লুট – নাদিন গর্ডিমার অনুবাদ:দীপাঞ্জনা মণ্ডল
[লেখক পরিচিতি:– নাদিন গর্ডিমার, প্রখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান লেখক। ১৯২৩ সালের, ২২শে নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নাদিন গর্ডিমার-এর লেখায় মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যজনিত রাজনীতি এবং নীতিগত সমস্যা উঠে আসত। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য নীতি লাগু থাকাকালীন তাঁর “বার্গার’স ডটার” এবং “জুলাই’স পিপল” বই দুখানি নিষিদ্ধ করা হয়। আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেস পার্টি নিষিদ্ধ থাকাকালীন তিনি পার্টির সদস্য ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।]
সে এক প্রবল ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলের হিসেবে যা পৃথিবীতে এযাবৎ তালিকাভুক্ত ভূমিকম্পের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রার।
একটা মহাদেশীয় পাত এই ভূমিকম্পে নড়ে যায়। সচরাচর এই ধরনের কম্পনের ফলে বন্যা হয়, এই মহাকম্পনে ঘটল উলটোটা, সমুদ্র এক ঝটকায় অনেকটা পিছিয়ে গেল। ফলে সমুদ্রতলের ক্ষয়াটে জাহাজ, ঘরবাড়ির কাঠামো, নাচঘরের বাতিদান, কলঘরের আসবাব, জলদস্যুদের সিন্দুক, টিভির স্ক্রিন, ডাকবাহী গাড়ি, বিমানের অবশেষ, কামান, ভাঙাচোরা মার্বেলের মূর্তি, কালাশনিকভ, পর্যটক বোঝাই বাসের ধাতব খোল, ধর্মীয় দীক্ষাপত্র, বাসন ধোয়ার সরঞ্জাম, কম্পিউটার, তলোয়ারের আচ্ছাদনের টুকরো, প্রস্তরীভূত মুদ্রাসহ, পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন অঞ্চল তখন উন্মুক্ত। লোকজন যারা আগে তাদের টালমাটাল বাড়ি থেকে সামুদ্রিক পাহাড়ে ছুটেছিল তারা ফিরল ক্লান্ত পায়ে, তাদের অবাক কৌতূহল ঝাঁপিয়ে পড়ল সমুদ্রতলের বিচিত্র সম্ভারে। স্থলভূমির ভাঙন আর গর্জনের ত্রাসে সব সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। সমুদ্রের জলে ধৌত জিনিসগুলি চকচকে, সময়ের ক্রম তাদের নেই, সময় শুধুমাত্র তারই প্রভাবে কোনও জিনিসকে এরকম পরিবর্তিত করে না—এগুলো সব মিলে একরকম, সবই নষ্ট, সবটা একসঙ্গে লুট করে নেবার মতো।
সুতরাং লোকজন এসব নেবার জন্য ছুটল। নির্দিষ্ট এক সময়ের, সবসময়ের, কোনও এক সময়ের–দামি সব জিনিস; যা কাজে লাগতেও পারে, কি জিনিস ঠিক বোঝাই যাচ্ছে না কিন্তু কেউ হয়তো বুঝবে এমন কিছু, কোনও ধনবানের জিনিস যেটা এখন আমারই, যদি তুমি না নাও অন্য কেউ তো নেবেই, পা পিছলে গেঁথে যাচ্ছিল, জলতলের ওপরে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় সামুদ্রিক আগাছা ছিল তাদের ফাঁকেফোকরে, কেউ খেয়াল করল না এখানে কোনও মাছ নেই, সমস্ত জ্যান্ত বাসিন্দা জলের সঙ্গে সঙ্গে সরে গেছিল। রাজনৈতিক পালাবদলের সময়ে দোকানে লুঠপাট যেমন মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল এ যেন অনেকটা সেরকম। পুরুষ, মহিলা ও শিশু সবাই কাদা আর বালি ঘেঁটে আশ্চর্য দ্রুততায় যা সব তুলে আনছিল তার ভেতরে তারা কী পেতে চাইছে তা-ই তারা জানত না, তবে এটা বস্তুগত লাভের থেকেও বেশি ছিল, কারণ যে প্রাকৃতিক শক্তির কাছে তারা অসহায়ভাবে পরাস্ত এ যেন তাকেই লুঠে নেওয়ার সামিল। নাও, নাও সব; দখল করার সময়ে তারা তাদের নষ্ট হয়ে পড়া বাড়িঘরের কথা ভুলে থাকতে পারছিল, আর ভুলে থাকতে পারছিল সেখানে থাকা নশ্বর সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির কথাও। সেখানে অনুপস্থিত সমুদ্রপাখির কান্নার মতো তীক্ষ্ণ স্বরে নৈঃশব্দ ভেঙে তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিল, আর তাই তারা দূর থেকে আসা বিরাট ঝড়ের আওয়াজ শুনতে পায়নি। আর তার পরেই সমুদ্র গিলে ফেলেছিল তাদের।
দূরদর্শনের পর্দায় আসল ঘটনার সামান্যই আভাস পাওয়া গেছিল, আর বেতারে যে অল্প অশক্ত, দুর্বল আর দূরদর্শী মানুষ পাহাড় থেকে নীচে নেমে আসেনি তাদের সঙ্গে কথোপকথনে কিছু জানা যায়, এবং সংবাদপত্রে সমুদ্রের তার উপকূলে উগড়ে যাওয়া দেহের হিসেব পাওয়া যায়; মোটের ওপর এই ছিল জানার সূত্র।
কিন্তু লেখক তা জানেন যা আর কেউ জানে না, কল্পনা দিয়ে জানার আমূল পরিবর্তন করতে পারেন তিনি।
এখন তাই শোনো, একজন তার সারাজীবনে একটা নির্দিষ্ট (কিছু) জিনিস চেয়েছে। তার প্রচুর সম্পদ, যা কিছু তার চোখে পড়ে প্রায়, ফলে সেইসব সংগ্রহ সে পছন্দ করে, কিছু জিনিস সে লক্ষ করে না ইচ্ছে করেই কারণ সেইসব তার না থাকলেও চলত অথচ না কিনে পারেনি—একটা আধুনিক বাতি যেটায় সে পড়াশোনা করত, বিছানার মাথার দিকে টাঙানো জাপানি চিত্রশিল্পী হোকুসাই-এর বিখ্যাত ‘দুরন্ত ঢেউ’—এমন নয় যে সে প্রাচ্যের জিনিস সংগ্রহ করত, তবে এই ছবি যেহেতু মাথার দিকে টাঙানো তাই এটাকে কেবল ঘর সাজানোর উপকরণের বেশি বলা চলে, এদিকে সেটা তারই দৃষ্টির পিছনে বছরের পর বছর টাঙানো ছিল বিছানার ঠিক মাথার দিক বরাবর। এই-ই সব—নানান জিনিসপত্র—সেই নির্দিষ্ট কিছু-টি ছাড়া।
সমুদ্রতীরবর্তী পাহাড়ে একটা পুরনো কিন্তু সুসজ্জিত বাড়িতে শহরের কোলাহল থেকে দূরে অবসরপ্রাপ্ত, দীর্ঘদিনের বিবাহবিচ্ছিন্ন মানুষটি বাস করত। গ্রামের এক মহিলা বাড়ি সাফসুতরো আর রান্নাবান্না করত এবং অবশ্যই আর কোনওভাবে মালিককে বিরক্ত করত না। উত্তেজনার থেকে মুক্তির আশীর্বাদপ্রাপ্ত এই জীবন, ও ধরনের ঝামেলার জীবন সে কাটিয়েছে, সে উত্তেজনা আনন্দের হোক বা না হোক; কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গিতে এরকম কখনও ঘটেনি, সম্মতিক্রমে তো নয়ই, শুধু বাধ্য হয়েই কাটিয়েছে যতটুকু যা। যারা—সমুদ্রের উজ্জ্বল তটে জঞ্জালে পরিণত সম্পদ, যা সব একরকম, উন্মুক্ত ও অতীত—তার জন্য কেবলই ছোটাছুটি করছিল, সে তাদেরই একজন।
বাকি সব লুটেরা যাদের মতো সে একেবারেই নয়, যাদের সঙ্গে তার কোনও মিলই নেই তাদেরই মতো করে— চীনেমাটির নকশাদার খোলামকুচি, ধ্বংস-নির্মিত ভাস্কর্য, বর্জ্য ও মরচে, নোনা জলে গেঁজিয়ে ওঠা মদের পিপে, একটা ডুবে যাওয়া রেসিং মোটরসাইকেল, দন্তচিকিৎসার চেয়ার—একটা জিনিস থেকে সে অন্য আরেকটায় ছুটে ছুটে যাচ্ছিল, অজান্তে তার পা পড়ছিল ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা মানুষের পাঁজরের আর পায়ের পাতার হাড়ে। কিন্তু সে অন্যান্যদের মতো উন্মুক্ত সব জিনিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি ততক্ষণ, যতক্ষণ সেই নির্দিষ্ট জিনিসটি (আয়না?) পায়, সামুদ্রিক কমলা-বাদামি শৈবাল দিয়ে সুসজ্জিত বেণীবদ্ধ যেটি, শুক্তি আর খাঁজকাটা লাল প্রবাল দিয়ে আঁটো করে বাঁধা। এটা যেন বাস্তবায়িত এক অসম্ভব; সে জানত ওটা কোথায় থাকার কথা, সমুদ্রের গভীরে, কিন্তু জানত না কী সেই জিনিস, ফলে আগে কখনও এটা খুঁজে পায়নি সে। যা কখনও ঘটেনি তেমন কোনও ঘটনা ঘটলেই একমাত্র এটা পাওয়া যেতে পারত, যেমন এই হঠাৎ প্রবল প্রক্ষোভ—রিখটার স্কেলের হিসেবে যা পৃথিবীতে এযাবৎ তালিকাভুক্ত ভূমিকম্পের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রার।
সে ওই জিনিসটি তুলে নিল, আয়নাটির থেকে বালির ঝিকমিক ঝরে পড়ল, গড়িয়ে গেল চকচকে জল, সে নিজের সঙ্গে নিল আয়নাটি, শেষ অব্দি অধিকারে পেল ওকে।
এবং তখনই যেন তার বিছানার মাথার দিকের ছবির থেকে সেই ‘দুরন্ত ঢেউ’ এসে তাকে ভাসিয়ে নিল।
তার নাম রাজধানীতে ভূতপূর্ব শাসকগোষ্ঠীতে পরিচিত ছিল, সে নাম এখন বেঁচে থাকা মানুষদের তালিকায় রইল না। তার কঙ্কাল অন্য সব সদ্য নিহতদের সঙ্গে, প্রাচীন জলদস্যু আর জেলেদের সঙ্গে, স্বৈরতন্ত্রের কালে উড়োজাহাজ ভেঙে যারা পড়েছিল তাদের সবার সঙ্গে সমুদ্রে মিশে গেল এমনভাবে যে আর কোনোদিন তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। কে তাদের আলাদা করবে, তারা কোথায় আর রইল আসলে, শুধুই ওই দিনটায়?
কোনও ফুল ভাসল না স্মৃতিতর্পণের।
অতল জলে তলিয়ে গেল সমস্ত।