মীর মোশাররফ হোসেন বিস্মৃতির অন্তরালে – দীপক সাহা 

শেয়ার করুন

উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আদর্শ তুলে ধরেন। ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ, বিচার ও সাম্যের এক দুর্লভ পরিচয় রয়েছে তাঁর লেখায়। মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়েও মুসলমানের গোমাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ছিল ক্ষুরধার। শরীরে জমিদারি রক্ত থাকলেও লম্পট, অত্যাচারী জমিদারদের কুকীর্তি নিয়ে নাটক লিখতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। আজীবন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। সমসাময়িক কালের থেকে তিনি কয়েক যোজন এগিয়ে ছিলেন। 

হ্যাঁ, তিনি মীর মোশাররফ হোসেন। পুরো নাম সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন। বাংলা ভাষার অন্যতম উজ্জ্বল গদ্যশিল্পী। মীর মোশাররফ হোসেন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। মুসলিম সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ মীর মোশাররফ হোসেন বিশুদ্ধ বাংলায় অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে আরবি-ফারসি মিশ্রিত তথাকথিত মুসলমানি বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করেছিলেন। সহজ সাবলীল গতি, ওজস্বিতা তাঁর রচনাকে স্বকীয় স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বলিষ্ঠ লেখক মীর মোশাররফ হোসেনের ১৭৫ তম জন্মবার্ষিকীর সূচনায় তাঁকে নিয়ে চর্চার দীনতা খুবই দুর্ভাগ্যের। বাংলার সাহিত্যসংস্কৃতিতে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি আজ বড়োই নিষ্প্রভ। 

বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার (তদানীন্তন নদিয়া জেলায়) কুমারখালির গড়াই তীরবর্তী লাহিনীপাড়ার সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে মীর মোশাররফ হোসেন ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর (২৮ কার্তিক, ১২৫৪ বঙ্গাব্দ) নবাব সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন এবং দৌলতুন্নেছার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ‘মীর’ দিল্লীর মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের দেওয়া খেতাব। মীর মোশাররফ হোসেনের প্রপিতামহের পিতা সৈয়দ কুতুবুল্লাহ ‘মীর’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। জগমোহন নন্দীর পাঠশালা, কুমারখালির ইংলিশ স্কুল, পদমদী নবাব স্কুল ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল-এ পড়ার কথা লেখকের আত্নজীবনীতে লেখা আছে। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে। তিনি কিছুকাল কলকাতায় বসবাস করেন।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মীর মোশাররফ হোসেন-এর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী সমাজের অর্ন্তভুক্ত। মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বহীন সময়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এ সময়ে মুসলমান লেখকগণ ছিলেন স্বেচ্ছানির্বাসিত। তাঁরা পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতিকে বর্জন করছিলেন। ফলে, তাঁরা মধ্যযুগের একঘেয়ে সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে দো-ভাষী পুঁথি রচনা করেই ছিলেন তৃপ্ত। মীর মোশাররফ হোসেনের অসাধারণ কৃতিত্ব এই যে, তিনি দো-ভাষী পুঁথির মিশ্র ভাষারীতি থেকে বেরিয়ে এসে এক ধরনের বিশেষ শালীন সাধুগদ্যের চর্চা শুরু করেন। তিনি অবনমিত মুসলিম সমাজকে আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী করে তোলেন।  

‘আমাদের শিক্ষা’ নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “বঙ্গবাসী মুসলমানদের দেশভাষা বা মাতৃভাষা ‘বাঙ্গালা’। মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নাই, সে মানুষ নহে। বিশেষ সাংসারিক কাজকর্ম্মে মাতৃভাষারই সম্পূর্ণ অধিকার। মাতৃভাষায় অবহেলা করিয়া অন্য দুই ভাষায় বিখ্যাত পণ্ডিত হইলেও তাহার প্রতিপত্তি নাই। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি প্রাণের প্রাণ যে স্ত্রী, তাহার নিকটেও আদর নাই। অসুবিধাও বিস্তর। ইস্তক ঘরকন্নার কার্য্য নাগাদে রাজসংশ্রবী যাবতীয় কার্য্যে বঙ্গবাসী মুসলমানদের বাঙ্গালা ভাষার প্রয়োজন।”

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার চার বছর পর মোশাররফের প্রথম উপন্যাস ‘রত্নবতী’ (১৮৬৯) প্রকাশিত হয়। রূপকথা জাতীয় গল্পের এই বইটি তেমন সাফল্য না পেলেও প্রথম কবিতার বই ‘গোরাই ব্রিজ বা গৌরী সেতু’ (১৮৭৩) পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এরপর তিনি একে একে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, কাব্য, সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ক ৩৬টি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৭৩ সালেই প্রকাশিত ‘জমিদার দর্পণ’ নাটক তাঁকে খ্যাতি এনে দিল। এ দেশের এক অত্যাচারী জমিদার হায়ওয়ান আলির দুষ্কর্ম, প্রজাপীড়ন, লাম্পট্যের কথা আছে নাটকটিতে। এর ভূমিকায় মশাররফ লিখেছেন— ‘নিরপেক্ষভাবে আপন মুখ দর্পণে দেখিলে যেমন ভালমন্দ বিচার করা যায়, পরের মুখে তত ভাল হয় না। জমিদার বংশে আমার জন্ম, আত্মীয়-স্বজন সকলেই জমিদার, সুতরাং জমিদারের ছবি অঙ্কিত করিতে বিশেষ আয়াস আবশ্যক করে না।’ বোঝাই যাচ্ছে, নাটকটির বিষয় কাল্পনিক মাত্র নয়। নাটক রচয়িতার প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘বঙ্গদর্শন’-এ তিনি লিখেছেন, “জনৈক কৃতবিদ্য মুসলমান কর্তৃক এই নাটকখানি বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ভাষায় প্রণীত হইয়াছে। মুসলমানি বাঙ্গালার চিহ্নমাত্র ইহাতে নাই। বরং অনেক হিন্দুর প্রণীত বাঙ্গালার অপেক্ষা এই মুসলমান লেখকের বাঙ্গালা পরিশুদ্ধ। …আমাদিগের বলা কর্তব্য যে নাটকখানি অনেকাংশে ভাল হইয়াছে।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কৃষক বিদ্রোহে উস্কানি দেওয়ার ভয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় নাটকখানির প্রকাশ ও অভিনয় বন্ধের সুপারিশ করেছিলেন। এ নাটকখানির কাহিনি, সংলাপ, চরিত্র চিত্রণ ও নাটকীয়তাগুণে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’-এর চেয়ে অনেকাংশে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে। 

মাইকেল যেমন কবিতায় রামায়ণের কাহিনি নিয়ে এক অপরূপ ট্র্যাজেডি ‘মেঘনাদ বধ’ রচনার মধ্য দিয়ে পুরাণের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছিলেন তেমনি মীর মোশাররফ গদ্যে কারবালার ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’ ট্র্যাজেডি রচনার মাধ্যমে ইতিহাসের নবজন্ম দান করলেন। মোশাররফ হোসেনের সাহিত্যকীর্তির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘বিষাদ-সিন্ধু’ (তিন খণ্ড, ১৮৮৫, ১৮৮৭, ১৮৯১)। কারবালার যুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত বিষাদ সিন্ধু তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম। এক দিকে যুদ্ধ-হাহাকার-রক্তস্রোত; অন্য দিকে অনিঃশেষ প্রেমবাসনা উপন্যাসটিকে অনন্য করে তুলেছে। 

‘বিষাদসিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের একটি ধ্রুপদী গ্রন্থ। ইসলামের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বিষাদান্তক মর্মন্তুদ কারবালার কাহিনি অবলম্বনে গ্রন্থটি তিনটি খণ্ডে রচিত। মহরম পর্ব (১৮৮৫), উদ্ধার পর্ব (১৮৮৭), এজিদবধ পর্ব (১৮৯১)। গ্রন্থের মুখবন্ধে লেখক দাবি করেছেন, “পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া ‘বিষাদ সিন্ধু’ বিরচিত হইল।” ‘বিষাদ সিন্ধু’ একটি মহাকাব্যোপম বৃহদাকার উপন্যাস। এ প্রসঙ্গে ক্ষেত্র গুপ্ত বলেছেন, ‘বাংলায় মহাকাব্যিক কিছু অবশ্যই আছে। কিন্তু খাঁটি মহাকাব্যের কাছাকাছি উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’। ‘বিষাদ সিন্ধু’ গদ্যে লেখা মহাকাব্য এবং একটি ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্স।’ এ উপন্যাসের এজিদ চরিত্র শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ চরিত্রের সমান্তরাল। ‘বিষাদ সিন্ধু’ বাংলার মুসলমান সমাজে ধর্মগ্রন্থের মতো শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও পঠিত হয়। মীর মোশাররফ হোসেনের অপর গ্রন্থগুলি বাদ দিলেও মাত্র এই একখানি গ্রন্থ রচনার জন্য তাঁকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক আখ্যায়িত করা যায়। 

‘গো-জীবন’ নামক তাঁর বিতর্কিত রচনাটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালের মার্চ মাসে। গো-জীবনের লেখক মূলত উপমহাদেশে গরু কোরবানি নিয়ে হিন্দু মুসলমানের যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান, তার ব্যাপারে মন্তব্য রাখেন নিজের। শামসুর রাহমান তাঁর “আমাদের সমাজ ও লেখকের স্বাধীনতা” প্রবন্ধে মীর মোশাররফ হোসেন-এর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ‘গো-জীবন’-এর শুরুতেই বলা হয়েছে, “আমাদের মধ্যে ‘হালাল’ এবং ‘হারাম’ দুইটি কথা আছে। হালাল গ্রহণীয়, হারাম পরিত্যাজ্য। একথাও স্বীকার্য যে গোমাংস হালাল, খাইতে বাধা নেই। …গো-মাংস না খাইলে মোসলমান থাকিবে না, মহাপাপী হইয়া নরকযন্ত্রণা ভোগ করিতে হইছে… একথা কোথাও লিখা নাই। …এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু-মোসলমান উভয় জাতিই প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্ম ভিন্ন, কিন্তু মর্মে ও কর্মে এক-সংসার কার্যে, ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না। আপদে, বিপদে, সুখে দুঃখে, সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ নাই, রক্ষার উপায় নাই। …এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা, তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কী? …আরবে কেহই গরু কোরবানি করে না। ধর্মের গতি বড় চমৎকার। পাহাড় পর্বত, মরুভূমি সমুদ্র, নদ-নদী ছাড়াইয়া মোসলমান ধর্ম ভারতে আসিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে কোরবানি আসিয়াছে। এদেশে দোম্বা নাই-দোম্বার পরিবর্তে ছাগ, উঠের পরিবর্তে গো, এই হইল শাস্ত্রকারদিগের ব্যবস্থা। …গরু কোরবানি না হইয়া ছাগলও কোরবানি হইতে পারে। তাহাতেও ধর্ম রক্ষা হয়।”

কী উদার, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী বক্তব্য মীর মোশাররফ হোসেনের। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি যে কল্যাণকর, এ-কথা তিনি খুব সুন্দর এবং জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু ‘বিষাদ সিন্ধু’র অমর স্রষ্টাকে তাঁর বক্তব্যের জন্যে বেশ খেসারত দিতে হয়েছে, সইতে হয়েছে অপমান। রক্ষণশীল, গোঁড়া মুসলমানরা খেপে গিয়ে ‘গো-জীবন’-এর ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবাদ তো করেইছে, ধর্মসভা ডেকে মীর মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে কাফের ও তাঁর স্ত্রীকে হারাম জারি করে। লেখককে ‘তওবা’ করতেও বলা হয়। অপমানিত বিষণ্ণ লেখক ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। আখেরে ব্যাপারটি চুকে-বুকে যায়, মীর 
মোশাররফ হোসেন বলেন যে তিনি ‘গো-জীবন’ পুনর্বার ছাপাবেন না। ‘গো-জীবন’ পুনর্বার না ছাপার আশ্বাস দিয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’র লেখক কিন্তু তাঁর শিল্পী-সত্তা বজায় রাখতে পারেননি। নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ, ভগ্নহৃদয় মীর মোশাররফ হোসেন ফতোয়াবাজদের প্রদর্শিত পথে হাঁটতে শুরু করেন, রুদ্ধ হয়ে যায় তাঁর সৃজনশীল লেখনীর গতি। এরপর তাঁর লেখনী থেকে যা নিঃসৃত হল তাতে আর মীরের শৈল্পিক ঝলক রইল না। আরও কয়েকটি বই প্রকাশিত হল বটে। কিন্তু আত্মিক মৃত্যু ঘটল লেখকের। 

তিনি প্রথম জীবনে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ (১৮৬৩) ও কবি ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১) পত্রিকায় টুকিটাকি সংবাদ প্রেরণ করতেন। এই সুবাদে কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল যা আমৃত্যু বহাল থাকে। এ কারণেই তাঁকে কাঙাল হরিনাথের সাহিত্যশিষ্য বলা হয়। মীর একখানি (রবেনা সুদিন কুদিন কয়দিন গেলে) বাউল গান লিখে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘ফিকিরচাঁদ ফকির’-এর বাউল দলের সদস্য হন। ‘মশা বাউল’ ভণিতায় তিনি কয়েকখানি উৎকৃষ্ট বাউল সংগীত রচনা করেছিলেন। সংগীত সম্বন্ধে মীরের বেশ ভালো জ্ঞান ছিল। তাঁর ‘সংগীত লহরীতে’ বিভিন্ন তালের অনেকগুলি সংগীত আছে।

‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ মীর মোশাররফ হোসেনের আত্মকথা। এই উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ মীর সাহেবের পিতা-মাতার দাম্পত্য জীবন ও তাঁর নিজের শৈশব জীবনের কাহিনি। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ না উপন্যাস, না যথার্থ আত্মজীবনী। এ উপন্যাসের কাহিনির একদিকে রয়েছে নীলকর টি আই কেনীর সঙ্গে সুন্দরপুরের মহিলা জমিদার প্যারী সুন্দরীর দ্বন্দ্ব, রায়ত প্রজার উপর কেনীর অত্যাচার-নিপীড়ন, নীলবিদ্রোহ ও কেনীর পরিণতি। কাহিনির দ্বিতীয় ধারাটি গড়ে উঠেছে মোশাররফ হোসেনের পিতা মীর মোয়াজ্জম হোসেনের সঙ্গে তার ভ্রাতুষ্পুত্রী পতি সা গোলামের তিক্ত সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোয়াজ্জম হোসেনের দাম্পত্য জীবনের ঘটনা। আর এ দু-ধারার যোগসূত্র স্থাপন করেছেন মোয়াজ্জম হোসেন। এ গ্রন্থে বিবৃত নীলচাষ ও প্রজা আন্দোলনের কাহিনি আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রসঙ্গ হলেও বৃহদার্থে তা জাতীয় ইতিহাসেরই অঙ্গ। 

পাশ্চাত্য ভাবধারাপুষ্ট সমসাময়িক সাহিত্যিকগণ যে সময়ে রস-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে চলেছেন, সে সময়ে মীর মোশাররফ হোসেন ব্যতীত অন্য কোনো মুসলিম গদ্য লেখককে সাহিত্য পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেখা যায়নি। ইসলামী ভাবধারার উজ্জীবন অপেক্ষা সমাজের দোষ-ক্রটি উদঘাটন এবং জীবন চিত্রাঙ্কনের প্রতি তাঁর দৃষ্টি বেশি নিবন্ধ ছিল। এ কারণে তাঁর সাহিত্য মুসলমান-হিন্দু সকলের কাছে ছিল জনপ্রিয়। তাঁর মতো একজন হৃদয়বান এবং মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন সাহিত্যিকের আবির্ভাব নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর।

পরিশেষে এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, একটি বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে মীর মোশাররফ হোসেন উপন্যাস রচনায় শিল্পী-চৈতন্যে যে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন তার প্রেক্ষিতেই পুঁথি সাহিত্যের গণ্ডি পেরিয়ে আধুনিক জীবন-সাহিত্যে পদার্পণের দরজা উম্মুক্ত করতে পেরেছিলেন। তিনি ইতিহাসকে তাঁর শিল্প কুশলতার মাধ্যমে নবরূপদানে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর প্রথম জীবনীকার শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মোশাররফ হোসেনের অবদান সম্পর্কে উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমানের দান সম্পর্কে যদি স্বতন্ত্রভাবে বিচার করা চলে, তাহা হইলে বলিতে হইবে, একদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যে দান, অন্যদিকে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ প্রণেতা মীর মোশাররফ হোসেনের স্থান ঠিক অনুরূপ। এদেশের মুসলমান সমাজে তিনিই সর্বপ্রথম সাহিত্য শিল্পী এবং এখন পর্যন্ত তিনিই প্রধান সাহিত্য শিল্পী হইয়া আছেন।” মীর মোশাররফ হোসেনকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্রপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করা হলেও অসঙ্গত হয় না। ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৬৪ বছরে তাঁর জীবনদীপ নিভে যায়। পদমদীর মাটিতেই মীর মোশাররফ হোসেন চিরনিদ্রায় শায়িত।  

ছবি- আন্তর্জাল 

তথ্যসূত্র:

১.মীর মোশাররফ হোসেন – সিতাজুদ্দীন আমেদ 
২. বিন্দু বৃত্তান্তে -এস.এম কামরুল হাসান
৩. সাহিত্য সাধক চরিতমালা—ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় 
৪. বিভিন্ন পত্রপত্রিকা।
৫.উইকিপিডিয়া 

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *