কাহিনি একটি শরণার্থীশিবির – অরিত্র সান্যাল

কাহিনি একটি শরণার্থীশিবির – অরিত্র সান্যাল

শেয়ার করুন

একটা সাদা কালো সুর শোনা যাচ্ছে কি?

মনোভঙ্গির মতো শীর্ণ একটা গাছ, 

হৃদয়ের মতো অপূর্ব এক যতি,

আর বহুক্ষণ নিয়ে ভূমিষ্ট হচ্ছে দুঃখের জগত।

একটা সাদা কালো সুর শোনা যাচ্ছে কি?

আমি দেখেছি, প্রতিটা দুঃখের তিনটি করে মা থাকে।

একটি সেই কুকুর, ছোটোবেলার গল্প থেকে 

অনেকদূর তাড়া খেয়ে

যে আজ রাত্রি অব্দি দিগন্তের পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। 

একদিন আচমকা সে নিজের মুখোমুখি চলে আসায়

জগত ছিটকে পড়ল সেই পুরোনো গল্পতে–

ছিল এক বিম্ব আর ছিল তাকে পেরিয়ে যাবার সাঁকো।

ছিল খুব সহজ ধীবর এককালে।

এককালে মানুষের মন থেকে ভেসে আসত চেরিফল স্বাদ।

ছলো-ছলো ক্লান্ত ধীবর এক, 

সারা গায়ে অতিকায় যুদ্ধের পাথর শুকোচ্ছে–

ক্ষমা করো, দূর হিম অন্যমনস্কতার দেশ,

ক্ষমা করো, কাউকে বলিনি,

প্রথম যে হিমবাহ, তা ছিল মানুষের চোখের ভিতর।

দুধ-রঙা করুণার রসে যারা গোসল করতে যায় তারপর থেকে,

ফেরেনি। নীরবতার এক অদ্ভুত জন্ম ছিল সে না-ফেরা–

হু হু অন্ধকারে উন্মত্ত স্কেচের একটি ঘোড়া 

হেঁটে চলেছে, সমস্ত দেওয়াল জুড়ে। 

দুঃখের মা।

বাইরে তখন কল্পনার বন্য থৈ থৈ–

গাছেদের পাতায় পাতায় উদ্ধৃত চাঁদের আলো–

কুপিত নিঃশ্বাস হয়ে আছে হাওয়া।

এই প্রাচীন দেবতাময় মুহূর্তে সামান্য একটি বাড়ি–

প্রণামে জড়ো করা অসহায় দুই হাত হয়ে 

কম্পমান। সেই প্রণামকে, এই সর্বস্ব প্রণামকে 

সমস্ত চেতনা নত হয়ে মা বলে ডেকে উঠল।

খুব ধীর প্রলয়ে সেতার বেজে চলেছে তখন।

কিছু একটা হবে এবার–

মূলত আর্তদের আশ্রয় দিতেই

এই গল্প–

সামান্য অবতারণার মধ্যেই 

একটি কূলভাঙা সংসার এঁটে যায়।

উঁচু খাটের ওপর জীবনের নাড়ি নক্ষত্র, বাক্সপ্যাঁটরা

এসে জমা হয়েছে।

কার শীতল মনোযোগের মতো চাঁদের আলো?

পাখির কেমন মৃত্যুর মতো চঞ্চল ওই ছায়া?

অন্ধকারকে সুরের মতো বাজিয়ে তুলছে কে?

ঘরের মেঝে অব্দি জল থৈ থৈ লাল–

এই রাত্রি নিকষ জল করপুটে–

এখান থেকেই সূর্য বেরিয়ে আসবে সকালে!–

ভাবা যায় না। 

নদী ঘরের ভেতর ঢুকে এসেছে তখন।

একে একে দুঃখের মায়েদের ছায়া জমছে

ঘরের কোনায়। 

ক্ষমা ভিক্ষার মতো সজল হয়ে উঠেছে

ঘরের চাল। তুমি কি দেখতে পেলে

জীবনের ভিজে চোখ, ধ্যাবড়ানো কাজল–

রাত্রির মতো ফিকে হয়ে আসছে?

সেই পবিত্র ব্রাহ্মমুহূর্তে যখন সবকিছুই শিরোধার্য–

ধীবর পাগলের মতো তার অদৃষ্ট ঠুকছে–

তার স্মৃতি থেকে আঁখিকোটর অবধি 

কয়েকটি দানো হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে এগিয়ে এল।

হিম বেড়ে যাচ্ছে সর্বত্র। 

অন্ত্যমিলের মতো আমি শুয়ে ছিলুম দুজনের মাঝে।

পুরুষ গভীর রাত্রে উঠে যায় মাছের সন্ধানে,

আর, আর মায়ের পাশ থেকে গড়িয়ে

হাঁটুজলে আমি ডুবে গেলাম–

শুনেছি বাইরে তখন নানা আকারে স্বপ্ন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে,

জোনাকির মতো জ্বলছে নিভছে আওয়াজ।

ধীবর দেখল মগ্ন হয়ে থাকা ভূখণ্ডে 

লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ চকচক করছে।

তারাদের স্রোতের বিপরীতে জোর সাঁতার কাটছে

কয়েকটি উজ্জ্বলতর আদি মীন–

গামছা পেতে তাদের ধরা যাবে না–

আঁজলায় বারংবার অন্ধকার উঠে আসছে।

যে অন্ধকার ব্যপ্ত চরাচরে 

একটি দো-চালা শরনার্থী শিবির,

দুঃখের। ধীবরের হাত হারিয়ে গেছে 

মহাশূন্যে। 

মহাশূন্য হাতে তাই ঘরে ফিরে আসা।

সময় এবার নিজের সমস্ত প্রার্থনা ঘনিয়ে তোলে। 

সমস্ত ছায়া ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে

আবর্তন অনুসারে।

নদীর জল ঘরের ভিতর আলোড়িত দেখে

ধীবর, তৎক্ষণাৎ উল্লসিত, বঁড়শি দিয়ে বিদ্ধ করল

অন্ধ জ্যোৎস্নালোক–ক্ষণমুহূর্তের জন্য, তারপর, 

সেতার থেমে গেল।

কাহিনি বিপদসীমা অতিক্রম করছে দেখে

ঘোড়াটি এগিয়ে দিল লাল রং–

যা সে চুরি করে এনেছিল দূর যুদ্ধের ছবি থেকে। 

বঁড়শিটি জল থেকে তুলতেই সব অস্পষ্ট।

বরফমানব রে রে করে দাপিয়ে নামল 

চোখ থেকে।

প্রতি ঝড়ের শেষ বিদ্যুৎচমকের লেজ ধরে খেলাধুলো করতে

একটা বুড়ো আকাশে উড়ে যায়–

মেঘের ভিতর বঁড়শি বিঁধিয়ে দেবতারা

তাকে তুলে মেপে নেয় জগতের ভাবগতিক, দুঃখ দুর্দশা।

ঘুমন্ত শরীর মায়ের–

দুই তরল স্তন সদ্য জেগে উঠেছে, 

তীব্র তার হ্রেষাধ্বনি

ক্লান্ত ধীবর শেষ দৃশ্যটি

মনে করতে চেষ্টা করে–শেষ দৃশ্যে 

আমি যদি মাছ হতাম– 

এই সংসার বেঁচে যেত।

আমায় ক্ষমা করো

আমায় ক্ষমা করো

দুঃখের দিগন্ত আমি বাড়িয়ে দিলুম

একটি মুহূর্তের জন্ম–একটি মুহূর্তের কাঁটা

চিরতরে বিঁধে আছে মানুষের ভিতর।

বঁড়শি তুলতেই চোখ ঝলসে যাচ্ছে–

একটি স্তব্ধ শিখা গেঁথে আছে দেখে

ডুকরে উঠে মাছ হয়ে যেতে চাইল মা–

পিতা, যন্ত্রণায় মুগ্ধ,

ইতিহাসের বড়ো বড়ো যুদ্ধের কথা ভাবছে,

ভাবছে সামান্য বেঁচে থাকার আয়োজন হিসেবে

কত বৃথা ছিল পৃথিবীতে এত এত শূন্যতার জন্ম দেওয়া।

ভাবছে আর সন্তানকে বঁড়শি থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে, হতভম্ব,

অতঃপর রেখে আসছে গভীর বরফের দেশে।

যদি সে কোনোদিন ফিরে আসে,

অতিকায় তুষারমানব হয়ে–

অশ্রুর মতো সে গলে পড়বেই–

মিশে যাবে নদীর জলে–তাকে চিনে নিতে ক্লেশ হবে না।

কিন্তু আপাতত আমাদের প্রয়োজন নিদ্রার, 

খুব ভারী নিদ্রা যাতে স্বপ্নোদয়ের তাড়া নেই।

আমরা নিদ্রা যাই–আমাদের মন এখন গভীর 

অরণ্যের ভিতর ফলের মতো পচে গিয়েছে–

এই আমাদের জীবন–একটি প্রণাম যা মাত্র ধারণ করতে পারে–

চতুর্দিক তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের ঝাঁঝরা করে দিয়েছে–

একটি দুঃখের মা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আছে তার মধ্যেই–

এখন একটি বিশাল মাছ সূর্য আড়াল করে এল

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২