মা – সৈকতা দাস

শেয়ার করুন
মা, এবার কি আপনার খাবার নিয়ে আসব?
চমকে উঠলেন বাসন্তী দেবী। একমনে চশমার কাঁচটা মুছছিলেন তিনি। আজকাল বড্ড ঝাপসা লাগে সবকিছু।
যাও, আমি যাচ্ছি। বলেই উঠে পড়লেন তিনি। আশ্রমের সবাই হয়ত অপেক্ষা করছে তার জন্য। এই মৌ মেয়েটি খুব ভালো। সবসময় তাঁর খেয়াল রাখে। না! আজ আর দেরী করা যাবেনা। কাল সকালে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ সারতে হবে তাঁকে।
কেন এভাবে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন? খুব শান্ত গলায় জানতে চাইলেন বাসন্তী দেবী। এই বড়িশা গ্রামটা একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। চাষ-বাসই মূল জীবিকা। আগে অনেক দূরে স্কুল ছিল বলে গ্রামের মেয়েরা কেউ পড়তে যেত না। তিনবছর আগে তাই গ্রামের মধ্যেই একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুল হয়েছে। কিন্তু অবস্থা এতটুকুও বদলায়নি। বাবা-মা রা ক্লাস সেভেন-এইটেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। তাদের যুক্তি এরপর যদি আর ভালো সম্বন্ধ না পাওয়া যায়! নীলা এই গ্রামেরই এক অত্যন্ত মেধাবী মেয়ে। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও যথেষ্ট আশাবাদী ওকে নিয়ে। তাই কাল খবরটা শুনে চুপ করে গিয়েছিলেন বাসন্তী দেবী।
কি হল, উত্তর দিচ্ছেন না যে? বলুন এই মেয়েটির মেধা কেন নষ্ট করতে চাইছেন? জানেন, পুলিশে খবর দিলে কি হাল হবে আপনার? একদৃষ্টে নীলার বাবার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন উনি।
থাকেন তো একটা ছোট্ট আশ্রমে! ঘর-সংসার কিছু আছে আপনার? ওই ভিখিরির বাচ্চাগুলোকে তো তুলে এনে মানুষ করছেন। নিজের মেয়ে থাকলে মেয়ে থাকার কি জ্বালা টের পেতেন। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে তখনও আরও অনেক কথা  বলে চলেছেন সত্যবাবু, নীলার বাবা! কিন্তু বাসন্তী দেবী কিছুই শুনতে পারছেন না। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল ওঁর।
…………..
মা, ও মা, তুমি কেন ভাইকে কিছু বলনা গো? এভাবে ভাত ছুঁড়ল!
জানিস তো তোর ভাই ওরকম!
তাই বলে এত অশান্তি। দেখবে মা, তোমার ছেলেই কোনদিন আমায় মেরে ফেলবে!
আবার বাজে কথা! যা তুই মোবাইল ঘাঁট।
কি হল, কিছু বলুন, চুপ করে গেলেন কেন?
প্লিজ, দিদিমণি, আমার বাবার কথায় কিছু মনে করনা না। ও দিদিমণি, তুমি কিছু বলছনা কেন?
নীলার ডাকে সম্বিত ফেরে বাসন্তী দেবীর।
কি যেন বলছিলেন? আমার মেয়ে থাকলে? তাহলে নীলা আজ থেকে আমারই মেয়ে। ও আমার আশ্রয়েই থাকবে।
ওর পড়া, বিয়ের খরচ আপনি সামলাবেন তো? নাকি তখন আবার আমার কাছে হাত পাততে আসবেন?
আজ থেকে ওর পুরো দায়িত্ব আমার। আপনার মত বাবা থাকার চেয়ে………
হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি, বুঝেছি। অমন কুলাঙ্গার মেয়ে আমারও চাইনা, যে মেয়ে বাপের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে……………. না! আর কিছু বলার আগেই আচমকা একটা চড় এসে পড়ল গালে!
……….
মা, তুমি কিছু বললে না তো? বাবা আজও এভাবে আমায় বলল! তোমার নামে টাকা থাকলে আমি তোমায় বালিশ চাপা দিয়ে খুন করতাম মা? বাবা একথাটা বলতে পারল? কেন, মা? আমি তো নিজের পড়াশুনার খরচটাও টিউশন করে……………..
সেদিন হাউহাউ করে কাঁদছিল মেয়েটা। চুপ করাতে পারেননি উনি।
……..
হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন নীলার বাবা। তার সামনে দিয়ে তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেল!
নীলা, আজ থেকে তুই আশ্রমে থাকবি। মন দিয়ে লেখাপড়া কর, বুঝলি? তোর বাবাকে জবাব দিতে হবে তো!
অবাক হয়ে মানুষটাকে দেখে নীলা। তাদের গ্রামের এই বাসন্তী দিদিমণি। কবে যে উনি এই গ্রামে এসে উঠেছেন আর কি করে যে এই ছোট্ট আশ্রমটাকে এত বড় করলেন তা কেউ জানেনা। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল ওঁকে দেখলেই খুব শান্ত এক মানুষ মনেহয়। অথচ রেগে গেলে যে উনি কি তা তো একটু আগেই সবাই দেখল। কিন্তু উনি রাগলেন কেন? ওর বাবা ওঁর মেয়ের কথা বলেছিল বলে!
দিদিমণি, ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে নীল।
বল মা।
তোমার মেয়ে আছে দিদিমণি?
মুহুর্তে মুখটা কঠিন হয়ে যায় বাসন্তী দেবীর।
…………
কেন মা? কেন এত কষ্ট পাও তুমি। প্রতিবাদ কেন করনা? আমাকেও সবকিছু মেনে নিতে বল কেন? এই দেখ, ভাই আমায় কিভাবে মেরেছে!
আয়, ওষুধ লাগিয়ে দিই। কেন ঝগড়া করিস বল তো?
ওকে কিছু বলবে না মা?  আচ্ছা মা, আমি যদি বাবার নিজের মেয়ে হতাম তাহলেও কি……………! ভাই তো এখনও কিছু জানেনা মা, তবুও এরকম করে কেন? কেন কিছু বলনা ওকে?
বললে যে আবার ঘরে অশান্তি হবে। আমার আর এই অশান্তির মধ্যে বাঁচতে ইচ্ছে করেনা।
চল মা, একটা ছোট্ট আশ্রমে চলে যাই, লাল মেঝে, টালি দেওয়া। একটা ছোট্ট পুকুর পাশে। আমি, তুমি আর অনেক বাচ্চা। তাদের সঠিক শিক্ষা দেব মা, মানুষের মত মানুষ তৈরি করব।
আমি কি করে যাব বল? তোর ভাই তো ছোট।
ধুর! ও মানুষ হবে না। মা জানো, আজ আবার একটা মেয়ের বিয়ে আটকেছি আমরা।
বলিস কি! কলেজ ছেড়ে এসব করে বেড়াচ্ছিস?
আরে মেয়েটা কত ছোট জানো? সামান্য কটা টাকার জন্যে ওর বাবা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল!
………
দিদিমণি, কাঁদছ?
এত প্রশ্ন না করে যাও ঘরে গিয়ে পড়তে বোস।
দৌড়ে ঘরে চলে গেল নীল।
এ কি করছিলেন তিনি! কাঁদছিলেন সবার সামনে। না! কারোর সামনে আর দুর্বল হবেন না তিনি, কারোর সামনে। আজ খুব সহেলীর ছবিটা দেখতে ইচ্ছে করছে আবার। এই ধুলো পড়া ট্রাঙ্ক ঘেঁটে বের করলেন সহেলীর ছবিটা, আর উইপোকায় কাটা গল্পের বইগুলো! হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি, যাঁকে এতগুলো বছরে কেউ কোন পরিস্হিতিতে কাঁদতে দেখেনি। বাইরে তখন কয়েক জোড়া চোখ অবাক হয়ে তাদের দিদিমণিকে দেখছে!
…………
মা, আমার খুব কষ্ট হয় মা। ভাই কেন আমাকে এভাবে অপমান করে? তোমার মনে আছে, ছোটবেলায় ওকে কোলে নিতে দিতেনা বলে খুব কাঁদতাম। আর আজ! আর কত অত্যাচার সহ্য করতে হবে মা? প্রতিদিন যে একটু  একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি!
তুই একটা ভালো চাকরি পেয়ে আমায় নিয়ে চলে যাবি।
তুমি যাবেনা মা, আমি জানি তুমি যাবেনা। মা, আমি যদি নাও থাকি আমার গল্পের বইগুলো যেন কাউকে দিয়ে দিওনা। ওগুলো আমার প্রাণ, মা।
বইগুলোয় হাত বুলোতে বুলোতে ‘মা’ ডাক খুঁজে চলেছেন বাসন্তী দেবী। সেদিন যদি………
…….
মা, তুমি আমায় চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ যা, তোর জন্যই এত অশান্তি। জানিস তো তোর বাবা আর ভাই তোকে সহ্য করতে পারেনা। তবু বেঁচে আছিস কোন লজ্জায়? আমি হলে তো……..
ঠিক আছে মা, আমি তো তোমার সব কথা শুনি বল। এটাও শুনব!
বুঝতে পারেননি রাগের মাথায় কত বড় কথাটা বলে ফেলেছেন! যখন খেয়াল হল অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছে। না! তাঁর মেয়ে আর ফিরে আসেনি। ফিরে এখছিল লরিতে থেঁতলানো শরীরটা। তারপর আর ওই বাড়িতে থাকতে পারেননি বাসন্তী দেবী। কাকে দোষ দিতেন উনি? কে দায়ী ছিল? বেরিয়ে পড়েছিলেন এইটুকু সম্বল করে। মেয়েটার যে স্বপ্নই ছিল…….
দিদিমণি, ও দিদিমণি, তুমি কেন কাঁদছ? আমার কথায় কষ্ট পেলে?
নীলার মায়াভরা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত আনন্দ হল ওঁর। এ যে তাঁর মেয়েরই চোখ। হ্যাঁ, ওই তো মৌ, রঞ্জা, নূতন সবার চোখ তো ঠিক তাঁর মেয়ের মত!
মেয়ের ফটোর দিকে তাকিয়ে হাসলেন বাসন্তী দেবী। এই তো তাঁর মেয়ের মুখেও আজ হাসি ফুটেছে।
আজ তোদের একটা গল্প শোনাব।
গল্প? হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ! সবাই হৈ হৈ করে উঠল।
এই ছবিটা কার জানিস?
কার?
এক সাহসী রাজকন্যের।
বাইরে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। এক মায়াবী আলোয় চারপাশ ভরে গেছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। ভেতরে তখন চশমা পরা একজন গল্প বলে চলেছে কচিকাঁচাদের। ঠিক এই দৃশ্যটাই তো সে দেখতে চেয়েছিল একদিন। দূরে, সবার অজান্তে গোধূলির আলোর সাথেই একটা ছায়াও মিলিয়ে গেল আস্তে আস্তে!
শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *