ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন ও দুনিয়া বদলের শিক্ষা – রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
আপনাদের কাজ সফল হয়েছে।
—বের্টোল্ট ব্রেখ্ট
… … … … … … … …
আপনাদের কাহিনী চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে
এ দুনিয়াকে বদলে দিতে গেলে কী কী লাগে
ক্রোধ, একাগ্রতা, তাল, বিদ্রোহী চিত্ত,
দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষিপ্রতা, গভীর চিন্তার স্থৈর্য,
নিরুত্তাপ সহ্যশক্তি, অসীম অধ্যবসায়,
একক ও সমগ্র—বিশেষ ও সাধারণ—
দুইই উপলব্ধির ক্ষমতা।
বাস্তবকে সম্যক বুঝে, তবেই না পারবো
বাস্তবকে আমূল বদলে দিতে।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিআনভ নিকোলাই লেনিন আজীবন একটি লক্ষ্যেই স্থির ছিলেন : দুনিয়াকে বদলাতে হবে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এতদিন মানুষ শুধু খণ্ডিত জীবন ধারণ ক’রে এসেছে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নতুন মানুষ তৈরি করতে হবে, মানবিক কোনো কিছুই যার কাছে দূরের জিনিস হবে না। সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে সব রণাঙ্গনে “আমরা বলি, শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের কাজ বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ করার সংগ্রামের একটি অংশ। আমরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করি যে জীবন ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন শিক্ষা মিথ্যা ও শঠতা।“
বিপ্লবী আন্দোলনে লেনিনের হাতে-খড়ি হয়েছিল ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। ১৮৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জার-বিরোধী ছাত্রদের একটি সভায় যোগদানের অপরাধে তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন, অতঃপর গ্রেপ্তার ও নির্বাসন। সেই থেকেই পুলিসের খাতায় পাকাপোক্তভাবেই নাম উঠ্লো।
অভিজ্ঞতা থেকে লেনিন জানতেন, যে-দেশে নিরক্ষরতার হার মোট জনসংখ্যার ৭৬%, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে পারে মাত্র ২০%, মাধ্যমিক স্তরে পড়ে মাত্রা ৫%, উচ্চতর শিক্ষা নিতে আসে তারও কম, সে-দেশে একদিকে যেমন ছাত্রসমাজের মধ্য থেকে বিপ্লবী দেশকর্মী ও বুদ্ধিজীবি বেরিয়ে আসবে তেমনি এই সুবিধাভোগী, ব্যাপক মেহনতী মানুষ-থেকে-বিচ্ছিন্ন অংশ প্রতিবিপ্লবের নেতৃত্ব দিতেও এগিয়ে আসতে পারে। অক্টোবর বিপ্লবের পর দেশান্তরবাসী কাদেত পার্টি’র নেতা পি, এন, মিলিউকোভ তাঁর দেশীয় সহযোগীদের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন, “ক্রম-বর্ধমান সংখ্যায় ছাত্রযুবকদের সমবেত করাও, কারণ আসন্ন ঘটনাবলীতে (অর্থাৎ পরিকল্পিত প্রতিবিপ্লবে—লেখক) তারাই প্রধান ভূমিকা পালন করবে…ব্যাপক
ছাত্রসমাজের সমর্থন লাভের জন্য সর্বশক্তিদিয়ে চেষ্টা করো।’’ অক্টোবর বিপ্লবের পর সারা দেশটাকে ঢেলে সাজানোর সঙ্গে সঙ্গে লেনিন তাই নজর দিয়েছিলেন শিক্ষাসংস্কার ও তার গণতন্ত্রীকরণের উপর, ছাত্রসমাজের মধ্যে যাতে প্রতিবিপ্লব শিকড় গাড়তে না-পারে তার দিকে, এবং দিন বদলের সঙ্গে তাল রেখে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিপ্লবী আদর্শবাদ ও সত্যিকারের জ্ঞানবিদ্যায় ছাত্রসমাজকে সঞ্জীবিত করতে।
॥ দুই ॥
সর্বজনীন অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার দাবি প্রথম তুলেছিলেন আধুনিক সাম্যবাদের একজন প্রধান উদ্গাতা, গ্রাখুস বাবুফ (১৭৬০-১৭৯৭)। Manifesto of the Equals (১৭৯৬)-এ তিনি সোচ্চারে ঘোষণা করেন : “আমরা সবাই সমান তাই নয় কি?… বয়স এবং লিঙ্গ ছাড়া মানুষের মধ্যে আর কোনো তফাৎ যেন না থাকে। সকলের যখন সমান প্রয়োজন ও ক্ষমতা, সকলের তখন এক শিক্ষা ও এক জীবনযাত্রার মান হোক্।” আকাশচারী (Utopian) সমাজতন্ত্রী রবার্ট ওএম এবং শার্ল ফুরিয়ে-র মত ছিল : একজন তরুণকে নানাদিকের কারিগরীবিদ্যা শেখানোই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত, যাতে মানুষের নানাবিধ ক্ষমতার বহুমুখী বিকাশ ঘটতে পারে এবং শ্রমবিভাগের ফলে শ্রমের যে আকর্ষণ ক্ষমতা কমে
গেছে তা আবার ফিরিয়ে আনা যায়। মার্কস্ এঙ্গেল্স্ তাঁদের কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’-এ পুঁজিবাদী শ্রেণীকে তীব্র ব্যঙ্গ করে লেখেন : ‘আর তোমাদের শিক্ষা! তা কি সামাজিক বিষয় নয়, যে সামাজিক অবস্থায় তোমরা শিক্ষাদান করছ তার দ্বারা কি তা নির্ধারিত হচ্ছে না, নির্ধারিত হচ্ছে না বিদ্যালয় ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপের দ্বারা? সাম্যবাদীরা শিক্ষার উপর সমাজের হস্তক্ষেপ উদ্ভাবন করেনি : তারা শুধু এই হস্তক্ষেপের চরিত্র বদলে দিতে এবং শিক্ষাকে শাসক শ্রেণীর প্রভাব মুক্ত করতে চায়।’ ঐ ইশ্তেহারেই দ্বিতীয় অধ্যায়ে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচীর তালিকার শেষে
রয়েছে :
‘সরকারী বিদ্যালয়ে সকল শিশুর জন্য অবৈতনিক শিক্ষা। বর্তমান, রূপে শিশুদের কারখানার কাজ অবলোপ। শিল্প-উৎপাদনের সঙ্গে শিক্ষার মিলন ইত্যাদি।’
এই কর্মসূচীকেই বাস্তবে রূপায়িত করেন লেনিন। উপরের ঐ সংক্ষিপ্ত সূত্রের তাত্ত্বিক ভাষ্য (‘সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচীতে নৈতিকতা ও শিক্ষার সমস্যাবলী’) ও প্রয়োগ-সাফল্য—দু’এরই কৃতিত্ব লেনিনের। মহামান্য ভারত সরকার তার স্বরচিত সংবিধানে এ বিষয়ে নির্দেশাত্মক নীতি গ্রহণ ক’রেও কাজের ক্ষেত্রে যে তিমিরে সেই তিমিরেই পড়ে আছেন, তাঁদের গর্ব তাঁরা হচ্ছেন এশিয়ার “বৃহত্তম গণতন্ত্র”, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই (নাকি সমান-সমান) তাঁদের স্থান!
লেনিনের নেতৃত্বে তথাকথিত সর্বগ্রাসী (totalitarian) সমাজে কিন্তু অতি দ্রুত একাজ সম্পন্ন হয়েছিল। লেনিন চেয়েছিলেন ‘এক নতুন মানুষকে শিক্ষা দিতে যার মধ্যে আত্মিক সম্পদ, নৈতিক শুদ্ধতা ও চমৎকার স্বাস্থ্যের সুষম সমন্বয়’ ঘটবে। মস্কোর লেনিন জেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্রদের কাছে ভাষণ-প্রসঙ্গে (১৭ই এপ্রিল, ১৯৬১) মিখাইল ইভানোভিচ কালিনিন তিনটি বিষয় আয়ত্ত করার দিকে বিশেষ নজর দিতে বলেছিলেন: মাতৃভাষা, গণিত ও শরীর চর্চা। এই ই তো লেনিনের শিক্ষা৷
শুধু নামেই সর্বজনীন অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা নয়, আইন পাশ ক’রে দায়সারা গোছের ব্যবস্থা নয়–সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকর্মে দেশের মানুষকে পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহার করা, দেশীয় উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করা, শিক্ষাকে শাসকশ্রেণীর প্রভাব মুক্ত ক’রে প্রকৃত সত্যের ছাড়পত্রে পরিণত করাই ছিল লেনিনের লক্ষ্য। “শিক্ষার জন্য শিক্ষা” নয়, “নবম কংগ্রেসের (সারা-রুশ সোভিয়েত সমূহের নবম কংগ্রেস) অভিমত এই যে শিক্ষা বিষয়ক জনকমিশারিয়েটের এই নতুন সময়ে কর্তব্য হ’লো সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে কৃষক ও শ্রমিকদের ভেতর থেকে সর্বক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের শিক্ষা দেওয়া; এবং এই কংগ্রেস নির্দেশ দেয় যে স্কুলশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব বহির্ভূত শিক্ষাকে সামগ্রিকভাবে সাধারণতন্ত্রের এবং নির্দিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলের চলতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আরও ঘনিষ্টভাবে যুক্ত
হ’তে হবে।”
।। তিন।।
“জ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও অভিজ্ঞতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরিচালনা ছাড়া সমাজতন্ত্রে উত্তরণ অসম্ভব হবে, কারণ সমাজতন্ত্র দাবি করে পুঁজিবাদের তুলনায় এবং পুঁজিবাদ কর্তৃক অর্জিত ভিত্তির উপরে
শ্রমের অধিকতর উৎপাদনশীলতার দিকে সচেতন ব্যাপক অগ্রগতি।”
“সোভিয়েত স্কুল ও শ্রমিকদের বিভাগ গঠন করা হয়েছে; কয়েক লক্ষ তরুণ পড়াশুনা করছে, কিন্তু যাই হোক, কাজ শুরু হয়েছে; এবং আমি মনে করি এই কাজ ফলপ্রসূ হবে।… আমরা আর কয়েক বছরের মধ্যেই বিরাট সংখ্যক তরুণকে পাবো, যারা অমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে আগাগোড়া মেরামত করতে সক্ষম হবে।”
প্রথম লেখাটি ১৯১৮ সালের, দ্বিতীয়টি ১৯২২-এর। ইতিমধ্যে, গৃহযুদ্ধের অত্যন্ত কঠোর অবস্থায়, সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র যখন বহু রণক্ষেত্রে একসঙ্গে সামাল দিতে ব্যস্ত তখন নিঝনি-নোভগরোদ, ইরখুৎস্ক্ প্রভৃতি জায়গায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়।
হুকুমনামায় সই করেছেন লেনিন, এক-এক করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কাজান পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটুট, ব্রিরানস্ক টেকনোলজিক্যাল ইনষ্টিটুট, লাল বিমান বাহিনীর ইনষ্টিট্যুট অব ইনজিনিআর্স ইত্যাদি। ১৯২১ সালে উচ্চতর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত আইনটি হীত হয়। এবং এই বিদ্যালয় সংগঠনের কাজে নিযুক্ত থাকেন লেনিনের স্ত্রী নাদেঝ্দা ক্রুপস্কাইয়া, আনাতোলি লুনাচারস্কি, ফিওদর পেত্রভ-এর মতো বিশিষ্ট নেতারা, সঙ্গে যোগ দেন বিখ্যাত পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীর দল (ও-ওয়াই, স্মিড্ট্, বি, আর, উইলিঅম্স্, এ এই ফার্সমান প্রমুখ)। লেনিন জানতেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তবিদ্যা বা টেকনোলজিই হবে নতুন সমাজ ও নতুন মানুষ গড়ার বিশ্বকর্মা।[১]
১৯২০ সালে ঘোষণা করা হয়। নতুন অর্থনৈতিক নীতি (N E P) ও বৈদ্যুতিকরণের কর্মসূচীর কথা। অতি বানপন্থীরা ভলতেঅরের ভাষায় ব্যঙ্গ ক’রে উঠলেন, এবার কোকিলের মুখে ডাক উঠেছে বিদায়—বসন্তের, সোভিয়েত সরকারের মৃত্যু হ’লো (The cuckoo has cuckooed the end of the Soviet Government) বক্তৃতামঞ্চের পিছনে আধ-অন্ধকার রাশিয়ার মানচিত্রের উপর দিয়ে একটি বৈদ্যুতিক আলোর বিন্দু এক শহর থেকে আরেক গ্রামে নেচে নেচে এগিয়ে চলতে থাকলো, লেনিন বুঝিয়ে চললেন কোথায় হবে বিদ্যুৎ-তৈরীর কেন্দ্র, কোথায় নদীর গতি থেকে গড়ে উঠবে বিরাট বিদ্যুৎভাণ্ডার। লেনিন বললেন: সাম্যবাদ হ’লো সোভিয়েত ক্ষমতা ও বৈদ্যুতিকরণের যোগফল। সকলের সানন্দ সম্মতির
সামনে ব্যর্থ আক্রোশে গোঁড়াপন্থী রাদেক শুধু বললেন, Electrification নয়, electrofiction, বৈদ্যুতিকরণ নয়, বিদ্যুৎ এর আষাঢ়ে গল্প। মায় এইচ. জি. ওয়েলসের মতো দক্ষিণপন্থী সমাজতন্ত্রীও লেনিনকে “ক্রেমলিনের স্বপ্নচারী” ব’লে অভিহিত করলেন। এই বিদ্যুতের আকাশকুসুম (Electric Utopia) কী করে লেনিন সম্ভব করবেন রাশিয়ায়, যে দেশ তাঁর নিজেরই স্বীকারোক্তি-মতো : “আর এমন কোন দেশ নেই যা এত বর্বর এবং যেখানে ব্যাপক জনসাধারণের কাছ থেকে এতটা পরিমাণে শিক্ষা, আলো ও জ্ঞান কেড়ে নেওয়া হয়েছে—ইওরোপে এমন আর একটিও দেশ নেই, রাশিয়াই ব্যতিক্রম।” কার্ল কাউটস্কিও ভেবেছিলেন শুধু উপযুক্ত কারিগর ও প্রযুক্তিবিদের অভাবেই সোভিয়েতে সমাজতন্ত্র নষ্ট হ’য়ে যাবে। কিন্তু তা হয় নি। ১৯৫৭-র গাগরিন ১৯১৭র লেনিনেরই মানসসন্তান।
।।চার।।
‘যুব লীগের কর্তব্য’ শীর্ষক ঐতিহাসিক ভাষণে (২রা অক্টোবর ১৯২০) লেনিন বলেছিলেন, এক কথায় যুবকদের কাজ হ’লো শেখা (the tasks of the youth… might be summed up in a simple word: learn)। কোন কাজ না ক’রে, কোনো সংগ্রামে অংশ না নিয়ে শুধু পুঁথিগত শিক্ষা যে কখনো কার্যকর হ’তে পারে না, লেনিন অবশ্য এই মর্মেও সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, “কেন না তাতে তত্ত্ব ও প্রয়োগের ব্যবধান, যা কিনা পুরানো বুর্জোয়া সমাজের সবচেয়ে নিন্দনীয় ও অপকারী লক্ষণ, অব্যাহতই থেকে যাবে।” কিন্তু শুধু রাজনৈতিক শিক্ষা বা ‘সর্বহারার সংস্কৃতি’র বুলি-সর্বস্বতাই যথেষ্ট নয়, শিখতে হবে সব কিছু—পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ইতিহাস, অর্থনীতি, মানবিক জ্ঞানভাণ্ডারের সকল সামগ্রী। ‘সর্বহারার সংস্কৃতি আকাশ থেকে পড়ে না, নিজেদের যাঁরা সর্বহারার সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ব’লে জাহির করেন এ তাঁদের আবিষ্কার নয়। পুঁজিবাদী, জমিদারী ও আমলাতান্ত্রিক সমাজের জোয়ালের তলায় থেকে মানুষের সঞ্চিত জ্ঞানভাণ্ডারের যুক্তিসংগত বিকাশই হবে, সর্বহারার সংস্কৃতি।’ গণিত ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের পরিবর্তে শুধু বুনিয়াদী রাজনীতি শিক্ষার বিরোধিতা ক’রে মিখাইল কালিনিন তাই বলেছিলেন যদি কেউ কৃষিতে মার্কসবাদ প্রয়োগ করতে চায় তাকে কৃষি বিষয়ে পড়াশুনা করতে হবে, কৃষি বিশেষজ্ঞ হ’তে হবে। যোসেফ স্তালিনও বলেছিলেন : ‘গড়তে গেলে জানতে হবে, বিজ্ঞানকে আয়ত্ব করতে হবে। কিন্তু জানতে গেলে পড়াশুনা করতে হবে, পড়াশুনা করতে হবে ধৈর্য ধরে, মনোযোগ দিয়ে।’ ১৯৪০ সালে নয়া গণতন্ত্র ও তার সংস্কৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাওসেতুং-ও লেনিনের মতোই লিখেছিলেন :
‘আজ যা-কিছু প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে তা-ই আমাদের আত্মস্থ করতে হবে, শুধু অন্যান্য জাতির বর্তমান সমাজতান্ত্রিক বা নয়াগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে নয়, বিদেশী রাষ্ট্রের প্রাচীন সংস্কৃতি, যেমন আলোকপ্রাপ্তির যুগে (age of enlightenment) বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের সংস্কৃতি থেকেও আমরা গ্রহণ করবো।’
লেনিনের অনুসরণে মাও সে তুং আরও বলেছিলেন, ঠিক মতো হজম করার কথা। লেনিন সতর্ক ক’রে বলেছিলেন, শুধু জানাই যথেষ্ট নয়, ‘আমাদের পাখি পড়ার দরকার নেই, কিন্তু প্রতিটি ছাত্রের মনকে মৌলিক তথ্যের জ্ঞান দিয়ে আরও বিকশিত ও পরিপূর্ণ করার প্রয়োজন আছে।…তোমরা শুধু জ্ঞান সঞ্চয় (assimiliate) করবে না, বিচার বিবেচনা ক’রে তা সঞ্চয় করো।’ একবারে না বুঝলে বারবার পড়ো, বুদ্ধি খাটাও, নিজের মতো করে বুঝতে শেখো, পুঁথিনির্ভর হয়ো না—স্ভের্দলোভ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের কাছে রাষ্ট্র সম্পর্কে বক্তৃতা করতে গিয়ে লেনিন বারবার এই কথাই বলেছিলেন। বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন এই নূতন মানুষই সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, নিত্যনূতন অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে পারে। স্নায়ু বিধ্বস্ত পেট গরম লোক আমাদের দরকার নেই- কালিনিনও এই কথা বলেছিলেন।
আদর্শ সূত্র নির্দেশক-গ্রন্থ (Reference Book) কী রকম হওয়া উচিত সে সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধে ও চিঠিতে লেনিন তাঁর ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তাকে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত হ’তে হবে, তথ্যপূর্ণ বিষয় তাতে প্রচুর পরিমাণে থাকবে, বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল্যবান হবে, রূপরেখায় সুসংগত ও সুশৃঙ্খল হবে এবং প্রয়োজনীয় প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি থাকবে।
বস্তুনিষ্ঠ, বিচারগ্রাহ্য ও জীবনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার প্রতিই ছিল লেনিনের পক্ষপাত। ধোঁয়াটে পুঁথিসর্বস্ব নির্বোধ বাগাড়ম্বর ও ডিগ্রীবিলাসকে তিনি বিদ্রূপ করেছেন।
||পাঁচ||
কিন্তু ভ্লাদিমির ইলিচের শ্রেষ্ঠ পরিচয় শিক্ষাশাস্ত্রী হিসাবে নয়। শতকরা ২৪ জন সাক্ষরের দেশে আজ প্রতি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আগের তুলনায় ৬৫% বেশি বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছেন—এটাই সবচেয়ে আজব ইন্দ্রজাল। সারাদেশ থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করার জন্য ছাত্র ও যুবসমাজকে ডাক দিয়েছিলেন লেনিন। অতি দ্রুত সে কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
লেনিনের আমলে জনশিক্ষা বিষয়ক জনকমিশার (আমাদের ভাষায়, শিক্ষা-মন্ত্রী), বহুমানভাজন রাষ্ট্রনীতিবিদ্, বিপ্লবী প্রচারক ও নাট্যকার আনাতোলি ভার্সিলিয়ভিচ্ লুনাচারস্কি একবার একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলেছিলেন: ‘কেন লেনিনের কাছে সাক্ষরতা ও বৈদ্যুতীকরণ সোভিয়েত ক্ষমতার পরে তার প্রকৃত অর্থ অর্জন করলো?’ উত্তর দিতে গিয়ে লুনাচারস্কি লিখেছেন: ‘একথা বলা নিস্প্রয়োজন যে বিপ্লবের বিজয়ের দিন উচ্চ সাক্ষরতা সম্পন্ন লোক পাওয়া আদৌ খারাপ ব্যাপার নয়, কিন্তু তা আমাদের সাক্ষরতার সঙ্গে এক ব্যাপার হবে না। শ্রমিক ও গরীব কৃষককে সেই সাক্ষরতা দেওয়া হয়েছে একদিকে তাদের আরও ভালো করে শোষণ করার জন্য আর অন্যদিকে তাদের আরও ভালো করে ঠকানোর জন্য। আমরা দেখতে পাচ্ছি কেমন করে মেনশেভিকরা পুরোহিতদের পদচিহ্ন ধরে তাদেরই পাশাপাশি মেহনতী মানুষের আত্ম-সচেতনতার যথার্থ বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে এই “সাক্ষরতা”কে ব্যবহার করছে সাফল্যের সঙ্গেই (যদিও এই সাফল্যটুকু অবশ্যই সাময়িক), সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কখনোই নিরক্ষরতার উপর ভিত্তি করে গড়া যায় না, ‘কিন্তু, যদি একটি বড়ো ভুল করতে না চাও, এই সাক্ষরতা ও পড়াশুনার কাজ যেন আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম, অর্থনৈতিক সংগ্রাম, আমাদের শিল্পায়ণ ও যৌথ কৃষিগঠনের (Collectivisation) কাজ থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিছিন্ন না-হয়।’ লেনিনের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘প্রাভদা’য় প্রকাশিত (২১ শে জানুয়ারি, ১৯৩০) “সংস্কৃতি প্রসঙ্গে লেনিন” নামক রচনায় লুনাচারস্কি বিশদভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এখনও তার অনুধাবনযোগ্যতা এতটুকু কমে নি।
||ছয়||
কোথায় সে লেনিনের দেশ, কোথায় আমরা! কোথায় সোয়ুজের মহাকাশ পরিক্রমা, কোথায় আলের পথে আঁধার নামায় দুশ্চিন্তা! কোথায় শিক্ষার সূর্যকরোজ্বল ভাস্বরতা, কোথায় কেরোসিন তেলের অভাবে নিষ্প্রদীপ পরীক্ষার আগের রাত।
জীবনের অসমাপ্ত তীর্থদর্শন সারতে ভগ্নস্বাস্থ্য সত্ত্বেও লুনাচারস্কির আমন্ত্রণে লেনিনের দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘রাশিয়ায় গিয়েছিলুম ওদের শিক্ষাবিধি দেখবার জন্যে। দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছি।…এখানকার শিক্ষার কাজ সজীব প্রণালীতে। আমি বরাবর বলে এসেছি, শিক্ষাকে জীবনযাত্রার সঙ্গে মিলিয়ে চালানো উচিত। তার থেকে অবিচ্ছিন্ন করে নিলে ওটা ভাণ্ডারের সামগ্রী হয়, পাকযন্ত্রের খাদ্য হয় না।…এরা সংসারের সীমা থেকে ইস্কুলের সীমাকে সরিয়ে রাখে নি। এরা পাশ করাবার কিংবা পণ্ডিত করবার জন্যে শেখায় না–সর্বতোভাবে মনুষ করবার জন্য শেখায়।’ গান্ধীর ছাত্রদের
সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘তাকে চালনা করতে হয়, সে চলে, আপনা থেকে তাকে কিছু ভাবতে হয় না।’ সোভিয়েত দেশে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন ঠিক এর উল্টো, তৈরি হচ্ছে নতুন মানুষ, যে আপনা থেকে ভাবতে শেখে, নিজে নিজেই চলতে জানে।
ভাবতে ভালো লাগে, লেনিন ও রবীন্দ্রনাথ পরস্পরের সংগে সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযোগ না পেলেও পরস্পরকে জানতেন। লেনিনের কথা রবীন্দ্রনাথের নিশ্চয়ই অজানা ছিল না, লেনিনও লেখাপত্র মারফৎ জানতেন রবীন্দ্রনাথকে। প্রবীণ আকাদোমিশিয়ান কিওদর নিকোলায়েভিচ্ পেত্রভের সাক্ষ্য অনুসারে জানা যায়, লেনিন রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়েছিলেন, একবার লুনাচারস্কি ও পেত্রভের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আলোচনাও করেছিলেন সপ্রশংস মনোভাব নিয়ে।[২] শিক্ষাদীক্ষা সম্পর্কে বই লিখতে গিয়ে ক্রুপস্কাইয়া রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষাও অনুধাবন করেছিলেন। লেনিনও জানতেন শ্রীনিকেতনের কথা। ( মাসুদ আলি খাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, “সোভিয়েট ল্যাণ্ড”, নভেম্বর, ১৯৬০, সংখ্যা ২২)
“আমি যা বহুকাল ধ্যান করেছি রাশিয়ায় দেখলুম এরা তা কাজে খাটিয়েছে, আমি পারি নি বলে দুঃখ হ’লো।’ সেই দুঃখ দূর করাই আজকের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিজ্ঞা। লেনিন শতবার্ষিকীর প্রারম্ভে আমাদের শপথ রবীন্দ্রনাথের বহুকালের ধ্যানকে আমরাই কাজে খাটাবো। ভারতের বুকেও প্রতিষ্ঠা করবো সমাজতন্ত্রের পতাকা, আমাদের গৌরবময় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার যথাযোগ্যভাবে বহন করবো, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক শিক্ষার আদর্শকে আত্মস্থ করবে ভবিষ্যতের নতুন মানুষ।
[১] মনে পড়ে যে আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা বিপ্লবী আর্ণেস্তো চে গুয়েভারা-র কথা। তাঁর বাচ্চাদের কাছে
লেখা শেষ চিঠিতে ‘চে’ বলেছিলেন : ‘সাচ্চা বিপ্লবী হয়ে গড়ে ওঠো। ভালো ক’রে পড়াশুনো করো যাতে
প্রযুক্তিবিদ্যা আয়ত্ত করতে পারো যা তোমায় প্রকৃতিকে আয়ত্ত করতেও সমর্থ করবে।’
[২] লেনিনের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে ও পাঠকক্ষে রবীন্দ্রনাথের ‘পার্সোনালিটি’ (ইংরেজি থেকে আই, ওয়াই,
কোলুবোভ্স্কি-কৃত রুশ অনুবাদ, ১৯২২), ‘ন্যাশনালিজ্ম্’ (ইংরেজি থেকে কোলুবোভ্স্কি ও এম, আই, তুবয়ানাস্কি-কৃত রুশ অনুবাদ, ১৯২২ এবং এ, শাক্লিয়াভেব-কৃত ও এম, এন, শোয়ার্তজ, সম্পাদিত জার্মান অনুবাদ) ও ‘ঘরে-বাইরে’, (ইংরেজি ‘দা হোম অ্যাণ্ড দা ওয়ার্লড্’ থেকে জেড, ঝুয়াভস্কায়া-কৃত জার্মান অনুবাদ) পাওয়া গেছে। এ-ছাড়াও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের নাটক ও কবিতার একটি নির্বাচিত সংকলন (ডি, ডি, গিপ্পিউস ও অন্যান্য কর্তৃক রুশ ভাষায় অনুদিত ও এম, ভোলস্কি ও কে, চুকোভ্স্কি কর্তৃক সম্পাদিত ১৯২৩) ও ‘এক্স্ ওরিএন্তে লুকস্’ (প্রাচ্যের আলো) নামে রবীন্দ্র-প্রতিভা সম্পর্কে একটি আলোচনা গ্রন্থ (এন, শেবুইকেভ কর্তৃক রচিত, ১৯২৩)। [“সপ্তাহ”, বর্ষ ৩, সংখ্যা ১১, ২১শে নভেম্বর ১৯৬৯, পৃ. ১৯–২০ ]
বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন
১৯তম রাজ্য সম্মেলন
নুরুল নগর (নৈহাটী)
প্রকাশকাল: ১৯৭০