নদী, শ্রাবণী ও মফস্বল বৃত্তান্ত – পাপড়ি রহমান

শেয়ার করুন


ফুটে-ওঠা-ভোর দেখতে দেখতে আমি রুনিদের বাড়িতে পৌঁছে যাই। অনেকদিন বাদে কোনো মফস্বলি-সকাল আমাকে রীতিমতো ঘোরগ্রস্ত করে ফেলেছিল। শান্ত-নীরব-সমাহিত ওই সকালের ভিতর দিয়ে আমাদের অটোরিক্সা ধীরে-সুস্থে, প্রায় নিঃশব্দে চলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেটা ছিল একেবারেই অসম্ভব। থ্রি-হুইলের ওই যান থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাকের মতো একটানা শব্দ সরিয়ে ফেলা যায়নি। আমি সে চেষ্টাও করিনি। বরং ধোঁয়াটে-আলোর ভিতর আমি সত্যিকার অর্থেই মফস্বলি-সকাল দেখায় মগ্ন ছিলাম। আমার এই একাগ্র-মগ্নতাকে গাঢ় করে তুলেছিল রাতের বৃষ্টিপাতে সতেজ হয়ে থাকা রাস্তাগুলো। এঁকে-বেঁকে-যাওয়া পিচঢালা কালো-রাস্তা। ধুলোবালি শূন্য ভেজা-রাস্তা। চড়াই-উৎরাই কম। কোনো কোনো রাস্তার বাঁক পেরুনোর আগেই মনে হচ্ছিল যেন কোনো নদী! নিস্তরঙ্গ-কালো-নদী। যে নদীতে ঢেউ নাই। জলের কোলাহল নাই। কোনোরকম উত্তেজনা নাই। যেন-বা কালো দুধের ওপর ঘন কালো সর পড়ে আছে। অথচ ওই কালো রাস্তার ধারে আমি সত্যিই এক নদী বয়ে যেতে দেখেছিলাম। বিস্তৃত সেই নদী। আর শ্রাবণের নদী মানেই উন্মত্ত। যৌবন লুটিয়ে দেবার বাসনায় মঞ্জুরিত। তীব্র কামুক আহ্বানে গতি হারা।

ওই যৌবনমত্ত নদী বইছিল পথগুলোর ধার ঘেঁষেই। তবুও আমি মতিচ্ছন্নতায় আক্রান্ত হলাম। পূর্বরাতের বৃষ্টিজলে বাসি ভাবে ভিজে-থাকা রাস্তাগুলোকেই আমার নদী বলে মনে হল। নদীটাকে রাস্তা ভেবে আমাদের অটোরিক্সা যদি ওই পথে ধাবিত হত! কিংবা চালককেও যদি আমার মতন মতিচ্ছন্নতায় পেয়ে বসত? আর সে অটোরিক্সার গতি ঘুরিয়ে দিত? তাহলে বিপদ ছিল। সর্ব্বোচ বিপদ। ভাগ্যিস, সে তা করে নাই।

কেউ অন্যের মনের ভাবনা দেখতে পায় না। পাশাপাশি বসে বা হেঁটে বা শুয়ে থেকেও কেউ অন্যের মনোজগত দেখতে পায় না। এটা আমার ওই সময়ই মনে হয়েছিল। এবং আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। অবশ্য আমিও তাদের মনোজগত দেখতে পাচ্ছিলাম না। এক ধরনের স্বস্তি নিয়ে আমি তাকিয়েছিলাম রুনির দিকে। রুনি আমার ইশকুল-কালের বন্ধু। শুধু রুনি নয়, আমি অটোরিক্সা-চালকের দিকেও তাকিয়েছিলাম। এমনকি রুনিদের বাড়ির কেয়ারটেকার মাহবুবের দিকেও।

মাহবুব বসেছে অটোচালকের পাশাপাশি। রুনির পূর্বপুরুষ জমিদার ছিল বিধায় এই বিভাজন। রাজা আর প্রজার সারি এক নয়। আমার পাশে বসে থাকা নীলরক্তধারী-রাজকন্যা-রুনি; তবে কি আমিও রাজা সারির?

এ প্রশ্ন হারিয়ে গিয়ে রুনির মনোজগত আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু তা দেখার কোনো উপায়ই আমার জানা ছিল না।

পেছনের সিটে আমি আর রুনি পাশাপাশি। সামনে মাহবুব আর চালক পাশাপাশি। আমাদের চারজনের মাঝে কোনো কাপড়ের পর্দা টানা নাই। চালক আর যাত্রীর বিভাজন স্টিলের গরাদ দিয়ে। যা দেখলেই চোর আর পুলিশের কথা মনে পড়ে। কে এখানে পুলিশ আর কে চোর? উত্তর যা-ই হোক আমরা এখানে কেউ কারও মন পড়তে পারছি না। অথচ চারজনের গন্তব্য একই দিকে।
মাহবুব আমাদের রিসিভ করার জন্য বাস-টার্মিনালে ছিল। পূর্বরাতের ঝড়-জলে সেও হয়তো ভিজেছিল। তাই যদি না-হবে জলের ছিঁটেফোটা কেন তার শরীরে লেগে আছে?

মাহবুব যখন বাসের পেট থেকে আমাদের লাগেজ টেনে আনে, আমি জলচিহ্ন দেখছিলাম। তার পরনের প্যান্টের পায়ের অংশটা ভেজা। পায়ের স্যান্ডেলটাও ভেজা-মলিন দেখাচ্ছিল। এসব নিশ্চয়ই বৃষ্টিপাতের বাসিজলের কারবার।

তখনও আমরা অটোতে চড়ি নাই। আর নদীর সাক্ষাৎ পাই নাই। পেলে হয়তো আমি অন্যকিছু ভাবতাম। রাস্তার বদলে মাহবুবকে না ঠিক মাহবুব নয়, মাহবুবের পায়ের পাতাগুলোকেই আমার নদী মনে হতে পারত। অথচ আমি দিব্যি দেখেছিলাম কালো পায়ের পাতায় টলটলে-জল!

কোনো কোনো মানুষের জল-ভেজা-পা শাপলা ফুলের মতো দেখায়। সতেজ ও পবিত্র। সুগন্ধিযুক্ত। সব শাপলায় তেমন সুগন্ধ থাকে না। যে শাপলাফুল তারাকৃতি হয় তাতে সুগন্ধ বেশি থাকে। আর যেসব শাপলারা ভোর-ভোর ফুটে ওঠে। রোদ্দুরের সামান্য কিরণেই মেলে-রাখা পাপড়গিুলো গুটিয়ে ফেলে। অথচ ফুটন্ত অবস্থায় জলের ঢেউদের হালকা-সুবাসে আমোদিত করে রাখে। ওই ফুলের আমি মনে মনে নাম দিয়েছি তারাশাপলা। লাগেজ টানার সময় মাহবুবের ভেজা-পা দেখে আমার তারাশাপলার কথা মনে পড়েছিল। হতে পারে মফস্বলি-ভোরের শ্রী আর নীরবতায় আমি মুগ্ধ ছিলাম। ফলে আমার ভাবনায় ফুল-পাখি-প্রজাপতিরা উড়ে এসেছিল।

অটো এসে থামে রুনিদের বাড়ির গেটে। আমি আর রুনি নামি। মাহবুব ফের লাগেজ টানে অথবা ভাড়া মেটায়। আমাদের সামনের বদ্ধ গেট হঠাৎ খুলে যায়। আমি বুঝতে পারি না কে খুলল গেট? নাকি আগেই খোলা ছিল? আমি তখন নদী-রাস্তা-তারাশাপলার বিভ্রান্তিতে। অথবা পদযুগলের ঘাপলায়। মাহবুব তখনই অটোর ভাড়া মেটায়।

বাড়ির ভিতর পা দিয়েই আমার মনে পড়ে যায় আলিবাবা আর চল্লিশ চোর। সেই মন্ত্র চিচিং-ফাঁক। রুনি তো চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল তাহলে গেটটা খুলল কে? নাকি প্রায় মুখস্থ হয়ে যাওয়া মন্ত্রটি আমিই আওড়েছিলাম? কিন্তু রুনিদের বাড়িতে এই প্রথমবার এলাম আমি। ওদের মন্ত্র আমি কীভাবে জানব?

নদী আর জল-ভেজা-পথ, তারাশাপলার সৌরভ, বৃষ্টিস্নাত-পদযুগলের মতো ফের আমি রহস্যের ভিতর তালগোল পাকাই।

যাবতীয় বদ্ধ-দুয়ার খোলার-মন্ত্র কী একই নাকি? চিচিং ফাঁক!

গেটের ভিতরে এক টুকরো লন। তাতে বিছিয়ে থাকা সবুজ-ঘাস সাদাটে দেখায়। সকালের আলো এখনও ম্লান। সূর্যের শিশুদাঁত সবে হেসেছে। হয়তো ঘাসেদের রং বদলানো এই আলোতেই সহজ। কিন্তু আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি ঘাসের রং সাদাটে অন্য কারণে। অজস্র পাকা-জামরুল ঘাসের উপর বিছিয়ে রয়েছে। বাঁদুরের দঙ্গল রাতভর খাওয়া-আধাখাওয়া-আস্ত জামরুল এন্তার ফেলেছে।

লন পেরিয়ে ঘরের দরজায় যেতে যেতে আলো যেন প্রায় নিভে আসে। মেঘ করল নাকি ফের? ভেবে আমি উপরে তাকাই। এক বিশাল বৃক্ষ পাতা ঢেলে দাঁড়িয়ে আছে। সেও ফলবতী। এই বৃক্ষ আমি চিনি, বিলম্বী!

জামরুল আর বিলম্বীর সাথে ঝুলে আছে কামরাঙা। ঘরের দরজা সাদা রঙে ডুবানো। এবং এই দরজাও পূর্ববৎ খুলে গেলে আমার ফের মনে পড়ে
চিচিং ফাঁক!

খুব অনায়াসে ঘরে প্রবেশ করি আমি। দুইশত বছরের প্রাচীন এক গৃহ। সময় ও ধূলিতে অনুজ্জ্বল হয়ে পড়া আসবাবে পরিপূর্ণ!

পারস্য-গালিচার ওপর আলবোলার নল হাতে বসে আছে সুন্দরী-নর্তকী। ওই সালংকারা নর্তকী যেন এক্ষুনি গেয়ে উঠবে – পিয়া ঘর আনা। ঝাড়বাতির আলোতে ঝলসে উঠবে তার পরনের ঘাগরা। ঝমঝমিয়ে বেজে উঠবে পায়ের ঘুঙুর। নৃত্যের তালে-তালে খুলে যাবে নাকের কুন্দনের নথ। আর ঝরে পড়বে খোঁপার তাজাফুল। অথবা ফুলেদের পাপড়ি।

০২.

তরজার বেড়ার ঘরে টিনের চৌচালা। সবই সাদা রঙে ডুবানো। সুরকি আর চুনের গুঁড়ার মিশ্রণের ওপর নিপুণভাবে প্রলেপ দেয়া। ফলে বাইরের উত্তাপ ঘরের ভিতরে কম প্রবেশ করে। চৌচালা-চালের কড়ি-বরগা অনেক উঁচুতে উঠে টিনের আচ্ছাদন নিয়েছে। উপর থেকে নেমে আসা ভাপ-তাপও উঁচুতেই ঝুলে থাকে। প্রায় মরচে-ধরা বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়ায় ওই ভাপ-তাপ মেঝেতে নামাতে পারে না। মেঝের ওপর প্লাস্টিক-ম্যাট বিছানো। বিবর্ণ রং ও ভঙ্গুর চেহারা আড়াল করার প্রয়াস। কিংবা হতে পারে প্রাচীন জীবনকে নতুনের সাথে একাকার করে রাখা।

মোদ্দাকথা ঘরটা বেশ প্রশস্ত ও আরামদায়ক। এবং আমার পছন্দ হয়ে গেল। বহু পুরাতন আমলের খাট, তাতে নরম বিছানা। খাটের পাশ দিয়ে পার্সিয়ান খাটপোষ পেতে রাখা।

রুনি আর আমার একই বিছানা। যদিও আমি শোওয়া-শুয়ি শেয়ার করতে পারি না, কিন্তু রুনির বাড়িতে এসে মেনে নিলাম। এর কারণও পেয়ে গেলাম। এক. এই বাড়িতে দ্বিতীয় কোনো শোবার ঘর নাই। পেছনের ঘরগুলো কেয়ারটেকার মাহবুবের দখলে। দুই, রুনি এতটাই গুটিয়ে-শুটিয়ে ঘুমায় যে, আমার পাশে কেউ ঘুমাচ্ছে এটা বুঝা যায় না। এটা রুনির অভ্যাস না আভিজাত্য ঠিক ধরতে পারলাম না। অবশ্য অভ্যাসই কালক্রমে আভিজাত্যের অংশ হয়ে ওঠে।

খাটের পায়ের দিকে দেয়াল-ঘেঁষে ড্রেসিং-টেবিল। আর বহু পুরাতন কয়েকটা সোফা এদিক সেদিক পেতে রাখা। সোফার গদিগুলো খটখটে। দুইটা পুরাতন স্টিলের-দেরাজ। এরাও সাদা রঙে ভরপুর।

মাহবুবের বউ তফুরার সারাক্ষণ তদারকিতে আমাদের দীর্ঘ-পথের ক্লান্তি উবে গেল। এই দম্পতির চারজন ছেলেমেয়ে। বড়ো মেয়েটার বয়স তের কি চৌদ্দ। নাম মাহি। বয়সের তুলনায় বাড়ন্ত গড়ন। আমার আর রুনির ফুটফরমায়েশের জন্য মাহি ছায়ার মতো লেগে রইল।
খাটের উপর ঝকঝকে বিছানা। বালিশ-চাদর-বেডকভার। এত ঝাড়া-মোছা সত্ত্বেও ঘর থেকে পুরাতনী গন্ধটা বিলীন হয় নাই।

পারস্য-গালিচার ওপর স্থির বসে-থাকা নারীটির দিকে তাকিয়েও আমি তেমনই ভেবেছি। ধূলা পড়ে ওই নারীটির চেহারাও যেন ধূলাকার হয়ে গেছে। প্রাচীন-ঘর, আসবাব, কুশন-কভার, ঝালর-দেয়া-পর্দা। অথবা বেডকভার জুড়ে সময়ের ধূলি-পড়া আবছা-গন্ধ! যা আমাকে নতুন কোনো অভিজ্ঞতার ভিতর ছুঁড়ে ফেলছিল। রুনি আমার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার সম্মুখে আমি ছিলাম নির্বিকার।

আমাদের শোবার ঘরের ভিতরেই বাথরুম। বেশ বড়োসড়ো। প্রাচীন আমলের কমোড। স্নানের জন্য চৌকোনাকৃতি জায়গা। তাতে জল আটকানোর ব্যবস্থা। একপাশে পুরাতনী বেসিন। বেসিনের ভেতরটা গভীর। রীতিমতো কুঁজো হয়ে মুখ ধুতে হয়। মরচে-ধরা জলকল। ও থেকে কীভাবে জল বেরোয়? আমি বিস্মিত হই।
তফুরা বেশ পরিশ্রমী। বেডকভার তুলে বিছানা ভালো করে ঝেড়েমুছে দেয়। ক্লান্তিতে আমি শুয়ে পড়ি। বিছানায় শুয়ে উপরে তাকালে দেখি, চালটা যে টিনের তা বুঝার উপায় নাই। সাদা-মোটা-কাগজ দিয়ে পুরো ঘরটাই আবৃত। ঘুমের ভিতর ঢুকতে-ঢুকতে আমার মনে হয়, টাঙানো কোনো সাদা-তাঁবুর তলায় শান্ত-স্নিগ্ধ-বিছানায় আমরা ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি।

হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। এখন রাত কত? আমি বুঝতে পারি না। ঘরের ভিতর কালো-জালের-মতো অন্ধকার ছড়িয়ে রয়েছে। নতুন জায়গা বলে আমি পূর্ব-পশ্চিমও বুঝতে পারি না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারি, রুনি অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ওর আপাদমস্তক কোনো কিছুতে ঢেকে রাখা। ফলে ও নারী না পুরুষ সেটাও অনুমান করার উপায় নাই।
তীব্র অন্ধকার খানিকটা চোখে সয়ে এলে আমি ফের রুনির দিকে তাকাই। ওর কোনো নড়াচড়া নাই। যেন কোনো শবদেহ পাশে শুয়ে আছে।

শবদেহ পাশে নিয়েই আমি হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণ খুঁজি। কিন্তু কিছুই স্পষ্ট করে মনে করতে পারি না। তবুও এটা খেয়াল হয় যে, কোনো বিকট শব্দেই আমার ঘুম ভেঙেছে। এবং এটা ভাবার পরক্ষণেই আমি ফের ধুমধাম আওয়াজ শুনতে পাই। কীসের শব্দ বুঝতে পারি না। কিন্তু এটা বুঝতে পরি ঘরের চাল বেয়ে শব্দ নীচে নামছে। ভয়ে আমি কানের উপর বালিশ চেপে ধরি। কিন্তু আরও জোরে শব্দ হতে থাকে।
গহীন-অন্ধকারের ভিতর শুয়ে-শুয়ে আমি শব্দ এড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি। এত কিছুর পরও রুনির ঘুম ভাঙে না। সে মৃতবৎ শুয়ে থাকে। আর আমি ভয়ের ভিতর সমর্পিত থাকি। আমার সমস্ত শরীর কুলকুল ঘামে ভিজে ওঠে। আমিও কি তবে রুনির মতো মারা যাচ্ছি?
ওই অন্ধকার রাত্রি কখন যে ভোরের দরজা খুলে দেয়, আমি টের পাই না। বেশ বেলায় ঘুম ভাঙলে দেখি রুনি তখনও মরে আছে। ফের বিকট শব্দ হয়। এবং আমার অতি কাছেই। আমি তাকিয়ে দেখি এক বিড়াল।
বিড়াল আমার কাছে চিরকাল ভয়ের উৎস। ছোটোকালেই আমরা জানতাম, বিড়াল শতরূপী হয়। যাকে বিড়াল মনে করছি সে আদতে অন্যকিছু। বিড়ালের বেশ ধরে এসেছে। সদ্য দেখা-পাওয়া বিড়ালের সঙ্গে আমার আই কনট্যাক্ট হয়। সে চোখ সরায় না। আমিও চোখ সরাই না। সে কি বিড়াল না বাঘ? তার গায়ে ঘিয়ে আর হলদে ডোরা। আর সে বেশ স্বাস্থ্যবান।

এই ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ, সে ঢুকল কীভাবে? কিন্তু সে যেমনি এসেছিল তেমনই হাওয়া হয়ে যায়। দিনের আলোতেও আমি ফের ভয় পেতে থাকি।

আমার অ্যালান পোর বিড়ালের কথা মনে পড়ে। আশ্চর্য! ভীতু মনে কত কী যে উদয় হয়। বিদেশি ওই বিড়ালের সঙ্গে বাংলাদেশি বিড়ালকে তুলনা করার কোনো মানে আছে?

বিড়ালটা কখন জানি হাওয়া হয়ে যায়। আর রুনি সামান্য নড়ে ওঠে। গ্রীষ্মকালে সামান্য হাওয়া বইলে নিমপাতা যেভাবে নড়ে ওঠে, সেভাবে। আচ্ছা, রুনি কি বিছানায় শোয়া মাত্রই মরে যায়? আর রোদ্দুর চড়তা হলে জীবন ফিরে পায়?

আমার হঠাৎ ‘সোনারকাঠি-রূপারকাঠি’ রূপকথার রাজকন্যার কথা মনে পড়ে। রুনি যে রাজকন্যা এটা তাকে দেখলেই অনুধাবন করা যায়। কিন্তু তাই বলে সোনারকাঠি-রূপারকাঠি বদল ছাড়া তার যে ঘুমও ভাঙে না, এটা কী করে সম্ভব?

রুনি কথা বলে ওঠে, ‘কী রে! যা ঘুমাইলি রাতভর। একটুও নড়িস নাই।’

শুনে আমি অবাক হয়ে যাই।

আমি যেমন গতরাতে রুনিকে মরে যেতে দেখেছি, সেও কি আমাকে তেমনই দেখেছে?

বাথরুমে ঢুকে আমি দরজা বন্ধ করি। এতে করে রুনি ঘরের ভিতর আটকা পড়ে যায়। এ ঘরের বাসিন্দাদের কেউ বাথরুমে গেলে এভাবেই যেতে হয়। তফুরা যে দরজা দিয়ে ঢুকবে সেটাও বন্ধ রয়েছে।

পুরাতন মডেলের কমোড। পুরাতন কল। এমনকি কলের তলায় পেতে রাখা বদনাটাও বহু পুরাতন। রং-জ্বলা-নিষ্প্রভ। আমার বামপাশের দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। জুলাই মাস, ১৯৯৫। আমি চমকে উঠি। জুলাই মাস! তার মানে গত বিশ বছরে এ বাড়িতে কোনো নতুন বছর ঢুকে নাই।

এ বাড়িতে কেউ থাকে না তেমন তো নয়! মাহবুব আর তফুরা বাস করে। ওদের বাচ্চাকাচ্চা। বিদেশ থেকে রুনি আসে। ওর বোন ও ভাইও আসে। তাহলে ১৯৯৫ সাল কেন বাথরুমে ঝুলে আছে? এইসব ভাবনার ভিতর আমি কল ছাড়ি। দীর্ঘকাল পর জলের সরু ধারা নামে। আয়রনের আধিক্য হেতু কফিরঙা জল। নাকি রক্ত! আমার শরীর হিম হয়ে আসে। আমি তড়িঘড়ি বদনা হাতে নিতেই ভয়ে কেঁপে উঠি। ধাতব স্পর্শের বদলে নরম ও কোমল অনুভূতি – একটা ডোরকাটা বিড়াল শুয়ে আছে। আর আমি তার পিঠে হাত রেখেছি!

০৩.

রুনিদের প্রাচীন ঘরটার জানালা গলিয়ে দুদ্দাড় করে মেঘ ঢুকে পড়ে। ফলে ঘরের ভিতরটা ধোঁয়া-ধোঁয়া আর শীতল। বাতি-না জ্বালানো পর্যন্ত কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। ওই মেঘকক্ষের ভিতর আমি চুপচাপ বসে থাকি। জানালার বাইরের অবিশ্রাম বৃষ্টি আমাকে অবাক করে দেয়। এই শহরে বড়ো অদ্ভুতভাবে জল ঝরে।

ঝরছে তো ঝরছেই। অক্লান্ত এই ঝরে পড়া।

জামরুলগুলো জলে ভিজে টসটসা। পাতাগুলো জলমগ্ন। বিলম্বী গাছটাও অবিরাম ভিজছে। ভিজতে ভিজতে তার বাকল কালচে হয়ে উঠেছে। জলের ঝাপটায় ভিজে একসা কামরাঙাগাছটি। এন্তার বেগুনি-বর্ণ-ফুল ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টি-স্রোতে। বৃষ্টির প্রবহমান জলে ফুলরাশি ভাসতে দেখে আমার নদীর কথা মনে পড়ে। ফুলনদী! আহা! জলধারা ক্ষীণ হলেও এ তো নদী-ই। ফুলনদী — নইলে এত ফুল এর জলে ভেসে যায় কেন?

তুমুল তুফান আর বৃষ্টি। প্রচণ্ড ঝড়ো-হাওয়া। আসমান ভেঙে পড়ছে জলধারা। থইথই শ্রাবণে আমি গৃহবন্দি। অটোরিক্সায় আসার পথে নদীতে আমি জল উথলে উঠতে দেখেছিলাম। জল-ভরন্ত নদী আমাকে বলে দিয়েছিল ভরা-শাওন। নইলে ওই নদীকে অমন সোমত্ত দেখাত না! ভরা-বর্ষার সমস্ত চিহ্নই ফুটে রয়েছে এই শহরে। মাহবুবের জল-ভেজা-পা আর পিচরাস্তার উপর গড়িয়ে যাওয়া বৃষ্টির দাগ।

রুনিদের জানলায় বসলেই আমি যেন ওই নদীটাকে দেখতে পাই। টিনের-চালে বৃষ্টির-ফোঁটা সংগীত-মুখর হয়ে ওঠে। জলকণারা জানালার ফিনফিন পর্দায় মুক্তোদানার মতো ঝুলে থাকে। মেঘ-থমথমে ঘরের ভিতর আমি হঠাৎ আরও দুটো দেরাজ দেখতে পাই। সাদা-রঙে-চুবানো। এই দুটো কেন আগে দেখিনি?

তফুরাকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘খালাম্মা, এইহানে তো পানির পাম্প।’

ঘরের ভিতর পানির পাম্প! হতেই পারে। দুইশত বৎসর পূর্বে পানির পাম্প ঘরে রাখাই স্বাভাবিক।

ওইদিনও আমি রাতভর ঘুমাতে পারি না। বিদ‌্ঘুটে শব্দরা আমাকে জাগিয়ে রাখে। হয়তো অ্যালান পোর বিড়ালেরা দলবেঁধে আসে। রুনির শবদেহ তেমনই নিঃসাড়। ভোরের দিকে তন্দ্রার ভিতর থেকে আমি হঠাৎ জেগে উঠি।

খাটের পাশে ড্রেসিং টেবিলের ওপর সুরকি-চুন-বালি আর কাঠের টুকরা ধ্বসে পড়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখি, ওই সুরকি আর চুনের স্তূপের নিচে এক বিড়াল লেজ নাড়ছে। কালো আর শাদাতে ডোরাকাটা। এই বিড়ালটিকে আমি আগে দেখিনি। তফুরা ছুটে আসে। মাহবুবও। ওদের মেয়ে মাহি। ওরা ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ওদের চুপসানো মুখাবয়ব দেখি। ঘরের চাল দেখি। তাঁবুর মতো করে টানিয়ে দেয়া মোটা-কাগজটা একদিকে ঝুলে পড়েছে। হয়তো ওই পথেই সুরকি-চুন-বালি-কাঠের স্তূপ নেমেছে।

রুনিকে বিড়াল দেখার কথা বলতেই ও হা হা করে হেসে ওঠে।

‘এটা বিড়ালের কাজ। ঘরের চাল ভেঙে এই চুন-সুরকি-বিড়ালই ফেলেছে।’

বিড়াল কীভাবে অত উঁচু থেকে পড়ার পরও বেঁচে থাকে? আমার বোধগম্য হয় না। রুনিকে বলতেই সে বলে,
‘কী যে বলিস না! বিড়ালের হাড্ডি। ওরা সহজে মরে না।’
ওই ভাঙা-আবর্জনাতে আমি সিমেন্টের প্লাস্টারের অংশও দেখেছি। যদি ওসবই আমার বা রুনির মাথার ওপর পড়ত?

তফুরা আর মাহি ওইসব ধ্বস ঝাঁট দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। আমি হঠাৎ তাকিয়ে দেখি তফুরার পা-দুটো ভেজা-ভেজা দেখাচ্ছে। যেন সে এক্ষুনি পা ধুয়ে এসেছে।
তফুরার পদযুগলকে তারাশাপলার মতো দেখায়। আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আবছা-সুঘ্রাণ পাই।
ওইদিনের দুর্ঘটনার পর আমি রুনিদের বাড়ির সর্বত্র বিড়াল দেখি। যখন ডাইনিংয়ে খেতে বসি আমার পায়ের কাছে বিড়াল চলাফেরা করে। বাঘের মতো ডোরাকাটা বিড়াল। তফুরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে বলে,
‘কই খালাম্মা! বিড়ালউড়াল কিচ্ছু নাই।’

শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি ফের ঘন হয়ে নামে। বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে আমি বিলম্বী গাছটাকেও আর দেখতে পাই না। এমনকি জামরুলের পত্র-শাখাও অস্পষ্ট দেখায়।
মেঘের বড়োসড়ো চাঙর ঝুলে থাকে রুনিদের জানালায়। সেই ধূপছায়া রঙের ভিতর দিয়ে আমি আলোর ছিটেফোঁটাও দেখি না।

টিনের চালে ছোটোবড়ো নানারকম ফোঁটায় বৃষ্টির সংগীত বেজে চলে। আর মেঘের শরীরে মেঘ ঘনায়। বিজলি চমকালে আমি দেখি, রুনিদের চাল থেকে চুন-সুরকি-কাঠের টুকরা খুলে পড়ছে। চুন-সুরকির স্তূপ জমে ওঠে। আর সেখান থেকে এক বিড়াল মুখ বের করে ডেকে ওঠে!
গাছপালা-বাড়িঘর যাবতীয় কাঁপিয়ে কাছেপিঠেই কোথাও বাজ পড়ে। কিন্তু ওই বিড়াল আমাকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখে যে, আমি অন্যদিকে মনোযোগী হই না। ফলে রুনিদের প্রাচীন ঘরটা ধ্বসে পড়ার শব্দও আমার কানে আসে না। হয়তো ওটা বাজ পড়ার শব্দও হতে পারে।
ঝড়ো-হাওয়া প্রচণ্ড দাপট নিয়ে মেঘেদের ঘনঘন ডেকে আনে আর বিজলি চমকায় দুই চক্ষু অন্ধ করে দিয়ে। আমি রুনিকে ডাকার চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। আমার গলা ফুটে কোনো শব্দ বেরোয় না। আমি শুধু অনুভব করি, পানির পাম্প দিয়ে অসংখ্য বিড়াল ওঠানামা করছে। আর বিড়ালদের পদশব্দে একটা প্রাচীন বাড়ি ভেঙে পড়ছে।

আমার হঠাৎ মনে পড়ে, আমি বিড়ালদের নিয়ে না-ভেবে ওই নদী নিয়ে ভাবতে পারতাম। রুনিদের বাড়িতে আসার সময় যে বরফ-গলা-নদী দেখেছিলাম। আদতে ওটা ছিল একটা সংকেত। আর নদীটা ছিল মুক্তিযুদ্ধে শহীদ লেখক জহির রায়হানের নদী। আমি যদি একবার ওই নদীর কথা রুনিকে বলতাম। মাত্র একবার! ‘বরফ গলা নদীর’ দৃশ্যাবলি নিয়েও যদি একটিবার কথা বলতাম দুজন! তাহলে হয়তো এই ঝড়-জলের তাণ্ডব আমরা এড়াতে পারতাম। আমাদের নিশ্চিত অথচ অপঘাত-মৃত্যুও হয়তো আটকাতে পারতাম। দুঃখের বিষয়, বিদেশি বিড়ালদের নিয়ে আমরা এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, ওই নদীর কথা একেবারেই স্মরণ হয় নাই।

ফের তুমুল ঝড় আর বৃষ্টিতে আক্রান্ত হলে আমার আর রুনির যুগপৎ মনে পড়ে, নদীটার নাম ছিল ‘বরফ গলা নদী’। মফস্বলের নদীগুলোর এমন আজগুবি নামই হয়!

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *