স্তব্ধ রেখার পাশে – পার্থজিৎ চন্দ (দ্বিতীয় পর্ব)

স্তব্ধ রেখার পাশে – পার্থজিৎ চন্দ (দ্বিতীয় পর্ব)

শেয়ার করুন

পৃথিবীর সব পথই, একেকদিন মনে হয়, তাসের টেবিলের দিকে চলে গেছে। বিশেষত শনিবার অথবা রবিবার সূর্য ডুবলেই হাঁসফাস করে ওঠে কিছু মানুষ। শীত চলে যায়, গ্রীষ্ম চলে যায়, – মাস, বছর চলে যায় গড়াতে গড়াতে। একদিন ফুরফুরে হাওয়া বইতে থাকে বাইরে। বৃষ্টি আসে, দূরে রাস্তায় মহিলাদের হাসির শব্দ ভাসতে থাকে কখনো, গাছের শুকনো পাতাগুলি উড়তে থাকে বাতাসে। শুধু কিছু লোকের হাতে সারাবছর থেকে যায় সেই হরতন,রুইতন- সারাবছর বাটা হতে থাকে তাস- আর ঘরের মধ্যে ঝিমিয়ে পড়ে কেউ, কেউ হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বর্মনদের তাস খেলা সুভাষগ্রামের মানিক চক্রবর্তী মেনে নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে সুন্দর একটা কবিতাও লিখেছিলেন তিনি। আমি ছেলেবেলায় বিস্মিত হয়ে একেকদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবার তাস খেলা দেখতাম। বিশেষত তাসের সাফলিং…
তাসের আড্ডায় বসে থাকতে থাকতে আমি দেখেছি সময় কিরকম ঈগল পাখির ডানার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। ঐসব আচ্ছন্ন মানুষ যারা স্বপ্নের মধ্যেও কথা বলে আমি দেখেছি তাদের। শুধু অফিস যাওয়া আর ফিরে আসা। আর ডাঁটা-চচ্চড়ি। আর ঘুম। আর তাস। … বাহান্নটা তাস যদি আমার জীবনটাকেও ওইরকম পাল্টে দিতে পারত, আমার দুঃখ থাকত না কোনো। (শয়নযান- ভাস্কর চক্রবর্তী)

ভাস্করের ‘শয়নযান’-এর ভেতর এক আশ্চর্য উত্তর-কলকাতার গন্ধ ছড়িয়ে আছে; বৃষ্টি নামছে, গঙ্গার দিক থেকে হাওয়া এসে ঘুরে ঘুরে কাঁদতে কাঁদতে মিলিয়ে গেল গলি থেকে আরও কানা-গলির মধ্যে। অবিশ্বাস্য সে কান্না; কোনও শব্দ কেউ কোনওদিন শুনতে পাবে না। অথচ গঙ্গার দিক থেকে উড়ে আসা বৃষ্টিকণার দিকে তাকিয়ে, তাকে গায়ে মেখে বোঝা যাবে কেউ কাঁদছে… দূরে কেউ কাঁদছে।
এক প্রকাণ্ড স্থিরচিত্রের ভেতর স্তব্ধ হয়ে রয়েছে মানুষ, গঙ্গার ঘাট, শিবলিঙ্গ… ছাদের মাথায় নামছে পায়রা।
উত্তর-কলকাতার মধ্যে মিশে থাকা ওই গন্ধের থেকে কিছুতেই আলাদা করা যাবে না ভাস্করের ‘শয়নযান’-কে।
ঠিক যেমন দক্ষিণ-ফ্রান্স থেকে পৃথক করা যাবে না ভ্যান গগ, মাতিস, পিকাসো থেকে শুরু করে পল সেজান পর্যন্ত কোনও শিল্পীকেই। রক্তের ভেতর শিল্পের নীল বিষ নিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বারবার তাঁরা ছুটে গেছেন দক্ষিণ-ফ্রান্সে। সেখানকার উজ্জ্বলতার কাছে কোথাও যেন শান্তি পেয়েছিল তাঁদের সত্তা। সত্যিই কি শান্তি পেয়েছিল? না কি মহত্তর কোনও ‘অশান্তি’র খোঁজে তাঁরা ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে? অনেকটা যেভাবে পতঙ্গভুক ফুলের কাছে ছুটে যায় পতঙ্গ।
ভাস্করের ‘শয়নযান’ বুকের উপর রেখে দীর্ঘ দীর্ঘ দিন তাকিয়ে থেকেছি পল সেজান-এর ‘দ্য কার্ড প্লেয়ার্স’ সিরিজের দু’টি ছবির দিকে।
জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে তাঁর ছবি বিক্রি হওয়াটাই ছিল বিস্ময়কর ঘটনা। ‘দ্য হাউস অফ দ্য হ্যাঙড ম্যান’ ছবিটি যখন বিক্রি হয়েছিল তখন সেটিকে বেশ বিস্ময়কর ঘটনা বলেই মনে হয়েছিল, সেজানের শিল্পের ‘বাজার’-এর নিরিখে। এ ছবিটির কাছে ছুটে আসতেই হবে। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে শুয়ে থাকা রাস্তাটির দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হবে আমাদের। কিন্তু তার আগে ‘দ্য কার্ড প্লেয়ার্স’ ছবি দু’টির কাছে কিছুক্ষণ বসে থাকা যাক।
একটি টেবিলের দু’-দিকে দু’জন তাসুড়ে বসে।
ডান-দিকের মানুষটি টেবিলের উপর সামান্য বেশি ঝুঁকে; বাম-দিকের মানুষটির ঠোঁটে চুরুট।
সেজানের অধিকাংশ ছবিতে শক্তিশালী স্ট্রোক দেখতে পাওয়া যায়, প্রথমদিকের ছবিগুলিতে সে স্ট্রোক বেশি দৃশ্যমান। এ ছবিটিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ছবিটিকে যদি লম্বালম্বি ভাগ করা যায় তা হলে তীব্র ‘কন্ট্রাস্ট’ লক্ষ করা যাবে।
ডান-দিকে মুখে চুরুটওয়ালা মানুষটি ধূসর পোশাক পরে, উলটো দিকের মানুষটির পোশাক শাদা।
দু’-জনের চোয়ালের কাছে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে কাঠিন্য; যেন প্রহরের পর প্রহর বয়ে যাবে এবং তারা বসে থাকবে তাসের টেবিলে।
সম্ভাবনার হাতে জীবনের প্রহরগুলি তুলে দিয়ে বসে আছে দু’টি মানুষ।
বহুক্ষণ ছবিটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, এ কি আসলে জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে ঘটে যাওয়া স্থির কোনও খেলা? কেউ কারও মুখের দিকে তাকিয়ে নেই, অথচ দু’জনেই দু’জনের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন। দু’জনেই নিজের হাতে তাস গোপন রেখেছে; যে টেবিলের উপর তাদের হাত সে টেবিলক্লথ’টি হলুদ। বিষণ্ন হলুদের আভা উঠে আসছে সেখান থেকে।

দ্য কার্ড প্লেয়ার্স

‘দ্য কার্ড প্লেয়ার্স’ সিরিজের দ্বিতীয় ছবিটিতে সর্বমোট পাঁচজন উপস্থিত। তিনজন তাসের টেবিলে, একটি মেয়ে ও একজন মাঝবয়সী পুরুষ তাদের খেলার দর্শক। এখানেও সেজানের ভারী স্ট্রোকস চোখে এড়াবে না। টেবিলে বসে থাকা তিনজন খেলোয়াড়ের অভিব্যক্তি’তে কোথাও উচ্ছ্বাসের ছাপ নেই। প্রত্যেকেই যেন বিষণ্ন ও হতাশ; জয়ের উল্লাসের থেকেও তাদের ঘিরে রেখেছে এক অদ্ভুত শঙ্কা ও উদ্বেগ। এমনকি চুরুট-ঠোঁটে যে মানুষটি এ খেলার দর্শক তার চোখে-মুখেও নির্লিপ্তি।
ক্যানভাসের ডানদিকে বসে থাকা মেয়েটি অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে খেলার দিকে।
জীবনের সমস্ত তাসের টেবিলের ওপর কি এভাবেই নেমে আসে ঈগলপাখি ও তার ডানায় বেঁধে উড়ে চলে যায় ‘সময়’কে নিয়ে? জীবন আদপে কি একটি তাসের টেবিলের ম্যাক্রো-রূপ, হারজিতের বাইরেও যেখানে উত্তেজনার জন্য আসে মানুষ এবং ক্রমাগত এক সময়ে তাদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠতে থাকে, তারপর তাদের গ্রাস করে বিষণ্নতা।
আর টেবিলের পাশে বসে থেকে ওই মেয়েটি কি তাসের প্রনোদনা? তার উপস্থিতি কি একটা সময় পর্যন্ত প্রভাবিত করে তাসুড়েকে? এখানে লক্ষ করা জরুরি, তুলনায় কম বয়সী পুরুষটির কাছাকাছি মেয়েটিকে রেখেছেন সেজান। একমাত্র সে পুরুষটিই হয়তো মেয়েটির উপস্থিতি নিয়ে সামান্য হলেও ভাবিত; অন্য দুই খেলোয়াড়ের সে ভাবনাটুকুও নেই। ছবিটিতে আলো খেলা করছে এমনভাবে যে সবার মুখ সমানভাবে আলোকিত।
এবং একটা সময়ে আবিষ্কার করা যাবে যে টেবিলের ওপর খেলা হয়ে চলেছে তার রঙ শাদা।
শাদা, অসম্ভব শাদা এক টেবিলের ওপর খেলা করে চলেছে তাসগুলি।
হুহু করে ছুটে যাওয়া সময়ের মধ্যে মানুষের বসে থাকা ও ক্রমশ নির্লিপ্ত হয়ে ওঠার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ছবিগুলির সব থেকে বড় আবেদন। ছবি দু’টি দেখার ফাঁকে মনে হয় তাস এক অজুহাত; মানুষ আসলে কাটিয়ে দিতে চায় তার বিষণ্ণতার দীর্ঘ দীর্ঘ প্রহরগুলি। সে এসে বসে তাসের কাছে। একটা সময় পর তাস তাদের নিয়ে খেলতে শুরু করে।
তাসের এই অনুপম শিল্পের থেকে হত্যার শিল্পের দূরত্ব ঠিক কতটা?
জীবনে বহু হত্যার কাহিনি পড়েছি আরও কোটি কোটি মানুষের মতো; তবে হত্যা বা হত্যা-সহায়তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকা দু’টি চিত্র থেকে বেরোতে পারিনি। বেরোতে পারবও না কোনওদিন।
যতবার সে দু’টি চিত্রের কাছে ফিরে গেছি ততবার মনে হয়েছে এ হত্যা আসলে হত্যার থেকেও বেশি কিছু। গূঢ়, আদিম, পাশবিক, দুর্জ্ঞেয় সে দুটি হত্যা বা হত্যা-সহায়তা।
‘রক্তাক্ত ঝরোখা’র একটি কবিতায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখছেন,
‘ধানখেতে বেড়াতে এসেছে দু-জন,
ধানখেতে শিশু রেখে পালাচ্ছে দু-জন;

‘এবার স্টেশনে চলো’ বলল একজন;
‘এবার স্টেশনে চলো’ বলল একজন।

‘সাঁকো বেয়ে নিচে এসো’ এ ওকে বলল,
‘সাঁকো বেয়ে নিচে এসো’ এ ওকে বলল।

আর নেমে এসে দ্যাখে সুন্দর কাঁথায়
রক্তমাখা শিশু নিয়ে ধানী নৌকা যায়।’
-পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন, কবিতাটির মধ্যে একটি তীব্র শ্বাসরোধী সিনেম্যাটিক চলন আছে। ধানখেতে কেন দু-জন মানুষ একটি শিশু’কে রেখে পালাচ্ছে তার কোনও কারণ উল্লেখ করা নেই কবিতাটিতে। এমনকি এটিও বলা নেই যে ‘দু-জন’ আসলে দুই ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ কি না। কিন্তু যেহেতু শিশু, যেহেতু ধানখেত সেহেতু আমাদের অবচেতন থেকে চেতনের দিকে ডলফিনের মতো ঘাই মেরে ওঠে দুই নারী-পুরুষ মূর্তি।
এ কবিতাটিতে হয়তো সরাসরি হত্যা নেই; কিন্তু হত্যার সমান নিষ্ঠুরতা আছে। অনেকগুলি সম্ভাবনা আমাদের ক্রমাগত তাড়িত করে চলে ‘কারণ’টিকে খুঁজে বার করতে। এ কি পরিণতিহীন যৌনতার দিকে হেঁটে যাওয়া দুটি নরনারী’র চাহিদার প্রকাশ? না কি কোনও সামাজিক কারণে তারা ধানখেতে ফেলে রেখে যেতে বাধ্য হচ্ছে শিশুটিকে! এবং তলে তলে আরেকটি ঘটনাও ঘটিয়ে দিয়ে যায় কবিতাটি- নারী’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকা মাতৃধারণা, ধাত্রীধারণা ও তথাকথিত ‘শুভ’ধারণাকে ছারখার করে দেয় লেখা’টি।
সুন্দর কাঁথায় কেন রক্তমাখা শিশুটিকে নিয়ে ধানী-নৌকা চলে যাচ্ছে, এ ‘চলে যাওয়া’ সময় স্রোতকে ইঙ্গিত করছে কি না তা নিয়ে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না; ঠিক যেমন যায়নি শিশুটিকে ধানখেতে ফেলে রেখে নারী-পুরুষের চলে যাবার কারণ নির্ণয় করা ও হত্যার সমান নিষ্ঠুরতার তল্ খুঁজে পাওয়া।
দ্বিতীয় যে হত্যা-পরিকল্পনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তরুণ বয়সে এবং নিষ্ঠুরতার শ্বাসরোধী যে মহা-পতঙ্গভুক ফুল থেকে আজও মুক্তি পাইনি সেটি অবশ্যই ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথের মধ্যে ঘটে যাওয়া হত্যা-পরিকল্পনা।
কেন মানুষ গুপ্তহত্যার দিকে ছুটে যায়?
সে কি শুধুই ট্র্যাজেডির পরিণাম, না কি তার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে সৃষ্টির মূলে ঘনিয়ে থাকা দুর্জ্ঞেয় অন্ধকার?
মানুষের সমস্ত শিল্প যেমন সত্য তেমনই কি সত্য এই হননেচ্ছা?
সেজানের ‘দ্য মার্ডার’ ছবিটি তাঁর জীবনের এক বিশেষ পর্বে আঁকা। ১৮৬১-তে তিনি প্যারিসে চলে এসেছিলেন। তখনও দেখা হয়নি হুর্তোশ ফিকে’র সঙ্গে; ফিকে’র সঙ্গ তাঁকে ধীরে ধীরে নিয়ে চলে যাবে শান্ত প্রকৃতির দিকে।
সেজান ততদিনে সমালোচিত হয়ে উঠেছেন তাঁর ইমপেস্টো-টেকনিকের জন্য। প্যালেট-নাইফে রঙ নিয়ে ক্যানভাসে গাঢ় স্ট্রোক…।
এ ছবিটিতেও তার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। যে অন্ধকার প্রত্ন ও আদিম তার ভেতরে ঘটে যাচ্ছে হত্যাকাণ্ড। হত্যা-নদী থেকে উঠে এসেছে দু’জন মানুষ। তারা একজন মানুষ’কে ভূপাতিত করে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চলেছে।
ছবিটি’তে তিনজন চরিত্র; কারও মুখ দৃশ্যমান নয়। ব্যাকগ্রাউন্ড গাঢ়, ধূসর। হত্যাকারী দু’জনের মধ্যে একজন মহিলা, সে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে মানুষটিকে। আর হত্যাকারী পুরুষটির পোশাক উড়ছে হাওয়ায়, ডান-হাতে ধরা ছুরি নেমে আসা মুহূর্তের অপেক্ষা শুধু। এবং দৃষ্টি বহুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে নারী’টির ক্রমশ ‘পুরুষালী’ হয়ে ওঠা সুস্পষ্ট, শক্তিশালী মাংসপেশির কাছে। যার হাতে ছুরি, তার ডান-পা হাঁটুর কাছ থেকে বেঁকে রয়েছে। সে মাটি থেকে শুষে নিতে চাইছে হত্যার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত শক্তি। হত্যাকারী’র দু’টি পা অমোঘভাবে জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার ক্রোধ আর ঘৃণা।
জগতের মহা-হত্যাশালায় এ গুপ্ত-হত্যার পিছনের কোনও কারণ উন্মোচিত করতে চাননি সেজান। শুধু নদীর ইশারা রেখেছেন; হয়তো হত্যার পর তাকে ভাসিয়ে দেওয়া হবে সে নদীতে।
চারপাশ থেকে আর সব উপাদান’কে অন্ধকারে, ধূসরে শুষে নিয়েছেন সেজান। কিন্তু সমস্ত হত্যাদৃশ্যের কাছে বসে আমাদের মনে হয়, কেন এ হত্যা? কেন, কেন, কেন? হত্যা হওয়া মানুষটি কি ত্রিকোণ প্রেমের শিকার? সে কি কোনও কারণে এই দুই নর-নারী’র মধ্যে এসে পড়েছিল? তাকে কি ডেকে আনা হয়েছিল নদীর ধারে গূঢ় সংকেতের মাধ্যমে?
এ সম্ভাবনার পথটি চেনা, অতিচেনা। আরও একটি সম্ভাবনার কথা বিদ্যুতঝলকের মতো মাথায় ঘুরতে শুরু করেছিল।
আবহমানের সমস্ত গুপ্ত-হত্যার নিদর্শন হিসাবে যদি মাটিতে চেপে ধরা মানুষটিকে গণ্য করা হয় তা হলে কি সেজান আসলে বলে গেলেন যে হত্যার শিল্পের কাছে নারী-পুরুষের ভূমিকা একই রকম! নারী’র মধ্যে আরোপিত পেলব-সত্তা সেখানে অলীক হয়ে যায়। না কি প্রকৃতির ভিতর আসলে লুকিয়ে রয়েছে নারী ও পুরুষ- দুটি সত্তা’ই! জন্মের পর জন্ম ধরে মানুষ আসলে দুই অমোঘ ঘাতকের কাছে মাথা পেতে দিয়ে শুয়ে রয়েছে আর তারা ‘দু’জন’ ক্রমাগত হত্যার পরে তাদের একে একে ভাসিয়ে দিচ্ছে নদীর জলে… ভেসে যাচ্ছে শব… ভেসে যাচ্ছে শবাধার।
ছবিটির সামনে বসে থাকতে থাকতে আরেকটি বিষয়’ও ঘটে; মনে হয় এ দুই হত্যাকারী যদি রক্তমাংসের নর-নারী হয় তা হলে কি তারা নদীর জলে রক্তের দাগ ধুয়ে বাড়ি ফিরে যাবে? তীব্র কাঁটা’টিকে উপড়ে ফেলে তাদের হৃদয় কি শান্তি পাবে? না কি তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে জেগে উঠবে এক একটি ‘ম্যাকবেথ’ ও ‘লেডি ম্যাকবেথ’?

দ্য মার্ডার


শুধু কি হত্যার পর! হত্যার আগেও কি হত্যাকারী আসলে নিজেকেই হত্যা করে না বারবার! নিজেকে ওই বারবার হত্যার মধ্যে দিয়েই প্রকৃত হত্যাকাণ্ডটি সমাপন হয়ে যায়।
‘ম্যাকবেথ’ নাটকে এ ঘটনাটিই ঘটেছে; ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথ নিজেদের হত্যা করেছে বারবার। রাজাডানকান’কে হত্যার আগে ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথের কথোপকথন ছিল এ রকম’
MACBETH
Methought I heard a voice cry ‘Sleep no more!
Macbeth does murder sleep’, the innocent sleep,
Sleep that knits up the ravell’d sleeve of care,
The death of each day’s life, sore labour’s bath,
Balm of hurt minds, great nature’s second course,
Chief nourisher in life’s feast,–
LADY MACBETH
What do you mean?
MACBETH
Still it cried ‘Sleep no more!’ to all the house:
‘Glamis hath murder’d sleep, and therefore Cawdor
Shall sleep no more; Macbeth shall sleep no more.’
LADY MACBETH
Who was it that thus cried? Why, worthy thane,
You do unbend your noble strength, to think
So brainsickly of things. Go get some water,
And wash this filthy witness from your hand.
Why did you bring these daggers from the place?
They must lie there: go carry them; and smear
The sleepy grooms with blood
-যে মানুষ নিজে আবিষ্কার করে সেই পূর্বাভাস যেখানে বলা হচ্ছে, পুরবাসী, তোমরা আর ঘুমিয়ে থেকো না… তোমাদের পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ আছে যে ঘুমন্ত মানুষ’কে পর্যন্ত হত্যা করতে পারে, সে মানুষ আসলে নিজেকে হত্যা করেছে বহু আগেই।
আত্মহত্যা ছাড়া পৃথিবীতে কোনও গুপ্তহত্যা সফল ও সার্থক হয়নি আজ পর্যন্ত।
ছবিটির ডিপ-স্পেসে বয়ে যাওয়া নদীর ইশারা রেখেছিলেন সেজান; সে কি শুধু শব’টিকে ভাসিয়ে দেবার জন্য? মনে হয়, না; সম-সময়ের শিল্পের প্রতি তিনি ও তাঁর বন্ধু’রা সন্দেহের দৃষ্টি ছুড়ে দিচ্ছিলেন। নির্মাণ করতে চাইছিলেন কেতাবি-ধারার বাইরে বেরিয়ে নিজস্ব পরিসর; সেখানে ক্যানভাসে ফুটিয়ে রাখা প্রতিটি রেখার মূল্য অপরিসীম।
ক্যানভাসে ফুটে থাকা ওই নদী আসলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি স্বেচ্ছাচারী’ কবিতায় উল্লেখিত নদীর কাছাকাছি এসে পড়ছে কোথাও। শক্তি লিখছেন,
‘তীরে কি প্রচণ্ড কলরব
‘জলে ভেসে যায় কার শব
কোথা ছিল বাড়ি?’
রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়- ‘আমি স্বেচ্ছাচারী!’
-শব-নিরপেক্ষ এক নদী বয়ে যাচ্ছে, সে কি দেখছে এই হত্যাকাণ্ড? সে কি ‘সচেতন’ হয়ে উঠছে এটি দেখে? না কি এ স্বেচ্ছাচার তাকে নির্লিপ্ত থাকার বর্ম দান করেছে?
ছবির ক্ষেত্রে (বিশেষ করে সেজানের মতো মহা-শক্তিশালী শিল্পীর ক্ষেত্রে) তার সামনে দীর্ঘ দীর্ঘ সময়ে বসে থাকা জরুরি। জরুরি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেটিকে দেখা।
সেজানের সঙ্গে তাঁর বাবা লুই অগাস্ট-এর সম্পর্ক কোনও দিনই একমাত্রিক ছিল না। লুই পুত্রের শিল্পকলা নিয়ে খুব বেশি উৎসাহী ছিলেন না; আবার তিনি সেজান’কে নিয়মিত অর্থ দিয়ে যেতেন, এটিও সমান সত্য।
লুই অগাস্ট যে ভীষণ সুযোগ-সন্ধানী, চতুর, সফল মানুষ ছিলেন সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। জীবনের একটা সময়ে তিনি রূপান্তুরিত হয়েছিলেন ‘সুদখোর’-এ। কিন্তু সেজানের আঁকা তাঁর বাবার পোর্ট্রেট নিয়ে একদিন চমৎকার একটি বিদ্যুৎ-ইশারা পেয়েছিলাম জন কিয়ার-এর Paul Cezanne / Critical Lives- গ্রন্থটিতে।
কিয়ার আমাদের দেখতে বাধ্য করছেন, অগাস্টের হাতে L’Evenement সংবাদপত্র; এ সংবাদপত্রটিতে সেজানের একান্ত বন্ধু এমিলি জোলা লিখতেন। অগাস্টের পছন্দের সংবাদপত্র ছিল, তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল Le Siecle।
ছবিটিতে লক্ষ করার বিষয়, অগাস্ট যে চেয়ারটিতে বসে আছেন সেটি গদি-মোড়া, প্রায় রাজ-সিংহাসনের মতো।
এবার যে সূত্রটি ছবি দেখার ক্ষেত্রে কেউ বলে দেবে না, যা ছবির সামনে বসে থাকতে থাকতে একদিন আপনার-আমার মাথায় ঝলকের মতো খেলা করে যাবে সেটি হল- আমরা আবিষ্কার করব অগাস্ট জীবনের পরিণত-পর্বে এসেও, যাবতীয় জাগতিক সফলতা অর্জন করার পরেও ‘চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে নেই।’
বরং তাঁর ভঙ্গি কিছুটা সতর্কতার, অ্যলার্টনেসের… পিছনের দেওয়ালটিতে সেজান দুটি শেডস ব্যবহার করেছেন। ক্যানভাসের ডান-দিক অধীকতর গাঢ়, বাম-দিকে আরেকটি ‘খেলা’ লুকিয়ে রয়েছে।
অগাস্টের মাথার ঠিক পিছনে সিজান একটি ছবি রেখেছেন, প্রকৃতির… গাঢ়, প্যালেট-নাইফ দিয়ে আঁকা সম্ভবত।
বাবার সঙ্গে টানাপোড়েনের সম্পর্কটিকে ক্যানভাসে রেখে যাবার সময়ে সেজান ভুললেন না নিজের ‘দস্তখত’টি রেখে যেতে। ছবির ভেতর রেখে গেলেন ‘ছবি’।
এ যেন একই সঙ্গে স্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যানের চিত্র- পিতা-পুত্র একই সঙ্গে একে অপরকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন ও প্রত্যাখ্যান করছেন।

দ্য আর্টিস্ট’স ফাদার


আলবেয়ার কামু তাঁর ‘মিথ অফ সিসিফাস’-এ লিখছেন,
‘There is butone truly serious philosophical problem, and that is suicide. Judging whetherlife is or is not worth living amounts to answering the fundamental question ofphilosophy. All the rest – whether or not the world has three dimensions,whether the mind has nine or twelve categories – comes afterwards’
বাঙালী পাঠকমাত্রই জানেন শিল্প ও অস্তিত্ত্বের ভেতর খেলা করে যাওয়া বিপন্ন বিস্ময়ের কথা ‘আট বছর আগের একদিন’ নামে একটি কবিতায় লিখিত হয়েছিল। লিখিত হয়েছিল,
‘জানি – তবু জানি
নারীর হৃদয় – প্রেম – শিশু – গৃহ – নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তিনয়, সচ্ছলতা নয় –
আরো এক বিপন্নবিস্ময়
আমাদের অন্তর্গতরক্তের ভিতরে
খেলা করে’
-জীবনানন্দ আরও লিখেছিলেন, ‘চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে / একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;।’
প্রশ্ন উঠতেই পারে সেজানের ‘দ্য হাউস অফ দ্য হ্যাঙড ম্যান’ ছবিটিতে তো আলোর প্রকাশ্য উৎসব।
বুক-চাপা টিলার মাঝখান দিয়ে নেমে গেছে রাস্তা। কাছের দীর্ঘকায় গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে পাতা-ঝরিয়ে। একটি পাথুরে বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে; সমস্ত ‘আলো’ গায়ে মেখে নির্জনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হলুদ-রঙের বোল্ড স্ট্রোকস বাড়িটিকে বিষণ্ণ করে তুলেছে, যত ডিপ-স্পেসে যাওয়া যাবে তত দেখা দেবে অন্যান্য বাড়ির ইশারা।
তাদের চিমনিতে সেজান লালাভ বর্ণ ফুটিয়ে তুলেছেন। জনপদের ইশারা, সেখানে যেন জীবন ও যৌনতার কোনও শেষ নেই।
শুধু এ সবকিছুর থেকে নিজের মুদ্রাদোষে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘দ্য হাউস অফ দ্য হ্যাঙড ম্যান’।
জীবনানন্দের কবিতায় রাতের অন্ধকারে যে ‘খেলা’ সম্পন্ন হয়েছিল এ ছবিটিতে প্রকাশ্য দিনের আলোয় তা সম্পন্ন হয়ে চলেছে।

দ্য হাউস অফ দ্য হ্যাঙড ম্যান

-ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেআরেকটি বিষয় ‘আবিষ্কার’ করে শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত নেমে যায়; সেটা হয়তো জীবনানন্দের কবিতাটি পড়ে থাকার কারণে কিছুটা। ক্যানভাসের ডান-দিকে একটি রাস্তা উঠে গেছে টিলার বুক বেয়ে।
মনে হয়, বহু কোটি বছরের ওপার থেকে এক প্রত্ন-জীব, ডায়ানোসরের মতো তার গলা, তাকিয়ে রয়েছে বাড়িটির দিকে।
রাস্তাটি রূপান্তরিত হতে শুরু করে প্রত্ন-প্রাণী’তে। সে বুকে ধরে থাকে ‘উটের গ্রীবার মতো’ই নিস্তব্ধতা।
একজন শিল্পী কি তাঁর সৃষ্টির সময়ে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ হয়ে ওঠেন? সে সময়ে কি তিনি একই সঙ্গে ধারণ করে থাকেন নারী ও পুরুষ সত্তা?
রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে বারবার সেটা মনে হওয়া স্বাভাবিক; সেজানের ‘দ্য বাথার্স অ্যট রেস্ট’ ও ‘দ্য লার্জ বাথার্স’ দেখেও সেটা মনে হওয়া স্বাভাবিক।
‘দ্য বাথার্স অ্যট রেস্ট’ ছবিটিতে চারজন পুরুষ, দু’জন নগ্ন। একজন পুরুষ শুয়ে আছে ঘাসে, বাকি তিনজন দণ্ডায়মান। লক্ষ করার, তাদের দৃষ্টি উদাসীনভাবে ক্যানভাস ছাড়িয়ে চার’টি দিকে ছড়িয়ে গেছে।
অনন্ত প্রকৃতি ও অবসরের কাছে নিজেদের সঁপে দিয়েছে চারজন পুরুষ। ক্যানভাসের বাম-দিকে দণ্ডায়মান পুরুষটির সমান্তরাল একটি গাছে। ঋজু, লম্বা গাছটি পুরুষ-যৌনতাকে চিহ্নিত করছে। অ্যজুর-রঙের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ ও দিগন্তে টিলার ইশারা।
সব থেকে আশ্চর্য করে ঘাসের বুকে শুয়ে থাকা পুরুষটি; তার সমস্ত ভঙ্গির মধ্যে ‘নারী-সুলভ’ ইশারা। সে কি প্রকৃতির মাঝখানে এসে নিজেকে সঁপে দিতে চাইছে, যেভাবে নারী যৌনতার সময়ে সঁপে দেয় নিজেকে পুরুষের কাছে?
এবং ছবিটি থেকে চোখ সরিয়ে নিতে নিতে আরও একবার স্তম্ভিত হয়ে যেতে হবে। ক্যানভাসের বাম-দিকে দণ্ডায়মান পুরুষটির পায়ের কাছে পড়ে আছে এক-টুকরো ত্রিভুজাকৃতি রোদ অথবা ঘাসজমি।

দ্য বাথার্স অ্যট রেস্ট

-এ ত্রিভুজ তো নারী-যৌনতার প্রতীক। নির্জন প্রকৃতির মধ্যে, সেজানের গাঢ় রঙের খেলা ও বোল্ড ব্রাশ-স্ট্রোকের এ রহস্যময় খেলা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।
সেজান পুরুষের স্নানের পাশাপাশি নারী’র স্নান’ও দেখেছিলেন; ‘দ্য লার্জ বাথার্স’ তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম। জীবনের শেষ দশ বছর এমন আশ্চর্য স্নানদৃশ্য দেখে চলেছিলেন সেজান।
বিশাল ক্যানভাসে অয়েল-পেইন্ট; আয়তাকার ক্যানভাস, অথচ দু’-পাশ থেকে ঝুঁকে পড়া গাছগুলি ক্যানভাসটিকে দর্শকের কাছে করে তুলছে পিরামিডাকৃতি।
ছবিটিতে নগ্নিকাদের মধ্যে কয়েকজন কীসের যেন প্রতীক্ষায় উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। জলাশয় পেরিয়ে চলে গেছে তাদের দৃষ্টি।
আপাত-শান্ত প্রহরের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে দমবন্ধ অবস্থা।
ক্যানভাসের একদম ডিপ-এ আরও জলের ইশারা এবং সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে নীলাভ এক লাইটহাউস।

দ্য লার্জ বাথার্স

-এ ছবিটিতেও একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ-যৌনতাকে প্রকাশ ক’রে এমন চিহ্ন রেখে গেলেন সেজান। অথবা পিরামিডাকৃতি (ত্রিকোণের আভাস বিশিষ্ট) দৃষ্টি-পথের মধ্যে পুরুষ-দণ্ডের আভাস রেখে সেজান নারী’র ধাত্রী-ভূমিকা ও ধারন-ক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে গেলেন।
অনেক সময়েই সেজানের ছবির সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতার কিছু ‘অদ্ভুত’ সাযুজ্য দেখে চমকে উঠেছি। যেমন ‘ইটারনাল ফেমিনাইন’ ছবিটি সেজান সৃষ্টি করছেন আঠারো’শো ছিয়াত্তর-সাতাত্তর সাল নাগাদ।
‘গোধুলিসন্ধির নৃত্য’-তে জীবনানন্দ লিখছেন,
‘প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের
তুলোর বালিশে মাথা রেখে তার মানবীয় ঘুমে
স্বাদ নেই; এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে
ওই চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে- বরুণে
ক্রূর পথ নিয়ে যায় হরিতকী বনে- জ্যোৎস্নায়।
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন
শেষ হ’য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ
পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক-কর্কট-তুলা-মীন’।
-এ কথা অনস্বীকার্য যে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো’।
এ ক্যানভাসের মধ্যস্থলে নিজেকে উন্মুক্ত করে শুয়ে ‘একজন’ নারী’
কিন্তু জীবনানন্দ তো এটিও লিখেছিলেন, ‘পুরুষ তাদের; কৃতকর্ম নবীন; / খোঁপার ভিতরে চুলে : নরকের নবজাত মেঘ, / পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ।’
সেজান তাঁর ছবিতে নারীটির দু’-চোখে লালাভ স্ট্রোক দিয়েছেন। এটি একই সঙ্গে নারী’টির মণি-হারা চোখ (ফলত অন্ধত্ব) ও যৌন-ইশারাকে সূচিত করে। কিছুতেই স্পষ্ট হয় না, এ নারী ‘সিডিউস’ করে চলেছে তার চারদিকে ভীড় করে আসা পুরুষ’দের, না কি এ দর্শকামের উৎসবের মাঝখানে শুয়ে সে ব্যথিত ও অন্ধ করে দিতে চাইছে নিজেকে।
একজন চিত্রকর (ডান-দিকের শেষতম ব্যক্তি) এঁকে চলেছেন দৃশ্যটি।
কী যেন এক বিচিত্র, দুর্বোধ্য, দুর্জ্ঞেয় কারণে নারীটির পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে বহু পুরুষ।

ইটারনাল ফেমিনাইন

-কী চায় তারা নারীটির কাছে? যৌনতা? উল্লাস? আর এ সবের মধ্যে দাঁড়িয়েও, নিজের চারদিকে নির্জনতার বর্ম দিয়ে কি শিল্পী’কে সৃষ্টি করে যেতে হয়?
পর মুহূর্তেই আর একটা সম্ভাবনার কথাও মনে হয়- শুয়ে থাকা নারীটিকে কি খুব গোপনে ভালবেসে গেছে ওই শিল্পী?
এ দর্শকামের উৎসবের ভিতরে দাঁড়িয়েও কি তাকে রক্ষা করে চলতে হচ্ছে তার প্রেম’কে, আত্মদীপ’কে?
কোনও উত্তর নেই; শিল্পের কোনও ‘উত্তর’ হয় না। যা হয় তা আসলে অনন্ত সম্ভাবনার খেলা।
যেমন ‘দ্য অ্যবডাকশন’ ছবিটি; এটিও তেল-রঙে আঁকা। ধূসর, গাঢ় সবুজ, কালো রঙের ছোপ ক্যানভাসটিকে শ্বাসরুদ্ধ করে দেওয়া প্রতিক্ষার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। মহাজাগতিক, প্রত্ন-আলো এসে পড়েছে অতি-সবল পুরুষটির গায়ে। সে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে এক নারী’কে।
কেন এই অপহরণ? নারী’টির দু’টি পা ও ডান-হাতের অবস্থান দেখলে মনে হতে বাধ্য সে প্রতিরোধের স্তর পেরিয়ে এসেছে। সে কি নিজেকে সমর্পণ করেছে স্বেচ্ছায়? না কি সে বাধ্য হয়েছে?
ছবিটি জুড়ে এ প্রশ্নের পাশাপাশি ঘুরে বেড়াতে থাকে নারী ও পুরুষটির পরিচয়। পুরুষটিকে কেউ কেউ চিহ্নিত করেছেন হারকিউলিস বা প্লুটো হিসাবে। নারী’কে আলসেসটিস হিসাবে।

দ্য অ্যবডাকশন

-কিন্তু হঠাৎ আমাদের চোখ পড়বে ছবিটিতে পুতুলাকৃতি অন্য দুই শরীরের দিকে। নারী ও পুরুষের মধ্যে ঘটে যাওয়া যৌনতা, পাপবোধ কি এখনও তাদের স্পর্শ করেনি? না কি তাদের মধ্যে থেকে উঠে আসা যৌনতা অতিকায় আকৃতি ধারণ করেছে অপহরণকারী ও অপহৃত হয়ে যাওয়া যাওয়া নারী-পুরুষের মধ্যে? এই আদিম যৌনবোধের কাছে কি আমরা আসলে ওই শিশু দু’টির মতো ‘অসহায়’?
আদিম, বন্য, প্রত্ন যৌনতার এক নির্বাক ছায়াচিত্র এ ছবিটি।
সেজানের যে ছবিটির দেখতে দেখতে এ পর্ব শেষ হবে সেটি হল, ‘দ্য কিচেন টেবিল’। এটিও অয়েল-পেইন্টিং। জীবনের অনন্ত সম্ভারের মতো ফল ও ফলের ঝুড়ি ভরে আছে টেবিলটিকে।

দ্য কিচেন টেবিল

-স্থির একটি চিত্র, টেবিলের উপর কয়েকটি পট। এই অনন্ত সম্ভার অপেক্ষা করছে কার বা কাদের জন্য?
খাদকের উপস্থিতি নেই কোথাও, অথচ কিচেন-টেবিল আছে। উপচে পড়া ফলের রাশি আছে। সেজান টেবিলের উপর পেতে রাখা কাপড়টিকে দুমড়ে-মুচড়ে ক্যানভাসের স্পেস-কে ভাঙচুর করেছেন।
কিছুই না-বলার শিল্প ছেয়ে আছে ছবিটিকে। ছবিটি আসলে কিছুই হয়ে উঠতে চায়নি, এই কিছুই না-হয়ে ওঠার শিল্প সব থেকে বেশি ঘাতক, হয়তো। তার কাছে আমাদের দীর্ঘ দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয়, উঠে যেতে হয়, আবার তার সামনে চলে আসতে হয়।
এবং হঠাৎ আবিষ্কার করা যায়, যে টেবিলের উপর ফলগুলি রাখা রয়েছে তার বাম-দিকের প্রান্তের সঙ্গে ডান-দিকের প্রান্ত (সরলরেখায়) মিলছেনা। শাদা টেবিলক্লথের নিচে তারা বিভক্ত হয়ে গেছে।
তা হলে কি টেবিল আসলে দু’টি? স্পেস-কে ভাঙচুর করে টেবিলক্লথের নীচে সেজান আসলে দু’টি টেবিল’কে নিপুনভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন।
জীবন ও জীবনের অনন্ত উপহারের নীচে দু’টি কাঠের টেবিল মিশে গেছে। তাদের ঢেকে রেখেছে দুধ-শাদা টেবিলক্লথ এবং সেজানের ‘ম্যাজিক’।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২