পৃথিবী গল্পময় – শুভজিৎ বসাক

পৃথিবী গল্পময় – শুভজিৎ বসাক

শেয়ার করুন

কৌশিকী- কি গো?
শ্রীময়- কি হয়েছে?
কৌশিকী- কথা আছে একটু ঘোরো না!
(শ্রীময় তখন ল্যাপটপে কাজ করছিল।রাত এগারোটা বেজে গিয়েছে।একটু আগে নৈশভোজ করে এসে ল্যাপটপটা নিয়ে বিছানার ওপরে হেলান দিয়ে বসেছে শ্রীময় আর তখনই ওর স্ত্রী কৌশিকী এসে তার পাশে বসে ডাকছে।)
শ্রীময়- (ল্যাপটপেই চোখ রেখে) কি বলার বলো না।শুনছি তো!
কৌশিকী- (বিরক্তির সুরে) কেন পাশে ফিরতে তোমার কিসের অ্যালার্জি হচ্ছে?
শ্রীময় চুপ করে খটাখট্ লাপটপের বোতাম টিপে কাজ করে চলল কোনও উত্তর না দিয়ে।
কৌশিকী- (রাগের স্বরে) মাত্র দু’বছর হয়েছে বিয়ে হয়েছে আমাদের,আর তাতেই এত অনীহা যে নিজের বৌ ডাকলেও শুনতে ইচ্ছে করছে না? আর রাস্তায় বেরোলে অন্য মেয়েদের দিকে নির্দ্বিধায় তাকাতে পারো বলো?
(শ্রীময় এবার কাজ বন্ধ করে কৌশিকীর দিকে তাকালো।)
শ্রীময়- (আশ্চর্য হয়ে) মানে? কথা কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছো বোঝো সেটা! আমি মেয়েদের দিকে তাকাতে যাবো কেন?
কৌশিকী- থাক।আর বলতে হবে না।তুমি আমায় নিয়ে রাস্তায় বেরোলে আমার চেয়ে অন্য মেয়েদের দিকে চেয়ে থাকো বেশি করে তা বুঝি না ভেবেছো? এতই বোকা নাকি আমি?
শ্রীময়- (বিড়বিড় করে বলল ল্যাপটপের দিকে চেয়ে) এতটা চালাকও নও তুমি।বুঝলে এসব বাজে কথা বলতে না।
(কৌশিকী শুনতে পেল খানিক কথা তখনই।)
কৌশিকী- (কথাটা শুনে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল) এ বলবেই তো এখন আমাকে বোকা আরও কতকিছু! বিয়ে যে হয়ে গিয়েছে,তাই দাসী হয়ে সব কথা শুনতে হবে তোমার।কিছু বললেও এখন তোমার কানে সেটা বিষ মনে হবে। আর এই তুমিই মনে আছে বিয়ের আগে আমাকে মানানোর জন্য কি কি করতে?
(শ্রীময় বুঝল এবার ভীষণ বিপদ উপস্থিত হয়েছে।এখন বৌয়ের কথা না শুনলে সে সত্যিই রাতে কেঁদে বসবে।ছোট ফ্ল্যাটবাড়ি।যদি সত্যিই কাঁদে তবে ব্যাপারটা ভীষণ বাজে হবে ভেবে ল্যাপটপটা বন্ধ করে আপাতত টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে সোজা হয় বসল।)
শ্রীময়- নাও শান্তি? ল্যাপটপ সরিয়ে দিয়েছি।এবার বলো কি বলবে?
(মুখে হাসি ফুটল কৌশিকীর।সে চোখটা মুছে নিয়ে বরের কাঁধে মাথা রেখে বসল।)
কৌশিকী- আমি জানি তুমি রাস্তায় বেরোলে অন্য মেয়েদের দিকে তাকাও না।অন্য মেয়ে দেখলেই মাথা নীচু করে রাখো।আমি লক্ষ্য করেছি সেটা আগেও।
শ্রীময়- (অবাক হয়ে) আগে? আর আগে যদি দেখেও থাকো তবে বললে কেন মিথ্যে কথা?
কৌশকী- (মৃদু হেসে) বিয়ের আগে যখন প্রেম শুরু করিনি তখনও দেখেছি তোমাকে।আমারই চোখে চোখ রেখে কখনও কথা বলতে পারতে বলো? এত লাজুক যে আগে থেকেই সে অন্য মেয়েদেরও যে একইভাবে দেখবে তা কি বলে দিতে হয়?
শ্রীময়- তবে এতদিন বলোনি যে?
কৌশিকী- তাহলে আমি ঠিক বলেছি বলো মিস্টার লাজুক মহাশয়!
(শ্রীময় হাসল।)
কৌশিকী- যেটা বলার ছিল সেটা হল কালকে কি মনে আছে?
শ্রীময়- কি?
কৌশকী- মনে নেই?
শ্রীময়- মনে পড়ছে না।একটু বলো।
কৌশিকী- আজ থেকে পাঁচ বছর আগে কালকের তারিখে তোমার লেখা গল্প নামী সংবাদপত্রে প্রথম প্রকাশ হয়েছিল।আর তারপর থেকে একে একে লিখে আজ তুমি পরিচিত মুখ পাঠকদের কাছে।সবাই তোমায় চেনে “চমক দেওয়ার লেখক” হিসাবে।পড়ে মনে হয় অতি সাধারণ,কিন্তু আসল চমক পাওয়া যায় শেষ অবধি পড়লে।যখন তোমার প্রথম গল্প বের হয় তখন তুমি মাস্টার্স পড়ছো আর আমি ঐ কলেজেই থার্ড ইয়ারে ছিলাম।
শ্রীময়- (হেসে বলল) এটা তুমি মনে রেখেছো? আমার তো পেপারটার নামও মনে নেই!
(কৌশিকী বালিশের তলা থেকে পেপারটা বার করে তার চোখের সামনে তুলে ধরল।)
পেপারটা তুলে নিল শ্রীময় আর হেসে বলল, “এত খবর আমার আজও রাখো আগের মত?”
কৌশিকী নিজের মাথার পরচুলটা খুলে ফেলল।এবং হাতে নিয়ে বলল, “আমার ক্যান্সার থার্ড স্টেজ জেনেও তুমি আমার প্রতি ভালবাসাটা একমুহর্ত কমিয়েছো? যখনই কেমো চলে আমি কতটা দুর্বল হই তা তুমি আমার চেয়ে ভালো বোঝো সেটা লক্ষ্য করলেই ভাল করে বোঝা যায়।আমার এও মনে আছে যে আমার সাথে সম্পর্ক হওয়ার আগে থেকেই আমার রোগটা তোমাকে বলাতেও আমাকেই চেয়ে তুমি নাছোড়বান্দা ছিলে।কখনও আমার সামনে কাঁদোনি বা কিছু বলোনি জানি,তবে আড়ালে যে আমাকে নিয়েই ভাবতে তা তোমার চোখ আর কাজ বলেছিল আমায়।তাহলে এই মানুষটাকে ভুলে কি যাওয়া যায় সহজে? আর এও তো জানি প্রতি রাতে শোবার আগে তোমার ল্যাপটপে আমার আগের ছবিগুলো দেখো।সব বুঝেও তোমাকে নিজের কাছে আঁকড়ে রাখি এই ভেবে যে আর তো ক’টাদিন!”
শ্রীময়- (কৌশিকীকে সামনে বসিয়ে তাকে ধরে) আজেবাজে কথা বলো না।তুমি যে কি আমার জীবনে তা বোধহয় বলে বোঝানো সম্ভব নয়।থার্ড স্টেজেও মানুষ বাঁচে।
কৌশকী- (হেসে) হ্যাঁ জানি তো বাঁচে।আমি যদি নাও বাঁচি তবু তোমার গল্পে বাঁচবো।আমি এই জন্মে তোমার সাথেই বাঁচব যদি নাও থকি।তাই শেষ স্টেজ এলেও বাঁচার আশাই দেখবো খালি।
আর কথা বলল না শ্রীময়।আলোটা নিভিয়ে দিয়ে দুজনেই শুইয়ে পড়ল।অন্ধকারে বালিশ ভেজে কেবল,চোখের জলটা বোঝা যায় না।কিন্তু কৌশিকী সব বোঝে।এবং কৌশিকী এও জানে যে সে যদি না থাকে তবে শ্রীময়ের চেয়ে বেশী ক্ষতি কারও হবে না।তাই যে কয়েকটা দিন বাঁচবে হেসেখেলে,খুনসুটিতে বাঁচবে শ্রীময়কে নিয়ে যাতে সেগুলোই পরবর্তীতে তার বেঁচে থাকার রসদ হয়।যে মানুষটা নিজের স্ত্রীকে আজও আগের মত ভালবাসে,তার সবকিছুতে পুরাতন প্রেমিকাকেই খুঁজে পায় সেই মানুষ আজকের দিনে বোধহয় গল্পে ছাড়াও হাতেগোনা গুটিকয়েক বাস্তবেও মেলে তার প্রমাণ শ্রীময় নিজে।গালে হাত দিয়ে জল মুছতে গেল কৌশিকী শ্রীময়ের আর তখনই হাতটা ধরে নিল শ্রীময়।কৌশিকী হেসে বলল, “জীবনে অনেক চমক বাকি আছে এখনও।এটুকুতেই হারলে চলবে মিস্টার লাজুক?” দূরে কোথায় একটা বড় লরি চলে গেল রাস্তা দিয়ে আর তার জেরে কেঁপে উঠল মাটিটা কিছু মুহূর্তের জন্য।তারপর আবার সবকিছু শান্ত হল।পৃথিবী যেন গল্পময় মনে হল কোনও ঘরের অব্যক্ত লেখার মাঝে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২