দুঃ-দর্শন – ঝুমা সমাদ্দার

শেয়ার করুন

টিভির মতো এমন বুঝভুম্বুল বাক্স’ আর হয়ই নাকোনটা যে মজার আর কোনটা যে
গম্ভীর হয়ে দু’দণ্ড ভাবার, বুঝে উঠতে পারাই সবচেয়ে গোলমালের। যত সিরিয়াস
অনুষ্ঠান, ততই মজাআর যত হাসির অনুষ্ঠান, ততই দুর্বোধ্য
ধরুন, আপনি খেটেখুটে অফিস থেকে ফিরে খবর দেখবেন মনে করে টিভিটা
চালালেন । দেখলেন কেউ গলায় ব্যাঙ বসিয়ে হেঁকে উঠলেন, “মঙ্গল গ্রহে
বুদ্ধমূর্ত্তি ।” ঢিঢ্ ঢিস্ ঢিস্ ঢিস্ (পিলে চমকানো মিউজিক) । আপনি
উৎকর্ণ হয়ে এগিয়ে বসলেন । বলে কি? মঙ্গল গ্রহে বুদ্ধমূর্ত্তি? ব্যাপারটা
কি? দেখতে হচ্ছে তো !
আমেরিকার আবিষ্কার, মঙ্গল গ্রহে বুদ্ধমূর্ত্তি । দুটি শব্দ যোগ হল

 আবার সেই পিলে চমকানো শব্দবাণ । আপনি মাথাটা আরও একটু এগিয়ে বসলেন ।
চায়ের কাপ আপনার হাতেই রয়ে গেল, ঠোঁট পর্যন্ত আর পৌঁছল না ।
মার্কিন উপগ্রহ থেকে আসা ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে
বুদ্ধমূর্ত্তির ছায়া ।” ঢিস্ ঢিস্ ঢিস্ ঢিস্ ঢিস্ । দুটি-চারটি করে শব্দ
যোগ হয় আর মিউজিকের ভলিউম ক্রমশঃ বাড়তে থাকে । এতক্ষণ যে ছবিটা
স্ক্রিণের এককোণ থেকে উঁকি মারছিল, সেটা এবার সরে এসে স্ক্রিণ জুড়ে বসল
আপনি তাড়াতাড়ি চায়ের কাপটা রেখে চোখ সরু করে দেখবার চেষ্টা করছেন,
স্ক্রিণের উপর লাল দাগ কেটে গোল করে দেখানো বস্তুটা কি ? বড় বড় পাথরের
মাঝে অস্পষ্ট ছায়া ছায়া মতন কি যেন ।
এমন সময় হঠাৎ শুরু হয়ে গেল ” অমুক টেলিব্র্যান্ড… আপনাকে দিচ্ছে
বাতের মলম, তার সঙ্গে আপনি ফ্রি পাচ্ছেন এক সেট কাঁচের গ্লাস ।” ব্যাস,
দিল আপনার উৎকণ্ঠায় জল ঢেলে । খানিক পরে আবার শুরু হলো । আবার যেই আপনার
ঔৎসুক্য, অনুসন্ধিৎসা ইত্যাদি ইত্যাদি চরমে, কিছু বোঝার আগেই আবার ফরসা
হওয়ার ক্রিম , নয় গেঞ্জি জাঙ্গিয়া, নয়তো হেল্থ ড্রিঙ্ক, কিছু না কিছু
একটা এসে হাজির হবেই হবে ।
বহুক্ষণ ধৈর্য ধরে, আপনি ব্যাপারটা দেখেই ছাড়বেন, বলে বসেই রয়েছেন, বসেই
রয়েছেন, অবশেষে দেখলেন, ঘটনার মোড় ঘুরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দিকে চলে
গেল । আপনি হাঁ করে বসে ভাবতে লাগলেন, হাসবেন নাকি কাঁদবেন ।
অথবা ধরুন, আপনার কিছুই ভালো লাগছে না । আপনি ভাবলেন, কমেডি শো
দেখে একটু মন হাল্কা করা যাক । কমেডি শো দেখে আপনার মনে হতেই পারে, ‘
ব্যপারটা কি হোলো ? হুমম্ , একটু ভাবতে হচ্ছে তো ।গুরুগম্ভীর সব
বিষয়বস্তু ।
তেমনি,সিরিয়াস খবরাদি দেখে আপনার হাসি পাবে, প্রতিযোগিতার বহর দেখে
আপনার কান্না পাবে , ডেলি শোপ দেখে আপনার পলিটিক্সের হাড় হদ্দ চেনা হয়ে
যাবে । চাই কি, আপনি ইলেকশনেও দাঁড়িয়ে পড়তে পারেন । আপনাকে জেতানোর
দায়িত্ব নেবে ডেলি শোপ ।
এসবের মধ্যে একমাত্র দ্রষ্টব্য জিনিস বিজ্ঞাপন । বিজ্ঞাপন দেখে
অন্তত আপনি হাসি কান্নার মাঝামাঝি একটা ইমোশন নিয়ে বসে থাকতে পারবেন ।
কষ্ট করে ভাবতে চেষ্টা করবেন না, ‘এটা কি ছিল?’ চোখ বন্ধ করে জানবেন,
সাদা রঙের ল্যাব কোট‘ , মানেই অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বস্ত। বিজ্ঞাপনের
মা‘ , মানেই আদর্শ মা‘ , তিনি অসম্ভব রকমের স্নেহপরায়ণা। যখন ছেলেপুলের
বেধড়ক পিটুনি প্রয়োজন, তখনও সেই মামিটিমিটি হেসে তাদের সমস্ত বায়না
মিটিয়ে থাকেন।
আর যে শো আপনাকে হাসাবে, কাঁদাবে, ভাবাবে, নাচাবে, গাওয়াবে, তা হলো
রিয়্যালিটি শোসব রকম ইমোশন হামানদিস্তায় পেশাই করে তৈরি হয় এই
রিয়্যালিটি শোকথা না ফোটা শিশু থেকে, কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ
পর্যন্ত, সক্কলে মুখিয়ে রয়েছি রিয়্যালিটি শো‘-এ নাম লেখানোর জন্য ।
একবার রিয়্যালিটি শোয়ে মুখ দেখাতে পারলেই পলকে বাজিমাত ।রাতারাতি
বিখ্যাত । ঠিক যেরকমটি আমি হয়েছিলুম।
হ্যাঁ, শোনো, এখনই পাঁচ কান কোরো না ।”-অফিসে দীপার ফোন আসা
মানেই, ফেরার সময় কিছু না কিছু নিয়ে বাড়িতে ঢোকার ফরমায়েশ । কিন্তু অমন
ফিসফিসিয়ে প্রেমালাপের মতো, কিংবা গোপন ষড়যন্ত্রের মতো হিসহিসে গলা শুনেই
ভেবলে গেছি ।
ম্.. মানে… ক্.. ক্কি.. হয়েছে? ”
ফোন এসেছিলো… ও.. ও”- ওরে বাপরে ! একেবারে কিলো খানেক রসগোল্লার রস
গলায় ঢেলে আহ্লাদে গলে গিয়ে টেনে টেনে বলে উঠেছে দীপা । একেবারে
বিবাহপূর্ব প্রেমকালীণ সুর দীপার গলায়। বেদম ঘাবড়ে গিয়েছি ।
ক্কার ফোন? কি বলেছে? কি হয়েছে, খুলে বলো দেখি ।”
চিৎকার করছ কেন ? আস্তে.. আস্তে । আরে, ‘নবজীবনচ্যানেল থেকে ফোন
করেছিল । রান্নার কম্পটিশনের রিয়্যালিটি শোয়ে যে রেসিপি পাঠিয়ে চিঠি
দিয়েছিলাম, মনে নেই? ওরা ফোন করেছিল । ডেকেছে সামনের মঙ্গলবার ।”-বুঝতে
পারলাম, এতো গোপন অথচ উত্তেজক খবরটা পরিবেশনের উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যায়
নিতাই এই অপাত্রেই পরিবেশন ।
বাড়ি ফিরতেই শুরু গোপন পরামর্শ । পিঠে পুলি স্পেশালএ কি কি
রান্না করা যায় , অডিশনে ওরা কি কি জিজ্ঞেস করতে পারে, কেমন ভাবে সাজলে
ভালো দেখায়, এমনকি দীপার মুখের কোন অংশটা বেশি ভালো দেখতে, ক্যামেরায়
সামনে মুখের কোন দিকটা ঘুরিয়ে দেখাতে হবে , সে বিষয়েও আমার বিশেষজ্ঞের
মতামত গুরুত্ব সহকারে ধার্য হল । আমার এই পদোন্নতিতে আমি যারপরনাই আপ্লুত
এই কদিনে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হওয়ার জোগাড়, দিবারাত্র একটাই
ভাবনা, এক্সক্লুসিভ অথচ স্বাদে-গন্ধে ভরপুর কি রান্না যথোপযুক্ত হয় ।
যদিও এই ব্যাপারে আমার হস্তক্ষেপ তেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তবু বিপদে পড়লে তো
মানুষ খড়কুটোটাও আঁকড়ে ধরে । অনেক ভাবনা চিন্তা, অনেক রান্নার বই-টই
ঘাঁটাঘাঁটির পর অবশেষে যেটা পছন্দ হলো, তা হলো, “লাউয়ের পায়েস” । কি
জ্বালা ! আর জিনিস পেল না ? লোকে যতই আজকাল লাউয়ের গুণপনায় মোহিত হয়ে
যাক, লাউয়ের নাম শুনলেই আমার কেমন যেন নিজেকে গরু‘ ‘গরুমনে হতে থাকে ।
নিরীহ, গৃহপালিত, ভাবলেশহীন । স্বভাবে যতই নিরীহ হই, মনে মনে আমার
দুরাকাঙ্খা, একদিন না একদিন আমি প্রবল পুরুষ সিংহহয়ে উঠবই।
হে ঈশ্বর ! মঙ্গলবার আর কতো দেরী ? প্রতিদিন এই এক লাউয়ের পায়েস
আমাকে গলাধঃকরণ করতে হচ্ছে । রোজ সকালে বাজারে গিয়ে নধর, গোলগাল, জমিদার
বাড়ির সেজকত্তার মতো গায়ের রঙ দেখে কচি লাউ কিনে আনো, আর বিকেলে তাই
দিয়ে প্রস্তুত অদ্ভুত স্বাদের পায়েস গেলো ।
একই পায়েস যে এত ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের হতে পারে ! বই দেখে
হুবহু টুকে দিলে নাকি চলবে না, থাকতে হবে নিজস্ব কিছু অভিনবত্ব । তাই
রোজই কিছু না কিছু এক্সপেরিমেন্ট চলছে , কখনো তার মধ্যে বাদাম কিসমিস
পড়ছে, তো কখনো খোয়া ক্ষীর, কখনো গোলাপ জল আবার কখনো মিঠা আতর । লাউ বাদ
দিয়ে বাদাম, কিসমিস, খোয়া ক্ষীর-টীর গুলোই কেবল দিলে হতো না ? ওসব
দেবভোগ্য জিনিসের ভুষ্টিনাশ করার জন্যই বুঝি এই অখাদ্য লাউ ! কখনো লাউ
কুরিয়ে নিয়ে ঘিয়ে ভেজে তৈরী করা হচ্ছে আবার কখনো সেদ্ধ করে জল ফেলে দিয়ে
লাউয়ের আদ্যশ্রাদ্ধ চলছে আর আমাকেই গিলতে হচ্ছে সেই পিন্ডি ।
ল্যাবরেটরির একমাত্র গিনিপিগ এই বেচারা আমি । আবার কোনমতে
জল-টল দিয়ে গিলে ফেললেও চলবে না, স্বাদ বুঝতে হবে, বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে
হবে ।
সকল আঁধার রজনীই একসময় অতিক্রান্ত হয় । হোলোও । অবশেষে
মঙ্গলবার এলো । দীপা, হ্যাঁ, দীপার মতো বীরাঙ্গনারও নাকি টেনশন হয় ! কি
আশ্চর্য ! যে কিনা এই সসাগরা পৃথিবীতে একমাত্র আরশুলাছাড়া কারওক্কে
ভয় করে না, তারও নাকি ভয় ভয় করছে । এই ধরিত্রী কাঁপানো সংকট মুহূর্তে আমি
ছাড়া কে তাকে উদ্ধার করবে ? বিশেষত, যখন পুরুষ সিংহহওয়ার বাসনা পোষণ
করছি মনে মনে । নিজেকে প্রমান করার এই সুযোগ ছাড়তে আছে ? চল, অফিস ছুটি
নিয়ে, গিন্নীর পেছু পেছু। উর্দ্ধ গগনে বাজে মাদলের ভঙ্গিতে চললাম।
সকাল থেকে লাউয়ের পায়েস হাতে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছি
রোদে গলদঘর্ম হয়ে। পৌঁছনোর পরই দীপার গায়ে সিরিয়াল নম্বর লেখা কাগজ
সাঁটিয়ে দিয়েছিল যা কিনা ঘামে ভিজে, কুঁচকে, নেতিয়ে বাসি লুচির দশা হয়েছে
দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পেটে ছুঁচোর ডন দিচ্ছে । মাঝে মনে হয়েছিল, দুচ্ছাই,
হলোই বা লাউয়ের পায়েস‘, খাদ্যদ্রব্য তো বটে, খেয়ে দেয়ে বাড়ি ফিরে যাই।
সাহস জুটিয়ে উঠতে পারিনি।
বেলা গড়িয়ে গেলে ডাক পড়ল দীপশিখা বসু, ততক্ষণে ছেড়ে দে
মা কেঁদে বাঁচিদশা, ভয় ডর আর কিছু নেই । আমার পুরুষ সিংহত্ব আর কোনো
কাজেই লাগল না । বাইরে ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর শ্রীমতী বেরিয়ে এলেন,
মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি ।
আবার সামনের সোমবার । এবার সবাইকে বলতে পারবো, বাড়ি ফিরেই
সব্বাইকে জানাতে হবে ।”-বোঝ, এই অধম যে অফিস কামাই করে সারাটা দিন প্যালা
দিচ্ছে, তার কথা মাথায় এল না । এল বন্ধু বান্ধবদের কখন বলতে পারবেন, সেই
কথা ।
খুশীতে ডগমগ করছেন মহারানি, ক্ষিদে তেষ্টা ভুলে । এদিকে আমার
প্রাণ যায় । এতগুলো দিন অখাদ্য কুখাদ্য গুলো আমাকেই গেলানো হয়েছে, আর
এখন এই আনন্দঘণ মুহূর্তে যত অকালকুষ্মান্ড বন্ধু বান্ধব । কোথায় আমাকে
একটু যত্ন আত্তি করে ভালো মন্দ খাওয়ানোর কথা ভাববে, তা নয় । খ্যাতির এমনই
মোহ ।
বাড়ি ফিরেই বসে পড়েছে ফোন হাতে নিয়ে । জনে জনে
পাকড়াও করে নিজের সাফল্যের বর্ননা দিয়ে চলেছে দিকে দিকে প্রচারিত
হচ্ছে নিজ খ্যাতি, নিজেরই মুখে। পদগৌরবে ভুলেই গেছে, এই গৃহপালিত বেচারার
কথা ।
আরে, বোসদা, এত বড় খবরটা চেপে গেলে ? কবে খাওয়াচ্ছো বলো
।”-পরদিন অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে সকলে । কি সর্বনাশ !
এরাও খবর পেয়ে গেছে ? কি এক বিখ্যাত হওয়ার ঠেলায়, কেবলই গাঁট-গচ্চা আমার
দীপার বান্ধবী সুনয়নার প্রতিবেশী আমাদের অফিসের মুখার্জিদা । তার কাছ
থেকেই রটেছে খবরটা অফিসে । এত তাড়াতাড়ি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ! এ যে
এপিডেমিকের বাড়া !
পরের সপ্তাহ জুড়ে চললো বিউটি পার্লার পর্ব । এবার তাঁকে টিভির
পর্দায় দেখা যাবে । অতএব, আর চেখে দেখা নয়, চোখে দেখার সাধনা । মাথা থেকে
পা পর্যন্ত ঝাড়পোঁছের ঠেলা । অফিসে বেরোনোর আগে যদি সারা মুখে সবুজ রঙের
পোঁচ দেখে বেরোই , তো অফিস থেকে ফিরে সাদা রঙের চুনকাম । আর তারই সঙ্গে
দামী শাড়ি, জুতো চটি, রকমারি কসমেটিকস্ কেনাকাটির পালা । এ কি রান্নার
প্রতিযোগিতা, না বিউটি কনটেস্ট কে জানে ।
সোমবার সকাল থেকে হই হই পালা । আজও এই বেচারাকেই গলায় ফাঁস দিয়ে
টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হলো, যদিও আজ আর তাঁর ভয় ডর কিছু ছিল না । আজ
পুনরায় তিনি বীরাঙ্গনা। তবু, একজনকে সঙ্গী করতে হবে, এমনকি , তার মুখও
দেখানো হবে টিভির পর্দায় । আহা ! কি পরম সৌভাগ্য আমার ! অবশেষে লাউয়ের
পায়েসের গুষ্টির ভুষ্টিনাশ করার দাম পাওয়া গেল হাতেনাতে । ফোকটে বিখ্যাত
হওয়ার পরম সুযোগ আমার কব্জায় ।
গেলুম। ক্যামেরার সমনে বসে বসে দেখলুম, রান্নার প্রতিযোগিতায়
আরও দুজন রাঁধুনীর সঙ্গে দীপাও সমান বিক্রমে রন্ধনযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলো ।
আগে পিছে গোটা তিনেক ক্যামেরা, তার সামনে রাঁধুনীরা বেশ সপ্রতিভ । মেয়েরা
সবসময়ই আমাদের চেয়ে বেশী সাহসী ।
আমরা তিন গোবেচারা স্বামী দুরুদুরু বক্ষে বসে আছি একটু
দূরে, চেয়ারে । তিনজনের মুখেই ক্যাবলা হাসি । বোঝাই যাচ্ছে তিন জনেই
ফোকটে বিখ্যাত হওয়ার লোভে অগ্রসর হলেও, এখন পেছন ফিরে দৌড় মারতে পারলে
বাঁচি । কেন যে আমাদের এখানে টেনে আনা, ক্যামেরার সামনে যে কি করা হবে
আমাদের নিয়ে, এই এখন আমাদের মনে লাখ টাকার প্রশ্ন
রান্না শেষ হলো । যা কিছু করার, যা কিছু বলার সঞ্চালক এবং
রাঁধুনীরাই করলেন, বললেন। আমাদের তেমন কিছু বলতে দেওয়া হয় নি । মা
বিপত্তারিনী বাঁচিয়েছেন । শুধু ক্যামেরার সামনে একটা ভ্যালভ্যালে হাসি
ঝুলিয়ে রাখা । সবশেষে রান্না চেখে দেখবার ভয়ংকর দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হল
ভালো লাগুক আর না লাগুক, অম্লান বদনে খেয়ে যেতে হবে, এতটুকু নাক মুখ
বিকৃত করা যাবে না, এই ছিল আমাদের চ্যালেঞ্জ । লোকে বিখ্যাত হওয়ার জন্য
কি না কি করছে, আর আমরা এ টুকু পারব না?
ভাবলেশহীন মুখে খেয়ে গেলাম, লবণাক্ত মুগডালের বাদশাহী
পাটিসাপ্টা‘, বিকট গন্ধ যুক্ত রুই মাছের ক্ষীরপুলি‘, এবং দীপার অদ্ভুত
স্বাদের লাউয়ের পরমান্নখেতে যেমনই হোক, জাঁকালো এক একটা নাম তো আছে
তারই জোরেই খেয়ে গেলাম । ভাগ্য ভালো, আমাদের উপর বিচারের ভার ছিল না ।
শুধুই খাওয়া, আর বহু কষ্টে “উমম, খুবই ভালো” , “অসাধারণ” , “দারুণ
হয়েছে,” ইত্যাদি বলে যাওয়া । তা ক্যামেরার সামনে এটুকু পারব না ? বিচারে
দ্বিতীয় হলো দীপার লাউয়ের পরমান্ন
সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে , পরদিন থেকে শুরু হলো আমার মিশন আত্মপ্রচার
যেখানে যাকে পেয়েছি, ধরে পাকড়ে, –
আরে, শ্যামলেন্দু যে, কেমন আছো ভাই ? ”
ভালো আছেন তো , মাসিমা? ”
কি গো খেন্তির মা, কেমন, ভালো তো ? ”
রাস্তা ঘাট, বাজার, অফিস, রেশন, দোকান কোথাও কাউকে ছাড়ছি না
পরিচিত, অপরিচিত, স্বল্প পরিচিত সবাইকে ধরে ধরে কুশল জিজ্ঞাসা করে
ছাড়ছি । আসল লক্ষ্য, যে করে হোক, জানিয়ে দেওয়া, আগামী মাসের সতেরো
তারিখে দীপার রান্নার এপিসোড টেলিকাস্ট হবে । তার সঙ্গে এই শ্রীমানেরও
বদনখানি দেখা যাবে টিভির পর্দায় । কোথাও ভিড়ের মধ্যে কোনো সামান্য
পরিচিত কারোকে দেখতে পেলেই হলো । ভিড়ের মধ্যে একবার খবরটা পরিবেশন করতে
পারলেই, কেল্লা ফতে । অন্তত দশটা মুখ আমার দিকে ঘুরে যাবে । আমিও চারদিকে
হাসি হাসি মুখে চাই । হ্যাঁ , আমিই সেই , যাঁকে সতেরো তারিখ টিভির
পর্দায় দেখা যাবে ।ওঃ, কি গর্ব !
দিন কুড়ি দিকে দিকে প্রচারের পর মনে হলো চেনা অচেনা কেউ আর
বাকি নেই খবরটা জানতে । তবে সম্প্রচারের দুই এক দিন আগে আবার সকলকে মনে
করিয়ে দেওয়া।
হ্যালো, সুশান্ত, ভালো তো? হ্যাঁ, যা বলছিলাম, মনে রেখো, আগামী বুধবার
কিন্তু , হ্যাঁ, বিকেল সাড়ে পাঁচটায়, ভুলে যেও না কিন্তু ।”- ভোলবার
কোনো উপায় রাখিনি তাদের ।। বার বার মনে করানোর পালা শেষ করে তবে ক্ষান্তি
দিলাম ।
পরদিন সকালে মর্নিংওয়াকে বের হতেই, আবছা অন্ধকারে হঠাৎ সামনে
উপস্থিত সমরেশদা ।
কাল দেখলাম তোমাকে টিভিতে । ভারী সুন্দর লাগছিল কিন্তু । তোমার
গিন্নীকে তো চেনাই যায় না । অপূর্ব !
না, মানে, ইয়ে, ঠিক ভেবে পাচ্ছি না…
কি আবার ভাববে হে ? কোনো ভাবনা নেই, যাব একদিন তোমার বাড়ি । তোমার
গিন্নী যে অত ভালো রাঁধতে পারেন, জানা ছিল না তো !কপাল করে বউ পেয়েছ ভাই
রোজ রোজ কেমন ভালো-মন্দ খানা জোটে তোমার কপালে । যাব ভাই, সময় করে
একদিন । কিছু ভালো-মন্দ আমাদের কপালেও কি আর জুটবে না ? হে হে ! আসি ভাই,
তাড়া আছে ।” -বলেই একরকম দৌড় লাগালেন । জবাব দেওয়ার মওকা না দিয়েই ।
বাজারে, অফিসে, পথেঘাটে যত পরিচিত-অপরিচিত সকলের মুখে একই কথা ।
কি ভালো যে লাগছিল তোমাকে দেখতে । আমার বাড়ির সক্কলে, এমনকি কাজের
মাসি, বাসনউলি, পুরাণা কাগিজ,ছাতা সারাবি পর্যন্ত সব্বাই তোমাকে টিভিতে
দেখতে পেয়ে কী খুশী… কী খুশী!
অফিসের অনিন্দ্যর পেয়ারের ছোট শালীর তিন বছরের মেয়েটা পর্যন্ত নাকি
সারাদিন না খেয়ে বসেছিল, টিভিতে আমাকে দেখবে বলে । তা থাকতেই পারে । আমি
তো , আমি, উত্তম পুরুষ, আমি তো আর অনিন্দ্য নই, যে অধম পুরুষ হব ।
কিন্তু মুশকিল একটাই, সেদিন অফিস কামাই করে বিকেল চারটে থেকে রাত নটা
পর্যন্ত টিভিতে জয় হনুমান চ্যানেলের সামনে ধর্না দিয়ে বসে থেকেও আমাকে
আমি দেখতেই পাই নি মোটে । পরে চ্যানেলে ফোন করে উত্তর পাওয়া গেল ,
অনিবার্যকারণবশতঃ ওই দিনের রন্ধনরঙ্গিনীঅনুষ্ঠানটি বাতিল করতে বাধ্য
হওয়ায় আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ।”

 

চিত্রঋণ মৌমিতা ভট্টাচার্য্য

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *