পবিত্রতার মৃত্যু – দেবারতি বি

শেয়ার করুন

(এটা মেক্সিকোর পুরাণ থেকে নেওয়া গল্প,আমি নিজের মত করে লিখেছি।)

কোটজালকোয়া –
আমার নিজের হাতে গড়া এই মেক্সিকোয়,এই টোলানে আজ আমার শেষ দিন। শেষবারের মত একবার দুচোখভরে দেখে নিচ্ছি সবকিছু। আমার দুপাশে ভাই তেজকলিপোকা আর বোন কোরেন। আমি জানি কোরেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে,চোখ ফেরাচ্ছে না। আমারও খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওকে। না, কোরেনের দিকে চোখ তুলে তাকাবার যোগ্যতা আর আমার নেই। আমি সারাজীবন ওকে কিছু দিতে পারিনি,আর আজ তো.. তেজকলিপোকা, ভাই তুমি ওকে দেখো।

তেজকলিপোকা –
আজকে কোরেন আর মেক্সিকোর লোক আমাকে দোষ দিচ্ছে কোটজালকোয়ার স্বেচ্ছা নির্বাসনের জন্য। আমার দিকটা কেউ ভেবে দেখে না। প্রত্যেকটা কাজ দুজনে একসঙ্গে করেছি আমরা,নাম হয়েছে কোটজালকোয়ার। আমাকে ছাড়া আজকের মেক্সিকো,আজকের টোলান তৈরি হত? যখন নরকের দেবতা সব মানুষের প্রাণহরণ করেছিলেন, আমিই তো আগুন পেরিয়ে নরকে গেছিলাম। সেখানে সমস্ত মানুষের হাড়ের পাহাড় পেরিয়ে নিজের শক্তির পরীক্ষা দিয়ে ফিরিয়ে এনেছিলাম মানুষের প্রাণ। হ্যাঁ,শর্ত ছিল একটা জীবনের পর মানুষকে মরতে হবে একবারের মত। তারপরে মানুষের মরণশীলতার জন্য আমাকে দায়ী করা হল!!

কোরেন –
সুখ আর দুঃখ কি এভাবেই জড়িয়ে থাকে? অভাবনীয় সুখের পরেই চরমতম দুঃখ এসে সামনে দাঁড়ায়?কোটজালকোয়া আমার দিকে তাকাচ্ছেনা, ওর নীতিবোধে আঘাত লেগেছে। ওর এই নীতিবোধের জন্যই ওকে এত শ্রদ্ধা করে সবাই। কিন্তু পুরো নীতিসর্বস্ব হয়ে কেউই বাঁচতে পারেনা,কোটজালকোয়াও নয়। ওর  যদি কালো-হলুদ পালকে সাজানো একটা চেহারা থাকে তাহলে ডানাওয়ালা সাপের মত একটা চেহারাও আছে। ও নিজেও সেটাকে অস্বীকার করতে পারে না। সেটা দেখার জন্য আমার সমস্ত সত্তা অপেক্ষা করেছে এতদিন। কাল সেই চেহারাটা একবারের জন্য বেরিয়ে এসেছিল,তাতে এত লজ্জা আর অপরাধবোধের কী আছে?

কোটজালকোয়া –
যখন পূর্ব সমুদ্র পার করে মেক্সিকোতে এসেছিলাম এখানে কী ছিল? আমি মেক্সিকোবাসীকে ভুট্টা চাষ করতে শিখিয়েছি, লোকে আমাকে ভুট্টা চাষের,সভ্যতার দেবতা বলে চেনে। আমিই লিখতে শিখিয়েছি, কাপড় পরতে শিখিয়েছি, ঘর বাঁধতে শিখিয়েছি,পবিত্রতা শিখিয়েছি। শহর বানিয়েছি, মন্দির বানিয়েছি, সেই মন্দির কোরেনের হাতে তুলে দিয়েছি। ও মন্দির পরিষ্কার রাখে,পবিত্র রাখে, কুমারী মেয়েদের পবিত্রতার দেবী হয়ে উঠেছে। কোরেন আমার বোন, ওকে আর কোনদিন দেখতে পাব না ভাবতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু আমাকে যেতেই হবে।

তেজকলিপোকা-
এখানে প্রথম এসে দেখি লোকে ধর্মের নামে রক্ত ঝরায় শুধু। ব্যাপারটা কোটজালকোয়ার ভালো লাগল না। ও সবাইকে শেখাল রক্তের বদলে ফুল ফল প্রজাপতি দিয়ে পুজো করতে, তাতে নাকি দেবতা বেশি খুশি হন। যত্ত বাজে কথা, রক্তের দাম না দিলে কি কিছু পাওয়া যায়? পরিশ্রম করে রক্ত ঝরিয়েই জীবনের আসল সাফল্য আসে। কিন্তু  আমার কথা কে শোনে? কোরেন তো সবসময় কোটজালকোয়াকেই সমর্থন করবে। ওরা ভালোবাসে একে অন্যকে,মুখে যতই পবিত্রতার কথা বলুক। সোজা রাস্তায় কাজ হল না দেখে আমি যদি কৌশল করে থাকি,তাতে কী এমন দোষ হয়েছে?

কোরেন –
শুরুতে তো আমরা তিনজন  মিলেমিশেই কাজ করতাম। তারপর তেজকলিপোকার কী যে হল, ও নিজের ইচ্ছেমত কাজ করতে শুরু করল। তিনটে তার দিয়ে একটা যন্ত্র বানিয়ে সুর তৈরি করতে লাগল, আর বানালো মদ। কোটজালকোয়া বোধহয় এসব পছন্দ করত না,কিন্তু বলেনি কখনো। দেখতে দেখতে মেক্সিকোর মানুষ মদ আর সুরে মেতে উঠল। মদ আর সুর দুটো জিনিসের মধ্যেই জাদু আছে, মানুষকে সব ভুলিয়ে দিতে পারে।তেজকলিপোকার জনপ্রিয়তা বাড়ছিল, সে উৎসবের আয়োজন করল। সেই উৎসবের ফলে যে এতকিছু হয়ে যাবে আমরা ভাবতেও পারিনি।

কোটজালকোয়া –
তেজকলিপোকা যখন উৎসবের কথা বলল,আমি কেন রাজী হয়েছিলাম? কে জানে,হয়ত আমারও মদ খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। সেরাতে সারা মেক্সিকো মদ আর সুরে ভেসে গিয়েছিল,এত আনন্দ অনেকদিন হয়নি। সুরের পর সুর বাজছিল আর আমি পাত্রের পর পাত্র মদ খাচ্ছিলাম। যখন উঠলাম আমার মাথার মধ্যে সুর ছাড়া আর কিছু ছিল না। মাথার মধ্যে সুর,আর শিরায় ধমনীতে মদ ভরে আমি কোরেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সারা মেক্সিকো আমার দিকে তাকিয়ে বাঁচে,আমি কোরেনের দিকে তাকাই।

কোরেন –
কেন কোটজালকোয়া?কেন তুমি শুরুতেই আমাকে বিয়ে করলে না? কে আটকাতো? হয়ত তোমার ওই নীতিবোধ তোমাকে আটকেছিল? কাল যখন তুমি আমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলে, আমি কি তোমাকে আটকাতে পারতাম? যদি তোমাকে আটকাতে পারতাম তাহলে আমাকে পবিত্রতার দেবী হয়ে থাকতে হত না এতবছর। তুমি ভাবছ তুমি আমার ওপর অত্যাচার করেছ কাল রাতে।ওই মাতাল অবস্থায় আমি না চাইলে তুমি জোর করতে পারতে আমার ওপর? যাকে তুমি জোরজবরদস্তি ভাবছ,আমি তাকে ভালোবাসা বলি। তোমাকে এসব বোঝানো কঠিন। আমাদের কাল রাতের ভালোবাসায় কি আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি? যদি তাই হয়,যদি তোমার সন্তানের মা হই, হয়ত আমি পবিত্রতার দেবী না হয়ে সন্তানজন্মের দেবী হয়ে উঠব।

কোটজালকোয়া –
আজ সকালে ঘুম ভাঙল কোরেনের বিছানায়। যখন বুঝতে পারলাম কী করেছি কাল,নিজের ওপর রাগে পাগল হয়ে গেলাম। নিজের হাতে ভাঙতে লাগলাম আমার সাধের টোলান শহর, কোরেন আর তেজকলিপোকা না আটকালে একটা পাথরও আস্ত থাকত না। রাগ কমতে এলো লজ্জা আর অপরাধবোধ। এইতো, এবার পশ্চিম সমুদ্রের পারে এসে গেছি। সমুদ্র লাল করে সূর্যাস্ত হচ্ছে,আমার নৌকোও তৈরি। বিদায় মেক্সিকো, বিদায় কোরেন। আমি ফিরব তোমার কাছে,যত দেরি হোক,আমি নিজের অপরাধ স্খালন করে ফিরব তোমার কাছে, ততদিন কি তোমরা আমাকে মনে রাখবে?

তেজকলিপোকা –
কোটজালকোয়া চলে গেল। ওর যা করার ও করে গেছে,এইবার আমি মেক্সিকোর দায়িত্ব নেব। দেবতাকে রক্ত দিয়ে পুজো করব। তার জন্য দরকার হলে দেশবিদেশ থেকে মানুষ ধরে আনব বলি দেওয়ার জন্য। দাম না দিয়ে পৃথিবীতে কিছু পাওয়া যায় না। যত ফোঁটা রক্ত দেবতাকে দেব,তত ফোঁটা জল তিনি বৃষ্টি করে ফিরিয়ে দেবেন। মেক্সিকো সবুজ ফসলে ভরে উঠবে। আচ্ছা, কোটজালকোয়া কি সত্যিই ফিরবে? মন বলছে অন্য কেউ ওর চেহারা নিয়ে ফিরে আসবে,ওই পূর্বসমুদ্র থেকেই। সেদিন যত দেরিতে আসে ততই ভাল,সে বড় ভয়ঙ্কর দিন হবে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *