সন্ধিবেলার কাব্য : গোধূলি রেজিমেন্ট – ত্রয়ী চট্টোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

ঝড়ের সম্ভবনা যত গাঢ় হয় চরাচর স্তব্ধ হয়ে আসে; যুদ্ধ যত নিকটে আসে পরস্পর-বিরোধী অভিসন্ধিগুলো দানা বাঁধে, দল গড়ে। শ্রীকৃষ্ণ তর্জনীনির্দেশ করেন, ‘ধনুকে টঙ্কার দাও…নৌকো সাজাও’। এ কণ্ঠস্বর আসলে সময়ের, এ দাবিও সময়েরই। যুদ্ধের প্রাক-মুহূর্তে সূচনাধ্বনির অপেক্ষায় প্রশ্বাসে বারুদগন্ধ ভরে সবকিছুকে আপাতভাবে থমকে দেয় সময়; কিন্তু নিজে বইতে থাকে চোরাস্রোতের মতো। আবার অনিবার্য যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে মানুষ যখন আত্মসর্বস্ব হয়ে নিজেকে লালন করতে মগ্ন তখন সময়ের গর্ভ থেকেই জন্ম নেয় কবিতা, গান, ছবি, শিল্প যা মানুষকে বিস্মৃতির কানাগলি থেকে টেনে এনে সম্বিত ফিরিয়ে দিতে প্রয়াস পায়। এই দায়বদ্ধতা নিয়েই একজন মানুষ শিল্পী হয়ে ওঠেন, এই দায়বদ্ধতা থেকেই একজন কবি কবিতা লেখেন। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম কুড়ি বছর বিগত প্রায়। বর্তমান সময়ের দাবি মেনে নিয়ে যাঁরা কলমে শান দিচ্ছেন তাঁদের অন্যতম একজন কবি গৌরব চক্রবর্তী। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হল তাঁর ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘গোধূলি রেজিমেন্ট’।
চার ফর্মার এই বইতে আছে তিপান্নটি কবিতা। বেশিরভাগ কবিতাই প্রেমের কবিতা। সেই প্রেম মূলত ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে জন্ম নিলেও ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে। ছায়া বিছায়। ফুল ফোটায়। শিকড় ছড়ায়। আসলে কবিতার জগতে ব্যক্তিগত বলে কিছু হয় না। কবিতা যতখানি কবির তার থেকেও অনেক বেশি পাঠকের। ধরা যাক ‘গোধুলি রেজিমেন্ট’-এর দ্বিতীয় কবিতাটি অর্থাৎ ‘বৃষ্টি নামলে’ একটা আশ্রয়ের কথা বলে, বৃষ্টি হল সেই অনুঘটক যা দুটি মানুষের সম্পর্ক বা সম্পর্কহীনতার রসায়নকে অতীতচারী করে তোলে। যে আশ্রয় ছিল একদিন অথচ এখন আর তা নেই, সেই থাকা এবং না থাকার অনুরণন কবিতাটিকে ঘিরে আছে। এই কবিতা পাঠককে আত্মসমীক্ষণে উসকায়। সন্দেহ, অবিশ্বাস, জনশ্রুতি, ভ্রান্তির ঢেউ এসে ভেঙে দিয়ে গেছে কত বালির ঘর। পাঠক বোঝে সে সম্পর্ক-বাড়ির ভিতে বিশ্বাসের বন্ধন ছিল না কোথাও। পাঠক শেখে আরও কত আশ্রয় আর প্রশ্রয়ের প্রয়োজন একটা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে। কেমন হতে পারে মানুষের সেই চির-আকাঙ্ক্ষিত প্রেম সেকথা বলেছেন কবি তাঁর আরেকটি কবিতায়। কবিতার নাম ‘তোমাকে যেভাবে চেয়েছি’। এই কবিতায় প্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে অনেক object আছে। হাসি, ফুল, গান, প্রজাপতি, মেঘপিওন ইত্যাদি প্রভৃতি অলংকারের মতো ইতস্তত ছড়িয়ে আছে কবিতার শরীরে। কিন্তু কবিতার আত্মা নিহিত আছে একটি পরম প্রার্থনার ভিতর। সেই প্রার্থনা হলো, দুটি জীবন এক হয়ে যেন মিশে যেতে পারে পরস্পরের আকাঙ্ক্ষায়। এই পরম প্রার্থনা নিয়ে কবি যখনই নিমগ্ন হন তখনই সেই মগ্নতা অতীতের দরজা খুলে দেয়। অতীতটাই তখন হয়ে যায় বর্তমান। সেইজন্যই সরলরৈখিক সময়ের concept ভেঙে যায়। এমনকি ভবিষ্যতের সম্ভবনাগুলোকেও গ্রাস করে নেওয়ার আয়োজনে অতীত হয়ে ওঠে অমোঘ নিয়তি। ‘অপেক্ষা’, ‘দূরে দূরে’, ‘সম্পর্ক’, ‘গোলাপবিদূষী’, ‘ডানা’, ‘প্রতিটি নূপুর জানে’, ‘গায়িকা’, ‘সাময়িকী’ এই কবিতাগুলো সামগ্রিকভাবে অতীতময়। কিছু কবিতার ক্ষেত্রে কেন্দ্রে অতীত থাকলেও তাকে ঘিরে আবর্তিত কাল বর্তমান বা ভবিষ্যৎ-চিহ্ন দিয়ে বিন্যস্ত হয়।
‘ধ্বংসের মুখোমুখি’, ‘জন্মদিন, ২৪শে জুলাই’, ‘ক্ষমা’, ‘তর করিনি’ এমন কিছু কবিতা যেখানে প্রেম থেকেও নেই আর। অভিমান জমে জমে কবিতার কথাগুলো যেন প্রেমহীন বাঁচা অভ্যাস করে নিয়েছে। “আরও আরও অন্ধকার হও” অথবা “চিরকাল বুঝে নিও ভালোবাসা সহজে মেলে না” এই কথাগুলি উচ্চারিত হয়েছে অমোঘ যন্ত্রণা নিয়ে। সেই স্তর পেরিয়ে এসেছে নির্লিপ্তি। এমনই একটি কবিতা ‘ভোগ’। আরেকটি কবিতা ‘পাথরের ফুল’। এইসব কবিতায় কবি বিষাদমগ্ন হতে চান। বিষাদ লালন করেন। কিন্তু আনন্দকে এড়াতে পারেন না। কারণ বিষাদের সার-জলে পুষ্ট হয়েই বিচ্ছেদের ভূমিতে গোলাপ ফোটে। আরও একবার মনে পড়ে যায়—”Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.” P. B. Shelley
এই বইয়ের প্রায় সব কবিতাই গদ্য কবিতা। একটিমাত্র কবিতা ব্যতিক্রম—‘গোধূলি রেজিমেন্ট’। বিষয়বস্তু, গঠনবিন্যাস, স্বরনিক্ষেপ সব দিক থেকেই কবিতাটি ব্যতিক্রমী। আত্মরতির গণ্ডি অতিক্রমের অঙ্গীকার আছে এই কবিতায়। “গাছের বদলে গাছ…মৃত্যুর বদলে মৃত্যু না” বিবেকের উদ্দেশ্যে এই আহ্বান যেন নতুনের ইঙ্গিত। কাব্যবোধের এই বিস্তার, নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করার এই প্রয়াস কবিকে পাঠকের কাছে আরও সম্ভবনাময় করে তোলে। ব্যক্তিগত প্রেমের কুয়াশা ঘেরা প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিময় অনুভূতি অনুবাদের পাশাপাশি লেখা হয়ে যায় আরও কিছু কবিতা। যেমন ‘বাৎসল্য’, ‘সিরিয়া হত্যাকাণ্ডের পর’, ‘চিঠি’, ‘এই সবে বিশ্বাস করেছি’। বর্তমান সময়ের দাবি থেকেই লেখা হয়েছে এই কবিতাগুলি। মানুষ যত সভ্য হিসেবে এক এক ধাপ অগ্রসর হয়েছে ততই মানবিকতা, বিবেকবোধ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হিংসা, হত্যা, বিদ্বেষ, রক্তপাত এসব কিছুই বহুকাল আগে থেকে সভ্যতার সমান্তরালে বয়ে চলেছে। তাই সিরিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমরা খুব সহজেই মিলিয়ে নিতে পারি জালিয়ানওয়ালাবাগের অগ্নিকাণ্ডকে বা হিরোশিমা নাগাসাকির বোমা বিস্ফোরণকে অথবা হোয়াইট হাউস ধ্বংসকে। গৌরবের এই কবিতাগুলি তাই বিশেষ কোনো দেশকালের পরিসরে বিচার না করাই শ্রেয়। আজ একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও যখন খুবই দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশ এবং প্রতিবেশী কিছু দেশের সঙ্কট উপস্থিত হয়েছে রাজনৈতিক দলাদলি, কুসংস্কার ও ধর্মীয় মৌলবাদকে ঘিরে তখন গৌরবের কিছু কবিতা খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। এই ঘনিয়ে ওঠা দূরবস্থার দিনে এমন কবিতাই পারে বিবেক জাগিয়ে তুলতে। সমস্ত অশুভ, অবিশ্বাস, সঙ্কটকে ফ্রীজ শটে স্থির করে দিয়ে কবি বলেন “ভালোবেসে ভালো থাকা যায়”।

প্রচ্ছদ

এই বইতে মনোযোগ আকর্ষণের দুটি শৈল্পিক প্রচেষ্টা আছে। এক. চিত্রকল্প নির্মাণ। আর দুই. নতুন কিছু শব্দ নির্মাণ। চিত্রকল্পের ব্যবহার অনেকাংশেই চেতনাপ্রবাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন ধরা যাক “প্রজাপতিরা উড়ে উড়ে এসে আমাদের স্বপ্নগুলো থেকে রং মাখতে মাখতে ফিরে যাবে…”, “দিগন্ত ডুবে গেছে সূর্যাস্ত সম্বল নিয়ে”, “তোমার কল্কালাগা চাহনিগুলো” অথবা একটিমাত্র শব্দ “কদম্বকবরী”— কথার পাশে কথা সাজিয়ে এমন ছবি ফুটিয়ে তোলায় কবিতায় আলাদা মাত্রা যোগ হয়েছে। যেকোনো মেজাজের কবিতাতেই স্বতন্ত্র স্বর নির্মিত হয়েছে। আর আছে নতুন শব্দ। যেমন ‘বাতাসমাতৃক’, ‘জীবাশ্মমাধুরী’, ‘বিকেলপনা’, ‘বিষাদ-তহবিল’, ‘কলমপ্রণতি’। কবি এই শব্দগুলি সৃষ্টি করেছেন বেশ প্রত্যয়ের সাথে। শব্দগুলির প্রয়োগ বিভিন্ন কবিতায় কাঙ্ক্ষিত আবহাওয়া নির্মাণ করেছে। তবে এগুলির আবেদন কেবল অনুভূতির জগতে।
ব্যক্তিগত প্রেম, অপ্রেম, বিষাদ, নির্লিপ্তি পেরিয়ে কবি বলেছেন বৃহত্তর প্রেমের কথা, মানবতার কথা। তবু নির্মম সত্যি এটাই যে যুদ্ধ হয়। শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যই কখনো কখনো অনিবার্য হয়ে ওঠে যুদ্ধ। নতুন কিছু সৃষ্টি হয় পুরাতনের ধ্বংসস্তূপের উপরেই। তাই পালনকর্তাই একসময় হয়ে ওঠেন সংহারক। শ্রীকৃষ্ণ বলেন “পৃথিবী উড়ে যাক একা একা যুদ্ধ পরিক্রমায়”। কবি শ্রীকৃষ্ণের মিথ এবং গীতার যুদ্ধলগ্নের প্রাক-মুহূর্তটির বিনির্মাণ করেছেন খুবই নিপুণতার সাথে। বর্তমান কালবেলায় যখন পারমাণবিক ব্রহ্মাস্ত্র বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশের মুঠোর মধ্যে তখন হিংসা, রক্তপাত, স্বেচ্ছাচার সচেতনভাবেই ভুলে থাকতে হবে আমাদের। মহাভারতের কাহিনিতেও আমরা দেখেছি মানবসম্পদ রক্ষার স্বার্থে যুদ্ধঘোষণার পূর্বে একাধিকবার শান্তিপ্রস্তাবের প্রসঙ্গ এসেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত দুইপক্ষকে কুরুক্ষেত্রে মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সেটাও ছিল এক সন্ধিলগ্ন। কৌরব ও পাণ্ডব দুইপক্ষ নিজেদের ভ্রাতৃত্ব ভুলে অপেক্ষা করেছিল কতক্ষণে শঙ্খধ্বনি হবে। চতুরঙ্গ বাহিনীর পদযাত্রার ধূলায় সেদিনও আকাশ আচ্ছন্ন করে ঘনিয়ে এসেছিল এক গোধূলি। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যুগে যুগে বারবার ঘটেছে। আজও এমনই গোধূলিবেলা যখন প্রেমের আলো আর অপ্রেমের অন্ধকার দ্বন্দ্বে মেতেছে। মানবতার আকাশ আচ্ছন্ন করেছে সংশয় আর অবিশ্বাসের ধূলিকণা। এই সময়ের, এই সন্ধিবেলার ফসল ‘গোধূলি রেজিমেন্ট’।

কাব্যগ্রন্থ গোধূলি রেজিমেন্ট
কবি গৌরব চক্রবর্তী
প্রকাশনা হাওয়াকল
প্রথম প্রকাশ ২০১৮
মূল্য ১৬৫ টাকা

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *