পোখরায় আমরা (প্রথম পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য
এক
‘আরে আরে দ্যাখো তো… আবার পড়ে যাচ্ছে…’
বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই আওয়াজ কয়েকবার শোনা গেলেও আমরা কিন্তু কেউই কিছুই দেখছি না। শুধু পাশাপাশি বসা দুই বন্ধু একে অপরকে খুঁচিয়ে মুখ চাপা দিয়ে হেসে চলেছি। ওদিকে বাসের অন্য সিটে বসা দুই বন্ধু তাদের এই তৃতীয় বন্ধুর আর্ত চিৎকারে কী করছেন সেটা জানার জন্য মন আকুলি বিকুলি করলেও কোনো আওয়াজ করা যাচ্ছে না। করলেই তিনি বলে উঠতে পারেন—‘তোমরা কেউ আমার জায়গায় এসো, আমি একটু তোমাদের জায়গায় যাই, এখানে একদম ঘুমোতে পারছি না।’ তাই একেবারে স্পিকটি নট।
বাস্তবিক আমাদের কারুরই দেখার বা করার কিছুই নেই। এটা একদম যস্মিন দেশে যদাচার কেস। গোটা বাসের মাঝখানের প্যাসেজে একের পর এক মোড়া রেখে তাতে লোক বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আর রাত গভীর হলে যা হয় আরকি! তারা সবাই ঘুমোতে ঘুমোতে পাশের লোকের গায়ে পড়ে যাচ্ছে। আবার সেই লোকগুলোকেও দোষ দিয়ে খুব একটা লাভ নেই কারণ বাস যে রাস্তা দিয়ে চলেছে এবং যে হারে ঝাঁকাচ্ছে তাতে সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশের পেশোয়ার থেকে রওনা দেওয়া বাস ঝাঁকুনিকেও মনে হচ্ছে যে কোনো সময় হারিয়ে দেবে। এরকম লজঝড়ে বাস যে এত দূরপাল্লার পাহাড়ি পথে পাড়ি দেবার সাহস রাখে তাতে এইসব বাসের ড্রাইভারদের মনে হয় রাষ্ট্রের তরফে সাহসিকতার জন্য পুরষ্কার দেওয়া অবশ্য দরকার।
আবার বাস ছাড়বার পরই যে কাণ্ডের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়েছে তা বলতেই হয়। তখন বিকেল ইতিমধ্যেই খানিক পথ এগিয়ে গিয়েছে সন্ধের দিকে। আমাদের সেই লজঝড়ে বাসটি ছাড়ার খানিক পর এক জায়গায় এসে দাঁড়াতেই দেখি কয়েকজন মহিলা বাসে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লেন। তাদের কাছে প্রচুর সুপুরী প্যাকেট করা। সেগুলো তারা বাসের বিভিন্ন সিটের নীচে এদিক ওদিক লুকিয়ে ফেললেন। আমাদের সিটের নীচেও রেখে আমাদের যেন কী বললেন। বুঝতে পারলাম না। এবারে বাস ছাড়ল। খানিক দূর এগোবার পর এবারে বাসে উঠল পুলিশ। আর পুলিশের সাথে শুরু হল সেই সব মহিলাদের ধস্তাধস্তি। তখন আমাদের যে কী অবস্থা তা আর কহতব্য নয়। যাই হোক এমন খানিক চলার পর পুলিশ নিজের হিসেব বুঝে নিয়ে চলে যাবার পর আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এই যে এত কথা বলছি তার শুরুটা একটু বলে নেবার দরকার। আসলে আমরা চলেছি নেপালের পোখরার উদ্দেশ্যে। বন্ধু তাপস ওর চারজন সহকর্মী সহ এসে পৌঁছেছে শিলিগুড়ি। সে চারজনের তিনজন আবার পঞ্চাশোর্ধ এবং বহুদিনের সহকর্মী ও বন্ধু। আর আমি এদিক থেকে। ছয় স্যাঙাত আমরা এক হয়ে যা রেশন দরকার শিলিগুড়ি থেকে নিয়ে বাসে করে চলে এসেছি নেপাল সীমান্তের পানিট্যাঙ্কি। তারপর সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে মেচি নদী পেরিয়ে এপারে কাঁকরভিটা এসে বাস ধরেছি পোখরার। আর সে বাসেই ঘটে চলেছে এতসব কাণ্ড-কারখানা।
সারারাত ধরে চলে এই বাস কাল সকালে পৌঁছবে পোখরাতে। বাস ছাড়ার পরই দেখলাম নেপালি ভাষায় একজন বাসে উঠে কী যেন বলে সবাইকে কালো প্লাস্টিক দিচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড লেগেছিল বুঝতে। তারপরই ব্যাপারটা জলের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল। বমনাধারের ব্যাপারটা যে এত খুল্লমখুল্লা হতে পারে তা ভেবেই পাহাড়ি লোকগুলির প্রতি শ্রদ্ধাবনত হলাম। মনে হল এরা আর যাই হোক প্যাঁচালো হবে না।
সন্ধে আর রাতে বাস দাঁড়াল চা আর খাবারদাবার খেয়ে নেবার জন্য। বিশাল বড়ো ধাবা। আলো কম। টিমটিমে হলদে বাল্বের আলোয় কালো কালো ছায়ামূর্তি সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের খানিক ঠান্ডা ভাত জুটল। যাই হোক, খাবারদাবারের দিকে এই দীর্ঘ পথে বেশি মনোযোগ না দেওয়াই ভালো। কোনদিক থেকে কী রকম নিম্নচাপ আসে আর তাতে আকাশে কী পরিমাণ মেঘ ঘনাতে পারে এইসব ভেবে চুপচাপ বাসে গিয়ে বসলাম। বাস ছেড়ে দিল পোখরার জন্য।