রোকেয়া বেগম – অভিজিৎ চৌধুরী

শেয়ার করুন

রোকেয়া বেগম
-অভিজিৎ চৌধুরী

এতো গভীর কালো রং আমি খুব কম দেখেছি। ঠোঁট, চিবুক, হাতের নখগুলি, পায়ের পাতা সবটাই কালো।চুলও কালো, তবে অগভীর ও পাতলা। কোনদিন জবাকুসুম, কেয়োকার্পিনের গন্ধ পাইনি। নাকে নোলক নেই, কানে দুল অনেক দিনের রং ওঠা । হাতেও কখনও কোন কংকন দেখিনি।
আমি বললাম,
কি নাম যেন তোমার, ভুলেযাচ্ছি ।
নত মুখে সে বলল,
রোকেয়া বেগম।
চমকে উঠলাম। বললাম,
রোকেয়া খাতুন নয় একেবারেই বেগমসাহেবা ।
সে বলল – নবি তাই ডাকতেন । বলেই চমৎকার হাসল মেয়েটি । ঝকঝকে সাদা দাঁত । চোখেরমণি-দুটোওসাদাটেরপেলামকারণওরাসামান্যনেচেউঠেস্থিরহয়েগেল ।
বললাম,
এইনামেরঅর্থজানো !
না ।
আমি বললাম,
তুমি ফার্সি জানো ।
স্বাভাবিক উত্তর এলো – না ।
ফরাসিতে শব্দটা হল – রোকাইয়াহ যার অর্থ আকর্ষনীয়া ।
কতোদূর পড়েছ !
ক্লাস ট্যু । একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ – এসব জানি ।
আমি হাসলাম ।

বলল,
হাসছেন যে !
আমি একে পক্ষ, দুইয়ে চন্দ্র শিখিনি ।
তোমার কাছে জানব ।
খুশি হল রোকেয়া বেগম ।
বললাম,
বাংলা লিখতে জানো !
ঘাড় কাঁত করে বলল,
হ্যাঁ । পাতার পর পাতা লিখতে পারি ।
আমি তো সভানেত্রী ।
বললাম,
কিসের !
স্বনির্ভর গোষ্ঠির । প্রগতি স্বনির্ভর দল ।
একটা ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকিয়ে ছিল সে । কালকের ধূপবাতির গন্ধ এখনও ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে । খাটের পাশের জানলাটা খুলে দেয় রোকেয়া । আমি জানলা, দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকি । এখানে অনেক অজানা পোকামাকড় রয়েছে । দেওয়ালে মাকড়সা, কেন্নো বুকে ভর দিয়ে হামা দেয় । প্রচুর গাছ । অর্জুন, শাল, মেহগনি, বকুল । সূর্যের আলো প্রায় দেখা যায় না ।
আমি এবার বললাম,
রোজা করছ !
মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ ।
প্রতিদিন নামাজ পড়ো !
জি ।
পাঁচওয়াক্ত ।
হ্যাঁ ।
আরবি ভাষা কেন পড়ছ !
কোরানকে বুঝতে গেলে আরবি জানা দরকার ।
এইসময় ঝুড়ি – কোদাল নিয়ে নারী – পুরুষেরা একশ দিনের কাজ করতে এসেছে । কাল রাতে চাপা কোন উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল । ছোট-নলদায় একটা হাই-স্কুলে ক্লাস নাইনের একজন মুসলিম ছাত্র ক্লাস এইটের একটি হিন্দু মেয়েকে প্রকাশ্যে কিস্ করে । ওখানে হিন্দুরা সকলেই বাংলাদেশ থেকে আগত । একজন সক্রিয় বামপন্থী কর্মী আমায় বলেছিলেন, ‘ওখানে রয়েছে নমঃশূদ্ররা আর ঘোষেরা । তাই এতো গণ্ডগোল হয়’ ।
ঘোষেরা বলতে যারা এখনও দুধের ব্যবসা করে, তাদের দেখলেই চেনা যায় ।নমঃশূদ্রদের আমি আলাদা করে চিনতে পারিনা । বর্ণাশ্রমের চতুর্থ স্তর বোধহয় ।
মাটির কাজ করতে করতে ওরা বলাবলি করছিল কোথায় ভাঙা পুল দেখেছে, র্যা ফ ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখেছে – কেউবা অতি উৎসাহে রক্তের দাগের কথাও বলছে ।
আবার দেখলাম রোকেয়া ক্যালেণ্ডারটা দেখছে ।
এবার আমি বললাম,
তুমি নেবে ?
রোকেয়া কম কথা বলে । তবে আল্লাহের কথা বলতে গেলে তার চোখমুখ উজ্জ্বলহয়েওঠে । সেকোরানেরবিভিন্নসুরারকথাওজানে । তারকাছথেকেইজেনেছিনবিহচ্ছেনআল্লারএকমাত্রপ্রত্যক্ষবন্ধু ।
আমিএবারবললাম,
তোমারস্বামীওকিনবিছিলেন !
মুখনীচুকরেরোকেয়াবলল,
হ্যাঁ ।
আমিবললাম,
তাঁরইন্তেকালেরপরতুমি‘নিজামকে’সাদিকরেছ ।
তিনিআমায়খালাসদিয়েছিলেন ।
‘তালাক’আরখালাসযেআলাদারোকেয়ারকাছথেকেইজেনেছি । তালাকহচ্ছেপুরোপুরিবিচ্ছেদআরখালাসহচ্ছেদৈহিকবিচ্ছেদকিন্তুমানসিক বিচ্ছেদনয় ।
আমিএবারবললাম,
নবিরকাছথেকেইতুমিকোরান-পাঠশিখেছ !
রোকেয়াবলল,
হ্যাঁ ।
আরকিশিখেছ !
শরিয়তেরবিধান । কড়ানিয়ামকছিলওঁরজীবন । ধর্মেরনির্দেশেতিনিবিচারকরতেন । এছাড়াওহজকরেছেন, জাকাতদিয়েছেন, হাসপাতালকরেছেন, পাঁচওয়াক্তবাঁধানামাজপড়তেন ।
আমিএবারনাবলেপারলামনা–
কিন্তুঅনেকগুলিবিয়েওকরেছেন !
রোকেয়াবলল,
নবিরসুন্নৎ পুরাকরতেইতাঁকেতিনটেসাদিকরতেহয় ।
আমিবললাম,
আরোএকটাকরতেপারতেন ।
বলেইচমকেউঠলাম । কয়েকদিনধরেসাম্প্রদায়িকদাঙ্গারআবহাওয়াতৈরিহয়েরয়েছে ।
রোকেয়াবলল,
আমায়তিনিসাদিকরেনগরীববাবা-মাকেসাহায্যকরবেনবলে । এতোকালোমেয়েরবিয়েহচ্ছিলনা । তিনিআমায়সাদিকরেযেযৌতুকদেনতাতেআমারআব্বা, আম্মিসুখেরয়েছেন ।
কিন্তুতোমায়খালাসদিলেনকেন !
তাঁরইন্তেকালেরআগেআগেআমিচেয়েছিলাম ।
আমিবললাম,
তিনিদিলেন !
হ্যাঁদিলেন । বললেনতাঁরইন্তেকালেরপরযেনকোনগজবনাহয় । কয়েকটাকোরানবিনামূল্যেদেওয়াহয়, এছাড়াওএকটাকূপখনন, দুটোটিউবওয়েলএবংমসজিদসংস্কারেরজন্যব্যয়করলেইতিনিখুশিহবেন ।
নবিরএইকথাগুলিভাললাগল । তবুওসংশয়রইলতারতিনটেসাদির ।

আমিএবারস্পষ্টবললাম,
নবিরসঙ্গেতোমারদৈহিকসম্পর্কহয়নিকখনও ।
না । তিনিকখনওজোরকরেননি ।
মনেমনেভাবলামতিনটেবিয়েরকলংকনবিএমনিতেইনিলেন । এইযুগেবিশ্বাসকরাকঠিন ।
আমারমনোভাববুঝতেপেরেরোকেয়াবলল–
বাকীদুটোসাদিরব্যাপারেওনবিআল্লারসুন্নৎ পূরণকরেছিলেন ।
আমিবললাম,
তোমারছেলেমাধ্যমিকেবাংলায়ফেলকরলকেন !
রোকেয়াবলল,
সবাইতাইবলছে । এতোসোজাবিষয়েফেলকরল ।
বাংলাপড়তনা !
ওরবাংলাপড়তেভালোলাগেনা । আরবিশিখতেচায় ।
আমিবললাম,
আমাদেরবাংলাভাষাটাখারাপনয়কিন্তু । এইভাষায়লিখেঅনেকেবিশ্বেনামকরেছে ।
চুপকরেরইলরোকেয়া । আমিবললাম,
‘বিশ্ব’শব্দটাবোধহয়বুঝতেপারছনা !
রোকেয়াএবারউত্তরদিলো–
জানি । হজরতরসুলবিশ্বনবিছিলেন ।
নবিসাহেবহজকরতেমক্কা, মদিনাগেছিলেন ।
এবারআমিবললাম,
জাতীয়সংগীতকিজানো !
রোকেয়াবলল, না ।
এবারক্যালেণ্ডারটারদিকেতাকিয়েবললাম,
কারছবিজানো !
কোননবিসাহেবেরমতোনইলাগছে । শেরওয়ানিটুপিপরেছেন । গায়েকালোজোব্বা ।
এবারঅট্টহাসিতেফেটেপড়লাম । রোকেয়ালজ্জাপেয়েবেশকুঁকড়েগেল ।
কিছুক্ষণপরবললাম,
ইনিরবিঠাকুর । আমাদেরজাতীয়সংগীতলিখেছেন, সুরদিয়েছেন ।
আরোমূকহয়েগেলরোকেয়া ।
বলল–আমিকিছুবুঝতেপারছিনা ।
আমারগলায়সুরনেই । ইদানিংইন্দ্রেরকাছেনাচশিখছি । তাসেরদেশেরাজাহয়েছিলাম। তবুওগাইলামযতোটুকুপারি । রোকেয়াগানশুরুহতেইগলামেলালো । কখনওকখনওতারসুরেলাগলারকাছেআমিইদোহারধরলাম । শেষহলেআমিবললাম,
তুমিতোপুরোটাইজানো ।
স্কুলেথাকতেকরতেহতো । তবেশক্তবাংলাটাজানতামনা ।
এবারওআমারখুবহাসিপেল, হাসলামও ।
রোকেয়াহঠাৎ বলল,
হাসলেআপনাকেখুবসুন্দরদেখায় ।
বললাম, সকলকেইতাইদেখায় ।


রোকেয়া অনেকটাই লুকিয়ে রাখল নবির কথা । যতোই হোক মানুষটা শেষ অবধি তাকে খালাস দিয়েছে । রাতের পর রাত বুড়োর কাছে যেতে হতো । সকালে ধর্মকথা বলা মানুষটা তখন অন্যরকম । শরীরে কিছু ছিল না, কিছু পারতও না । শুধু চোখ দুটো খিদেয় জ্বলতো । হাদিশে নাকি আছে কম বয়সি বালিকাদের বিয়ে করার কথা । তাদের তলপেট গর্ভধারণের পক্ষে প্রশস্ত ।
নিজামের একটা ঘোড়ার গাড়ি ছিল । পলাশি স্টেশনে দাঁড়াত সে সওয়ারির জন্য ।
একদিন ফুফার বাড়ি থেকে ফিরছিল রোকেয়া । নিজামের গাড়িতে উঠল । অন্য কোন সওয়ারি ছিল না । তখন সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে । ঘোড়ার গাড়ি বড় রাস্তায় নামিয়ে দেয় । তারপর অনেকটাই পথ হেঁটে কালাপাড়া । যেতে যেতে পাটখেত পড়ে । তখন আবার এক মানুষ সমান উঁচু পাট । ভয় করছিল রোকেয়ার ।

বড় রাস্তায় পৌঁছে নিজাম বলল,
বাড়ি কতোদূর ?
সারা রাস্তা কোন কথা হয়নি । ভিতরে ভিতরে ভয়ে কেঁপেছে রোকেয়া । গাড়ি থেকে নামার পর রাতের অন্ধকারের সঙ্গে তার গায়ের রং মিশে গিয়ে হয়তো কিছু দেখাও যাচ্ছিল না ।
রোকেয়া মুখ নীচু করে বলল,
কালাপাড়া ।
নিজাম বলল,
তবে তো অনেকটাই যেতে হবে । ওঠো তবে ।
ঘোড়ার গাড়িতে উঠে মুখ খোলে রোকেয়া । তোমাকে তো সন্ধ্যের সময় তারাবি নামাজ পড়তে দেখলাম না !
এক টিপ খইনি মুখে দিয়ে নিজাম বলল,
নামাজ আমি পড়ি না । কি হবে ওসবে !
রোকেয়া এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে । সে যেন মজা পেয়ে গেছে, আবার বলে,
রোজা করো !
না ।
ইমাম –মোয়াজ্জিনদের ভয় করো না !
হাতঘড়িতে সময় দেখে নিজাম । এবার সে বলে,
তুমি তো নবির তিন নম্বর বিবি ছিলে !
রোকেয়া মৃদু স্বরে বলে,
হ্যাঁ ।
খালাস দিয়েছিল !
হ্যাঁ ।
বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায় ঘোড়ার গাড়ি । একতলা বাড়ি । হাঁস, মুর্গির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । বাঁশকাঠি দিয়ে আড়াল করা খাটা পায়খানা ।
এই বাড়িটা নবি তোমাকে দিয়েছে !
রোকেয়া বলে, হ্যাঁ ।
পায়খানাটা পাকা করোনি কেন !
রোকেয়া হেসে বলে
পয়সা নেই ।
সরকার থেকে দিচ্ছে তো । মেম্বারকে চেনোনা !
এইটুকু বলে চলে যায় নিজাম । সেই রাতে রোকেয়ার ঘুম হয় না ।
কয়েকদিন পর এক সকালে গ্রামের মেম্বারকে নিয়ে আসে নিজাম । পাকা পায়খানার দরখাস্ত নেয় । কয়েকদিনের মধ্যে কাজও শুরু হয় । তখনই ঘোড়ার গাড়ি ফেলে নিজামই রাজমিস্ত্রির কাজ করতে থাকে, রোকেয়া হয় জোগানদার ।
যে দিন পাকা পায়খানার কাজ শেষ হয়, রোকেয়া মেঝেয় বসে নামাজ পড়ছিল । নিজামকে দেখে জায়নামাজ গুটিয়ে উঠে পড়ে । ধূপবাতির গন্ধ নাকে পায় নিজাম ।
জমি – জিরেতের ভাগ পাওনি তুমি !
রোকেয়া বলে,
না ।
হঠাৎ নিজাম বলে,
তোমার আবার সাদি করতে সাধ হয় না !
নাকের পাটা ফুলে ওঠে রোকেয়ার । রাগ করেছে কিনা বুঝতে পারে না নিজাম । এবার রোকেয়া বলে,
নবি বলত ঔরত যে সাদি করবে তেমন পুরুষ কোথায় ! সব মুর্দা পুরুষ । মুনিশও খাটতে পারে না । তাই আমার তিনটে সাদি । খুদার কালাম রদ করে মানুষের সেই সাধ্য নাই ।
নিজাম বলে,
আমি মুর্দা পুরুষ নই । আমায় সাদি করবা তুমি ।
আরক্ত হয় রোকেয়ার মুখ ।
তারপর কয়েকদিন সেমুই, সুজি, পরোটার নাস্তা করে দেয় রোকেয়া । সাদি হয় । রোকেয়ার ঘরে এসে ওঠে নিজাম । এখন আর ঘোড়ার গাড়ি নেই । সওয়ারি হয় না । স্কুলে স্কুলে আইসক্রিম বিক্রি করে গরমের দিনে । কখনও কখনও মুসলিম জলসায় মাইক ভাড়া দেয় । রোকেয়াও একশ দিনের কাজ করে, বস্তা সেলাই করে আর রান্নার কাজও করে ।
নিজাম এখনও নামাজ পড়ে না । রোজাও রাখতে পারে না । তবে সে মাঝেমধ্যে মসজিদে যায় । কোরান পাঠ শোনে ।

রোকেয়ার মেয়ে আনোয়ারা ক্লাস সিক্সে পড়ে । এখন গরমের ছুটি চলছে । রোজার মাস । রোকেয়ার আট দিন রোজা করা হয়েছে ।
সেই ক্যালেণ্ডারটা এনেছিল রোকেয়া । নামাজের সময় উল্টিয়ে রাখে ।
সেদিন জায়নামাজ গুটিয়ে রোকেয়া মেয়েকে ডাকে , বলে –
তোদের স্কুলে প্রার্থনা হয় !
আনোয়ারা বলে, হ্যাঁ আম্মা ।
করবি তবে !
সকালের রোদে তখনও তেজ আসেনি । শুরু করে আনোয়ারা
জনগণমন অধিনায়ক . . .
রোকেয়া গলা মেলায় । এইসময় নিজামও এসে দাঁড়ায় । স্কুলের গেটের বাইরে আইসক্রিমের গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সেও শুনেছে অনেকদিন । তারও মুখস্থ হয়ে গেছে । সেও গলা মেলায় ।
এইভাবে গোটা ভারতবর্ষ রোকেয়ার ঘরে চলে আসে । খোদার সঙ্গে বান্দার অতিপ্রাকৃত সম্পর্ক টের পায় রোকেয়া । ধর্ম-বিরুদ্ধ মনস্কামনা থেকে সে ক্রমশ নিজেকে মুক্ত করে ।

 

অভিজিৎ চৌধুরী
বি.ডি.ও.তেহট্ট-২
পলাশিপাড়া, নদীয়া
তেহট্ট-২ , প.ব.
পিন -৭৪১১৫৫
৯৪৩৩২৭৪৬৬১, ৮১১৬৩৫৫৫৯৯
ই-মেলঃ- sahityeravi@gmail.com

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *