটিয়ে ফেলি! অনেক সময় বয়সকালে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি না পেলে ব্রেনে কেমিক্যাল ইম্ব্যালেন্স হয়, তখন এসব রিয়্যাকশনগুলো ঘটে!”
রামহরিবাবু আর কথা বাড়ালেন না, তাই হবে হয়ত! তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, এ বিষয়গুলো তাঁর অজানা নয়। মাথার মধ্যে রাসায়নিক ইম্ব্যালেন্স, হতেও পারে – চতুর্দিকেই তো ইম্ব্যালেন্সের ছড়াছড়ি, তিনি মনে করলেন!
সেই রাতেই তিনি নিজের ঘরে একাকী একটি ভ্রমণ পত্রিকায় নিবিষ্ট হয়ে ছিলেন, এমন সময় তাঁর ছেলে মনীশের প্রবেশ ঘটল, যেটা আজকাল সচরাচর ঘটে না, তাই রামহরিবাবু বেশ অবাকই হলেন!
মনীশ ঢুকেই বলল, “ডিস্টার্ব করলাম না তো?”
প্রশ্নটা বেশ সৌজন্যমূলক শোনাল। তিনি বদগন্ধটা আবার টের পেলেন, এবং বেশ তীব্রভাবেই!
“না না, একদমই না! কি বলবি বল?”
মনীশ বেশ ইতস্তত হয়ে রামহরিবাবুর হাতে একখানা কাগজ ধরিয়ে দিলো। তিনি দেখলেন, সেটা একখানা কোর্টের কাগজ। বদগন্ধটা নাকে ধক করে এসে লাগল! তিনি বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, “এসব কি?”
মনীশ ইতস্তত ভাবটা ঝেরে ফেলে জোর গলাতেই বলল, “এটা কোর্টের কাগজ বাবা! আমাদের দুই ভাইবোনের – মানে আমার আর রুমার নামে এই বাড়ির অংশটা লিখিয়ে দিয়েছিলে, এটা তারই কাগজ!”
রামহরিবাবু উদগ্রীব হয়ে বললেন, “ হ্যাঁ কিন্তু এসব আমায় এখন দেখাছিস কেন?”
মনীশ বিনা সঙ্কোচে বলল, “তুমি তো জানোই আমার ট্র্যান্সফারাবেল জব, আগামী মাসেই আমায় বোম্বে চলে যেতে হচ্ছে! কবে ফিরব জানি না, তাই তার আগে আমার হিসেবগুলো বুঝে নিলেই ভালো হয়। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ বোধহয়, আর তা না হলে পরিষ্কার করে দিচ্ছি – আমি আমার অংশ বুঝে নিতে চাই! কে বলতে পারে, পরে তোমার মাইন্ড চেঞ্জ হয়ে গেল – আর আমায় সবদিক থেকে বঞ্চিত করলে!”
রামহরিবাবু আর থাকতে পারলেন না, সারা ঘরে একটা বিকট বদগন্ধের কালো মেঘ যেন টের পেলেন, যেটা প্রায় আক্রমণকারী সৈন্যদলের মতো সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে তাঁর নাকের রন্ধ্র দিয়ে শরীরের সমস্ত স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ছে! আদালতের কাগজটা বিষধর সাপের মতো লাগছিল হাতে ধরে রাখতে! তিনি চোখ বন্ধ করলেন, তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল সাঁইতিরিশ বছর আগের ছবি – অফিসের কাজ ফেলে হাসপাতালে ছুটছেন রামহরিবাবু, হাতে কাগজে মোড়া একখানা সোনার বালা নিয়ে, তাড়াহুড়োর মধ্যে অনেক কষ্টে জোগাড় করতে পেরেছেন! সদ্যজাত পুত্রের মুখ কি আর খালি হাতে দেখা যায়?
পরক্ষনেই দৃশ্যান্তর ঘটল, ভেসে উঠল আরও একটা দৃশ্য। খেয়েদেয়ে সবে শুতে যাবেন তিনি, মশারির ভেতরে ঢুকে বেড সুইচ টিপতে গিয়ে দেখলেন পাশের ঘরে টেবিলে পড়ছে কিশোর মনীশ, তার মাথার কাছে বসে রয়েছে স্ত্রী বীণা, আর দু’সপ্তাহ পরেই মনীশের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা, তাই ছেলের ওপর সর্বক্ষণ নজর বীণার!
আরও দৃশ্য পরপর ভেসে আসছিল, কীভাবে জয়েন্ট পরীক্ষার ফল বেরোনোর দিন সারাদিন উপোস করে ঠাকুরঘরে পড়েছিল বীণা! ছেলেকে শিবপুরে পড়ানোর জন্য দেশের কিছু জমি বিক্রি করতে হয়েছিল, যা রাখা ছিল রুমার বিয়ের জন্য! একমাত্র মেয়ের বিয়েতে তাই তেমন জাঁকজমক করতে পারেননি তিনি !
মনে পড়ে, স্ত্রীর মৃত্যুর সময় ছেলে ইউরোপে ছিল – কোম্পানির প্রজেক্টে। ফিরেছিল প্রায় তিন সপ্তাহ পরে। বীণার মুখাগ্নি করেছিল রামহরিবাবুর ভাগ্নে!
যেই স্বামী- স্ত্রীর সুখ- দুঃখ, হাসি- আহ্লাদ- যন্ত্রণার সিংহভাগ জুড়ে ছিল মনীশ, সে আজ নিজের হিসেব বুঝে নিতে এসছে, বাড়ির অংশ চাইতে এসেছে!
বিকট বদগন্ধটা পাহাড়ের মতো রামহরিবাবুর মাথায় চেপে বসেছে! তিনি ঘর কাঁপিয়ে প্রায় ফেটে পড়লেন মনীশের ওপর, “দূর হয়ে যায় গর্ভস্রাব! ভেবেছিস কোর্টের কাগজ দেখালেই বাড়ির ভাগ পাবি! যে বাড়ি আমার রক্ত জল করে তৈরি করা, যে বাড়ির প্রত্যেকটা ইটের মধ্যে তোর মা বেঁচে আছে তা একখানা কাগজ দেখালেই ভাগ হবে ভেবেছিস! বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে!” রামহরিবাবু বেশিক্ষণ কথা বলতে পারছিলেন না, বদগন্ধে তাঁর দম আটকে আসছিল, বুকের ওপর কে যেন পাথর চাপা দিচ্ছে, তিনি জ্ঞান হারালেন!
বুকভরা শ্বাস নিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে রামহরিবাবু বলে উঠলেন, “আহ!” সত্যিই এক মনোরম, স্বর্গীয় অনুভুতি চারপাশে টের পাচ্ছেন তিনি !
আশ্রমের এই চত্তরটাই সব থেকে সুন্দর। পরিবেশটাও তেমনই। চারিদিকে কত মরশুমি ফুলের সমারোহ! জীবনের বাকি ক’টা দিন এখানেই কাটাবেন, এমনটাই ঠিক করেছেন তিনি। পেনসনের টাকায় ভালোভাবেই চলে যাবে তাঁর। আর তাঁর কোন পিছুটান নেই, নিজের বাড়ির প্রতি, নিজের সন্তান – যাদেরকে নিজের শরীরের অংশ বলে মনে করে এসেছিলেন এতদিন, তাদের প্রতি! আশ্রমের মহারাজের সঙ্গে অল্পদিনেই ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছে, তিনি আশ্রমের ছাত্রদের জন্য পার্টটাইম টিউটর রাখার কথা ভাবছেন, সে ব্যপারে রামহরিবাবুর সঙ্গে কথাও হয়েছে, তাঁর আপত্তি নেই, সময় কাটাবার একটা অবলম্বন পেয়ে গেলেন তিনি!
এখন আর বদগন্ধ তাঁকে তাড়া করে না, তাঁর চারিপাশে সারাক্ষণই লেগে থাকে জুঁই, চাঁপা আর বিভিন্ন ফুলের সুগন্ধ।
One Comment