প্রসঙ্গ ভাস্কর প্রসাদ – কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
স্থিতিশীলতা চিত্রের ধর্ম। কোলাহলহীন মন্থর একটি গ্রামদেশ দেখে আমাদের ভালো লাগে, আমরা বলি ঠিক যেন ছবির মতো গ্রাম। অনেকে প্রশ্ন করতেই পারেন—তবে কি জঙ্গমতা চিত্রকরের চিত্রে থাকে না! আমরা কি কখনও দেখিনি একটি জঙ্গম চিত্রকে ফ্রেমে আঁটা দেওয়ালে ঝুলে থাকতে বা বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসতে? উত্তর দেওয়ার আগে একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে দর্শকদের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত দৃষ্টিভঙ্গির অনন্যতা ছবিটিকে বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ মাত্রা দিয়ে থাকে। আমি আমার চরমতম মনোকষ্টের দিনেও লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসাকে আমার দিকে তাকিয়ে কেবল হেসে যেতেই দেখেছি। শুধু আমার ভিন্ন ভিন্ন মানসিক অবস্থান হেতু, সেই হাসির তীব্রতা, উদ্রেক পালটে পালটে গেছে। কখনও সেই হাসিকে শয়তানের হাসি, কখনও বা দেখনহাসি বা কখনও ‘ভেবো না আমি তো আছি’-ধরনের হাসি বলে মনে হয়েছে আমার। একটি চিত্রকর্মের তাৎপর্য যুগভেদে পরিবর্তন হতে পারে, কেন-না যে ঘটনাগুলি বিরাট এই ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে তা পরিবর্তনশীল, কেন-না তার সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসমূহ। তবে কি চিত্র একটা খণ্ডমুহূর্তকে আঁকড়ে ধরে স্থির হয়ে আছে! সেই লাস্ট রাইড টুগেদার-এর ব্রাউনিং এর মতো, ক্রিটিকরা কবিকে উদ্ধৃত করে বলবেন—“Life and death in the balance, the petty done, the undone vast, in pride and thankfulness, joy and fear, hand and brain, in words and deeds, life forever old yet new, changed not in kind but in degree, the instant made eternity.”
আমার ধারণা এইভাবে বললে চিত্রশিল্পের প্রতি অবিবেচনাই প্রকাশ পাবে আমাদের। আলোকচিত্রীরা মুহূর্তকে ধরে রাখেন ক্যামেরায়, কিন্তু একজন চিত্রকর তাঁর ব্রাশের ছোঁয়াতে মুহূর্তকে তৈরি করতে পারেন। আমি কয়েকজন বন্ধু চিত্রকরকে জানি, যাঁরা আঁকা মাঝপথে থামিয়ে তাঁদের অসমাপ্ত চিত্রকলাটিকে অধ্যয়ন করে থাকেন। তাঁর সদ্য আঁকতে বসা অসমাপ্ত চিত্রটি কেমন দেখাতে পারে দর্শকদের চোখে, জানবার এক গভীর আকাঙ্ক্ষায় দর্পণে প্রতিফলিত হতে দেখেন নিজের চিত্রকর্মটিকে। ঠিক যেমন কবিতা লিখনের কালে কবি তাঁর লেখাটিকে উচ্চারণ করে পড়েন।
কিন্তু একজন চিত্রশিল্পীর অভিশাপ এই, যে এই মুহূর্ত তৈরির কাজ তিনি কখনোই সমাপ্ত করে যেতে পারেন না। কেন-না তাঁর সমস্ত চিত্রকর্মের না আছে আরম্ভ, না আছে পরিসমাপ্তি। সেই কারণেই একজন চিত্রকর সিরিজ আঁকার দিকে ঝোঁকেন। বারবার একটি বিষয়কে মাথার মধ্যে নিয়ে, বারবার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার পরও, তাঁর তৃপ্তির ঢেঁকুর কখনও ওঠে না। এই জায়গাতেই একজন প্রকৃত কবির সাথে তাঁর বন্ধুত্ব।
কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, গানের মতোই পৃথিবীর সমস্ত কবিতা এফিমেরাল বা ক্ষণজীবী। কেন-না সময়ের ভার থাকে গানের মধ্যে, কবিতার মধ্যেও। কী সেই ভার? শিল্পের যেকোনো মাধ্যম যদি সময়কে ব্যবহার করে, সময়ানুবর্তিতা বা সময়ে কাজ সম্পাদনের উদ্যোগকেও তাকে মেনে চলতে হবে, সেই কারণে গানে আমরা সূচনা এবং সমাপ্তি লক্ষ করতে পারি। কবিতাতেও। শুধুমাত্র অল্পসংখ্যক কবিতাই এক গভীর অনির্দেশের দিকে পাঠককে চালনা করতে পারে, আমরা তাকে মহৎ কবিতা বলে জানি।
কবিতা বা গানে যে ছন্দ থাকে, সেই ছন্দই হল সময়ের উপাদান। এই সময়ের উপাদানকে আমরা আমাদের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে দি’। আমরা গানের বা ছন্দের তালে তালে মাথা দোলাই বা তাল ঠুকি। কিন্তু একটি ছবি দেখতে দেখতে মাথা দোলানো বা তাল ঠোকা আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না। কেন-না যেকোনো চিত্রশিল্পের মধ্যেই কাল বা সময় নিরবধি হয়ে আছে।
এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা শ্রী ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের শিল্পকর্মের মর্ম উপলব্ধিতে আমাদের সাহায্য করবে। যেকোনো মহান চিত্রশিল্পীর মতোই ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের চিত্রশিল্প আসলে এক বিরাট প্রফেসি বা ভবিষ্যৎবাণীর মতো ।
সময়ে সময়ে সেই ভবিষ্যৎবাণী হয়তো তাৎপর্য হারাতে পারে, সুতরাং সাময়িক হলেও প্রসঙ্গ হারাতে পারেন শিল্পী। কিন্তু যেহেতু সময়হীনতা চিত্রের আর একটি অন্যতম ধর্ম এবং কী ভাবে সমকাল তাঁর ছবিটিকে দেখছে, তা কিছুতেই ছবিটির স্থিরতাকে প্রভাবিত করতে পারে না, তাই শ্রী ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সমস্ত শিল্পকর্মই অবিনশ্বর।
এই দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনের ঠান্ডা পৃথিবীতে, যে কোনো প্রকৃত শিল্পীই বিস্ময়সূচক চিহ্নের মতন এবং শ্রী ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন। আমরা শুধু তাঁর ছবির দর্শক হিসেবে, নশ্বর কাগজে সৃষ্ট, অবিনশ্বর মুহূর্তগুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারি মাত্র। আর কিছু নয়।
পুনশ্চ: পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, যে এই গদ্যে, শিল্পী শ্রী ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ছবি নিয়ে, বিশেষ তেমন কোনো কথা নেই। অথচ খুব সম্ভব ছিল যে আমরা যাকে চিত্র সমালোচনা বলি—SPARK থিওরি যেমন S অর্থাৎ See, P অর্থাৎ Perceive, A অর্থাৎ Ask And Answer, R অর্থাৎ Reflect, K অর্থাৎ Know বা আরও অন্য কোনো চালু আর্ট থিওরির সাহায্যে তাঁর ছবিকে বুঝতে চেষ্টা করা অথবা আর একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা হল, তাঁর ছবি দেখতে দেখতে কিছু গুচ্ছ কবিতা লিখে ফেলা বা আর্ট ক্রিটিক Terry Barrett যেমন তাঁর প্রিন্সিপলস ফর ইন্টারপ্রেটিং আর্ট-এ যেমন বলেছেন—চিত্র শিল্পকর্ম সর্বদাই কিছু না কিছু বিষয় সম্পর্কিত হয় সেই রকম একটা জায়গা থেকে তাঁর ছবিকে বুঝতে চেষ্টা করা।
কিন্তু আমার বিশ্বাস চিত্রশিল্পে ব্যাখ্যা বা ইন্টারপ্রিটেশন অসম্ভব।
আজ পর্যন্ত চাঁদ-কে নিয়ে যত কবিতা পৃথিবীতে লেখা হয়েছে, তা যেমন চাঁদকে নিয়ে রচনা কিছু নয়, তা আসলে এক প্রতিশ্রুতি, যা আমাদের কাছে একরকম প্রশান্তি নিয়ে আসে—অথচ এই প্রশান্তি কোনো আশ্বাসের প্রশান্তি নয়। কবিতা আদায় করে এই প্রতিশ্রুতিকে তার ভাষা থেকে, ভাষা বহন করে, আশ্রয় দেয় কবির ভাবনাকে। তাই পৃথিবীর সমস্ত কবিতা অর্থবহ হয়ে ওঠবার আগে প্রথমত শব্দের। কবিতায় এই শব্দ, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দও হতে পারে। যেমন একটি লাইট হাউস এবং বন্দিদের জন্য তৈরি কুঠুরি একই সিমেন্ট এবং ইঁট দিয়ে তৈরি হয়েও ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যসাধন করতে পারে, ঠিক তেমনি এই বিনাশশীল পৃথিবীর সমস্ত রং এবং জ্যামিতিক রেখা ব্যবহার করে চিত্রকলা তার স্থিতিশীল ধর্মের কারণে এক বিদেহী সময়হীনতার কথা বলে যাকে আমরা সংবেদনশীল, বিশেষ এবং সাময়িকের ভেবে ভুল করি। এই বিদেহী সময়হীনতাকে আমার প্রণাম।