|

মাছ ভর্তা – নীলকমল ব্রহ্ম অনুবাদ: তপন মহন্ত

শেয়ার করুন

[নীলকমল ব্রহ্ম (১৯৪৪-১৯৯৯): বোড়ো সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক ছোটোগল্প রচয়িতা নীল কমল ব্রহ্ম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একজন শক্তিমান কবিও। বোড়ো সমাজে তিনি সাহিত্য সম্রাট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর বাস্তবধর্মী ছোটোগল্পের চরিত্রগুলি চিন্তায় চেতনায় নতুন যুগের প্রতিনিধি। অসমিয়া অনুবাদ ‘মাছর পিটিকা’ (না বাথৌন) গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন তপন মহন্ত। বোড়ো সমাজের প্রথা অনুযায়ী মিলনরত মাছ খাওয়া মহিলাদের জন্য নিষিদ্ধ (taboo)।] 

শিরদাঁড়াটা একটু সোজা করার কথা ভেবে উঠে দাঁড়াতেই হুংগার বৌদি চোখের সামনে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পান। উনি ভাবতেই পারেননি যে দুটোর মাঝে অমন অঘটন ঘটতে পারে। দৃশ্যটা তাঁর কাছে কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হল। ধানখেতে আল বাঁধতে থাকা দেবর হুংগাকে ঘটনাটি দেখানোর জন্য বৌদি তাকে চিৎকার করে ডাকেন।

“এ্যাই হুংগা, এদিকে আয় তো, তাড়াতাড়ি আয়।”

“কী হল বৌদি?”—কাছে এসে হুংগা জিজ্ঞেস করে।

“দ্যাখ দ্যাখ, ওই আপদ দুটো কীভাবে জড়াজড়ি করে খেলা করছে।”

“ছিঃ নির্লজ্জ কোথাকার! দাঁড়া, তোদের মজা দেখাচ্ছি।” একথা বলে হুংগা মাথাল বসিয়ে রাখা লাঠিটা তুলে নিয়ে মাছ দুটোর দিকে ধেয়ে যায় আর নিমেষে প্রাণীদুটোর জীবন নিঃশেষ করে। হুংগা মাছ দুটোকে কাদা থেকে তুলে এনে বৌদিকে দেখায়।

“হায় হায়! এটা কী করলি? বেচারারা আত্মমগ্ন হয়ে ক্রীড়া করছিল! এ্যাই হুংগা, তোর মহাপাপ হবে!” কথাগুলোয় কান না দিয়ে হুংগা বলে, “‘মাছ ভর্তা’ জমে যাবে দুপুরের খাবারের সাথে।”

তাড়াহুড়ো করে মাছ দুটোকে মাথাল দিয়ে ঢেকে রেখে হুংগা আবার খেতের আল জুড়তে গেল। এদিকে দেবর-বৌদির কথপোকথন পাশেই হাল বাইতে থাকা হুংগার বড়দাও শোনেন।

কিছুক্ষণ পরে হুংগা মাছ দুটো নিয়ে চটপট ঘরে ঢোকে।

হুংগার বড়দার শ্যালিকা অম্বা দুপুরের রান্নাবাড়ার কাজ সেরে বারোয়ারি কুয়ো থেকে জল আনতে যায়। বর্ষাকালে খেতের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার ফলে একা একা কষ্ট হয় বলে দিদি অম্বাকে দু-মাসের জন্য ডেকে আনিয়েছেন। হুংগাদের ঘরে আসার এক পক্ষকাল হয়ে গেছে অম্বার।

কাঁখে জলের কলসি নিয়ে চাতালে পা দিয়েই অম্বা রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা কাঠের হামানদিস্তার খুটখাট শব্দ শুনতে পায়। অম্বা ভাবে, ভেতরে কে হতে পারে! বারান্দা থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখে এ তো ছোটো জামাই বাবু। তন্ময় হয়ে হামানদিস্তায় কী যেন কুটছে। অম্বা আস্তে-ধীরে দরজাটা ঠেলে দিয়ে বলে,

“ছোট জা’ই বাবু, কী কুটছো?”

অম্বার দিকে মাথা তুলে না তাকিয়েই বলে, “মাছ ভর্তা।”

“আমিও খাবো কিন্তু।”

“ধ্যাৎ বোকা! তোকে খেতে হবে না। নিষেধ আছে।” হুংগা সলজ্জে কথাগুলো বলে।

“নিষেধ কেন! মাছ ভর্তাও খাওয়া যাবে না?” অম্বা অনুযোগের সুরে কথাগুলো বলে।

“এমন মাছ তোদের খেতে নেই! নিষিদ্ধ!” তাড়াতাড়ি হামানদিস্তা থেকে মাছ ভর্তা বের করে যত্ন সহকারে একটা বাটিতে রেখে হুংগা স্নানে বেরিয়ে যায়।

আজ ভাত খাওয়ার সময় হুংগা বড়দার সাথে না বসে বৌদির সাথেই রান্নাঘরে খেয়ে নেয়। রসুন দিয়ে বানানো মাছ ভর্তার ম-ম গন্ধে অম্বার জিভের জল সামলানো দায় হয়ে ওঠে। এদিকে দ্বিতীয় বার চাইতেও পারে না। আগেই নিষেধ করে রেখেছে। হয়তো খাওয়া যায় না! তবুও ছোটো জামাই বাবুর ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে দিদির উদ্দেশে বলে, “সত্যি কি খাওয়া যায় না, দিদি?”

“আমি কীভাবে জানবো, ওকেই জিজ্ঞেস কর!”—হুংগার দিকে তাকিয়ে দিদি বলে।

“এতগুলো ভর্তা ছোট জামাই বাবু একা খাবে, এত লোভী…” অম্বা কথা শেষ করার আগেই দিদি অম্বাকে ধমক দিয়ে বলে, “খাওয়ার সময় এমন কথা বলা কি ঠিক?”

এবার হুংগা বৌদির কথায় সমর্থনের আভাস পেয়ে বলে, “ইনি সত্যি বোকা! নিষেধ বলেছি না, নিষিদ্ধই। এমন মাছ তোর খাওয়া উচিৎ হবে না, নিষেধ আছে।”

“কী এমন মাছ এটা? অম্বা জানার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে। কিন্তু অম্বার কথায় কান না দিয়ে হুংগা হাত-মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। অম্বাও থালাবাটি ধোয়ার জন্য কুয়োর পারে যাওয়ার সময় জামাই বাবুকে পেয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেলে,

“জামাইবাবু, ছোটো জা’ইবাবুর খাওয়া মাছটা কী মাছ ছিল?”

“তোকে বলেনি ওরা?” জামাই বাবুও কথাটার উত্তর ঘুরিয়ে দেয়।

“কোথায় বলেছে! শুধু খাওয়া যায় না বলেছে। মাছ ভর্তাও খাওয়া যাবে না?”

“মানুষে বলে, এই মাছ না কি তোরা খেতে পারিস না!”

“না জামাই বাবু। আসলে সেটা কী মাছ ছিল?”

“ভ্যাদা মাছের সাথে চ্যাংয়ের কী যেন অঘটন ঘটা মাছ!” এবার জামাই বাবু লাজলজ্জা ঝেড়ে ফেলে কথাটা সোজাসুজি বলে।

“অ মাগো, নির্লজ্জ কোথাকার!” অম্বা লজ্জায় জামাই বাবুকে শাসন করার জন্য কৃত্রিম কোপে হাত তোলে।

জামাই বাবু আবার বলে, “একই কথা বারে বারে জিজ্ঞেস করিস কেন? সত্যি কথাটাই তো বললাম।”

প্রকৃত রহস্যটা দেরিতে বুঝে অম্বা খুব লজ্জিত হয়। লজ্জা ঢাকার জন্য জামাই বাবুকে কপট রাগ দেখিয়ে দু-চারটে কটু কথাও শুনিয়ে দেয়।

বিকেলে হুংগা ধানগাছের চারা বহনের জন্য বাঁক নিয়ে ধানখেতে যায়। অম্বা তখন ধানচারা তুলছিল। ছলনা করে অম্বা হুংগার কাছে আবার মাছ ভর্তার প্রসঙ্গ তোলে।

“ছোটো জা’ইবাবু, আজ আমাকে মাছ ভর্তা দিলে না কেন?”

“ধ্যাত্তেরি!” হুংগা অপ্রস্তুত হয়ে আবার বলে, “খায় না বলেছি না, খায় না।”

“খেলে কী হয়, ছোট জা’ইবাবু?” অম্বা হুংগাকে রাগানোর জন্য আবার বলে।

“বড়দা’র কাছ থেকে শুনে তখন তো সব কথা বুঝতে পেরেছিস, না? কোথায়, কীভাবে, কী কুকাজ করা মাছ! আমিও বারান্দা থেকে শুনতে পেয়েছি! আসল কথা হল, ভ্যাদা মাছ খুব শান্ত, বোকা। তাই চ্যাং, চিংড়ি, টাকি, ট্যাংরা সহ অন্য সব চতুর মাছের পাকচক্রে পড়ে তাকে নিজের পবিত্রতা হারাতে হয়। তাই তেমন মাছ খেলে তোদেরও কোনো পাকচক্রে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।”

অম্বা আরও কিছু কথা তুলতে পারে ভেবে হুংগা তাড়াতাড়ি কচি ধানচারার বাঁক কাঁধে তুলে নিয়ে খেতের দিকে এগিয়ে যায়।

সানন্দে লাজুক চোখ তুলে অম্বা একদৃষ্টে হুংগার দিকে তাকিয়ে থাকে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *