কমলা ভট্টাচার্য – সুমন চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

১৯ মে, ১৯৬১ কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে রাইফেলের গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে কমলা ভট্টাচার্যসহ ১২ জন বাঙালি তরুণ একের পর এক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এই ১২ জনের মধ্যে ৯ জন ঘটনার দিন এবং পরবর্তী সময়ে আরও দু’জন তরুণ তাজা প্রাণ মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঘটনার দিন যে ৯ জন শহীদ হন তারা হলেন :কানাই লাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। ঘটনার দু’দিন পর অর্থাৎ ২১ মে যে দু’জন শহীদ হন তারা হলেন : বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্র দেব।

উল্লেখিত ১১ শাহাদতবরণকারীদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক। তিনি ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রামরামান ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম সন্তান কমলা। কমলা ভট্টাচার্যদের আদি নিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে কমলা ও তার পারিবারের অন্যান্য সদস্য বাংলাদেশ ছেড়ে আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে চলে যায় এবং শিলচর পাবলিক স্কুল রোডে বসবাস শুরু করেন। কমলা শিলচরের চোতিলাল সেন ইন্সটিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ১৮ মে ১৯৬১ সালে তার মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়। চলমান ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে কমলা বরাবরই সচেতন ছিলেন। এ কারণে তিনি মেট্রিক পরীক্ষার পর আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন বলে মনস্থির করেন। ১৯ মে হরতাল শুরু হলে শিলচরের তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান ধর্মঘটে অংশগ্রহণের জন্য সেদিন সকালে যখন তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার বড় বোন প্রতিভা সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে তাকে ধর্মঘটে যেতে নিষেধ করেন। এরপরও এই মহীয়সী সাহসী নারী তার বড় বোনের নিষেধ উপেক্ষা করে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য বেরিয়ে পড়েন। কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী কমলার এই সংগ্রামী চেতনায় খুশি হন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পুলিশের টিয়ার গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এক টুকরো কাপড় কমলাকে ধরিয়ে দেন। কমলার সঙ্গে কমলার ছোট বোন মঙ্গলাও বেরিয়ে পড়ে ধর্মঘটে অংশগ্রহণের জন্য। অবস্থান ধর্মঘটকালে আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা যখন লাঠিচার্জ শুরু করে, তখন মঙ্গলা সেই লাঠির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। ততক্ষণে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে কমলা তার বোনের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে গেলে একটি বুলেট তার চক্ষু ভেদ করে মাথায় আঘাত করে এবং মুহূর্তে কমলা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এভাবেই বাঙালির প্রথম নারী ভাষাসৈনিক মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মাহুতি দেন। ভাষার জন্য কমলা ভট্টাচার্যের সেদিনের সেই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ সমগ্র বাঙালি নারী সমাজকে করেছে মহিমান্বিত।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *