পোখরায় আমরা (চতুর্থ পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য
চার
সব হিল স্টেশনের সাথেই সকালে ওঠবার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। বলাতে একটু মনে হয় ভুল হল। মধ্যরাতে ওঠবার বললেই মনে হয় যথার্থ হয়। দার্জিলিঙে গিয়ে যেমন ওই মধ্যরাতে উঠে টাইগার হিলে সূর্য ওঠা দেখতে যেতে হয়, আর সেজন্য সেই সময় থেকে উঠে সব সেরে টেরে প্রস্তুত হতে হয় আর তার সাথে যাবতীয় হ্যাঙ্গাম হতে থাকে বা হতে থাকে না, এখানেও দেখলাম তার ব্যাতিক্রম হল না। এই সকালে ওঠার চক্করে প্রায় সারা রাত ঘুম হল না বললেই চলে। আর সেই কাকভোরে উঠে গাড়ি ধরে আমরা পৌঁছালাম পোখরার ওপরে সারাংকোটে।
তবে এখানে দেখলাম দার্জিলিঙের মতো ব্যাপারটা অত কনফিউসিভ নয়। লোকজন সব একই দিকে দেখছে। ফলত, কি দেখছে এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমিও সেই দিকেই তাকিয়ে থাকলাম। আসলে সানরাইজ দেখতে গিয়ে যে সানরাইজ দেখতে হয় না, দেখতে হয় বরফের পাহাড়ের ওপর সূর্যের আলো পড়বার প্রথম খেলাটা, সেটা আমি জেনেছি অনেক পর। প্রথম কয়েকবার সূর্য ওঠা দেখে বা না দেখে বা ওইদিকে দেখেই আমার কেটে গিয়েছিল এবং বিশ্বাস করুন আমার সাথে অনেক লোকও কেবলমাত্র ওই দিকেই তাকিয়েছিল।
যাই হোক, এখানে সকল প্রকার কনফিউসন থেকে বেরিয়ে মচ্ছপুছারের ওপর সূর্যের প্রথম আলোর খেলা দেখলাম এবং আহা কী দেখিলাম! রং লাল থেকে কমলা হয়ে তারপর হলুদ এবং সব শেষে সাদা হয়ে গেল এটা চোখের সামনে দেখা সত্যিই এক অনির্বচনীয় ব্যাপার।
সানরাইজ দেখে এবারে যথারীতি আমরা সেই চিরাচরিত চক্করে পা দিলাম অর্থাৎ শুরু হল আমাদের পয়েন্ট পরিভ্রমণ। এবং গুচ্ছের বাজে জায়গা দেখলাম যেগুলো দেখার বাস্তবিক কোনো দরকারই ছিল না। তবে সকল অকাজের মধ্যেও যেমন একটা কাজ হয়, এখানেও তাই হল। পুরোনো নেপালের ঘরবাড়ি, চিরাচরিত মুখোশ-নক্সা ইত্যাদির সাথে পরিচিত হলাম।
আরেকটি কাজের কাজও হল। আমরা চিনলাম নেপাল সরকারের পর্যটন দপ্তরের অফিসটিকে এবং সেখানে নেমে পড়লাম। যেটা বলার কথা যে পোখরায় হাজারো ট্র্যাভেল এজেন্সির অফিস। তাদের চক্করে না পড়ে সোজাসুজি সরকারি অফিসে যাওয়াই লাভজনক। এখান থেকেই যাবতীয় খবর পাওয়া যায় এবং পারমিট হয়। তবে আশ্চর্য একখানা অভিজ্ঞতা হল। অফিসে নয়, অফিসের বাইরে। দুকপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি করাতে দিতে হল একশো টাকা। (তবে সাম্প্রতিক গিয়ে দেখলাম এরা কারুর ছবি না থাকলে অফিসেই বিনা পয়সায় সে ছবি তুলে দিচ্ছে)।
আর ঠিক হল যেদিনের গল্প বলছি তার পরের পর দিন আমরা মুক্তিনাথ যাব। আর মুক্তিনাথ মানেই তো জুমসুম, মুক্তিনাথ মানেই মুস্তাঙ্গ ভ্যালি, মুক্তিনাথ মানেই ছোটা টিবেট যার মানে পুরোপুরি কোল্ড ডেসার্ট। যাই হোক, কোথায় যাব তা তো ঠিক হল কিন্তু যাবটা কীভাবে? অফিস থেকে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল। গাড়িতে গেলে দু-তিন দিন তো লাগবেই যদি না বরফে রাস্তা আটকে যায়। তাই সব থেকে ভালো প্লেনে চলে যাওয়া। ঠিক হল আমরা তাই করব। যদিও এখন হলে একদমই আমরা সেটা করতাম না। তখন জানতাম না তাই করে ফেলেছি। কারণ মুক্তিনাথ যেতে গেলে নামতে হবে জুমসুম এয়ারপোর্টে যেখানে বছরে বেশ কয়েকখানা প্লেন ক্র্যাশ হয়। (গত মে মাসেও একখানা হয়েছে)।
প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে এবারে আমরা সকলে মিলে ছুটলাম এয়ারলাইন্স অফিসে। বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল নেপালের সরকারি পরিবহনেরই ভাড়া সব থেকে কম। ঠিক হল আমরা তাতেই যাব। তার যে কি চক্কর সে গল্পে পরে আসছি। এবারে টিকিটের জন্য আমরা সকলে টাকা দিলাম। তাপসের অগ্রজ এক সহকর্মী গেলেন টেবিলে টিকিট কাটতে, টাকা দিলেন ওপারে বসা লোকটিকে আর তারপর যে কী হল আমরা আজও বুঝে উঠতে পারিনি। লোকটি খানিক পর বলল আপনি তো টাকা দেননি। খানিক বাদ-বিসম্বাদের পর সেই অগ্রজ সহকর্মী আবার টাকা দিয়ে দিলেন। ভোজবাজির মতো একখানা ঘটনা ঘটে গেল।
তবে বিদেশে প্রথম প্লেনে চাপছি এই উত্তেজনায় সকলেই এত উত্তেজিত হলাম যে সেই বিকেলে আর ফেওয়ালেকের ধারে না বসে আমরা লেকে নৌকাবিহারই করে ফেললাম। রাত কাটল বাইরে গেলে যেভাবে কাটে সেভাবেই।