ভাঙা চোয়াল, শক্ত চোয়াল – সৌম্যজিৎ রজক

ভাঙা চোয়াল, শক্ত চোয়াল – সৌম্যজিৎ রজক

শেয়ার করুন

আট ঘণ্টার বেশি কাজ নয়। এ তো আর নতুন না, সেই কবেকার দাবি! বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অর্জিত সে অধিকার। তবু আজও সাত সকালে বেরোতে হয় বাইক নিয়ে। কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা! বারোটাও বেজে যায় কোনও কোনোদিন।

জয়ন্তর এমনই জীবন। দৈনিক পনের ঘণ্টা গড়ে কাজ।

দিনে অন্তত ২২টা ডেলিভারি করেন জয়ন্ত। তবে গিয়ে বাইক মেইনটেনেন্স-তেল-মোবিলের খরচা কেটে হাতে শ’ পাঁচ-ছয়েক টাকা আসে। বাড়িতে ষাটোর্ধ্ব মা; দিনে তিনবার ইনসুলিন তাঁর। এছাড়াও সংসারের অন্যান্য খরচখরচা তো আছেই।

দক্ষিণ চব্বিশের সুভাষগ্রাম থেকে কলকাতার নেতাজিনগরে সুইগীর ইন্সটামার্ট। সেইখান থেকে মাল তুলে কাস্টোমারদের বাড়ি বাড়ি। তবুও নাকি সে ‘শ্রমিক’ নয়। ‘শ্রমিক’-এর কোনও অধিকারও নেই তাই। না ন্যূনতম মজুরি, না মেডিক্যাল লিভ। নেই ইএসআই। খাতায় কলমে দুর্ঘটনাজনিত কিছু সুবিধে থাকলেও সেটা পেতে ছুটে যায় কালঘাম।

গত ১৮ই এপ্রিল ২০২৩ জয়ন্তর বাইকে ধাক্কা মারে একটি গাড়ি। চোয়াল ভেঙে যায়। সেন্সলেস। কয়েকদিন আগে হাসপাতাল থেকে ফিরলেও এখনও কথা বলতে পারছেন না ভালো ক’রে। বাড়ি থেকে বেরোতে পারছেন না। টলছেন।

“এমনিতে দু-দিন কামাই হলেই কোম্পানি দিনে চার-পাঁচ বার ফোন করে। এবার ১০ দিন হয়ে গেল কাজে যাচ্ছি না, কোনও খোঁজ নেয়নি একবারও। কোনোই কি দায়িত্ব নেই কোম্পানির?” কেটে কেটে, থেমে থেমে একথা বলছেন জয়ন্ত।

খোঁজ আসলে আছে। খোঁজ আছে বলেই খোঁজ নিচ্ছে না কোম্পানি। জয়ন্ত জানেন। এরকম ডেলিভারি লাইনে যাঁরা কাজ করেন, সকলেই জানেন।

১০ দিন হয়ে গেল এক পয়সা ইনকাম নেই। আরও অন্তত এক মাস এরকম চলবে। এদিকে মায়ের তো দিনে তিনবার ইনসুলিন, আরও নানান ওষুধ। এখন নিজেরও গাদা গাদা ওষুধ, ড্রেসিং ইত্যাদি। এছাড়াও সংসারের অন্যান্য খরচখরচা তো আছেই। খিদেও তো পায় মা-ছেলের নির্দিষ্ট সময় অন্তর! পায় না কি?

দুর্ঘটনা বিমার টাকা আদৌ মিলবে কিনা জানা নেই। চিকিৎসার জন্য নেই ইএসআই। নেই অসুস্থতাজনিত সবেতন ছুটি। ন্যূনতম কোনও আয়। এত রক্ত, এত জান দিয়ে দুনিয়ার মজদুরেরা যেটুকু যা আইনি অধিকার, নিজেদের রক্ষাকবচ অর্জন করেছিলেন, তার সব কিছু থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে জয়ন্তদের। এই একুশ শতকে।

আমাদের দেশে শ্রমিকশ্রেণি তার সংগঠিত চেহারাটা হারাতে শুরু করেছিল বহু আগেই। বিগত শতকের শেষাশেষি; সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের শুরু থেকেই। এতদিনে অসংগঠিত ক্ষেত্রের চেহারাটাও চেতরে-বেতরে গেছে। সারা দুনিয়ার মতো এই দেশেরও একটা বড়ো অংশই এখন তথাকথিত ‘স্বনিযুক্ত’। আমাদের জয়ন্ত যেমন।

গত ১৮-ই মে ২০২২ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পর্ষদ ‘State of Inequality in India Report’ প্রকাশ করেছেন। দেখা যাচ্ছে তাতে, দেশে আয় করেন এমন জনসংখ্যার সর্ববৃহৎ অংশটাই ‘স্বনিযুক্ত’। ৪৫.৭৮ শতাংশ।

স্বনিযুক্ত-ফণিযুক্ত আসলে বাজে কথা। আসলে বেকার, কোনও কাজ জোটেনি তাই কিছু একটা করছেন নিজেই। সুভাষগ্রামের এই জয়ন্ত দে-ই তো আসলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্ট-এর ডিগ্রী ঝোলায় নিয়েও বেকার ঘুরে বেরিয়েছেন বাজারে। চাকরি পাননি। নিজে ছবি আঁকতেন, ছবি তুলতেনও। কোনও চাকরি না পেয়ে শেষমেষ ধারদেনা ক’রে ছোট্ট একটা স্টুডিও বানিয়েছিলেন এক বন্ধুর সাথে মিলে। মা-ব্যাটায় খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মতন ইনকাম হয়ে যেত। কিন্তু লকডাউন! আরও কোটি মানুষের মতো তাঁকেও কর্মচ্যুত করল।

বেকার ছেলেটা ফ্যা ফ্যা ক’রে ঘুরে বাড়াবে ক’দিন? এমনই সময়, আবার, ব্রেইন স্ট্রোক হল মায়ের। বাঁ চোখের দৃষ্টি মুছে গেল পুরোপুরি, ডান চোখে ক্ষীণ। বাইক একটা ছিল, তাই নিয়ে ভিড়ে যেতে হল ডেলিভারির কাজে। এই তো গল্প তাঁর ‘স্বনিযুক্তি’র।

এরকমেরই স্বনিযুক্ত সব কর্মীদের অধিকাংশই কোনও না কোনও রকমের শ্রমিক। কিন্তু ‘শ্রমিক’ ডাকলে দিতে হবে শ্রমিকদের অর্জিত আইনি অধিকারগুলো। সেসব দেবে না বলে এই এক চালাকি পুঁজিওয়ালাদের।

আসলে ‘শ্রমিক’, এঁদেরই চুরি যাওয়া শ্রমের মূল্যে মুনাফা বাড়ছে কারোর না কারোর। কিন্তু নতুন এক প্যাঁচ দিয়ে গল্পটা কেবল অন্যভাবে লেখা।

কীরকম প্যাঁচ? শ্রমশক্তিকে নিয়োগ করো, সেটা তো করতেই হবে নাহলে তোমার জন্যে বাড়তি মূল্য তৈরি করবে কে? মুনাফা জোগাবে কে? তাই নিয়োগ করতেই হবে, করো! কিন্তু করো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। পরোক্ষভাবে। প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কটাকে দাও আবছা করে। তাহলেই কেল্লাফতে! মুনাফাও বাড়বে, পুঁজিবাদের লাঠিও ভাঙবে না!

এই যে কায়দা তাতে জয়ন্তদের চোয়াল ভাঙে রোজ। চোয়াল ভাঙা জয়ন্তদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে তরতরিয়ে।

২০২২ সালেরই ২৭শে জুন ভারত সরকারের নীতি আয়োগ-এর রিপোর্ট বলছে, এই দেশে প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বাইরে থাকা শ্রমিকের সংখ্যাটা কম করে ৭৭ লক্ষ। এবং তা ২০২৯-৩০ এর মধ্যে দাঁড়াবে ২ কোটি ৩৫ লাখে। প্রসঙ্গত ব্রিটেনে গত অর্ধ দশকে এই ধরনের শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৫০ শতাংশ হারে।

সুভাষগ্রাম থেকে সুইৎজারল্যাণ্ড পর্যন্ত সস্তা শ্রমের বাজারে এভাবেই আরও বেশি বেশি জয়ন্তদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোজ। মে-দিনের সে লড়াই থেকে অবিরাম সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে অর্জিত শ্রমিকদের আইনি রক্ষকবচগুলো সব কেড়ে নিয়ে। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়। আগ্রাসী লুটেরা কর্পোরেটের সামনে।

শ্রম-পুঁজির তীক্ষ্ণ-তীব্রতর দ্বন্দ্বে আত্মসমর্পণ নয়, ইতিহাস আশা করে, প্রত্যাঘাত। জয়ন্ত আশা করে, ‘শ্রমিক’-এর স্বীকৃতি। আর অধিকার।

অথচ মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবার অধিকার তাঁর দিনদাহাড়ে লুট হয়ে যায় রোজ। রোজ রাতে অন্ধকার মেখে জেগে থাকেন জয়ন্ত! তাঁর মতো আরও হাজার যুবক।

রাত্রি বাড়তে থাকে যত, জয়ন্তদের চোয়ালগুলো তত শক্ত হতে থাকে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২