পোখরায় আমরা (অষ্টম পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য
অষ্টম পর্ব
যতই চারিদিক দেখছি ক্যামেরার শাটার যেন কিছুতেই থামতে চাইছে না। হাওয়ার প্রচণ্ড দাপটের জন্য বড়োরা এয়ারপোর্টের ভেতরেই থাকলেন। এদিকে তাপস আর আমি বেরোলাম হোটেল খুঁজতে। ও ওর স্বভাবগতভাবেই এ-হোটেল সে-হোটেল করে যাচ্ছে আর আমি শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেদিকে পারছি ছবি তুলেই যাচ্ছি। পাথুরে রাস্তাঘাট, সেরকমই প্রায় পাথর দিয়ে বানানো বাড়িঘর আর মনে হচ্ছে যেন কেউ তাদেরকে ধরে হলুদ ফ্রেমের ওপর বসিয়ে দিয়েছে। সেই হলুদ ফ্রেমের মাথায় আবার একখানা সাদা বরফের চাদর আর তার থেকে এই দুপুরের রোদ পরে যেন ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
বার কয়েক নেপালে যাবার পর এখন বুঝতে পেরেছি যে কাঠমাণ্ডু বা পোখরাতে বা বিশেষত প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতে হোটেল ভাড়া সাধ্যের মধ্যে থাকলেও খাবারের দাম প্রচণ্ড বেশি। আর হবে নাই-বা কেন যখন সেই খাবার আমাদেরই সাথে প্লেনে করে এসেছে। সেই শর্ত মেনে নিয়েই জুমসুমে একখানা হোটেল ঠিক করে ফেলে আমরা সকলে মিলে চলে এলাম মুক্তিনাথের গাড়ি ঠিক করতে। ততক্ষণে বেলা প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে। বেশি দেরি করা যাবে না কারণ যে-কোনো সময়ে আবহাওয়া খারাপ হয়ে যেতে পারে। আবার মুক্তিনাথ যেতে আসতেও অনেকটা সময় লাগবে।
আমরা ছিলাম ছজন। আর এখানকার যা গাড়ি তাতে ড্রাইভার ছাড়া প্রায় ন-দশজনের জায়গা হয়ে যায়। এবারে আমাদের সাথে যোগ দিল একটি বাঙালি পরিবার। বাবা-মা আর সাথে দুইটি মেয়ে। তারা মাঝের সিটগুলো দখল করে নেওয়াতে আমাদের দুজন সিনিয়র ছাড়া সবাইকেই বসতে হল পেছনে। গাড়ি ছাড়ার আগে ওই দুই সুন্দরী যুবতী বোনেরা আমাদের মনে পুলক জাগালেও গোটা যাত্রাপথে তারা আমাদের পাত্তাও দিল না।
যাই হোক, জুমসুমের ভয়ানক পাহাড়ি রাস্তার ঝাঁকুনি পেরিয়ে আমরা যখন মুক্তিনাথের রাস্তায় আসলাম তখন চারিদিকে শুধু পাথুরে হলুদ ন্যাড়া পাহাড়। তার মাঝে মাঝে কাঁটাঝোপ। শুধু জটায়ুর সাথে ফেলুদার রসিকতা করার জন্য এখানে উটগুলো নেই। যত দেখি ততই অবাক হই। ততোধিক অবাক হই কত রকমের পর্যটক দেখে। দেখি সেই জনমানবহীন ধূসর এলাকায় এক শ্বেতাঙ্গিনি একা চলেছেন পায়ে হেঁটে। আমাদের গাড়ি যখন তাকে পেরিয়ে আসল দেখি ওইরকম শুনশান এলাকায় প্রচণ্ড হাওয়ার মধ্যে তার চারিদিকে কোথাও একটিও জনমানব নেই। চোখের সামনের দৃশ্যপটে শ্বেতাঙ্গিনি একা চলেছেন তার লক্ষ্যে। ধন্য সাহস, ধন্য মানসিকতা তাদের।
একসময় পেরুলাম কালিগন্ডকী নদী। হলুদের মধ্যে নীল ফিতের মতো সে বয়ে চলেছে। আর এখানেই দেখলাম লোক খুঁজে চলেছে নারায়ণ শিলা। কে জানে সে মিলবে কি মিলবে না।
বিধ্বস্ত হয়ে গাড়ি থেকে যেখানে নামলাম সেখানে থেকে সামান্য চড়াই পেরিয়ে পৌঁছতে হবে মুক্তিনাথ মন্দিরে। ছোট্ট একটি ছবির মতো গ্রাম, দু একটি দোকানপাট। তপনদা আমাদের হাতের ইশারায় এগোতে বলে একটি দোকানের বাইরের বেঞ্চে গিয়ে বসলেন। অনেক বলাতেও তিনি আর এগোবেন না। অতঃপর আমরা পাঁচজন মিলেই চললাম মুক্তিনাথ দর্শনে।
বড়ো লোহার গেট পেরিয়ে যেখানে ঢুকলাম সেখানে একই কম্পাউন্ডের ভেতর কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দির যাকে ওরা চোর্তেন বলে ডাকে। এদিক-সেদিক ঘুরছি-ফিরছি-দেখছি, এক লামা এসে আমাদের পবিত্র জল দিয়ে গেলেন। এর মধ্যেই হঠাৎ কথা নেই বাত্তা নেই কে যেন আমাদের উদ্দেশে স্পষ্ট বাংলায় বলে উঠল—আচ্ছা গঙ্গাসাগর মেলা এবারে কবে থেকে? আমাদের তো ভিরমি খাবার যোগাড়। একে ভিনদেশ। তার ওপর এইরকম প্রত্যন্ত এলাকা। সেখানে কিনা বাংলায় এই কথা। ঘুরে তাকিয়ে দেখি এক ভবঘুরে মতো জটাজুটওয়ালা লোক উত্তরের প্রত্যাশায় আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কী জানি কোন্ পুণ্যের আশায় তিনি এখান থেকে এতদূরে গিয়ে ঠাঁই গেড়েছেন?
বাইরে এসে আমরা সঙ্গে থাকা পাউরুটি আর মেয়োনিস দিয়ে খানিক গ্রাসাচ্ছাদন করলাম। বেলা তখন তিনটে চারটে হবে। যখন নামছি কী যে মোহময় লাগছে চারিদিক। যতই ছবি তুলছি কিছুতেই যেন আশ মিটছে না। একসময় মনে হচ্ছে চেয়ে থাকি আবার একসময় মনে হচ্ছে এই সুন্দরের ছবি তুলে বাড়িতে দেখাতে না পারলে জীবন বৃথা। বিকেলের সেই পড়ন্ত আলোয় নীল আকাশে তখন একখানা অবাক করার মতো চাঁদ উঠে এসেছে। হলদে বাড়িঘর, তার পেছনে একটা পাহাড়ের মাথায় বরফ পড়ে গোটা দৃশ্যটাকে যেন জাস্ট একটা অনবদ্য ফ্রেম বানিয়ে তুলেছে।