শস্যের শপথে সিঙ্ঘুতে বসন্ত – অম্লান চক্রবর্ত্তী
দিল্লি-হরিয়ানার মধ্যবর্তী কুণ্ডলী সীমান্তে ট্র্যাফিক জ্যামে দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের গাড়ি। ২৫শে ডিসেম্বর ২০২০-র বিকেল। জানালা দিয়ে দেখছিলাম ভারতের বুকে কৃষক বিদ্রোহের রূপ। প্রতিরোধের মঞ্চ থেকে, সহসা এক বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন এক গ্লাস কমলা লেবুর শরবত নিয়ে। ‘বেটা পি লো’—সস্নেহে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন শরবতের গ্লাস। ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ পঁয়ষট্টি, মাথায় লাল পাগড়ি, পরনে সাদা পাজামা-কুর্তা-হাতকাটা জ্যাকেট। স্নেহমাখা চোখে চকচক করছে সোনালি ফসলের অঙ্গীকার। করোনার কথা মাথায় রেখেও শরবত খেলাম। ভদ্রলোকের মুখ দেখে আমার মনে হল, মাতা-পিতা উভয়ের মুখের মেলবন্ধন। ভারতের কৃষক সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধি ইনি। গোটা দেশের মাতৃপিতৃ স্থানীয় মানুষ।
উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। কাঁপছিল পাশে-বসা বন্ধু সৌরভও। যে কোনও সংবেদনশীল মানুষই আলোড়িত হবেন। বলা ভালো, যিনি সারাদিনে একবারও খেয়েছেন, তিনিই হবেন আন্দোলিত।
শুরু থেকেই বলি। আমরা দুই বন্ধু দিল্লি থেকে সড়ক পথে যাচ্ছিলাম চন্ডিগড়। উত্তর দিল্লির রোহিণী থেকে জিটি রোড বরাবর কিছুদূর এগিয়ে পৌঁছলাম সিঙ্ঘু। দিল্লি-হরিয়ানার সীমান্ত। ভারতবর্ষের যত আন্তঃরাজ্য সীমান্ত আছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সীমান্ত। কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং মধ্য ও উত্তর হরিয়ানার সাথে বাকি দেশের স্থলপথে যোগাযোগ ঘটে শুধুমাত্র এই সীমান্ত পার হয়ে। এই সীমান্তে গত ডিসেম্বরের গোড়া থেকে অবস্থান করছেন কৃষকেরা। সিঙ্ঘু পৌঁছে তাই আমাদের গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হল কুণ্ডলী ৬১ নম্বর সেক্টরের গ্রামের রাস্তা দিয়ে। গলিপথ ঘুরে কুণ্ডলী সীমান্তে পুনরায় জিটি রোডে পৌঁছল আমাদের গাড়ি। সেখানেই দেখা হল শরবত দেওয়া ভদ্রলোকের সাথে। শরবত খেতে খেতে সৌরভ বলল, ‘অম্লান, চলো নামা যাক এখানেই।’ আমি অনেক্ষণ ধরেই ভাবছিলাম নেমে পড়ার কথা। বলা ভালো, এই বিদ্রোহের আঁচ গায়ে মেখে পুড়তে চাইছিলাম। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে।
“শিব ঠাকুরের আপন দেশে, আইন কানুন সর্বনেশে” – সুকুমার রায়
কি এই ‘একুশে আইন’ যার জন্য সোনার ফসল ফলানো মানুষগুলিকে রাতের পর রাত উত্তর ভারতের এই প্রবল ঠান্ডার মধ্যে রাস্তায় জেগে থাকতে হচ্ছে? ছোটো করে বলা যাক। সাথে একটু সাধারণ ব্যাখ্যাও থাক:
১। কৃষকদের উৎপাদন বাণিজ্য (প্রচার ও সুবিধাদি) আইন: শুনতে খুব সুন্দর লাগলেও এই আইনের বলে ব্যবসায়ীগণ যে-কোনও অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য নিজেদের পছন্দমতো মূল্যে ক্রয় করতে পারবেন। উক্ত অঞ্চলে যদি সেই শস্যের প্রয়োজনও থাকে, তবুও সেই চাহিদা মেটানো সম্পূর্ণ নির্ভর করবে সেই সংস্থার উপর। রাজ্য সরকারেরও কোনও হাত থাকবে না।
২। কৃষকদের মূল্য আশ্বাস এবং ফার্ম পরিষেবাদি আইন সম্পর্কিত চুক্তি: আশ্বাস ও চুক্তি দুটো পরস্পরবিরোধী শব্দ এক বাক্যের মধ্যে। মজাটা এখানেই। মরশুমের শুরুতে চুক্তি হবে একটি নির্দিষ্ট মূল্যের। যা স্থির করবেন, সেই কর্পোরেট। এরপর যদি মাঝে কোনও পোকামাকড়ের উৎপাত বা বিপর্যয় ঘটে (যেমন আমফান বা আয়লার মতো ঝড়, বন্যা, অনাবৃষ্টি বা মাজরা পোকার দাপট) এবং ফসলের ক্ষতি হয়, সেই দায়ভার গ্রহণ করতে সেই কর্পোরেট সংস্থা বাধ্য নন। অর্থাৎ, চুক্তিবদ্ধ আশ্বাস।
৩। প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য (সংশোধন) আইন: দানাশস্য, রবিশস্য এবং আলু, পেঁয়াজের মতো ‘বেসিক’ কিছু শস্যের উপর থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য তকমা তুলে দেওয়া। এর ফলে কোনও সংস্থা নিজেদের ইচ্ছা মতো এই শস্যের সঞ্চয় করে সারা দেশে সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। এরপর নিজেদের পছন্দ মতো দামে বিক্রিও করতে পারে।
এবার এই তিনটি আইনকে মেলানো যাক। বাংলায় ধান উৎপন্ন হল। কোনও সংস্থা ঠিক করল, কিলো প্রতি দশ টাকা দেবে কৃষককে। এবং দশ কিলো চাল উৎপাদন করার কথা। অর্থাৎ চুক্তি হল একশো টাকার। বীজ কেনা, সার মিলিয়ে কৃষকের নিজের থেকে গেল সত্তর টাকা। মরশুমের মাঝামাঝি এলো ঝড় বা পঙ্গপাল। চার কিলো ফসলের ক্ষতি হল, বাকি ছয় কিলো ফসলের উপর ভিত্তি করে কৃষক পেলেন মাত্র ষাট টাকা। অথচ, কৃষকের কিন্তু নিজস্ব ইনভেস্টমেন্ট, শ্রম মিলিয়ে তার বেশিই খরচ হয়েছে। এবার সেই চাল চলে গেল হয়তো দেশের অন্য প্রান্তে হিমঘরে। চালের তীব্র আকাল হল। তখন কুড়ি টাকা কিলো দরে চাল বিক্রি করতে পারবে সংস্থাটি।
লোকসান শুধু কৃষকের নয়, সাধারণ মানুষেরও সমূহ ক্ষতি।
“আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়, দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়” – সুকান্ত ভট্টাচার্য
অতএব রাস্তায় নামলেন কৃষকরা। ফসল ফলানো হাতে তুলে নিলেন প্রতিরোধের পতাকা। হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে এসে জড়ো হলেন তাঁরা। অবরোধ করলেন দিল্লি-হরিয়ানার মধ্যবর্তী সিঙ্ঘু সীমান্ত। অবস্থান করছেন তাঁরা। ট্রাক্টর–যা কৃষকদের নিত্যসঙ্গী এবং সম্বল তা এনে জড়ো হয়েছেন। দাবি একটাই—এই কৃষক-বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহার। কেন্দ্রীয় সরকার এবং কিছু একই দলভুক্ত রাজ্যের সরকার অবশ্য এই আন্দোলনকে দমাবার, ঠেকাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যে মন জানে শস্যের আব্দার, সেই মন অনড়। নাছোড় মনোভাব নিয়ে তাঁরা বসে আছেন রাজপথে। শুনলাম, গুরুপূর্ণিমাও পালন করা হয়েছে এই অবস্থান মঞ্চে।
গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়ল দলে দলে যোগ দিচ্ছেন আরও কৃষক। জড়ো হচ্ছে আরও ট্রাক্টর। ছোটো ছোটো তাঁবু বানানো হয়েছে ত্রিপল আর খড় দিয়ে। স্লোগানে স্লোগানে ছয়লাপ— ‘কিষান একতা জিন্দাবাদ’, কোথাও-বা ‘উই আর ফার্মার্স, নট টেররিস্ট’।
কিছুদূর এগোনোর পর দেখলাম, কাঠ জ্বালানো হচ্ছে। সেই আগুনে নিজেদের সেঁকে নিচ্ছেন কৃষকরা। ভারতবর্ষের চিরাচরিত দৃশ্য।
উত্তর ভারতে প্রবল শীত, তদুপরি বৃষ্টিও পড়ছে। আর শৈত্যপ্রবাহ। যেহেতু শিখ সম্প্রদায় সর্বপ্রথম এই সর্বভারতীয় আন্দোলন শুরু করেছেন, তাই খোলা হয়েছে লঙ্গর (যৌথ রান্নাঘর)। লঙ্গরখানায় চোখে পড়ল, পিতৃতন্ত্রের প্রভাব অতিক্রম করে গড়ে উঠেছে নারী-পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যৌথ লড়াইয়ের দৃশ্য। একসঙ্গে বসে রান্না করছেন, রুটি সেঁকছেন তাঁরা। আসলে কৃষক শব্দটি উভলিঙ্গ। আর মাঠেঘাটে তো একসাথেই চাষ করা হয়। চাষবাস একটি পরিবারের ইজ্জত।
শিখ ধর্মে ‘সেবাই পরম ব্রত’। তাই পথচলতি গাড়িতেও খাবার, শরবত দিচ্ছেন কৃষকরা। জল, চা, পকোড়া এগিয়ে দিচ্ছেন গাড়ির ভিতর বসে থাকা সহনাগরিকদের জন্য। এমনকি যে পুলিশ, আর্মি লাঠি উঁচিয়ে গেছিল আন্দোলনের দিকে, তাঁদের মুখের সামনেও কৃষকরা তুলে দিয়েছেন রুটি-তরকারির থালা।
“মোরা তুলব না ধান পরের গোলায়” – সলিল চৌধুরী
কথা হল বলবীর সিং নামে এক কৃষকের সাথে। জলন্ধর থেকে এসেছেন। আন্দোলনের প্রথম থেকে তিনি আছেন। কথাবার্তা হিন্দিতেই হল। বললেন, ‘কেন এই আইন মানব বলুন তো? গ্রীষ্মকালে পাঞ্জাব থেকে তামিলনাড়ু কী গরম পরে জানেন তো? ওই ভয়ঙ্কর গরমে আমরা চাষ করি। আগে থেকে দাম ঠিক হল। চাষ শুরু হল। এরপর পঙ্গপাল আছে, মাজরা পোকা আছে, ঝড়-বৃষ্টিতে শস্যের ক্ষতি আছে। কর্পোরেট বাবুরা তো ফসল নষ্ট হলে এক পয়সাও ঠেকাবে না। হয় কোনও কৃষকবন্ধু আইন করুক, নয়ত এত বছর ধরে যা চলে এসেছে, সেভাবেই চলুক।’
অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আগত প্রসাদ নামক এক চাষির গলায় আরও উষ্মা, ‘ভাবুন তো, ধান, গম, বাজরা, ডাল, আলুর উপর থেকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তকমাটা সরিয়ে নিল। তারপর কোনও বেসরকারি সংস্থা এসে বাজারের সব ফসল কিনে নিজেদের গুদামে রেখে দিল। বাজারে তৈরি করা হল কৃত্রিম আকাল। এবার চার গুণ দামে ফসল বিক্রি করে মুনাফা লুটে খেল সেই সংস্থা। দিনের শেষে সাধারণ মানুষেরও লাভ হল না, কৃষকেরও হাঁড়ি চড়ল না।’
বলবীর বা প্রসাদ যখন কথা বলছিলেন, তখন লক্ষ করছিলাম একটা অদ্ভুত জেদ তাঁদের চোখে-মুখে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই ঠান্ডায় কতদিন লড়তে পারবেন?’ এবার উত্তর এলো কোরাসে–‘যতদিন না সরকার এই তিনটি বিল তুলে নিচ্ছে ততদিন। শেষ না দেখে ছাড়ব না। যদি মৃত্যুও ঘটে, মেনে নেব, গোটা দেশের কৃষকদের জন্য মরেছি। ইতিহাসে লেখা থাকবে, এক কৃষক মরেছে কৃষিবিলের বিরুদ্ধে লড়াই করে।’
দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে, জিটি রোডের উপর দাঁড়িয়ে ইতিহাস শব্দটা শুনে চমকে উঠলাম।
“এ পথে আমি যে গেছি বারবার” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভারতবর্ষের ইতিহাস এ পথ ধরেই বারবার চলাচল করেছে। এই অঞ্চল ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তা। জিটি রোড গড়ে ওঠার আগে থেকেই। সিঙ্ঘু-কুণ্ডলী ছাড়িয়ে এই পথ ধরে কিছুদূর এগোলেই পানিপথ। প্রায় ৪৯৪ বছর আগে এই পানিপথেই ইব্রাহিম লোদি পরাজিত হন বাবরের হাতে। প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় বংশের রাজত্ব। তারও ত্রিশ বছর পর আকবরও এই পানিপথে হিমুকে পরাজিত করেন।
আরও কিছুদূর এগোলে কুরুক্ষেত্র। কৌরবগণের ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’-র অহংকার মাটিতে মিশে গেছিল এইখানে। দুষ্টের দমন, অপশাসন রুখতে এই পথ বারবার ভারতীয় রাজনীতিকে দেখিয়েছে নতুন দিশা।
সময় এগিয়ে চলছিল গন্তব্যের পথে। নির্মম শীত আসছিল দাঁত নখ বাড়িয়ে। চলন্ত গাড়ি থেকে শুনতে পেলাম, মাইকের সামনে গ্রন্থসাহিব পাঠ করছেন এক কৃষক। কাঠ জড়ো করে আরও আগুন জ্বালানো হচ্ছে। আকাশের রং মিলিয়ে যেতেই তারারা দৃশ্যমান হল। সেই তারাদের নীচে খোলা রাস্তায় শুয়ে সোনার ফসল ফলানো ভারতের কৃষকরা। “সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ”!!!
পুরো লেখাটা পড়েছি। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য 🙏