রোকেয়া : আজও সমান প্রাসঙ্গিক – আফরোজা খাতুন
নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর নারীশিক্ষানুরাগী কর্মযজ্ঞ ও তাঁদের ক্ষমতায়নের জন্য।আলোর বার্তা বহনকারী এই মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম১৮৮০ সালে অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এবং প্রয়াণমাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, কলকাতায়। রোকেয়ার জন্মও ৯ ডিসেম্বর বলে অনেকে উল্লেখ করলেও তাঁর জন্ম তারিখ নিয়ে কিন্তু এখনও বিতর্ক রয়েছে।
রোকেয়া বড় হয়েছেন কঠোর অবরোধ প্রথার মধ্যে। প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননি। বাড়িতে দাদা ইব্রাহিম সাবের আর দিদি করিমুন্নেসার কাছে ইংরেজি, বাংলা শেখেন। বিয়ের পর মুক্তমনা স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের সমর্থনে, সহযোগিতায় ইংরেজি-বাংলা-উর্দু বই পড়া ও সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। বিশ শতকের দ্বিতীয় বছরে বাংলা সাহিত্যে রোকেয়ার আর্বিভাব ‘পিপাসা (মহরম)’ প্রবন্ধ লিখে।
যখন যেদিকে চাই, কেবলি দেখিতে পাই-
“পিপাসা, পিপাসা”—
অসীম আলোর পিপাসা নিয়ে জন্মেছিলেন এই মেয়ে। তাই সমস্ত ঝড়ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করে আপন লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন। ১৯০৩-এ তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘অলঙ্কার না Badge of Slavery?’—নারীবাদী ভাবনার প্রথম প্রকাশ পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে। এই প্রবন্ধটি বিতর্কের সঞ্চার করে পুরুষ ও নারীর মধ্যেও। তাই সংশোধিত আকারে ‘আমাদের অবনতি’ শিরোনামে প্রকাশ হয়। তবুও তীব্র প্রতিবাদ চলে এই প্রবন্ধ নিয়ে। আর এক দফা সংশোধন করে ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ শিরোনামে মতিচুর সংকলনে প্রকাশিত হয়।
নারী জাগরণের কর্মী ও প্রেরণাদাতা রোকেয়া মেয়েদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মূল বাধা লক্ষ করেছেন সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে-‘…আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।…এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’
তাঁর বক্তব্যে, বিভিন্ন লেখায় এই খেদোক্তি ফুটে উঠেছে যে, দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ কিন্তু ঘরে ঘরে নারীদের অবস্থা ক্রীতদাসীদের থেকে কোন অবস্থায় ভাল নয়। সমাজের তৈরি নারীর এই দাসত্বের প্রশ্নে রোকেয়া যথেষ্ট মর্মাহত ছিলেন। মেয়েদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারে সজ্জিত হওয়াকেও দাসত্বের নিদর্শন মনে করে বলেছেন-‘…যে টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড় স্বর্ণ মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করেন, ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান-ভূষণে অলঙ্কৃতা করিতে চেষ্টা করিবেন। একখানা জ্ঞানগর্ভ পুস্তক পাঠে যে অনির্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলঙ্কার পরিলে তাহার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না।’দাসত্ব থেকে মুক্তির পথ শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। তাই রোকেয়ার বক্তব্য-‘যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না?’
রোকেয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা ‘Sultana’s Dream’ বা ‘সুলতানার স্বপ্ন’। সুলতানার স্বপ্নতে অবাধ কল্পনাশক্তি দিয়ে চিত্রিত করেছেন ‘নারীস্থান’, যেখানে লিঙ্গীয় ভূমিকা বাস্তবের বিপরীত। এই role reversal- এর সুবাদে মেয়েদের বিচরণ বাইরে আর পুরুষেরা রয়েছে অন্দরে। এখানে লেখক নারীকে পুরুষের সমান নয়, বরং তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হিসেবে চিত্রিত করেছেন।‘জেনানা’ প্রথার বিপরীতে‘মর্দানা’ প্রথা কল্পনা করে নারী-পুরুষের স্থান পরিবর্তন করেছেন। এই চিন্তা সেকালে এদেশে তো বটেই, সারা বিশ্বেই অভিনব ছিল। সম্পূর্ণ নারীবাদী চিন্তার ফসল তাঁর ‘সুলতানার স্বপ্ন’।
১৯০২ সালে রোকেয়া রচনা করেন তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’। যদিও গ্রন্থাকারে সেটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯২৪ সালে। পদ্মরাগ উপন্যাসের মূল পটভূমি ‘তারিণীভবন’ বস্তুত একটা নারী আশ্রম, যেখানে নানা ধর্মের, নানা বর্ণের নির্যাতিত, নিপীড়িত, সমাজ-নিষ্পেষিত, তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের ভিড়।পুরুষেরা এখানে অনুপস্থিত। কেবল কদাচিত দর্শনার্থী বা রোগী হিসেবে তাদের দেখা যায়।রোকেয়ার ব্যক্তিগত জীবনের আদর্শ এই তারিণীভবন। তাঁর মনের প্রশস্ত অসাম্প্রদায়িক আদর্শ এতে প্রতিফলিত হয়েছে।রোকেয়া এটাকে মধ্যবিত্ত গৃহের সীমানা ছাড়িয়ে সময়ের ঊর্ধ্বে এক বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন। তারিণী কর্মালয়ের সাহায্যে মেয়েরা খুঁজে পেয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ।যখন বাস্তবে ও সাহিত্যে ভদ্রমহিলাদের একটা অন্যতম লক্ষ্য ছিল সংসার, যখন নতুন যুগে, নতুন নারীর কাছে সংসার সুরক্ষা পবিত্র একটি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, যে দায়িত্ব পিতৃতন্ত্র আরোপিত, শোষণমূলক বোঝা এবং এটা বৈবাহিক সম্পর্কেরই অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ, যেখানে ভদ্রমহিলারা স্বেচ্ছায় প্রবেশ করেছে। অনিবার্যভাবে ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসের আয়েশা সিদ্দিকা সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে নিজেকে বোঝায় যে, স্বামীই নারীজীবনের সব চেয়ে বড় সম্পদ। তবু সে একাকী জীবন যাপনে তার সিদ্ধান্তের ব্যপারে অটল থাকে-‘ আমরা কি মাটির পুতুল যে, পুরুষ যখন ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করিবেন, আবার যখন ইচ্ছা গ্রহণ করিবেন?…তোমরা পদাঘাত করিবে আর আমরা তোমাদের পদলেহন করিব, সে দিন আর নাই।’ রোকেয়া নারীর আত্মমর্যাদা এবং আত্মনির্ভরশীলতার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
১৯৩১ সালে রোকেয়ার অবরোধ-বাসিনী প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের নিবেদন অংশে তিনি বলেছেন, ‘কতকগুলি ঐতিহাসিক ও চাক্ষুষ সত্য ঘটনার হাসি-কান্না লইয়া ‘অবরোধ-বাসিনী’ রচিত হইল।’ নিজ জীবনের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকেই অবরোধবাসিনীদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করে রোকেয়া বলেন-‘আমরা বহুকাল হইতে অবরোধে থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি। সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের-বিশেষতঃ আমার কিছুই নাই। মেছোনীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, “পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?”-সে কি উত্তর দিবে?’
জীবনের সকল অভিজ্ঞতা থেকে রোকেয়ার কর্মসাধনার মূল ব্রত হিসাবে উৎসারিত হয়েছে শিক্ষা আন্দোলন। ১৯০৯ সালে, স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর ভাগলপুরে পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ স্থাপন করেন। পারিবারিক নানা বাধা-সংকটে তাঁকে ভাগলপুর ছাড়তে হয়। ১৯১১ সালে আটজন ছাত্রী নিয়ে কলকাতায়প্রতিষ্ঠিত করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’টিকে। মুসলমান ঘরের মেয়েদের প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে নিয়ে এসে শিক্ষাদান সে সময়ে ছিল একটা বিরাট সংগ্রাম।ছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে আসার জন্য প্রায় এয়ারটাইট বাসের ব্যবস্থা করা হয়, পর্দা রক্ষার কারণে। রোকেয়ার এক বন্ধু মিসেস মুখার্জী বাস দেখে বলেছেন, ‘আপনাদের মোটরবাস তো বেশ সুন্দর হইয়াছে! প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে, আলমারী যাচ্ছে না কি-চারিদিকে একেবারে বন্ধ, তাই বড় আলমারি বলে ভ্রম হয়!’ স্কুলের ছোট ছোট মেয়েরা এই অন্ধকূপের মধ্যে ভয় এবং গরমে অজ্ঞান হয়ে পড়ছিল, বমি করছিল। তাই বাসের দরজার খড়খড়ি নামিয়ে, পর্দা দেওয়া হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি আসে রোকেয়ার কাছে, গাড়ির পর্দা বাতাসে উড়ে মেয়েদের বে-পর্দা করছে জানিয়ে। সমস্ত উর্দু দৈনিক পত্রিকা স্কুলের নামে কুৎসা রটাবে এইভাবে বে-পর্দাগাড়িতে মেয়েদের নিয়ে এলে। অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেও তিনি নিজে পর্দা মেনে চলতেন। এ সম্পর্কে রোকেয়া বলেছেন, ‘…আমি যে অনিচ্ছাকৃত অবরোধবাসিনী হয়েছি তার কারণ অনেক। আমার স্কুলটা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়ম-কাননগুলিও পালন করেছি। ‘অবরোধ-বাসিনী’-তে লিখেছেন-
‘কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,
কেন জন্ম লভিলাম পর্দা-নশীন ঘরে।’
নারীর মানবাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে রোকেয়া যেমন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তেমন ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ বা মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।এই সমিতির মূল লক্ষ্যই ছিল দেশের সুনাগরিক করে মুসলিম মেয়েদের গড়ে তোলা। নারী-অধিকার আন্দোলন, আত্মনির্ভরতার শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার প্রয়োজনীয়তায় আস্থা স্থাপন, দরিদ্র মেয়েদের শিক্ষাদান, বস্তিতে বস্তিতে কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রচার, অবরোধ থেকে নারীকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা, নির্যাতিত নারীদের আশ্রয় ও কাজের ব্যবস্থা, এমন নানাবিধ কাজে যুক্ত থেকেছে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’। রোকেয়া সাখাওয়াত বিদ্যালয়ের নথি, আঞ্জুমানের কাগজপত্র এবং তাঁর সাহিত্য আলোচনা করলেই বোঝা যায় রোকেয়া আজও কত প্রাসঙ্গিক।
ঋণ স্বীকার
১। মীরাতুন নাহার
২। সোনিয়া নিশাত আমিন
৩। মালেকা বেগম
[চিত্র ঋণ : ইন্টারনেট ]