কল্পবিজ্ঞান ও সত্যজিৎ – দীপ্তজিৎ মিশ্র

কল্পবিজ্ঞান ও সত্যজিৎ – দীপ্তজিৎ মিশ্র

শেয়ার করুন

বাংলা সাহিত্যে যেসব ঘরানা নিয়ে কাজ করা হয়, তার মধ্যে কল্পবিজ্ঞান বড়োই অবহেলিত বিষয়। বহু তথাকথিত প্রথিতযশা সাহিত্যিক কল্পবিজ্ঞানকে মূল ঘরানার সাহিত্য বলেই গণ্য করেন না, এমন ব্যাপারও এখন সহজেই পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই ঘরানাতেই একের পর এক মৌলিক গল্প লিখে গিয়েছেন সঙ্কর্ষণ রায়, অদ্রীশ বর্ধন, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো মানুষরা। কিন্তু এঁদের পাশাপাশি আরও একজন মানুষ এই বিশেষ ঘরানা নিয়ে নিয়মিত চিন্তা করে গিয়েছেন তাঁর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে বসে। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। তিনি ছিলেন বহুমুখী মানুষ। কাজেই, রহস্য, ভূত, সামাজিক ইত্যাদি ঘরানার সঙ্গে সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানের মতো আধুনিক ঘরানাতেও তাঁর বিচরণ ছিল অত্যন্ত সাবলীল।

তবে একটি-দু’টি কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখেই তিনি থেমে যাননি। এই বিষয় নিয়ে প্রভূত পরিমাণে চর্চা করেছেন তিনি। মননে ও যাপনে অত্যন্ত মাত্রায় আধুনিক না হলে এই কনসিসটেন্সি বজায় রাখা সম্ভব হয় না। শ্রীরায় শুধু কনসিসটেন্সিই বজায় রাখেননি, তার সঙ্গে, প্রতি কাহিনিতেই নিজের ভাবনাকে ক্রমে আধুনিক করে তুলেছেন তিনি।

১৯৬২ সালে সন্দেশ পত্রিকায় বেরোল তাঁর প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। দুটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এই বড়ো গল্পটি। এই কাহিনির নায়ক প্রফেসর শঙ্কু একজন আবিষ্কারক, তথা গবেষক। একটা কাহিনি লেখার মধ্যে দিয়েই শ্রীরায় দেখিয়ে দিতে পেরেছিলেন, তাঁর কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, কল্পনার ঘোড়া লম্বা রেসের জন্য তৈরি। প্রথম কাহিনিতেই প্রফেসর শঙ্কুর নানা আবিষ্কার তো তিনি দেখানই, একই সঙ্গে তিনি তাঁকে রওনা করিয়ে দেন মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী হয় তাঁর চাকর, পোষা বেড়াল নিউটন এবং তাঁর বানানো প্রথম রোবট বিধুশেখর! একই গল্পে কেবলমাত্র মহাকাশযাত্রা দিয়েই সেরে দেননি শ্রীরায়। ভিনগ্রহীরা তো ছিলই, যন্ত্রমানবও হাজির। শঙ্কুর বেড়াল নিউটনের মহাকাশযাত্রা এবং তার ছবি দেখে মনে হয়, এই কাহিনীঈ লেখার কিছু বছর আগে প্রকাশিত ষোড়শ টিনটিন কাহিনীই ‘Destination Moon’-এ কুট্টুসের স্পেসস্যুট দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।

যাই হোক, শঙ্কু দিয়ে শুরু হলেও, বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক ছোটোগল্পও লিখেছিলেন শ্রীরায়। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ প্রকাশিত হওয়ার একমাস বাদেই প্রকাশিত হয় শঙ্কু ব্যতীত তাঁর প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’। আগের কাহিনিতে পৃথিবীর বাইরে অভিযানে পালা সাঙ্গ হয়েছে। কাজেই, এবার পৃথিবীতে ভিনগ্রহীর আসার পালা। সে জন্য উড়ন্ত চাকতি, একটি কাল্পনিক গ্রহ এবং তারই এক নিরামিষাশী বাসিন্দার অবতারণা করা হল এই কাহিনিতে। তবে সাধারণত এই দুই উপাদান থাকা কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে দেখা যেত যে এই গ্রহান্তরের মানুষরা পৃথিবীর অপকার করতে আসছে। কিন্তু এই কাহিনিতে আসা এলিয়েনকে তিনি নিতান্তই এক মহাকাশ পর্যটক হিসেবে দেখিয়েই ক্ষান্ত দেন। তবে উপকারী গ্রহান্তরের জীবের কথাও উনি লিখেছিলেন, সে আলোচনা যথাস্থানে হবে। আপাতত পরবর্তী কাহিনির দিকে চোখ রাখা যাক।

‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ প্রকাশিত হওয়ার পরের মাসেই সন্দেশের জন্য আরও একটি কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি লেখেন শ্রীরায়। কাহিনির নাম ছিল ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম’। টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে শ্রীরায়ের এই প্রথম লেখা। পরবর্তীকালে এই উপাদানটিও ঘুরে ফিরে এসেছে। তবে, টাইম ট্র্যাভেলের মাধ্যম বারে বারে বদলে গিয়েছে।
এর পর প্রায় এক বছরের ব্যবধানে আবার ফিরে এলেন প্রফেসর শঙ্কু। আবারও সন্দেশের পাতাতেই ফিরলেন। এবারের কাহিনির মধ্যে লর্ড কারনারভন এবং তুতানখামেনের অভিশাপের কাহিনির ছায়া স্পষ্ট।

শুরু হল প্রফেসর শঙ্কুর জয়যাত্রা। একের পর এক শঙ্কু কাহিনি প্রকাশিত হতে লাগল প্রথমে সন্দেশের পাতায় ও পরে আনন্দমেলাতেও। প্রথমদিকে শঙ্কুর মধ্যে প্রভাব ছিল স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের সৃষ্ট চরিত্র প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের। যত সময় গিয়েছে, প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের সত্তা থেকে বেরিয়ে এসে গিরিডিবাসী এই আত্মভোলা ভদ্রলোক এক নব্য সত্তায় পরিণত হয়েছেন।

শঙ্কু কাহিনির ধারাবাহিক বিবরণ নিয়ে আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। প্রতিটি কাহিনিতেই নানা নতুন আবিষ্কার করেছেন প্রফেসর শঙ্কু। একই সঙ্গে, বিভিন্ন অভিযানে তাঁর সঙ্গী হয়েছে ওঁর প্রিয় কিছু আবিষ্কার—তার মধ্যে রয়েছে সর্বরোগহর মিরাকিউরল বড়ি, ক্ষিদেতেষ্টা মিটিয়ে দেওয়া বটিকা ইন্ডিকা, আত্মাদর্শনের জন্য নিওস্পেকট্রোস্কোপ, ‘পাখিপড়া’ বোঝানোর জন্য অরনিথন, সর্বোপরি নিশ্চিহ্নাস্ত্র অ্যানাইহিলিন। প্রতিটা শঙ্কু কাহিনি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বয়স বেড়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে অভিজ্ঞতাও। সে জন্য প্রতিটি নতুন কাহিনিতে আগের চেয়ে একটু হলেও বেশি প্রাজ্ঞ হয়েছেন শঙ্কু।

এবার শঙ্কু ছাড়া শ্রীরায়ের অন্যান্য কল্পবিজ্ঞান কাহিনির ব্যাপারে বাকি থেকে যাওয়া আলোচনাটা সেরে নেওয়া যাক।

১৯৬৫ সালে ‘আশ্চর্য’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় তিনি লিখলেন ‘ময়ূরকণ্ঠী জেলি’। কল্পবিজ্ঞান ও সামাজিক কাহিনির এক অদ্ভুত মিশেলে বিবেক দংশনের কাহিনি ছিল এটি। শ্রীরায় ছোটোগল্প লিখতেন মূলত ছোটোদের জন্য। কিন্তু, ‘ময়ূরকণ্ঠী জেলি’ তাঁর হাতে গোনা বড়োদের কাহিনির মধ্যে অন্যতম।

তার পরের বছর প্রেমেন্দ্র মিত্র, অমিতাভ রায়চৌধুরী, অদ্রীশ বর্ধন ও শ্রীরায় মিলে একটি বারোয়ারি কাহিনি সৃষ্টি করেছিলেন। তার নাম ‘সবুজ মানুষ’। সেই কাহিনিটিকে নাট্যরূপ দেওয়া হতে সেটি আকাশবাণীর ‘সাহিত্যবাসর’ অনুষ্ঠানে সম্প্রচারিত হয়েছিল।

কিন্তু এর পর শঙ্কু সিরিজ লেখার চক্করে শঙ্কু ব্যতীত অন্য কল্পবিজ্ঞান কাহিনি প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। তবে, আগুন কি আর চাপা থাকে? ১৯৭২ সালের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় আবার একটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনি প্রকাশিত হল। এই কাহিনিটিকে কেবলমাত্র কল্পবিজ্ঞান বলা যায় না। একই সঙ্গে ক্রসওভারও বটে। বাবা সুকুমার রায়ের বিখ্যাত সৃষ্টি হিজিবিজবিজ, ষষ্ঠীচরণ পালোয়ান, খিচুড়ির জীবজন্তু এবং আবোলতাবোলের অন্যান্য চরিত্রদের নিয়ে সুকুমারপুত্র মানিক লিখলেন ‘প্রফেসর হিজিবিজবিজ’।

এই লেখার পর আবার কল্পবিজ্ঞান গল্প লেখায় টানা ডুব। যদিও শঙ্কু প্রতি বছরই বেরোচ্ছে। ১৯৮৬ সালে আবার নতুন কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি লিখলেন আনন্দমেলার মাসিক সংখ্যায়। কাহিনির নাম ‘অনুকূল’। ততদিনে প্রফেসর শঙ্কু দুটি রোবট (বিধুশেখর ও রোবু) এবং একটি কম্পিউটার (কম্পু) বানিয়ে ফেলেছেন। এবার শ্রীরায় যে কল্পবিজ্ঞান কাহিনীটি লিখলেন, সেই কাহিনি অনুযায়ী কলকাতার বাজারে ভৃত্যস্বরূপ রোবট পাওয়া যায়। মধ্যবিত্তরাও যাতে কিনতে পারেন, সে জন্য ইএমআই ব্যবস্থাও রয়েছে। সময়ের থেকে এতখানি এগিয়ে কল্পনা বোধহয় কেবলমাত্র শ্রীরায়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল। এটিই ছিল শঙ্কু সিরিজের বাইরে সত্যজিৎ রায়ের লেখা শেষ কল্পবিজ্ঞান কাহিনি। আবার একদিক থেকে দেখলে এই কাহিনির মধ্যে কিছুটা ডিস্টোপিয়ার প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়।

তবে এই হার্ডকোর কল্পবিজ্ঞান ছাড়াও শ্রীরায়ের আরও বেশ কিছু কাহিনিতে কল্পবিজ্ঞানের প্রভাব পড়েছে সচেতনভাবে। এক এক করে আলোচনা করা যাক।

সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম বিখ্যাত এক গল্প হল ‘সেপ্টোপাসের ক্ষিদে’। এই গল্পটির ছায়া অবলম্বনে পরবর্তীকালে আন্দাজ তিন থেকে চারজন লেখক একটি করে মৌলিক কাহিনি লিখেছিলেন। এই সেপ্টোপাস হল এক মাংশাসি গাছ। তাতে কোনো সমস্যা নেই, কারণ এই ধরনের গাছ প্রকৃতিতে বিদ্যমান। তারা সাধারণত পাখিজাতীয় জীবকে ফাঁদে ফেলে তার জীবনরস শুষে ছেড়ে দেয়। কিন্তু শ্রীরায় ব্যাপারটা কল্পবৈজ্ঞানিক করে দেন এই বলে যে এই সপ্তশুঁড় বিশিষ্ট গাছ খালি মাংশাসিই নয়, যে কোনো প্রাণীর মাংসে তাদের অনীহা নেই। তার চেয়েও বড়ো কথা, এই সেপ্টোপাস মানুষের মতো ভাবতে পারে।

সাধারণ ঘটনাকে অসাধারণভাবে ভাবার এক অসামান্য ক্ষমতা ছিল শ্রীরায়ের। সেপ্টোপাসের ক্ষিদেতে তিনি যেভাবে এই বিষয়টিকে আনেন, সেরকমভাবেই সাধারণ ব্যাপারকে অসাধারণ করে তিনি আরও একটি কাহিনি লিখেছিলেন—‘বৃহচ্চঞ্চু’।

এ কাহিনির নায়ক তুলসীবাবু কবিরাজির পাতা খুঁজতে দণ্ডকারণ্যে গিয়ে এক অতিকায় মাপের ডিম দেখতে পান। অদ্ভুত ব্যাপার, তাঁদের উপস্থিতিতেই সেই ডিম ফুটে বেরোয় এক অতিকায় পাখির ছানা—বৃহচ্চঞ্চু। কাহিনি এগোতে থাকে কাহিনির মতো। কাহিনির প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে পাঠক জানতে পারেন, এ ভয়াল পাখি হল অ্যান্ডালগ্যালর্নিস। যা কিনা বহুকাল আগেই পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গিয়েছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কী করে তুলসীবাবু এ পাখির ডিম এমন এক সময়ে পেলেন, যখন কিনা পৃথিবীতে সে পাখির অস্তিত্বই নেই! তাহলে কি টাইম ট্র্যাভেল! পাঠকের মনে দোলাচলের ছাপ রেখে কাহিনি শেষ হয়। একই সঙ্গে প্রশ্ন রেখে যায়, এক সাধারণ গল্পের আড়ালে এ গল্প কি কল্পবিজ্ঞান নয়?

এরকম কল্পবিজ্ঞানের ছায়াযুক্ত আরও একটি কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়, যার নাম ‘ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট’। সত্যজিৎভক্ত মহলে তাঁর যে সব কাহিনি বিশেষ চর্চিত হয় না, এটি তার মধ্যে একটি। এই ‘ম্যাকেঞ্জি ফ্রুট’ মূলত একটি সামাজিক গল্প হলেও এই গাছের চারিত্রিক গুণাগুণের বিবরণ শুনলে বোঝা যায়, এই গাছই হল এই কাহিনির মূল কল্পবিজ্ঞান উপাদান।

তবে শুধু খাতায় কলমে কাহিনিই নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণেও কল্পবিজ্ঞানকে আনার পরিকল্পনা তাঁর ছিল। তিনি জানতেন, বাংলা সাহিত্য পাঠক এবং বাংলা ছবির দর্শকের যা দৈন্যদশা, তাতে উচ্চমানের কল্পবিজ্ঞানের ছবি না চলার সম্ভাবনাই বেশি। সে জন্য, তিনি সিদ্ধান্ত নেন হলিউডে তৈরি করবেন এই ছবি। ছবির কাহিনির জন্য বেছে নিলেন তাঁর লেখক জীবনের প্রথম দিকে লেখা ছোটোগল্প ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’-কে। এর চিত্রনাট্য তিনি লিখে ফেলেছিলেন ১৯৬৭ সালেই। ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ এই কাহিনির মূল ভিত্তি হলেও এর বাইরে বহু কল্পবিজ্ঞানের উপাদান এসেছিল। এখানে ভিনগ্রহীর জন্য যে যানটির পরিকল্পনা তিনি করেন, তা ভেতর থেকে দেখলে মনে হত এক মানুষের শরীরের অভ্যন্তর। এই কাহিনি শুনে স্টার আর্থার সি ক্লার্ক তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে কাজ শেষ করতে বলেন। কলকাতায় পুরো চিত্রনাট্য লেখা হয়ে যাওয়ার পরে ঠিক হয়ে গিয়েছিল প্রধান চরিত্রাভিনেতাও। কিন্তু তাঁর হয়ে যে ভদ্রলোক মধ্যস্থতা করছিলেন, তিনি বেশ কিছু গোলযোগ করায় ছবিটি আর শেষ অবধি হয়নি। বলা যায় না, হয়তো এই ছবির জন্য সেরা কল্পবিজ্ঞান ছবির শিরোপা আসত ভারতের ঝুলিতে।

কিন্তু এই ব্যাপারটা এখানে শেষ হয়নি। বিখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা কলম্বিয়া কোম্পানি এই ছবিটিতে টাকা লগ্নি করবে—এরকমই ঠিক ছিল। সে জন্য ছবির বহু মিমিয়োগ্রাফ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কলম্বিয়া কোম্পানির অফিসে। এ ছবি নির্মাণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে সেই মিমিয়োগ্রাফের কথা ভুলে গিয়েছিলেন শ্রীরায়। স্টিভেন স্পিলবার্গ এই মিমিয়োগ্রাফগুলি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বানিয়ে ফেলেন ‘ই.টি.’। সেই ছবিটি দেখে যখন আর্থার সি ক্লার্ক সবিস্তারে শ্রীরায়কে ব্যাপারটা জানান, তখন তিনি বলেন, ‘এখন আর এলিয়েন বানানো সম্ভব নয়। আমি এখন এলিয়েন বানালে সবাই বলবে আমি স্পিলবার্গের থেকে টুকেছি। কিন্তু ব্যাপারটা আদতেই উলটো।’

এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরেও শ্রীরায় কল্পবিজ্ঞানের ছবি নির্মাণের আশা ছাড়েননি। আশির দশকে দূরদর্শনের পর্দায় শুরু হয় ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’। পরিচালনা সন্দীপ রায়ের। কিন্তু ভাষাটা বাংলা নয়, হিন্দি। তার দ্বিতীয় সিজনে তিনি ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ অবলম্বনে ‘বন্ধু’ প্রযোজনা করেন। পুত্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও চিত্রনাট্য করে দিয়েছিলেন শ্রীরায় নিজেই। তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে এভাবে জলাঞ্জলি দিতে চাননি তিনি।

নিজের আশেপাশের বহু মানুষের তুলনায় সময়ের দিক থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন শ্রীরায়। কল্পবিজ্ঞান বিষয়টিকে সাদরে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। এই বিষয়ে নানা প্রবন্ধ লেখালিখিও করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এছাড়া, আকাশবাণীতে একবার প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সঙ্কর্ষণ রায়ের সঙ্গে এক আলোচনা সভায় তিনি এ বিষয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ মতামতও রাখেন।

কল্পবিজ্ঞান নিয়ে তাঁর সেই আশা পূরণ হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী ও বাংলা সাহিত্য পাঠক-লেখক জগতে বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান অনুরাগীও তৈরি হয়েছে। এমনকি, এখন এমন পাঠক ও লেখক দেখা যায়, যাঁরা কল্পবিজ্ঞান ছাড়া আর কিছু পড়েন না বা লেখেন না। এই ধারাকে জিইয়ে রেখেছে কল্পবিশ্বর মতো ওয়েবজিন, তথা প্রকাশনা। আশা করা যায়, আগামীতে এই ধারা শাখাপ্রশাখায় আরও বৃদ্ধি পেয়ে বাঙালির কল্পবিজ্ঞান চর্চাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২