অভিশপ্ত খেলার সেই গান – প্রবীর মিত্র
বেশ কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক তরজায়, মিছিলে ‘খেলা হবে’ বলে একটা কথা শুনছি। কিছু গানও বাজছে ভোটপ্রচারের স্পিকারে। আচ্ছা বলুন তো, খেলা নিয়ে কোন গানটা সবার আগে মাথায় আসে? সবাই একবাক্যে বলবেন, ‘সব খেলার সেরা বাঙ্গালীর তুমি ফুটবল’। ‘ধন্যিমেয়ে’ ছবির গান, মান্না দে’র কণ্ঠে। উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও জয়া ভাদুড়ি অভিনীত এই মজার ছবিটি ১৯৭১ সালে রিলিজ হয়েছিল। বেশ কয়েকটি হিট গানের মধ্যে এই ছবিতে মান্না দে-র গাওয়া এই গানটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। গানের কথা লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরারোপ করেছিলেন নচিকেতা ঘোষ। আজীবন মোহনবাগান সমর্থক মান্নাবাবু ফুটবল নিয়ে এই একটি গানই কিন্তু গাননি, আরও একটি গান ছিল, আজ সেই গানের গল্পই বলব। গানটি ছিল ‘খেলা ফুটবল খেলা, খোকা দেখতে গেল, সেই সকালবেলা’। শুনলে মনটা আজও বিষাদে ভরে যাবে। আজ যে সমস্ত ফুটবলপ্রেমীদের বয়েস ষাট পেরিয়েছে তারা হয়তো মনে করতে পারবেন এই গানটির সাথে জড়িয়ে আছে কলকাতা ফুটবলের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক দিন, ১৬ই আগস্ট, ১৯৮০। ইডেনে সেদিন ছিল কলকাতা লিগের ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান ডার্বি ম্যাচ। সেই সময়, ইডেনে ক্রিকেট ও ফুটবল দুটো খেলাই হত, কারণ তখনও যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের কাজ শেষ হতে বছর চারেক বাকী। সেদিন সেই ম্যাচে মোহনবাগান এর অধিনায়ক ছিলেন কম্পটন দত্ত ও ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন সত্যজিৎ মিত্র আর রেফারী ছিলেন সুধীন চট্টোপাধ্যায়। খেলা শুরু হবার কিছুক্ষণ পর ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড় দিলীপ পালিত অত্যন্ত বাজে ভাবে ফাউল করে বসলেন মোহনবাগানের বিদেশ বসুকে। কিন্তু রেফারী সুধীন চট্টোপাধ্যায় ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন এবং দিলীপ পালিতকে কোন রকম সতর্ক করলেন না। গ্যালারীতে তখন মোহনবাগান সমর্থকরা রাগে ফুঁসতে লাগলো। ঠিক একই ঘটনা পুনরায় ঘটল খেলার সেকেন্ড হাফ-এ। বিদেশ বসু ফাউল করে বসলেন ইস্টবেঙ্গলের দিলীপ পালিতকে। রেফারী সুধীন চট্টোপাধ্যায় বিদেশ বসুকে সটান লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে যেতে বললেন। ওদিকে তখন মোহনবাগান গ্যালারী রাগে ফেটে পড়ছে, মোহনবাগান সমর্থকদের চিল চিৎকারে কানপাতা দায়। খেলা প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়, তখন রেফারী আরও একটা সাংঘাতিক ভুল করে বসলেন। ঘটনাটা ব্যালেন্স করার জন্য এবার লাল কার্ড দেখিয়ে বসলেন দিলীপ পালিতকে। কোনমতে খেলা শেষ হোল ১-১ গোলে। কিন্তু ততক্ষনে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরাও তেতে উঠেছেন। এবার দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে প্রথমে কথা কাটাকাটি তার হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল, আর সেদিন ইডেন ছিল দর্শকপরিপূর্ণ। প্রাণভয়ে বেশ কিছু সমর্থক গ্যালারীর দুইতলা থেকে একতলায় ঝাঁপ দিয়ে সাঙ্ঘাতিক আহত হলেন, কেউবা প্রাণ হাতে করে গ্যালারী থেকে বেরনোর সরু রাস্তা দিয়ে বেরোতে চেষ্টা করলেন। এতে অনেকে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে অন্য সমর্থকদের পদপিস্টে প্রাণ হারালেন। ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ১৭ই আগস্ট আকাশবাণীর উপেন তরফদারের উপস্থাপনায় ‘সংবাদ বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানে রেডিওতে ভেসে আসে ‘খো-কা খো-কা’ বলে এক বৃদ্ধের হাহাকার। হয়ত একমাত্র সন্তান হারানোর বুকফাটা আর্তনাদ সেদিন সারা কোলকাতা শহরকে কাঁদিয়েছিল । নাট্য অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই অনুষ্ঠান শুনেছিলেন।
সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেল সেই দিন প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ১৬ জন ফুটবলপ্রেমী আর আহত হয়েছিলেন প্রায় শ’দেড়েক। এর ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮১ সালে Indian Football Association সেই দিনটিকে স্মরণ করে ‘ফুটবলপ্রেমী দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে এবং শুরু করে এক বিশাল রক্তদান উৎসব। আজও ইডেনের সামনে দিয়ে গেলে দেখা যায় সেইসব হতভাগ্যদের নাম শ্বেতপাথরে খোদাই করা আছে, যারা সেদিন ফুটবলের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর বহু বছর পর্যন্ত অনেকেই স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতে ভয় পেতেন। বন্ধ হয়ে যায় ইডেনে ফুটবল ম্যাচ।
বিখ্যাত সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষের স্মৃতিচারনায় জানা যায়, ঘটনার কয়েকমাস পর একদিন এইচ এম ভি-এর দমদম-এর রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে ‘টাকার ফানুস’ নামে একটি সিনেমার গান রেকর্ডিং হচ্ছিল। সুপর্ণকান্তির সুরে মান্না দে গান গাইবেন। রেকর্ডিং-এর পর মান্না দে-র সাথে আড্ডায় যোগ দিলেন অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও তরুনকুমার। কথায় কথায় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন সেইবছর ১৬ই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার উপর উনি একটি কবিতা লিখেছেন। মান্না দে শুনতে চাইলে, সত্যবাবু তাঁর স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনালেন আড্ডায় উপস্থিত সবাইকে।
মান্না দে মন দিয়ে কবিতাটা শুনলেন, তারপর বিষাদমাখা গলায় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, “আপনার কবিতাটা নিয়ে তো গান হতে পারে। আপনি কবিতাটা খোকাকে (সুপর্ণকান্তির ডাকনাম) দিয়ে দিন, ও গানটায় সুর করবে আমি গাইব।” তখন কলকাতায় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নহবত’ নাটকটি বেশ রমরমিয়ে চলছে। সত্যবাবু ভীষণ ব্যস্ত লোক হওয়া সত্বেও উনি সুপর্ণকান্তিকে সময় দিলেন গানটি এডিট করার জন্য। গানের প্রথম ধাপে উত্তেজনা। দ্বিতীয় ধাপে বিরহ। একসময় সুর রেডি হয়ে গেল। এরপর মান্না দে তাঁর প্রিয় খোকার ডাকে কোলকাতায় এলেন গানের রেকর্ডিং করতে। গানের সুর শুনে মান্না দে খুব খুশী হলেন এবং রেকর্ডিং হল সেই গান ‘খেলা ফুটবল খেলা’। সুপর্ণকান্তির স্মৃতিচারনায় আরও জানা যায় এই গানের সঙ্গে জড়িত কোন ব্যাক্তি কোন পারিশ্রমিক তো নেননি তার উপর মান্না দের ইচ্ছেয় সেই রেকর্ড বিক্রির সব টাকা সেই ১৬ জন হতভাগ্য পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
১৯৮১ সালে সরস্বতী পূজোর ঠিক আগে এই গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয় এইচ এম ভি থেকে। ফুটবল শহিদদের স্মৃতিতর্পণের জন্য কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবে রেকর্ডটির রিলিজ অনুষ্ঠান হয়েছিল। অনুষ্ঠানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল স্নেহাংশু আচার্য, পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, খেলোয়াড় বিদেশ বসু ও স্বয়ং মান্না দে। আবেগেতাড়িত মান্না দে সেদিন বলেছিলেন, ‘এমন কলঙ্কিত ঘটনা যেন খেলার মাঠে আর কোনও দিন না ঘটে আর যেন দ্বিতীয়বার ফুটবলের জন্য কোন মায়ের কোল যেন খালি না হয়।’
কিন্তু একটাই পরিতাপের বিষয় যে রেকর্ড রিলিজ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর সেদিনকার ঘটনার তদন্তের রিপোর্ট আসে এবং দেখা যায় প্রশাসনের চূড়ান্ত ব্যর্থতার শিকার হয়েছিল সেই সমস্ত ফুটবলপ্রেমী মানুষগুলো। উপরমহলের হস্তক্ষেপে রেকর্ডটি বাজার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আজও ইন্টারনেট একটু খুঁজলে গানটি পেয়ে যাবেন। আপনাদের সুবিধার জন্য গানের লিংকটা দিয়ে দিলাম, শুনুন আর অনুভব করতে চেষ্টা করুন সেই স্বজনহারা সমস্ত লোকেদের যন্ত্রণার কথা।
ঋণস্বীকার: এই সময়, ইন্টারনেট।