বঙ্কিমকুমার বর্মন-এর পাঁচটি কবিতা
আত্মীয়
রক্তের হাড় তেড়ে আসে যুবতীর ঘুমে
গলানো পিচের মতো রাত, এলোমেলো পায়ে
বিঁধে ফেলে আমাকে শস্যদানায়
এত তীক্ষ্ণ খিদের নখ, এই বুঝি ছিঁড়ে ফেলে
সম্ভ্রান্ত দাঁতের ফাঁকে আটকে পড়ে ভূখণ্ড পড়শি
কেউ নেই যে—হৃদয় বিকোবে স্বপ্নসাজে
মেঘলা মন তবু মেঘ হাঁকে জলদরে
অখণ্ড হৃদয় দুলে ওঠে আমলকীর বনে
ভস্মতাপে মুখ লুকিয়ে রশ্মির ভেতর—
ঢুকে পড়ে বুনে রাখা শুনশান কবিতাঘর
নেচে ফেরে ঘরে উচ্চস্বরে দুই মনোতীর
যেন আত্মীয়তার ভীষণ নূপুর বাজে আজ ব্রহ্মমূলে।
মহাপ্রাণ
ঋজুপথ ছুঁয়ে এল গেরস্ত রোদ আড্ডা ঘরে
সমস্ত কথা আজ আকাশবসন অঙ্গ সৌষ্ঠবে
দেখি শ্রমজীবী চাঁদ সলজ্জ মুখে তুলে নিল চায়ের কাপ
কবিতার শিশু মুখোমুখি বসে শোনে মাথা উঁচিয়ে
এই তো ছড়িয়ে গেল কথায় কথায় শিল্পের শেকড়
ভাবনায় ডুবে গেল প্রতিটি ফুলবন
টিয়া পাখির নাচ দেখা দিল ভিন্ন ভিন্ন সুরে
হে জগৎ মেলাও চিৎকারে কষ্টের নীল তাঁবু
মৌলিক অশ্রুতরবারি, পরম অনুভবে—
গেয়ে ফেরে পথ, পুষ্পের শুভ্র মহাপ্রাণ।
বন্ধুদিন
বন্ধুদিনে পিছল পথে বেজে ওঠে বাঁশি
প্রভূত বয়স ভেঙে লতাপাতা জড়িয়ে ধরে আঁখি
মাইল মাইল ছড়িয়ে গেছে বুকের কঠিন সুঁড়িপথ
পড়ে থাকে শেষে দিনের পায়ে রক্তের গোধূলি
হিম কলঙ্ক নিয়ে পুড়ে গেছে একাকী আঁধারের গুপ্তশ্রম
ক্ষয়ে যায় ভিতরে ভিতরে যাযাবর আলোর তল্লাট
তেমনি সরল আকূল পরম অগ্নিরেখা
মৃদু চলাচলে নিশানার সর্বস্ব অক্ষর লিপিকুশলতা
তুমি দ্যাখো প্রাচীনত্ব নিয়ে বটগাছটি দীর্ঘ হয়েছে কত
আরও কত উজ্জ্বল হয়েছে শিশির অস্থিমজ্জাসহ।
টিলা
রাত্রিচূড়া থেকে ছিটকে যায় শ্যামা পাখিটির হতবাক
পথে নেমেছে বৃক্ষদেশ, হাতে সবুজের উন্মাদ কৌশল
ঘোড়ার নিশ্বাসের তরুণ স্পর্ধা ছলকে ওঠে কপালে
ভেসে যাওয়া ক্ষমার ডানায় কাঁপে বেদনাফুল
উড়ছে জন্মবীজ করতলের সৌরবলে
এসো খরতাপে, অম্লমধুর সম্পর্ক বিস্তারে
এখানেই ঈশ্বর স্রোতগামী পাথরের আঁচল জ্যোৎস্নায়
দুরন্ত স্বপ্নচারী পিঠে নিল গর্ভজল
আদিগন্ত লৌকিক বৃষ্টিরহস্য মেনে
দু’চোখের অঝোর টিলায় তমসাতরি—
রাত্রি করি পারাবার, জোনাকির বিষণ্ণ জানালায়
সকল যজ্ঞে গমনাগমনে—স্থির জন্মভূমি।
মলাট
বিকৃত ধূপ চন্দনের গন্ধ ওড়ে মৃত্যুমুখে—
ন্যুব্জ বহনের ভার অশ্রুত দুই কাঁধ
শব দহনের পর আরও বেশি ফুলে ওঠে স্মৃতিশোক
নিঃসঙ্গ ঝুলে থাকে কথকতার গ্রীবা
হারায় সে মুখ প্রৌঢ়ের বচন
স্তব্ধ কুয়াশার উঠোন জুড়ে শ্বেত উচ্ছ্বাস
বেঁধে ফেলে আকাশমণির মাথা সোনার মতন
সে ব্যাখ্যার মূলে বাসা বাঁধে নশ্বর জল মাটি
দাঁড়িয়ে আছে যাপনের পা ভর্তি পায়চারি
সম্ভাব্য মলাটে বেড়ে ওঠে স্নেহময় ছায়ার চিরভ্রমণ।