রতন পাত্র, বলরাম বাস্কে ও পেরেস্ত্রোইকা – কুশান গুপ্ত
১
হাসনাবাদে বিকেলের মিটিং সেরে মুড়ি চানাচুর খাওয়ার অবসরে ঠোঙায় লেখা বড় বড় ছাপা অক্ষরে পেরেস্ত্রোইকা শব্দটি পুনরায় প্রত্যক্ষ করল রতন। নিকট-অতীতে কতবার এই আশ্চর্য শব্দটি তার চোখে পড়েছে তা বলা মুশকিল, তবে আজ সকালেই পার্টি মুখপত্রে পার্টি-কমরেডের অকালে জীবনাবসানের পাশের হেডলাইনে পেরেস্ত্রোইকা শব্দটি রতন দেখেছিল। অবশ্য সেই সকালে, ‘অকালে জীবনাবসান’ থেকে তার স্মরণে অনিবার্য এসেছিল শক্তি, কমরেড শক্তি মাইতি। তার অব্যবহিত পরেই সাতসকালে সে ফিরে গিয়েছিল দুই দশকেরও বেশি আগের দক্ষিণগেইড়া বাঁধের নিকটবর্তী আলঘেরা জমিতে, মনে হচ্ছিল, চিৎকার আর শ্লোগানের মধ্যে তার ডানদিকে রয়েছে শ্যামলা পঁচিশ বছরের কৃশকায় শক্তি। অভিন্নহৃদয় শক্তি ছিল তার সন্নিকটে সেই সব দিনে, চলে গেছে বছর পনেরো হলো।
অতঃপর, এড়াতে চেয়েছিল রতন, তথাপি উঁকি দিয়েছিল ধীরেনদার মুখের অবয়ব ও কণ্ঠস্বর: শান্ত হ রতন, কমিউনিস্টদের পার্টি ভিন্ন আর কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। ধীরেনদা, অর্থাৎ, ধীরেন দাস। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির জেলার প্রবাদপ্রতিম ধীরেনদা, যার সে-কালীন মন্ত্রশিষ্য রতন। আজ অবিশ্বাস্য মনে হলেও একথা সত্যি, পরবর্তী কালের ডাঙ্গেপন্থী হয়ে যাওয়া পার্টিপরিত্যক্ত ও নিঃসঙ্গ ধীরেনদাই একদা পয়লা মে জমি দখলের ডাক দিয়েছিল।
হাসনাবাদ থেকে ব্রিজে উঠে সাইকেলে চড়ার আগেই তার চোখে পড়ল, বলরাম, পানমনি বাস্কে ওরফে পানো-দির সম্পর্কে ভাই বলরাম বাস্কে, ধূ ধূ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কৃষ্ণকালো বলরাম বস্তুত শূন্যতার দিকে তাকিয়ে, হাতে ধরা একটি তোবড়ানো বাটি।
রতন তার দিকে এগিয়ে গেল।
সে তাকে কিছু বলার আগেই বলরাম দুই হাতঠুকে শরীর সামনের দিকে ঈষৎ ঝোঁকাল, গড় হই বাবু।
―এখানে দাঁড়িয়ে আছু কেন?রতন জিজ্ঞাসা করল।
―ভিখ মাগতিছি বাবু, এই উত্তর দেওয়ার সময় বলরামের ঠোঁটে কোনও অপরাধবোধ ছিল না।
কিন্তু এক ধরনের অপরাধবোধে আক্রান্ত হলো রতন পাত্র, যে প্রতিটি নির্বাচনে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে বামফ্রন্টের স্বচ্ছন্দ লিড এনে দেয়। বামপন্থী ফ্রন্ট ঐক্যের কত বছর হয়ে গেল, অথচ সাঁওতালপাড়ার বলরাম বাস্কে, পানমণি বাস্কের সম্পর্কে ভাই তার চোখের সামনে আঙুল দিয়ে তার সমূহ ব্যর্থতা চোখে দেখিয়ে দিচ্ছে! একটু সময় নিয়ে রতন বলল,
―ডাক্তার রায়ের ওখানে কাজ করুনি আর?
―ছাড়ি দিছে।
―কেন?
―গেট খুলতে দেরি হইয়ে গেল।
―দেরি হলো কেন?
―আমি ত্যাখন তার এলসিশনকে বল খেলাইতেছিলাম।
রতন আর কথা বাড়াল না। রতনের উদ্যোগে বলরাম ফরেস্টে কিছুদিন অস্থায়ী কর্মী হিসেবে নিযুক্ত ছিল। পরে সেই চাকরি চলে যায়। কয়েক মাস পর ডাক্তার রায়ের বাড়ির সিকিউরিটি হিসেবে বলরামের নিয়োগেও রতনের ভূমিকা ছিল। দীর্ঘদিন পরে তাকে রতন দেখল আজ।
এরপরেই রতন বলরামকে তার সঙ্গে ডাকল, রতন জোরে হাঁটছিল, লক্ষ্য করল, বলরাম পিছিয়ে পড়ছে বারবার। রতন বলল, কী হলো তোর, হাঁফাচ্ছু কেন?
―শরীরে বল কম বাবু।
―কত বয়েস তোর?
―কত হব্যে?ষাট বটে।
রতন কাঁসাইয়ের পাড়ের মাটির বাঁধে হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল। একবার পিছিয়ে দেখল বলরামকে। কালো গালে সামান্য অবিন্যস্ত দাড়ি ও খোঁচা চুল মিলেমিশে সাদা-কালো। চোখ দুটো ভাবলেশহীন। বলরামের ষাট? সন্দিহান রতন প্রশ্ন করল,
―ঝড়ের বছর তুই কত বড় হইছিলি?
বলরামের ঠোঁট নড়ল। তার সাদা দাঁত ঝিকোল, জল মাপার ভঙ্গিমায় সে ঈষৎ ঝুঁকে হাত নামাল―
―এই এত বড় বাবু।
রতন হাসল―জোর রাখ বলরাম। অনেক লড়াই বাকি। পানোদির ভাই তুই।
রতনকে অনুসরণ করে বলরাম রতনের বাড়ির পিছনের বাগানে গেল। বাঁদিকে কয়েকটি নারকেল ও পেয়ারা গাছ। ডানদিকে দুসারি বেগুন, দুসারি টমেটো, একসারি কাঁচালঙ্কা ও পেঁয়াজ। ওদিকে কিছু দূরে সামান্য জায়গা আয়তাকার, সেখানে পালং, নটের চারা মাথা তুলেছে। তেমন একটা ফলন হয় না। তবুও রতন পাঁচখুরির হাট থেকে ফিবছর কিছু চারা পোতে, কিছু বীজ ছড়ায়।
লেবু গাছের পাশে টিউব ওয়েল দেখিয়ে রতন বলল, কল পাম্প করতে পারবি? টাকা পাবি।
রতন বসে গেল তার ক্ষেতে। বলরাম টিউবওয়েল পাম্প করতে থাকল। নালা বেয়ে জল এগোয় রতনের ক্ষেতের মূল প্রণালী ধরে। রতন মাটি দিয়ে বাঁধ দেয়, জল বইতে থাকে মূল নালার লাগোয়া এক একটি সারিতে। হড় হড় করে জল ঢুকতে থাকে মাটির খোঁদলে। রতন ঝুঁকে ফাটল বন্ধ করে। সেচপথ ঠিক করতে করতে রতন বলরামের উদ্দেশে বলল, বল, কার্ল মার্কস।
―কারু মাস।
―ঠিক করে বল। বল কার্ল মার্কস।
বলরাম আবার ভুল বলে।
―বল, লাল ঝান্ডা করে পুকার।
বাঁহাতে পাম্প করতে করতে ডান হাত মুঠো করে বলরাম আকাশে তোলে―লাল ঝান্ডা করে পুকার।
রতনের দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একবার চোখ তুলে দেখল, বলরাম আলগোছে দাঁড়িয়ে এক হাতে পাম্প করছে। ঝকাং ঝকাং শব্দে ভলকে ভলকে জল উগরে দিচ্ছে টিউবওয়েল। সমস্ত শস্যের ভেতরে আসলে নিহিত পেশীর মেহনতের এই আদিম সেচজল। কৃষক আসলে শ্রমিক। এই হলো কৃষক-শ্রমিকের ঐক্য। কাস্তে ধানের শীষ যার প্রতীক। রতন ভুল সুরে গুনগুনিয়ে ওঠে, শেষ যাত্রা শুরু আজ কমরেড…
বুঝলি বলরাম, রতন এবার গান থামিয়ে বলল, একটা দেশ আছে অনেক দূরে, শুনছু ?
―আইজ্ঞা বাবু।
―তার নাম সোভিয়েত দেশ, দ্বিতীয় রোয়ের মুখ বাঁধ দিয়ে রতন একটু থামল, পরে আবার একটা খন্দ তৎপরতায় বোজাল, জল মাটির অন্দরে হুড়হুড় সেঁধিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ পেরেস্ত্রোইকা শব্দটি তাকে আক্রমণ করল, রতন কথাটা হারিয়ে ফেলল।
―কী বলছিলে, কুন দেশ, বলরাম পাল্টা প্রশ্ন করল এবার।
রতন সম্বিৎ ফিরে পেল।
–সোভিয়েত দেশ। সেখানে কোনও গরিব নেই। আবার বড়লোকও নেই। সবাই সমান।
―সেখানে কি ইংরাজি বলে, বাবু?
―না।অন্য ভাষা বলে। কিন্তু সবাই সমান, বুঝলি?আমি, তুই, তোর ডাক্তার, সবার মধ্যেকোনো ভেদাভেদ নেই।
―এমন কুন দেশ আছে বটে?
―আমাদের দেশও একদিন হবে। কিন্তু লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
―কার সঙ্গে লড়ব বাবু?
রতন থতমত হলো একটু। লড়াই কার সঙ্গে? পুঁজিবাদের সঙ্গে, স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে, বুর্জোয়া ব্যবস্থার সঙ্গে…এসব চেনা শব্দ মাথায় আসছিল। অকস্মাৎ পেরেস্ত্রোইকা শব্দটি আবার মাথায় এলো ভনভনে মাছির মত। তৃতীয় রোতে জল দিতে দিতে অন্যমনস্ক হলো রতন। সে কাদামাখা হাতে দেখতে পেল ১৯৭০ সালের মাওয়া চকমরামপুরের দক্ষিণগেইড়ার সেই ক্যানাল, যেখানে অগনন লোকের মধ্যে সে-ও দাঁড়িয়ে আছে। চিৎকার, শ্লোগান, লাঠি ও তীরধনুক নিয়ে কালো একদল মানুষ একটা ধানের ক্ষেতে, বেশির ভাগই ভুমিজ, বাগদী, সাঁওতাল। ক্যানালের ওপারে দক্ষিণগেইড়ার একটা রাস্তা, তার ওপরে রাইফেল ধরা বঙ্কিম জোতদারের বাহিনী… ক্রমেই লোক বাড়তে লাগল…শ্লোগান চিৎকার, রতন কমরেড শক্তি মাইতির সঙ্গে সামনের সারিতে, হঠাৎই ক্যানালের ওপার থেকে রাইফেলের গুলি ছুটে এল, কিছু বোঝার আগে বছর পঁচিশের লখু সরেন তার সামনে লাফ দিয়ে লুটিয়ে পড়ল, সেদিকে দুজনের সঙ্গে রতন অবিলম্বে ঝাঁপাল, রক্তে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছিল রতনের লুঙ্গি, লখু স্থির হয়ে গেল, তার চোখ দুটো অপলকে কোনদিকে তাকিয়ে ছিল রতন বুঝল না। ডানদিকে অনতিবিলম্বেই কাইল্যা বাগদী মাটিতে আছড়ে পড়ল। কাইল্যার তখন বাইশ। পায়ে গুলি বেঁধা কাইল্যা কাতরাচ্ছিল। তার পায়ে কাপড় বাঁধা হলো, রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিল না। ক্যানালের ওদিকে কোনোমতে যেতেই হবে…ওপারে গিয়ে হবে, এমন বলছিল তখন রতন, কিন্তু কীভাবে যাবে সে নিজেও বুঝছিল না। কার্তিক মুর্মু ডানদিকে সরলো, কিভাবে উঁচিয়ে থাকা তিনটে রাইফেল এড়িয়ে নরেন হাঁসদা আর বঁচা দোলই অত উঁচু ক্যানালের ওপারে পৌঁছেছিল রতন আজও জানে না। তারা দুজন গিয়ে রাইফেল মুচড়ে ধরে…কিন্তু নরেন বাঁচেনি। গুলিবিদ্ধ নরেনের মুঠোয় ধরা ছিল একটা সবুজ বোতাম।
সেই ঘটনার পরম্পরা রতনের কাছেই অজানা রয়ে গেছে আজও। সেই সম্মিলিত জনপ্রতিরোধ। শ্লোগান। চিৎকার। আর্তনাদ। মৃতদেহ। রক্ত ও বারুদের ধোঁয়া এই দুই ছাড়া আর ওই ক্যানেল ছাড়া কোনও কিছুর পূর্বাপর কেন মনে করতে পারে না রতন? তার কি বয়েস হয়ে গেছে? এসব অনাবশ্যক ভাবেই বা কেন রতন? আগামীর আরব্ধ কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তবে?
তবুও জনমানসে স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে হয়, বিপ্লবের, শ্রেণী সংগ্রামের, ধীরেনদা এই পাঠ দিতেন, যখন রতন তরুণ। চকমরামপুরের মাওয়া গ্রামে আর ভগলুশোল গ্রামে পয়লা মের জমিদখলের ডাক ছিল ধীরেনদার ডাক। মাওয়া গ্রামে যাকে সফল করেছিল কমরেড রতন পাত্র ও শক্তি মাইতি। শক্তি মারা গেছে অকালে। অভিন্নহৃদয় শক্তির অভাব এক এক মুহূর্তে আজও অনুভব করে রতন। ফিবছর পয়লা মে মাওয়া গ্রামে শহীদ দিবস পালিত হয়। মঞ্চে রাজনৈতিক নেতারা আসেন। বক্তব্য রাখেন। ভূমিপুত্র রতন পাত্র গ্রামে ঢুকলেই শ্লোগান শুরু হয়ে যায় আজও। অনেকে এই কুড়ি বছরে পার্টি ছেড়ে চলে গেছে, যাদের রতন নিজের হাতে গড়েছিল, যেমন বলাই খাঁড়া, মিহির জানা। কেউ কেউ ডাঙ্গের দলে, অন্যরা বড় শরিকের শিবিরে। কিন্তু তাকে, তার পার্টিকে ছেড়ে যায়নি কার্তিক মুর্মু, সনা বাগদীরা। চকমরামপুরের গ্রামাঞ্চলের মাটির সঙ্গে আজও মিশে আছে রতন, এমনকী এই মেদিনীপুর মিউনিসিপ্যালিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে তার মিছিলের সর্বাগ্রে ঝান্ডা ধরে পানমণি বাস্কে, সদলবলে।
শেষ রো-তে পৌঁছে চুপচাপ গাছের সিপিআইয়ের বছর পঞ্চাশের কৃষকনেতা, অন্যমনস্ক রতন মাস্টারের দুই ব্যস্ত হাত জল কাদায় কাঁচালঙ্কা ও পেঁয়াজের সারির অন্তর্বর্তী সেচপথ তৈরি করছিল। তার চিন্তাস্রোত সহসা ভেঙে দিল জল পাম্পরত বলরাম বাস্কের কণ্ঠস্বর: লাল ঝান্ডা করে পুকার…
২
গড় হই গ, মা জননী, মাথাটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে, মানসীর উদ্দেশে বলেছিল বলরাম। প্রথমবারই শুধু নয়, পরেও যতবার এসেছে ওভাবেই সম্ভাষণ করেছে বলরাম, একেকজনের এমন বিরল স্বভাব থাকে, ধীরেনদারও যেটা ছিল।
এ-বাড়িতে পরিচিত, আধা-পরিচিত মানুষেরা আসে। বৌদি সম্বোধনের সঙ্গেই মানসী অধিক পরিচিত, রতনের সুবাদে। কেবলমাত্র ধীরেনদাই মানসীকে ম্যাডাম ডাকত। কিন্তু ধীরেনদা মানসীর বাবার চেয়েও বয়সে বড়, এবং মানসী জানত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ধীরেন্দ্রনাথ দাস আদতে ফ্লার্ট করার মানুষ নয়। সত্তরের দশকে যতবার বাড়িতে ধীরেনদা আসত, এসেই ঘোষণা করত, চা খাব না, ম্যাডাম? সঙ্গে মুড়ি দেবে তো? ধীরেনদার ব্যক্তিগত কোনও আত্মীয় ছিল না, ধীরেনদা সার্বজনীন, এমন একটা বন্ধনহীন মানুষই কীভাবে সবাইকে অনায়াসে বেঁধে ফেলে, তাই মানসী ভাবত। তার মনে হত, রতনের একরোখা পথ ভুল নয়, রতনও হয়ত একদিন এমন সার্বজনীন হয়ে উঠবে, অন্তত কেউ কেউ তো রতনকে এখনই এমন মর্যাদা দেয়।
সেই বিকেলে বলরামকে প্রথম লক্ষ করে মানসী। কালো আবলুশের মত গায়ের রং, একটা মলিন সাদা কাপড়, হেঁটো ধুতির আদলে বাঁধা, উর্ধাঙ্গে একটি বিবর্ণ গেঞ্জি, কাঁধে একটি ঝোলা। ঈষৎ খোনা কণ্ঠস্বর, শক্তপোক্ত চেহারা, কিন্তু হাঁটে শ্লথ।
লোকটা স্বভাবেও অন্যরকম। রতন কোত্থেকে নিয়ে এসেছিল তাকে। পানো-দির সম্পর্কে ভাই, রতন তাকে দেখিয়ে মানসীকে বলেছিল, ওকে খেতে দাও কিছু। মানসী জানে, রতনের ইতস্তত অনুগামী কিছু থাকলেও বিশ্বস্ত একটি ক্ষুদ্র বলয় রয়েছে, যার মধ্যমণি পানোদি। পূর্বে পানমণি ভ্যাসিলেটিং বিপিন সাহার মিছিলে হাঁটত। তখন বিপিন সাহা এলাকার পুরপিতা।
বিপিন সাহা ছিল শহরের ভেতরে থাকা জনৈক মুহুরী, সিপিআই তাকে টিকিট দিত। কিন্তু বিপিন বিশ্বস্ত নয়। তার পার্টিস্বার্থ ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে নয়। সকলে টের পায় এসব, সুতরাং ক্রমভঙ্গুর পার্টিও। ১৯৭৫ সালে ১৯ নং ওয়ার্ডে জেলাশহরের অন্তর্গত পাথরঘাটার বস্তিতে পার্টিনিবেদিত রতন পাত্র একটি টালির বাড়ি তুলল। বছরখানেকের মধ্যে সংখ্যালঘুঅধ্যুষিত এ পাড়ার একজন হয়ে উঠল, এই ওয়ার্ডে আশির দশকে পাকাপোক্ত সংগঠন গড়ে উঠল সিপিআই-এর, রতন মাস্টারের নেতৃত্বে। যদিও, রতন যখন প্রথম এপাড়ায় আসে তখনও সিপিআই বামফ্রন্টে সামিল হয়নি। অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রবাদপ্রতিম কমরেড ধীরেন দাস তখনও ডাঙ্গেপন্থী হয়ে যাননি। তখনও ধীরেনদা এ বাড়িতে ফি হপ্তায় যখন তখন আসতেন। হাতে পালিশ করা একটি লাঠি, ওপরে বাঘের মুখ খোদাই করা। ধীরেনদা বাড়িতে ঢুকলে মানসী একটা গন্ধ পেত, অবিকল না হলেও গন্ধটার সঙ্গে মানসীর বাবার গায়ের ঘ্রাণের আদল জেগে উঠত। রতনের পার্টির লোকেদের বিশেষ একটা পছন্দ করে না মানসী, এছাড়া সারাক্ষণ যেসব রাজনৈতিক আলোচনা চলে তা মানসীর কাছে বস্তুত বিরক্তিকর।
কিন্তু ধীরেনদা আলাদা। মানসীর কাছে আজও। হয়ত রতনের কাছেও, কিন্তু রতন আজ আর এই স্বীকারোক্তি দেবে না। অবিভক্ত জেলার অবিভক্ত পার্টির বিশিষ্ট নেতা ধীরেনদার চোখে বছর সাতাশের রতন পড়ে গিয়েছিল কীভাবে। ষাটের দশক সেটা। ধীরে ধীরে রতন ধীরেনদার মন্ত্রশিষ্য হয়ে উঠল। শৌখিন সাবান মাখা রতন, ফিটফাট রতন, সিপিআই-এর কৃষক সংগঠনের কর্মী থেকে চালচুলোহীন নেতা হয়ে উঠল।
বিশেষত যেসময় ছিল মানসীর ক্রাইসিসের চূড়ান্ত সময় সেই সময় ধীরেনদা মানসীর পরিবারের পাশেই ছিল। রতন জমি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জেল খাটল, মানসী দুই সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িতে। কিন্তু আট মাস পরে অবিন্যস্ত চুল দাড়ি ও গায়ে উকুন নিয়ে ধীরেনদার উদ্যোগে রতন মামলায় রেহাই পেয়ে যখন বাড়ি ফিরল তখন সে আরও একরোখা। তার রাজনৈতিক পাঠ যেন এতদিনে সম্পূর্ণ হয়েছে, সাল গড়িয়েছে, কিন্তু দিনবদলের লড়াই তখনও বাকি।
মানসী নিঃসঙ্গ হয়ে উঠতে লাগল, ক্রমশঃ আরও। বিয়ের পরে সে ও রতন শহরের ভেতরে ভাড়া বাড়ি থেকে ফিহপ্তায় সেজেগুজে রিকশোয় চেপে উত্তম সুচিত্রা দেখতে যেত, সেসব ততদিনে নিছক অতীতচারিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে গ্রাম থেকে শহর পরিক্রমা করছে রতন, তার দুচোখে আগামীর স্বপ্ন, রতনের পার্টি ক্রমেই ভাঙছে, একা কুম্ভ হয়ে নিজের গড় পাহারা দিচ্ছে ধীরেন দাসের বিশ্বস্ত সেনাপতি রতন পাত্র, তার মানসীকে নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়?
রতন সেই কবে একদিন বলেছিল, ধীরেনদা পার্টি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মানসীর বিশ্বাস হয়নি। উনিশশো আশির কোনও একসময় ধীরেনদা একদিন এসেছিল, শেষবারের মত। এসেই তেমনই শান্ত স্বরে, ম্যাডাম ডাকল। রতন বাড়ির বাইরে ছিল, কখন এসে দুজনে কথা বলতে শুরু করেছিল, মানসী যখন চা নিয়ে এল তখন রতনের গলা উঁচু স্বরে চড়েছে। রতন চেঁচাচ্ছিল, আপনারা পার্টিকে ডুবিয়েছেন ধীরেনদা। আপনাদের জন্য আমাদের সংশোধনবাদী বলে সবাই।
―রতন, আমার একটা কথা শোন, ধীরেনদার গলায় অসহায়তা ছিল।
―পার্টি আমি ছাড়িনি ধীরেনদা। আপনি পার্টি ছাড়ছেন।
তারপরে একটু থেমেই রতন আরও জোরে গলা তুলল, সেদিন পয়লা মে কেন তাহলে জমি দখলের কল দিয়েছিলেন? আমি তো লড়াইয়ের ময়দানেই ছিলাম। সেদিনও পালাইনি। আজও পালাব না।
ধীরেনদা চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে যাওয়ার আগে হাতের লাঠিটা তুলে মাটি ঠুকতে ঠুকতে মানসীর দিকে তাকিয়ে, আসি ম্যাডাম, বলেছিল।
রতনের নির্দেশে কুড়ি টাকা বলরামের হাতে মানসী মজুরিবাবদ তুলে দিয়েছিল। তারপরে তাকে কিছু খেতে দিতে বলেছিল। বলরাম, পান্তা না মুড়ি কী খাবে, এই প্রশ্নের জবাবে দুটোই মিশিয়ে দিতে বলে। রতন বলরামকে পরের দিন এপাড়ার হারুর সঙ্গে যোগাযোগ করে আসতে বলে সাইকেল নিয়ে পার্টি অফিস বেরিয়ে গিয়েছিল।
মানসী একটা বড় জামবাটিতে রতনের মা রাজবালার জন্য জমানো পান্তার কিছুর সঙ্গে মুড়ি মিশিয়ে বাটিতে নুন কাঁচা লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়েছিল, সামান্য আলুভাজাও বাটিতে ছিল। বলরাম দাওয়াতে খেতে বসার আগে পুনরায় মানসীকে, গড় হই গ, জননী, বলে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছিল।
আইজ্ঞা মা, পান্তা মুড়ির গ্রাস তুলতে তুলতে বলল, পান্তাকে ইংরাজিতে কী বলে?
মানসী এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে থতমত খেল। একটু থেমে বলল, রাইস।
―ভাতকে কী বলে মা?
―রাইস-ই বলে।
―দুইটার একই নাম বটে?বিড়বিড় করে বলরাম।
অতঃপর বলরাম পেঁয়াজ, নুন, কাঁচালঙ্কা, মুড়ির ইংরিজি প্রতিশব্দ জিজ্ঞেস করল। এর মধ্যে মুড়ির প্রতিশব্দ বলতে হিমশিম খেল মানসী, সত্যিই বিষয়টা নিয়ে সে কখনও ভাবেনি।
―মা জননী, মোকে ইংরাজি শিখাইবে?
―তুমি বাংলা জানো?
―লেখতে পারি মা। নিজের নাম।
―তোমার ইংরিজি শেখার এত ইচ্ছে কেন?
―সাহেবের ঘরে সকলে কইত মা। মেমসাহেব কইত। বেটাবেটি কইত। সাহেবদের মতন ফটর ফটর মা।
―কোন সাহেব?
―ডাক্তারসাহেব। আমি গাড ছিলাম।
পরের সপ্তাহে আবার উদয় হয়েছিল বলরাম। হারুর সঙ্গে বাগানে জল দিয়ে ফিরে এসে বলরাম তার ঝোলা থেকে একটি স্লেট ও একটি পেন্সিল বের করেছিল। স্লেটে বাংলায় লেখা: বলরাম বাস্কে। আঁকাবাঁকা অক্ষর, মাত্রা যথাযথ নয়, যুক্তবর্ণে ত্রুটি আছে, তবুও সাদা অক্ষর থেকে তার নাম সনাক্ত করা যায়।
মানসী সেদিন তাকে ইংরিজি অক্ষর চেনাল। বলরাম মকশো করে, অক্ষরের ওপরে দাগ বোলায়, খোনা গলায় উচ্চারণ করে। মানসী লক্ষ করছিল, বলরামের হাত অক্ষর থেকে শিশুদের মত বেঁকে যাচ্ছে। তার হাত ধরে মানসী অক্ষর বরাবর নিয়ে যাচ্ছিল। পান্তা আর মুড়ি মিশিয়ে কাঁচা লঙ্কায় কামড় দিতে দিতে বলরাম যথারীতি ঝালের ইংরিজি প্রতিশব্দ জিজ্ঞেস করল। মানসীকে অবাক করে বলল, সাহেবের বিলাতি কুত্তা মা গ। এলসিশান। ইংরাজি বুঝতে পারে মা।
মানসী বিস্ময় প্রকাশ করেছিল, বলো কী?
―হ্যাঁ গ মা। সিট ডাউন। গেটাপ। এমন বলে মেমসাহেব। বলতে বলতে আঙুলে নির্দেশ দেখায় বলরাম।
তারপরে একটু থেমে বলরাম আবার উতলা হলো, মা গ, মেমসাহেব উঃ শিট বলে, উটার অর্থ কী?
মানসী বিব্রত হয়েছিল। প্রশ্ন এড়িয়েছিল। অক্ষর মুখস্থ করতে গিয়ে স্লেটের কাছে ঝুঁকে পড়া বলরামের হাত টলে টলে যাচ্ছিল। মানসী ধমক দিয়েছিল—কী হলো বলরাম, তোমার হাত বেঁকে যাচ্ছে কেন?
-―আঁকগুলা নজরে আসেনি আইজ্ঞে।
―তোমার বয়েস কত, বলরাম?
―ষাট বটে।
―ধুর।
―তবে কত?সত্তর হব্যে।
মাসখানেকের মধ্যে ইংরাজি ক্যাপিটাল ও স্মলকেস লেটার চিনে নিজের নাম আঁকাবাঁকা ইংরেজিতে বারবার লিখতে লিখতে সগর্বে স্লেটখানি তুলে ধরে বলরাম মানসীকে বারম্বার দেখাতে লাগল। মানসী দেখল, প্রতিবার যুগপৎ হাসছে বলরামের সাদা দাঁত ও স্লেটের অক্ষর।
মাসকয় পরে বলরাম আরেকদিন এসেছিল। সেদিন তার হাঁটার গতি লক্ষ্যনীয় শ্লথ। রতন সেদিন একটি চিঠি লিখে তাকে এক পরিচিত ডাক্তারের কাছে পাঠাল। পরে শেষবার তাকে মানসী দেখেছিল মাস ছয়েক আগে। সেদিন দাওয়াতে এসেই হাঁফাচ্ছিল বলরাম। মানসী তার সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলরাম বলল, সুগার হইছে মা। চোখে ছানি।
পরক্ষণে বলরাম জিজ্ঞাসু হয়েছিল, চিনি তো আমি খাইনি মা, তবে আমার রক্তে চিনি কেন?
এই সুবাদে বলরাম রক্তের প্রতিশব্দ জেনে নিয়ে ব্লাড, সুগার ও কাটারাক এই শব্দগুলি নিজের ভঙ্গিমায় বারবার উচ্চারণ করছিল সেদিন।
নির্বাচন এসে গেছে আবার। কার্যত বামফ্রন্টের নির্বাচনী কার্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়া রতনের দাওয়ায় সন্ধেয় আজকাল মাঝে মধ্যেই জ্বলে হ্যাজাক। দাওয়ায় ভিড়, বিড়ির গন্ধ, পাড়ার কলতলা থেকে মিছিলের পুরোভাগে শ্লোগান তোলে পানমণি বাস্কে। বিগত মাসদুই রতন বাড়ি ফেরে গভীর রাতে। বেরিয়ে পড়ে ভোরবেলায়। গত চারদিন সে চকমরামপুর গেছে। ফিরবে আগামিকাল।
অনেকদিন হস্টেল থেকে ছেলের কোনও চিঠি আসেনি, মানসী সন্ধেয় একা বসে বসে ভাবছিল।
৩
বিরানব্বইয়ের জানুয়ারির এক সকালে খাটে শায়িত রতনের মাথার কাছে একটি চেয়ার নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলেন জেলা কমিটির এক নেতা। আরেকটু দূরে একটি টুলে পার্টির যুব কমরেড। পায়ের কাছে মেঝেতেই বসে ছিল চকমরমাপুর থেকে আগত কার্ত্তিক মুর্মু। মানসী একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। ইতস্তত পায়চারি করছিল তার ছেলে।
রতনকে দিন আটেক আগে বেগুন খেতের পাশে ভোরবেলায় শায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার মুঠোয় সামান্য মাটি ধরা ছিল। তখনই তার চেতনা চলে গেছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও সে অদ্যাবধি কোমাতেই। কীসব অনর্গল বলে যায় সে… মাঝেমধ্যে তার নড়ে ওঠা ঠোঁট কখনও পয়লা মে, কখনও ধীরেনদা উচ্চারণ করে, যা শুধু মানসী টের পায়।
রতনের ছেলে, বাবার সেরিব্রাল, এই মর্মের টেলিগ্রাম পেয়ে রাতারাতি বাড়ি ছুটে আসে, তার দিনকয় আগেই সে তার বাবার পোস্টকার্ড পেয়েছিল। শেষ দুটি লাইনে লেখা ছিল—লাল ফৌজের সোভিয়েত ভেঙ্গে যায়নি। মনের জোর রেখো।
হঠাৎ চোখ বোজা রতনের ঠোঁট নড়ে উচ্চারণ করল—পেরেস্ত্রোইকা।
চমকে উঠে জেলানেতা পার্শ্ববর্তী কমরেডের উদ্দেশ্যে বললেন, শুনলে, রতনদা কী বললেন?
ঘাড় নাড়ল যুব কমরেড, মানসী স্পষ্ট শুনল, যুব কমরেডের মুখ থেকে উচ্চারিত হলো—পেরেস্ত্রোইকা।
মানসীরও মনে পড়ল শব্দটা। বিগত পয়লা মে একরকম জোর করে রতন তাকে নিয়ে গিয়েছিল মাওয়া চকমরামপুর। সকালে মিছিল করে একটা ক্যানেলের ধারে শহিদ বেদীতে দলবেঁধে গেল কাতারে কাতারে মানুষ। সন্ধেয় মাদল বাজল দ্রিদিম দ্রিদিম। আদিবাসী মহিলা-পুরুষদের নৃত্য শুরু হলো। এক রাজ্য স্তরের গুরুত্বপূর্ণ নেতা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। তার পাশে বসে রতন বলেছিল, কমরেড, পেরেস্ত্রোইকা একটু ব্যাখ্যা করবেন?
সামনের রো-তেই বসেছিল মানসী, গ্রামের কমরেডরাই তাকে টেনে এনে ওখানে বসতে বলেছিল।
রাজ্য নেতা বললেন, পার্টি লিটারেচার দেখুন কমরেড। একাধিক জায়গায় আমাদের ব্যাখ্যা আমরা রাখছি।
―কিন্তু, সাধারণ মানুষের কাছে আমরা কীভাবে এই ব্যাখ্যা নিয়ে যাব?
―নিজের অভিজ্ঞতায় আত্মস্থ করে নিয়ে। আপনি তো গ্রাসরুট চেনেন।
একটু থেমেই মঞ্চে ওঠার আগে রাজ্য নেতা বললেন, আসলে তিনটি কথা, শান্তি, স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্র। প্রথম শব্দে আমরা জোর দিচ্ছি। এছাড়া গণতন্ত্রে।
এর কিছু পরে রতন বক্তৃতা দিতে উঠল। কিন্তু মাত্র দুমিনিটের মাথায় জন প্রতিরোধের বিবরণ দিতে দিতে লঘু স্বরে উচ্চারণ করতে গিয়ে গলা বুজে গেল রতনের । তারপরেই ‘নরেন হাঁসদার হাতে ধরা ছিল জামার সবুজ বোতাম’ উল্লেখ করতে করতে কথা হারিয়ে ফেলল রতন। সকলে দেখতে পাচ্ছিল, মানসীও, মাওয়া চকমরামপুরের কৃষক নেতা রতন পাত্রের বিব্রত ক্রন্দনদৃশ্য।
―কমরেড রতন পাত্র ইমোশনাল হয়ে গেছেন, রাজ্য নেতা অন্য এক নেতাকে নেমে এসে বলছিলেন।
রতনের ঠোঁট নড়ে উঠল আবার। কী একটা উচ্চারণ করল সে অস্ফুটে, জেলা নেতা কান পাতলেন, শুনতে পেলেন, বুঝতে পারলেন না। চেয়ারে বসে থাকা জেলা নেতার হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ একটা ডাক শুনতে পেল মানসী, মা গ। মা জননী।
মানসী বাইরে ছুটে গেল। বলরাম। এক আদিবাসী কিশোর তার হাত ধরে রয়েছে। বলরামের চোখে একটা কালো চশমা, শূন্যতার দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ।
মানসী উচ্চারণ করল, বলরাম?
―বাবুকে দেখতে এলাম মা। অন্ধ হয়ে গেছি, মা জননী গো, বলরাম মাথা ঝুঁকিয়ে গড় করল, কোনদিকে মানসী, ঠাহর করতে পারল না।
ভেতরের ঘর অবধি মানসীর পেছন পেছন হাত ধরা অবস্থায় বলরাম হেঁটে এল, মন্থর। খাটের কাছে শায়িত রতনের কানের কাছে মানসী মুখ নিয়ে বলল, বলরাম এসেছে, শুনছ, বলরাম এসেছে, বলরাম। পানোদির ভাই।
রতনের ঠোঁট কাঁপল। একবার অস্ফুটে আওড়াল, লখু সরেন?
বলরাম খাটের কাছে দাঁড়াতে মানসী তার হাতটা রতনের হাতে ধরিয়ে দিল। রতনের হাত শক্ত হাতে মুঠো করে ডুকরে উঠল বলরাম, সব আঁধার হয়ে গেছে গ বাবু। কিছু দেখতে পাইনি আর। সব আঁধার।
বলরাম টের পেল না, জেলা কমিটির পার্টি কমরেড না, এমনকি মানসীও না, রতন তখন রক্তে মাখামাখি, বারুদের গন্ধ পাচ্ছিল, শুনতে পাচ্ছিল কাদের চিৎকার ও মুহুর্মুহু শ্লোগান। অতল অন্ধকারের ভেতরে হাতড়ে হাতড়ে দুই দশক আগের একটা ক্যানেলের ওপারে যেতে চাইছিল সে, আপ্রাণ।