সব কথা ব্যথার: গৌতম বসু – সঙ্ঘমিত্রা হালদার

সব কথা ব্যথার: গৌতম বসু – সঙ্ঘমিত্রা হালদার

শেয়ার করুন

এই জগত ও জীবনের যে বিপুল-বিরাট ঐশ্বর্য, চাইতেন তা তাঁর চেতনার অংশ হয়ে উঠুক। ‘আদম’ প্রকাশিত কবিতাসংগ্রহের ভূমিকায় চাতকের মতো ব্যক্ত করেছেন সেই অভিপ্রায়। তিনি কবি গৌতম বসু। কবিতাসংগ্রহের একদম শেষে ‘সংলাপ-১’ অংশে, কুৎস ও অশ্বসেনের কথোপকথনেও ঘুরেফিরে শ্রাবণধারার মতো উচ্চারিত হয় প্রায় এই কথাটাই—“চেতনার আরম্ভ কোথায় আর কোথায়ই বা তার সমাপন, এ-কি সহজে বোঝা যায়, অশ্বসেন? কতটুকুই-বা ওই মরজগৎ, পঞ্চইন্দ্রিয়ের পরিধি, এ-কথা আর কেউ বুঝুক বা না-বুঝুক, আমরা দুজনে বুঝি, সম্পূর্ণরূপে বুঝি।” ‘প্রায়’ বললাম এই কারণে, যে, ‘সংলাপ-১’ অংশের চেতনার কথা যেন এই ইন্দ্রিয়জগত আর মরজগতকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু ‘কবিতাসংগ্রহের’ ভূমিকা-কথায় এই জগত-চরাচরের যা কিছু ঐশ্বর্য তাকে চেতনায় ঠাহর করার কথা বলা হয়েছে। এক মুহূর্ত মনে হয়, তবে কি এই দুই চেতনা-জগতে কোনও দ্বন্দ্ব আছে? না, দ্বন্দ্ব নয়, বরং পারস্পরিক নির্ভরতা আছে। ব্যাপারটা এরকম, আমাদের ইন্দ্রিয় আছে বলেই না ইন্দ্রিয়াতীত বোধ আছে, পঞ্চইন্দ্রিয়কে ছাড়িয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে! এক অর্থে এই চেতনা এবং চৈতন্যের জগতই তাঁর কবিতায় প্রবেশের চাবিকাঠি।

মনে চেতনার আলোটি থাকলে কত সামান্য উপচারেই যে অসামান্যের স্পর্শ মর্মে বেজে ওঠে, নিবিড় ছায়া দেয়, তাঁর কবিতাই তার প্রমাণ—
“যতবার পার হয়েছি এবাজুদ্দিনের বাড়ি, দেখেছি, বাঁশের কঞ্চির গেটটি নারকেল দড়ি দিয়ে বেড়ার সঙ্গে বাঁধা, কেউ নেই এদিকে-ওদিকে। জায়গাটা নির্জন; পুবদিক থেকে বেঁকে-আসা কাঁচা রাস্তার পাশে কয়েকটা উঁচু ডাবগাছ, তারই কোল ঘেঁষে ভাঙা-ছেঁড়া ছায়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর ভিটে। এদিকে আর কোনও বসতি নেই, রাস্তার ওধারের জমি বসবাস অথবা ফলচাষের অযোগ্য, অসমতল, তাই কাঁটাঝোপ আর আগাছায় ভরা; ঘন সবুজের ভিতর কয়েকটা ছাগল চরছে। ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা মাড়াবার শব্দ আর নানা পাখির ডাক—এক প্রগাঢ় শান্তির ভিতর এবাজুদ্দিনের বাড়ি ডুবে আছে।” [রসাতল: এবাজুদ্দিন লস্কর]

কয়েক বছর আগে একবার কুমাউঁ’র এক ছোট্ট গ্রামে দিন তিনেক ছিলাম। সেখানের সভ্যতা হাজার বছর আগেকার সময়ের ভিতর এখনও দিব্যি এঁটে যায়। তো এক সকালে, একটু বেলার দিকে গ্রাম ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছু উপরে উঠে ঢালু একটা পাহাড়ের মাথায় বেশ কিছুটা সময় কাটাই। প্রায় ঘণ্টা চার-পাঁচেক। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু পাইন গাছ। আর মাথার উপর শুশ্রূষার মতো অক্ষত নীলাকাশ। আশেপাশের ইতস্তত বুনোঝোপ থেকে একটানা অবিরত ঝিঁঝিঁদের মুখে ফেনা তোলা সমস্বর। কানে তালা লাগতে লাগতে একসময় এই অবিরাম ডাক ইন্দ্রিয়-চেতনার অংশ হয়ে যায়। কানে আলাদা করে আর কিছু অনুভূত হয় না। তো ঝিঁঝিঁরব সয়ে আসতে না আসতে পাইনের কিছু উপর দিয়ে থেকে থেকে চিলেদের চক্কর কাটা নজরে আসে। একসময় তাও স্থির প্রকৃতির অংশ হয়ে যায়। আলাদা করে খেয়াল করতে হয় না। তারপর একসময় এই যা কিছু শব্দ স-ব নৈঃশব্দের ভেতর জেগে থাকে। একসময় সেই নৈঃশব্দের ফ্রেমে নিজেকে আর পাশের মানুষটাকেও দেখা যায়। চার-পাঁচ ঘণ্টার সময়ফ্রেমকে মনে হয় মিনিট দশ কী পনেরো। পরে যতবার মনে পড়েছে, এই ফ্রেমটা, মনে হয়েছে, শান্তি আসলে এরকম একটা ফ্রেম। যার দেখা ওই কুমাউঁ’র প্রত্যন্ত গ্রামটিতে পাওয়া গেছিল। আর গৌতম বসু’র কবিতাটা যতবার পড়ি, ততবার তার দেখা পাই। দারিদ্র্য অনেকসময়ই আমাদের মনকে ভেঙেচুরে দেয়। মনের গ্রহণক্ষমতা হারায়। কিন্তু সে যদি বাজারজাত তিমিঙ্গিল সভ্যতার ফাঁদে পা না দেয়, দারিদ্র্যের সংজ্ঞাটাই অনেকটা বদলে যায়। ‘এবাজুদ্দিন লস্কর’ কবিতাটা সেই কথাটার দিকেই যেন আঙুল নির্দেশ করে। সেইসঙ্গে চোরাস্রোতের মতোই গৌতমের কবিতার অন্দরে বোনা থাকে তাঁর রাজনৈতিক চেতনাও।

আসলে যা কিছু অকিঞ্চিৎকর, যা কিছু সামান্য, তার মধ্যে ঐশ্বর্যের সন্ধান পাওয়ার জন্য যে মন দরকার, মনের যে অবাধ অগাধ ঔৎসুক্য, যুগপৎ চঞ্চলতা আর স্থিতি প্রয়োজন, গৌতম বসু সেই মনের অধিকারী ছিলেন। তাই এ বিশ্বসংসারের কোনও তুচ্ছ আয়োজনেই তার ঐশ্বর্যটি, তার চেতনাটিকে খুঁজে পেতে তাঁকে বেগ পেতে হয়নি। পাতা-কুড়ানি থেকে মধ্য দুপুরে বাঁশগাছের নীচে জেগে থাকা পথ, পথের ধুলো, শ্রাবণ কিংবা শালিখ, সবার মধ্যে, সবকিছু থেকে চেতনার জলছাপ ফুটে ওঠে তাঁর মনে, ক্রিয়া করে।

জগতের যাবতীয় শুশ্রূষা আর ঐশ্বর্য যখন ক্রমে লোভের আগুনে পণ্যায়িত হচ্ছে আর ঝলসে যাচ্ছে; ফাঁকা হয়ে আসছে সুন্দরের বাগান, তখন সেই পরিবর্তিত পৃথিবীর কবিতা কেমন হবে, কেমন হওয়া উচিত, সেইসব নিয়ে মনে নিরন্তর প্রশ্নের বাঁধ ভাঙতে থাকে। এমনকি কবিতা লেখার কী মানে আছে আজ আর—এইসব বহু উত্থাপিত তর্ক-প্রতিতর্ক মনে এসে থাবা বসায়। গ্রীষ্মের প্রখরতায় দগ্ধ করে সেইসব প্রশ্নেরা। গৌতম বসু’র কবিতায়, ভাবনাচিন্তায় কোথায় যেন তার একটা ছায়াসূত্র টের পাই; সেইসব প্রশ্নের বিপ্রতীপে। যে ছায়ার প্রশ্রয়ে খানিকটা হলেও নিজের পথের আভাস টের পাওয়া যায়। একাধিক সাক্ষাৎকারে গৌতম বসু বলেছেন—পৃথিবীটা যে কেঁচো, কীট, ব্যাঙাচিরও, সেটা অধিকাংশ লেখাপত্রে অনুপস্থিত থাকে, তা তাঁকে আহত করে। শুধু সাক্ষাৎকার নয়, তাঁর লেখায়ও—যা কিছু অবহেলিত, মনোযোগহীন, নিরুচ্চার—তার প্রতি তাঁর সহজাত একটা টান ছিল। বেদনা কি ছিল না? ছিল তো! নাহলে লিখলেন কী করে—“বসুধাকে বলো/ সব কথা ব্যথার, তার মাঝে জ্বলছে ভূমণ্ডল।” এমনকি, আনন্দও তো বেদনার। কেন-না, তার থাকা তো ক্ষণকালের, শুধু তার প্রতি বিরহটি দীর্ঘ। আর ভূমণ্ডল? সেও কি বেদনাময় নয়? কেন-না, আমার বেদনা-মুকুরেই তো সে প্রতিভাত। অন্যদিকে, ‘সব কথা ব্যথার’ বলে ‘তার মাঝে জ্বলছে ভূমণ্ডল’ পাশাপাশি বসিয়ে গৌতম আদতে একটা আদ্যন্ত রাজনৈতিক ভাষ্যও জুড়ে দিলেন না কি? কী সংহত এই উচ্চারণ, তবু কী দগদগে, চেতনার মাঝে। আসলে সব কথা ব্যথার বলতে পেরেছিলেন, কারণ, তার মধ্যে বাকি পৃথিবীর প্রতি সমমর্মীতা ছিল। কেবল সহানুভূতি খুব কিছু করে উঠতে পারে না, যদি না সমমর্মীতা থাকে।

এই সমমর্মীতা থেকেই তিনি অনুভব করেন—জগৎটা কেবল আত্মসাৎকারী মানুষের নিমিত্ত নয়। তা সমানভাবে একজন দোয়েলের, ফিঙের, ব্যাঙ ও ব্যাঙাচির, ধুলো রোদ আর পথ ও পথিকের। যদিও সেই কথা বলার মতো পরিসর আর কলম খুব বেশি চোখে পড়ে না। একটা বুড়ো আংলা কিংবা একজন অবনীন্দ্রনাথ অথবা একদম সাম্প্রতিককালে রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘মিছিলের পরে’র মতো উপন্যাস হাতেগোনা। পৃথিবীটা যে আসলে সমানভাবে কেঁচো আর শামুকেরও বা আরও অনেকেরও; এই কথা মনে করিয়ে দিয়ে গৌতম আসলে এখানেও তাঁর রাজনৈতিক স্বরটি বুনে দেন। আমি যদি অন্যের প্রাপ্য জায়গাটা ছেড়ে দিতে পারি, আমার প্রয়োজন অতিরিক্ত বিষাক্ত লোভের ফণা, অন্যকে মারতে পারবে না। বরং একটা সুন্দর সহাবস্থান তৈরি হয়। আমার ভাগে কম পড়িতেছে—এই আতঙ্ক পুরীর পাণ্ডার মতো পিছু নেয় না। এই জগৎ-জীবনের যাবতীয় ঐশ্বর্য আর তার চেতনাকে ভোগ করবার মতো অবকাশ মেলে। স্বাদকোরকে সব রং-রূপ ছুঁয়ে ছেনে দেখবার অবকাশ আসে। অনেক সঞ্চয় আর উদ্বৃত্তের পাহাড় করে তার নীচেই হাঁসফাঁস করে চাপা পড়তে হয় না একদিন দুম করে। গৌতম জানতেন সে-কথা। তাই চাইতেন পৃথিবীটা সব্বার হোক, সমানতালে, সমানভাবে। অপরিসীম লোভের আগুনে এত সুন্দর গ্রহটা যে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে, তা আসলে আমাদের মনের দৈন্য। পৃথিবীটা যে সব্বার, এটা ঠিকঠাকভাবে পড়তে পারলে বুঝতে পারলে ঐশ্বর্য নিজেই তার দরজা খুলে দেবে। তাই তো জন্মান্ধ এবাজুদ্দিন লস্কর থেকে অনন্যাদের বাড়ির বোগেনভেলিয়া গাছ, শালিখপাখি থেকে শ্রাবণ, মোবিলের টিন হাতে বৈষ্ণবীর বিষণ্ণ কন্যাসন্তান, পথে কুড়িয়ে পাওয়া হলুদ পাতা, মধ্যাহ্নের বাঁশবন সবই তাঁর কবিতায় চরিত্র হয়ে ওঠে। প্রাণ পায়। তাঁর কবিতায় জল হয়ে ওঠে রামপ্রসাদ সেন। আসলে সংবেদনশীলতার রোঁয়া আর ব্যথার মতো ভালোবাসা নিয়ে যার দিকে তাকানো যায়, সে-ই সুন্দর হয়ে ওঠে। এ এক নিরবধি চর্চা। মনের লালন। মনকে রক্ষা করতে পারার আশ্চর্য কৌশল ও উপহার।

কবিতার পংক্তি থেকে পংক্তিতে রাজনীতির চোরাস্রোতের আভাস মিললেও গৌতমের কবিতায় মূলত একান্ত অন্তর্মুখী গোপন গহন মনের বিস্তার টের পাওয়া যায়। গৌতম, তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন—‘যা-কিছু হারাল সমাপ্তির আগেই, তা যেন জন্মায়, মরে, জন্মায়/ যা-কিছু লাভ করেছি, তা যেন হারাতে পারি।’—[আখতরী বাঈ: অগ্রন্থিত কবিতা]

যা-কিছু লাভ করেছি, তা যেন হারাতে পারি—এ কথা বলতে গেলে যেমন শক্তি অর্জন করা প্রয়োজন, তার বিন্দুমাত্র আমার নেই। কিন্তু এই কথার, এই পংক্তির, এই কবিতার শক্তি টের পাই। জীবনকে ছুঁয়ে ছেনে তার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা স্বভাব আমার। বোধকরি এই কারণেই, ২০০৪-০৫ সাল নাগাদ যখন ‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে’ আর ‘রসাতল’ নামে দুটো চটি বই আমার হাতে আসে, প্রথম পড়ায় খুব দোলা লেগেছে, এমনটা ঘটেনি। তবে এও সত্যি, বইদুটোর কাছে পরবর্তীকালে বারবার ফিরে গেছি। চোরা একটা আকর্ষণে। আস্তে আস্তে তাঁর কবিতার, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির শক্তি ও সৌন্দর্য পথ ও চোরাগলিগুলো টের পেয়েছি। কুয়াশার পর্দা আস্তে আস্তে সরেছে।

কবিতায় যে গৌতম এত নরম, অন্তর্মুখী, গদ্যে সেই গৌতমই চূড়ান্ত তার্কিক। তাঁর গদ্য আর কবিতার মেজাজের তুলনা খানিকটা তাঁর স্বভাবের মতোই, হয়তো-বা। তাঁর কবিতা, নরম ও অন্তর্মুখী, গোপন। গদ্য, ঋজু ও তর্কপ্রবণ। এমনিতে কথাবার্তার ফাঁকে প্রসঙ্গক্রমে, উনি নিজেকে ‘ভীতু’ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে ভালোবাসতেন। অথচ, একবার বছর দেড়েক আগে ওঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর এডিট করার সময় তথাকথিত কিছু পলিটিক্যাল ইনকারেক্ট তথা বিতর্কমূলক কিছু কথা আমি বাদ রাখার প্রস্তাব রাখি। কিন্তু গৌতম বসু, আমার প্রস্তাব দেখামাত্র ফিরতি মেইলে ঝটিতি জবাব দেন—কথাগুলো ওঁর তাই-ই মনে হয়। দরকারে ওঁকে ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখা যেতে পারে কি? এই হলেন কবি গৌতম বসু, একদিকে প্রবল অন্তর্মুখী, মৃদু, অন্যদিকে ঋজু, ভানহীন, আদ্যন্ত সেনসিটিভ। অবিচল, এমনকি বিরহেও—

অবশেষে কোনও এক মধ্যাহ্নে
বাঁশবনের ধারে, যদি কেউ ললাট স্পর্শ করে
ধীরে, অতিধীরে, তাকে দিও, আমার বিরহ।

[গঙ্গানারায়ণপুর: অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে]

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২