আদিবাসী বিদ্রোহ : একটি ব্যক্তিগত পাঠ – অন্বেষ বন্দ্যোপাধ্যায়

আদিবাসী বিদ্রোহ : একটি ব্যক্তিগত পাঠ – অন্বেষ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহগুলি স্বতন্ত্র গৌরবের দাবি রাখে। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এই স্বতঃস্ফূর্ত দ্বন্দ্বাহ্বান উঠে এসেছিল সমাজের সবচেয়ে নিচুতলা থেকে। এই বিদ্রোহের আদর্শ ও নেতৃত্ব পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছ থেকে ধার করা ছিল না। তা ছিল অনার্যদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর।

সামগ্রিকভাবে সমস্ত আদিবাসী বিদ্রোহগুলিকে অনুসন্ধান করা যাক। আমরা যাদের আদিবাসী বলি, তাদের মধ্যে নিজস্ব কিছু ভাগ আছে। বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি পরস্পরের থেকে আলাদা। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকেরা প্রথম থেকেই সমস্ত আদিবাসীদের এক ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই একটা সময়ের পর তারা সমস্ত উপজাতিগুলিকে সার্বজনীন করে তোলবার প্রক্রিয়া শুরু করে। কারণ আদিবাসীদের এক করে দিলে প্রশাসন পরিচালনার কাজ সহজতর হয়। কাজেই ব্রিটিশ শাসক উপজাতিগুলির মধ্যে সমতা আইন প্রবর্তন করতে উদ্যোগী হয়। অথচ বিভিন্ন উপজাতিগুলির সংস্কৃতি পৃথক হওয়ায় তাদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের সংকট দেখা দেয়। কারণ তাদের সকলের আইন এক ও অকৃত্রিম করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে আদিবাসীরা নিজেদের মধ্যেকার বৈসাদৃশ্য হারাচ্ছে, যেখানে পৃথক সংস্কৃতিই তাদের অস্তিত্বের প্রধান হাতিয়ার।

অপরপক্ষে আদিবাসীরা সম্পূর্ণরূপে জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। কিন্তু মহাজন দিকুরা সেসময়ে রেললাইন বানানোর জন্য সমস্ত বড়ো গাছ কেটে ফেলতে শুরু করে। বিভিন্ন উপজাতিগুলির কাছে মহুয়ার মতো বিশেষ কিছু গাছ ছিল পবিত্র। কিন্তু মহাজনরা সকল গাছগুলিকেই সমান চোখে দেখে এবং নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলতে থাকে। ফলে উপজাতিগুলির মধ্যে সংকট দেখা দেয় ও ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। আবার, সাঁওতাল সমাজের নিয়ম হচ্ছে যে তাদের মধ্যে কেউ কোনো অপরাধ করলে সন্ধেবেলা সকলে একটি স্থানে সমবেত হয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। অপরাধের বিচার করেন মাঝি বলে একজন। বিষয়টি সে-দিনই মিটে যায়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার নতুন নিয়ম চালু করে যে কোনো অপরাধ হলে প্রথমে থানায় ডাইরি করতে হবে, তার ভিত্তিতে চার্জশিট তৈরি হবে। এরপর ইনভেস্টিগেশন হবে এবং তারপর তদন্ত শুরু হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বিস্তর সময় লেগে যেত এবং অধিকাংশক্ষেত্রেই কোনো সমাধানসূত্র সামনে আসত না। উপজাতি গোষ্ঠীগুলির কাছে বিভিন্ন পাহাড় ছিল পবিত্র। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকার সেসময়ে ওইসব পাহাড়ে ভালো ভালো খনির সন্ধান পায়। অতএব সেখানে খননকার্য শুরু হয় এবং উপজাতিগুলির কাছে পাহাড়ের পবিত্রতা নষ্ট হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতেই আদিবাসীরা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।

সমস্ত আদিবাসী বিদ্রোহগুলির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য ছিল। প্রতিটি উপজাতির একজন করে স্থানীয় নেতৃত্ব ছিল। তাদের সকলেরই মূল বক্তব্য ছিল, ইংরেজরা এসে উপজাতিগুলির জীবন-জীবিকা ও ঐতিহ্যে আঘাত করেছে। আদিবাসীদের সেই পূর্বের গৌরব আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এই লড়াইতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রায় সমস্ত আদিবাসীরাই অংশগ্রহণ করেছিল। এভাবে দেশের পৃথক পৃথক স্থানে বিদ্রোহগুলি সংঘটিত হলেও অন্তর্নিহিত দিক থেকে সেগুলি ছিল এক ও অবিচ্ছিন্ন। জঙ্গলের ধুলোমাটিমাখা মানুষগুলির মধ্যে এমন বিশ্বাসের জোর তৈরি হয়েছিল যে লাঠি নিয়ে তারা ইংরেজের বন্দুকের মোকাবিলা করার সাহস পেয়েছিল। সুরেশ সিং বলেছেন, এদের মধ্যে বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল যে তাদের গায়ে গুলি লাগলেও সে গুলি অসক্রিয় হয়ে যাবে। সেই কারণেই দেখা গিয়েছিল যে ব্রিটিশের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন আদিবাসী যখন গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, তখন অন্যজন অসীম সাহসের সঙ্গে সে মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যাতে শত্রুর হাতে দেহটি না পড়ে। আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে লড়াই করেছিল। নিঃসন্দেহে এই সাহস এসেছিল তাদের বিশ্বাস থেকে, কল্‌জের জোর থেকে। আদিবাসী বিদ্রোহের সাধারণ চরিত্র হিসেবে একে অনায়াসেই চিহ্নিত করা চলে।

আদিবাসী বিদ্রোহগুলিতে জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম ইত্যাদি চেতনাকে প্রাধান্য দেওয়া ছিল অস্থিমজ্জাগত। কারণ এগুলি ছিল ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একেকটি উপায়। আদিবাসীরা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও অস্তিত্ব ধরে রাখতে এক ছাতার নীচে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ইতিহাসে এরকম উদাহরণ বড়ো একটা দেখা যায় না। আসলে সকলের স্বার্থ এক বিন্দুতে এসে মিলিত না হলে বড়ো আলোড়ন সৃষ্টি হতে পারে না। যুগে যুগে দেশনেতারা এই সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২