পোখরায় আমরা (দশম পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

দশম (অন্তিম) পর্ব

ছাদ থেকে নেমে তখন আড্ডা চলছে ঘরে। যে যার বিছানায় শুয়ে বা আধশোয়া হয়ে সারাদিনের কোথায় কী হয়েছে তা বলছে। অথবা বাড়ির কথা বলছে। তাপসরা যেমন সবাই একই স্কুলে চাকরি করে তাই ওদের স্কুলের মজার মজার গল্প বলছে। আমি আমার এদিককার গল্প বলছি। এটাই দিনের সব থেকে আকর্ষণীয় সময়। আড্ডার সাথে সাথেই যে যার ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে অল্পস্বল্প। পরদিন সকালেই আমাদের পোখরার ফিরতি ফ্লাইট।

আমাদের ঘোরা প্রায় শেষ। এরপর যদি পোখরায় আর দুদিন থাকি তবে সেটা হবে এক্সট্রা। কারণ পোখরাতেই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে হয়ে থাকে বিশ্ববিখ্যাত পোখরা উইন্টার স্ট্রিট ফেস্টিভাল। শুনেছি তাতে গোটা শহর জুড়ে চলে ক-দিনের উৎসব। সারা পৃথিবী থেকে লোক আসে এতে যোগদান করতে। দেখা গেল সকলের রেস্ত যা আছে কষ্টেসৃষ্টে হিসেব করে দুদিন চললে আমরা এই উৎসব দেখেই ঘরে ফিরতে পারব। কোনো অসুবিধে নেই। মনটা যেন খুশিতে নেচে উঠল। শরীরটা ধীরে ধীরে চলে যেতে লাগল লেপের নীচে। আহা… এর থেকে আরামের আর কিছু হয় না।

এরমধ্যেই হঠাৎ দরজায় ঠক্ ঠক্। এ ওর দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে না করতেই আবার ঠক্ ঠক্ ঠক্। কী হল রে বাবা এত রাতে! কে যে দরজাটা খুলেছিল এত দিন বাদে আর মনে পড়ে না। তবে যেটা মনে পড়ে যে দরজাটা খোলার সাথে সাথেই যে হিমশীতল হাওয়া এবং একই সাথে ওই প্রকৃতিরই বার্তা ঘরে প্রবেশ করল তা আমাদের শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।

মাথায় টুপি গায়ে সোয়েটার পরিহিত এক ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করে আমাদের জানালেন যে পরদিন নেপাল এয়ারলাইন্সের যে বিমানে আমাদের ফেরা ছিল তা ক্যানসেল হয়েছে। তাই আমাদের অন্য প্লেনে ব্যবস্থা করে নিতে হবে। আমরা সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। এ যেন সব শেষে এসে বিনা মেঘে বজ্রপাত। ক্যাশিয়ার দাদা জানালেন আমাদের সবার কাছে মিলে যা টাকা আছে তা দিয়ে পোখরাতে সস্তার হোটেলে হয়তো দু রাত থাকা যেতে পারে কিন্তু সকলের প্লেনভাড়া হবে না। অতএব উপায়?

যে ভদ্রলোক এই সংবাদ নিয়ে এসেছিলেন (যদিও তাকে ভদ্রলোক বলা যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে কারণ যিনি এই রকম মাথায় বাজ ফেলে দেওয়া খবর ওমন সুখের সময়ে নিয়ে আসতে পারেন, তাকে কি আদৌ ভদ্রলোক বলা যায়?) তিনি তখন উঠি উঠি করছেন। আমরা দেখলাম এই বার্তাবাহকই আমাদের সব। একে যদি পটানো যায় তা হলে ইনিই হয়তো আমাদের একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারেন। বন্দোবস্ত বলতে অন্য এয়ারলাইন্সের টিকিটের যেটুকু বাড়তি ভাড়া হবে সেটুকু দিয়েই আমরা যদি প্লেনে উঠতে পারি তাহলে এই যাত্রায় বেঁচে যাই। বাকিটা নেপাল এয়ারলাইন্স পরে দিয়ে দেবে।

অতএব শুরু হল সেই ব্যক্তিকে ভজনা। আমরা আমাদের যার কাছে যা খাদ্য অথবা পানীয়ের দ্রব্য ছিল তার সৎকারে সে সব বের করে দিতে লাগলাম আর তিনিও মহানন্দে তার সদ্‌ব্যবহার করতে লাগলেন। আমরা তাকে যথাসাধ্য বোঝাতে লাগলাম যে তিনি না দেখলে আমাদের এই পরিস্থিতিতে দেখবার মতো কেউ নেই। ঘণ্টাখানেক পর টলটলায়মান অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়ে আশীর্বাদের ঢঙে ঢুলুঢুলু চোখে তিনি আমাদের জানালেন কাল সকালে গিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করতে।

রাতটা প্রায় সবার নির্ঘুম কাটল। কোথায় ওই শীতে লেপের তলায় গিয়ে জমিয়ে ঘুমোব তা না, সারারাত সবাই প্রায় জেগে বসিয়ে কাটিয়ে দিলাম। কারণ সকাল ছটা থেকে পরপর প্লেন। তার আগেই আমাদের যা করার করে ফেলতে হবে। সবারই শেষের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল।

ঘুম ভাঙতেই দেখি ঘড়ির কাঁটা চারটের ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। ধড়মড় করে উঠে তাপসকে ডেকে বাথরুমে গিয়ে হাতে একটু জল লাগতেই যেন আর্তনাদ করে উঠলাম। এত ঠান্ডা জল হতে পারে! এ তো শরীরের যে কোনো জায়গায় লাগলে মনে হয় ফোসকা পড়ে যাবে।

যাই হোক, প্রাত্যহিক সমস্ত কাজকম্ম মিটিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে এয়ারপোর্টে গিয়ে সেই ব্যক্তির খোঁজ করতে যেতেই মনে পড়ল আমাদের তার নামটিই জেনে রাখা হয়নি। অতএব চেহারার বর্ণণা। সেসব দেবার পর একজন আমাদের বললেন যে অমুক জায়গায় সেই ব্যক্তি রাতে ঘুমোন। আমরা সেখানে খোঁজ করে দেখতে পারি।

আবার দৌড়োতে দৌড়োতে সেখানে গিয়ে দেখি যে রকম বলেছেন সেরকম তো বাড়ি আছে একখানা বটে। কিন্তু কোনো লোকজন নেই। অপরিচিত জায়গা। চিৎকার করব? কিন্তু আমাদেরও তো অন্য কোনো উপায় নেই। আলো ফুটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এরপর প্লেনগুলো একে একে উড়তে শুরু করবে। আর আমাদেরও এখান থেকে ফেরার সম্ভাবনা কমতে থাকবে।

ডাকাডাকি করাতে এক বৃদ্ধা বের হলেন প্রথমে। তাকে বললাম। তিনি বুঝলেন কি বুঝলেন না। ভেতরে চলে গেলেন। অতঃপর আবার ডাকতে হল। এবারে আরেক মহিলা বের হয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় আমাদেরকে কিছু বলে একটা ছোটো ঘরের দিকে দেখালেন। বুঝলাম সেটি এনাদের হালকা হবার ঘর। আমরা তার সামনে বসে পাহারা দিতে লাগলাম। ভদ্রলোক বের হয়ে অবাক চোখে আমাদের দিকে দেখলেন। আমরা এ-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছি। ভগবানও তো এমন মুখ ঘুরিয়ে নেন না। কাল রাতে এত তপস্যা করলাম এনার আর আজ সকালে চিনতেই পারছেন না।

যাই হোক, পরিচয় দেবার পর চিনতে পারলেন অবশেষে। কিন্তু এবারে তিনি গাঁইগুঁই করেন। বলেন আপনারা যান আমি আসছি। কিন্তু আমরাও আর উনাকে ছাড়তে রাজি নই। এদিকে ঘড়ির কাঁটা ঘুরে যাচ্ছে। আমরা সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি রেডি হয়ে বেরুলেন আর তাকে একপ্রকার পাকড়াও করে নিয়েই আমরা চললাম বিমানবন্দরের দিকে।

এবারে তিনি এক এয়ারলাইন্সে কথা বলেন। তারা না করে দেয়। অন্য এয়ারলাইন্সে যান। বুঝলাম তিনি খুব একটা কিছু করে উঠতে পারবেন না। অতএব আমাদেরই আসরে অবতীর্ণ হতে হল। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এক এয়ারলাইন্সের ম্যাডামকে রাজি করিয়ে আগের ব্যক্তিকে আমাদের জিম্মাদার হিসেবে রেখে বাড়তি টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আমরা প্লেনে উঠলাম। মনে হল কি বাঁচাটাই না বাঁচলাম। না হলে হয়তো সারাজীবন নেপালের ওই প্রত্যন্ত জায়গায় কোনো হোটেলে কাজ করেই বাকি জীবন কাটাতে হত।

এবারে পোখরা এয়ারপোর্টে নেমে একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি সবাই। খুব চাপ গিয়েছে সবার। কেউ গিয়েছে আবার বাড়িতে ফোন করে জানাতে। আমি আর তাপস আসন্ন উৎসবে কীভাবে পোখরা সেজে উঠবে আর আমরা কীভাবে আনন্দ করব তা নিয়ে গল্প করছি। হঠাৎ দেখি সঙ্গী মহাপাত্রবাবু হাতে কয়েকখানা কি কাগজের মতো নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছেন। এসে যা বললেন তাতে আমাদের হয়ে গেল। তাপসের সাথে একপ্রকার গণ্ডগোলই লেগে গেল ওর। উনি এক বাসের শেষের ছখানা সিটে আমাদের বাড়ি ফেরার টিকিট কেটে নিয়ে এসেছেন। আর তা নিয়ে কৃতিত্ব জাহির করছেন।

যাই হোক, কী আর করা। টিম তো আর ছাড়া যাবে না। গজরাতে গজরাতে বাসে উঠলাম আমরা দুজন। পোখরা স্ট্রিট ফেস্টিভাল আর দেখা হল না। টেবিল টেনিসের র‍্যাকেটে যেমন বল নাচায় তেমন লাফাতে লাফাতে বাস আমাদের নিয়ে চলল কাঁকরভিটা হয়ে শিলিগুড়ির দিকে।

ভোরের জুমসুম এয়ারপোর্ট
শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *