তার গল্প – সরোজ দরবার
পুরোপুরি নিরপেক্ষ ছিল সে। কোনও দলের সঙ্গেই তার কোনও যোগাযোগ ছিল না। অন্তত তার টুথব্রাশ, মাজন, চায়ের কাপ, বিস্কুটের কৌটো এমনটাই জানত। এ নিয়ে তারা তাই কোনোদিন কোনও সন্দেহ প্রকাশ করেনি।
আর এমনিতে তো সে শান্তই। আপনভোলা বলতে হয়। মাথা ঠান্ডা। সাতে-পাঁচে নেই। এতটা বড়ো হয়েছে, কোনোদিন কোনও দলের দিকে সে ফিরেও তাকায়নি। কোনও দলও তার দিকে তাকায়নি। একটা ইশতেহারও সে পড়েনি। কেউ তার হাতে ইশতেহারও দেয়নি। মিছিলে কেউ তাকে ডাকেনি। সেও কোনোদিন মিছিলে হাঁটেনি। শুধু ভোটের স্লিপ পেয়েছে সে এতদিন। আর নখের কালি। এর বাইরে আর কিছু নয়। একটা রাজনৈতিক কথা কেউ কোনোদিন তার মুখ থেকে শুনেছে কি না, মনে করতে পারল না। শুধু একদিন, যেদিন মাংসের একটা হাড় তার দুই চোয়ালের চাপ থেকে ফসকে বেরিয়ে আসতে চাইল, সে মৃদু স্বরে বলে ফেলেছিল, শালা মরা মুরগিরও এত প্রতিরোধ! তার মুখে এরকম কথা বেশ বেমানান। কিন্তু যেহেতু সে খুব আস্তে বলেছিল কথাটা, তাই আর কেউ শুনতে পায়নি। আর এরপর স্বভাবিকভাবে যা হয়, তাই-ই করেছিল সে। খুব জোরে চাপ দিয়েছিল, যাতে হাড়টা গুঁড়িয়ে যায়। তারপর তারিয়ে তারিয়ে চিবিয়ে ধুলোর মতো করে ফেলে থালার পাশে থু থু করে ফেলে দিয়েছিল।
এতে কেউ কোনও সন্দেহ করেনি। করার কথাও নয়। বরং তার বাড়ির লোকেরা এই ভেবে খুশি হয়েছিল যে, ছোটোবেলায় সে মাংসের হাড় চিবোতে বেজায় অপটু ছিল। আর এখন কেমন সহজেই ধুলো করে দিতে পারে।
অবশ্য এই ঘটনায় কিছুই প্রমাণ হয় না। কারণ, সকলেই জানেন, সে নিরপেক্ষই ছিল। অন্তত তার তেল-সাবান-মাজান, স্নানের গামছাও, সে কথাই জানত।
আর একদিনের কথা। একটা ছোট্ট লাল ডেঁয়ো পিপড়ে তার গায়ে উঠে পড়েছিল। হালকা ফুঁ দিয়ে সে সেটাকে ফেলে দিতে গেল। কিন্তু পিপড়েটা উলটে তার চামড়ায় মরণকামড় বসিয়ে দিল। সামান্য একটা পিপড়ের কামড়। কিন্তু তার খুব জ্বালা করল। জায়গাটা ফুলেও গিয়েছিল। সে তখন টোকা দিয়ে পিপড়েটাকে ফেলে দিল। কিন্তু বলার কথা হল, এরপর একদিন লাল পিপড়ের সরু লম্বা লাইন দেখে আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সে। পিপড়েগুলো বোধহয় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরছিল। হয়তো বৃষ্টির গন্ধ পেয়েছিল। সেই উদ্বাস্তু পিপড়েদের লম্বা লাইন দেখেই তার সেই পুরনো ফুলে ওঠা জায়গাটার কথা মনে পড়ল। যেন একটু মিশমিশিয়েও উঠেছিল জায়গাটা। সে তখন পায়ের জুতো দিয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে পিপড়ে মারতে লাগল। একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে না-যাওয়া অবধি যেন তার শান্তি নেই। এতবার করে পা ঘষল সে।
অবশ্য এতেও কিছু প্রমাণ হয় না। এমনিতে সে কোনও দলের ছিল না। নিরপেক্ষই ছিল। অন্তত তার মুদির দোকান, সেলুন, হাট-বাজার তাই-ই জানত। এমনকি, একদিন সে তার বন্ধুকে যেদিন বেধড়ক মারল সেদিনও তার সাইকেল, পাড়ার রক, মোড়ের জটলা – কেউ কিছুই ভাবেনি। বরং ধরেই নিয়েছিল যে, এমন ঠান্ডা মাথার ছেলেও যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তখন উলটোদিকে কিছু প্ররোচনা ছিলই। সকলে সেই উলটোদিকেই ঝুঁকে পড়েছিল। আর সেই আলোচনার অবসরে সে মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকেছিল। কে যেন শুধু বলেছিল, সে নাকি একবার একটা বেড়ালকে ইঁদুর ধরতে দেখে খুব খুশি হয়েছিল। একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো হাততালি দিয়ে উঠেছিল। শুধরে দিয়ে আর একজন বলেছিল, বাচ্চা ছেলের মতো নয়, সে নাকি তখন বেশ বাচ্চাই ছিল।
যাই হোক, এর পরের গল্পটা বেশি নয়। তাই খুব সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক। পুলিশ যখন তাকে খুনের দায়ে ধরতে এল, সকলেই হতবাক। তার চায়ের কাপ, বিস্কুটের কৌটো, তেল-সাবান-গামছা, পাড়ার জটলা, হাটবাজার, মুদি সেলুন – সব্বাই। কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে, সে একজনকে খুন করেছে। ফলে আইন আইনের পথেই চলবে। এবং তাকে খুনির সাজা মাথা পেতে নিতে হবে।
কিন্তু এই যে সে, এই যে ছাপোষা সে, সে একটা খুন কেন করবে? আর ঠিক তখনই প্রশ্নটা উঠেছিল। সে কি কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল? মতবিরোধ থেকে খুন! কোন পক্ষে ছিল তবে সে!
তখনই জিজ্ঞাসাবাদ পর্বে উঠে এসেছিল উপরের সব ঘটনাগুলো। এক একটা উত্তর একেক রকমের বিস্ময়ের, যদিও নেহাতই সাধারণ। যদিও তা থেকে প্রমাণিত হয় না যে, সে কোনও পক্ষ নিয়েছিল। বা, এই ঘটনাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বলে দিতে পারে না যে, খুনি হয়ে ওঠার প্রস্তুতি বহুদিন আগেই শুরু হয়েছিল তার মধ্যে। তবু, এখন এই খুনের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ঘটনাগুলোর ডট কানেক্ট করতে চাইলে, একটা রেখার অবয়ব ফুটে ওঠে বইকি।
তবু এই যুক্তি কেউ দেখালে, পালটা প্রশ্ন তো করাই যায় যে, যে মানুষ ফুল ছেঁড়ে, গাছ কাটে, মাছ বা মুরগি-খাসি কাটে, তাদেরও তবে খুনি হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এবং সভ্য সমাজকে তাহলে প্রতিনিয়ত তাদের থেকে দূরত্ব মেনটেন করতে হয়! যা সম্ভব নয়। উচিতও নয়। তা হয়ও না। ফলে এই সব ঘটনাবলি থেকে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। শুধু, নির্জলা সত্যি এই যে, সে একটা খুন করেছে।
এরপরে আর গল্পের কিছুই নেই প্রায়। স্রেফ একটা খটকা ছাড়া। এই যে সে, ছাপোষা কিছু ঘটনায় ব্যাখ্যাত সে, ঠিক কখন ছাপোষা থেকে খুনিতে রূপান্তরিত হল? একটা কোনও বিন্দুর কি দেখা মেলে? সহজ নয় খুঁজে পাওয়া। সে নিজে ছাড়া এ বিন্দু আর কেউই খুঁজে পাবে বলে শেষমেশ কেউ আর ভরসা করেনি।শুধু বাকি থেকে গিয়েছিল পুকুরপাড়। এযাবৎ তার কাছে কেউ যায়নি। তবে আসল বিন্দুটা কি না তার হাঁটুজলেই অবস্থান করছে।একদিন সে এই পুকুরপাড় ধরে ফিরতে গিয়ে দেখল একটা লিকলিকে সাপ ধরেছে ছোট্ট মাছকে। মাছটার ক্ষমতা তখন বেশি নেই। মরে যাবে খুব শিগগিরি। তাও শেষবারের মতো লেজটা একটু নাড়াবার ক্ষমতা রাখে। তাই-ই করল। সাপটা এঁকেবেঁকে তার সেই নড়নচড়ন সইয়ে নিল, যাতে মুখের কামড় ফসকে শিকার না পালায়। এইখানে দাঁড়িয়ে একবার তার মনে হয়েছিল, সাপটার গায়ে ঢিল ছুড়তে। যাতে সাপটা তার থেকেও বড়ো প্রাণীর অস্তিত্ব টের পেয়ে শিকার ছেড়ে পালায়। তাতে মাছটা বেঁচে গেলেও যেতে পারত। অথবা নাও পারত। কিন্তু একটা অসহায় মাছের কাতরানি, লেজ নাড়া দেখে সে স্থিরও থাকতে পারছিল না। অথচ বেশ বুঝছিল, সাপটাকে তাড়িয়ে কিছু লাভ হবে না। মাছটা মরবেই। কিংবা এটাই আসলে খাদ্য-খাদক শৃঙ্খল। তার এটা ভাঙার কোনও অধিকার নেই।
পুরো ব্যাপারটার দিকে সে আরো-একবার গভীর তাকিয়েছিল। এবং স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, সেই মুহূর্তে তার কোনও পক্ষ নেওয়াই উচিত নয়। সে ফিরে গিয়েছিল নিজের ঘরে।
কিন্তু থেকে যায় সেই একফোঁটা মাছের লেজ নাড়ানিটা। যতবার সে পুকুরপাড় ধরে যেত, ততবার মনে হত তার, একটা মাছ বাঁচার জন্য কাতরাচ্ছিল। লেজ নাড়াচ্ছিল, ছটফট করছিল। হয়তো মনে মনে প্রার্থনাও করছিল যে, তার তৈরি করা এই ক্ষুদ্র আলোড়ন কারো চোখে পড়ুক। কেউ তাকে বাঁচাক। এই পুরো ঘটনার সাক্ষী ছিল কেবলমাত্র সে। এবং সে কোনও পক্ষ নিতে পারেনি। সে নিরপেক্ষ থেকেছে। তাতে প্রকৃতির খাদ্য-খাদক শৃঙ্খল রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু সে শান্তি পায়নি।
একমাত্র পুকুরপাড়ই জানে, এখানটায় এসে, এই নাতিগভীর জলের দিকে তাকিয়ে সে কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠত। অসহায় হয়ে তাকাত। আর তারপরই একটা খুন করার জেদ চেপে উঠত তার মাথায়। ঠিক কোনদিন থেকে জানা নেই, তবে এই স্থির জলের মধ্যেই আছে সেই বিন্দু, সেই মুহূর্ত, যা ছাপোষা তাকে একদিন খুনি করে তুলেছিল। আজ পুলিশ এসে তাই তাকে নিয়ে গেল।
তার গল্পে এরপর আর কী-ই বা পড়ে থাকতে পারে! নেই-ও কিছু। শুধু সব চুকেবুকে যাওয়ার পর, এক সাংবাদিক – তিনি আসলে অফবিট গোছের কিছু স্টোরির খোঁজে ছিলেন – আমায় বললেন, আচ্ছা বলুন তো, সত্যিই কি ও কোনোদিন কোনও দলের ছিল না? আপনারা তো বহুদিনের পরিচিত? কিছু বেচাল লক্ষ্য করেননি? কোনোদিন কোনও পক্ষ নিতে? সে আমার পরিচিত শুধু কেন, কাছের মানুষই বটে। ফলে, এই মুহূর্তে আমি তাকে গোপন করি। তারপর নিচু গলায় বলি, না ভাই, আমি যদ্দূর জানি, কোনোদিন কোনও দলে ছিল না সে। পুরোপুরি নিরপেক্ষ-ই ছিল।
অদ্ভুত নিরাসক্ত ভঙ্গিতে লেখা। অসম্ভব হার্ড হিটিং। মার্ক এন্টনি স্টাইলের কথন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্রতা আর তারাপদ রায়ের বিদ্রুপ। চমৎকার