|

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ২১ )

শেয়ার করুন

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব–একুশ

দুপুরের একটু পরে সেখানে এক তরুণ এলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সিনেমার হিরো। গায়ের রং অত্যধিক সাদা, রোদে ট্যান হওয়া চামড়া, চোখদুটো রহস্যময় নীল আর হারমোনিয়ামের মতো গম্ভীর গলার স্বর। আমরা কথা বলছিলাম অনতিবিলম্বে প্রকাশিত হবে যে পত্রিকা তাই নিয়ে। কথা বলতে বলতে তিনি টেবিলক্লথের উপর মাত্র ছ’টা লাইনে একটা লড়াইয়ের ষাঁড়ের স্কেচ এঁকে তার নীচে ফুয়েনমাইয়োরের জন্য একটা ছোট্ট বার্তা লিখে সই করে দিলেন। তারপর পেনসিলটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিয়ে সজোরে দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন। আমি নিজের লেখার মধ্যে এতটাই ডুবে ছিলাম যে ছবির নীচে কী নাম লিখলেন সেটাও খেয়াল করিনি। এভাবেই সারাদিন ধরে লিখে চললাম, খাবার পর্যন্ত খাইনি। তারপর বিকেলের আলো নিভে এলে নতুন উপন্যাসের প্রথম খসড়া নিয়ে আমি বেরোলাম। মনে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, কিন্তু বেশ খুশি খুশিও লাগছে। কারণ একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম যে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যে উপন্যাসটা লিখছিলাম, অথচ কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলাম না, শেষ পর্যন্ত তা লেখার জন্য একটা ব্যতিক্রমী পথ খুঁজে পেয়েছি।

সেদিন রাতে জানতে পারলাম যে দুপুরে যে তরুণ এসেছিলেন তিনি শিল্পী আলেহান্দ্রো ওব্রেগোন। তাঁর বহু ইউরোপ ভ্রমণের একটি সাঙ্গ করে সদ্য ফিরেছেন। তিনি যে শুধু কলোম্বিয়ার শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের অন্যতম ছিলেন তাই নয়, বন্ধুদের কাছেও ছিলেন ভীষণ প্রিয় একজন মানুষ। নির্ধারিত সময়ের আগেই দেশে ফিরে এসেছেন শুধুমাত্র ‘ক্রোনিকা’ পত্রিকার উদ্বোধনে উপস্থিত থাকার জন্য। তাঁকে দেখতে পেলাম বাররিয়ো আবাহো এলাকায় লা লুস লেনে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে বসে আছেন। রেস্তোরাঁটার কোনো নাম ছিল না। আলফোনসো ফুয়েনমাইয়োর তার নাম রেখেছিলেন গ্রাহাম গ্রীনের সদ্য প্রকাশিত একটা বইয়ের নামে–‘তৃতীয় ব্যক্তি’। আলেহান্দ্রোর দেশে ফেরা সব সময়েই ছিল একটা বিরাট ঘটনা আর সেই রাতেরটা তুঙ্গে পৌঁছল এক প্রশিক্ষিত ঝিঁঝিঁপোকার প্রদর্শনীতে। পোকাটা মানুষের মতোই তার প্রভুর সমস্ত নির্দেশ পালন করছিল। সে দু-পায়ে দাঁড়াল, ডানা ছড়াল, তালে তালে শিস দিয়ে গান গাইল এবং সবশেষে নাটকের মতো ঝুঁকে সবার অভিনন্দন গ্রহণ করল। এবার সেই রিং মাস্টার প্রচুর হাততালিতে বিভোর হয়ে আঙুলের ডগা দিয়ে পোকাটার ডানাদুটো ধরলেন, তারপর উপস্থিত সকলের বিস্ময়াভূত চোখের সামনে তাকে মুখের মধ্যে ফেলে দিলেন ও পরম আনন্দের সঙ্গে জ্যান্ত পোকাটা চিবিয়ে খেয়ে ফেললেন। প্রচুর প্রশংসা ও উপহার দিয়েও সেই অবুঝ প্রশিক্ষককে শান্ত করা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না। অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম যে জনসমক্ষে সেটাই তাঁর প্রথম ঝিঁঝিঁপোকা খাওয়া ছিল না এবং শেষও নয়।

সেই দিনগুলোতে ওই শহরটাকে আর হাফ ডজন বন্ধুদের যত আপন মনে হত তা যেন আর কখনও মনে হয়নি। এই বন্ধুর দল তখন দেশের সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে ‘বাররানকিয়া দল’ হিসাবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। তাঁরা ছিলেন তরুণ লেখক ও শিল্পী যাঁরা শহরের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁদের গুরু ছিলেন কাতালুনিয়ার মানুষ খ্যাতনামা নাট্যকার ও বইবিক্রেতা দোন রামোন বিনিয়েস। তিনি ১৯২৪ সাল থেকে এসপাসা বিশ্বকোষের[১] কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

এঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। তখন আমি কার্তাহেনা—যেখানে আমি থাকতাম–সেখান থেকে ‘এল উনিবের্সাল’ খবরের কাগজের সম্পাদকীয় প্রধান ক্লেমেন্তে মানুয়েল সাবালার সুপারিশ নিয়ে এখানে এসেছি। ওই কাগজেই আমার প্রথম দিকের সম্পাদকীয় লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা একটা গোটা রাত কাটিয়ে দিয়েছিলাম কথা বলে। সমস্ত কিছু নিয়ে কথা হয়েছিল। তখন থেকেই আমাদের মধ্যে এমন একটা উৎসাহী ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ গড়ে উঠল, বইয়ের আদান-প্রদান ও সাহিত্যিক রসিকতার বিনিময় হতে লাগল যে তাঁদের সঙ্গেই কাজ করতে শুরু করে দিলাম। মূল দলের তিনজন খুবই নাম করেছিলেন তাঁদের স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব ও লেখনীর দক্ষতায়: হেরমান বার্গাস, আলফোনসো ফুয়েনমাইয়োর ও আলবারো সেপেদা সামুদিয়ো। আমাদের মধ্যে সর্ব ব্যাপারে এত মিল ছিল যে খারাপ ভাষায় বললে বলা যেত আমরা একই বাবার সন্তান ছিলাম। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আমাদের একটা আলাদা ছাপ দিয়ে দিয়েছিলেন এবং আমাদের পছন্দও করতেন না। তার কারণ ছিল আমাদের স্বাধীনচেতা মানসিকতা, অপ্রতিরোধ্য কাজের প্রেরণা, সৃষ্টির দৃঢ়সংকল্প নিয়ে নিজের পথ তৈরি করে এগিয়ে যাওয়া এবং আত্মপ্রচারের ধ্বজা না ওড়ানো। তবে সবসময় যে নিয়তি প্রসন্ন থাকত এমনটাও নয়।

আলফোনসো ফুয়েনমাইয়োর তখন আঠাশ বছরের এক উজ্জ্বল লেখক ও সাংবাদিক। ‘এল এরালদো’ পত্রিকায় বেশ অনেকদিন ধরে একটি কলাম লিখছিলেন–‘দিনের বাতাস’। সেখানে একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন, শেক্সপিয়র থেকে নেওয়া–‘পাক’[২]। তাঁর প্রাণখোলা ব্যবহার ও রসবোধের সঙ্গে যত বেশি পরিচিত হতে লাগলাম, ততই অবাক হয়ে ভাবতাম যত রকমের বিষয় কল্পনা করা যায় সেই সমস্ত বিষয়ের উপরে চারটি ভাষায় তিনি কী করে এত বই পড়েছেন! তাঁর জীবনের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতাটি একটা বিরাট ভাঙা গাড়ি নিয়ে। তখন তাঁর প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স। গাড়িটাকে কুড়ি কিলোমিটার গতিতে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে চালাতেন। ট্যাক্সি চালকরা, যাঁরা ছিল তাঁর সবচেয়ে বড়ো বন্ধু, দূর থেকে দেখেই গাড়িটা চিনতে পারতেন আর সব এদিক-ওদিক সরে যেতেন তাঁকে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য।

হেরমান বার্গাস কান্ত্যিয়ো সান্ধ্য কাগজ ‘এল নাসিয়োনাল’-এ কলাম লিখতেন। তিনি একজন জ্ঞানী ও ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্য সমালোচক। তাঁর গদ্যের এমনই টান ছিল যে পাঠকের মনে হত তিনি বলেছেন বলেই ঘটনাগুলো ঘটেছে। রেডিয়োর শ্রেষ্ঠ উপস্থাপকদের মধ্যেও তিনি ছিলেন অন্যতম এবং নতুন নতুন পেশার রমরমার সেই সময়টায় নিঃসন্দেহে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি জ্ঞানবান। তাছাড়াও তাঁর মতো সহজাত সাংবাদিক খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল, ঠিক যে-রকমটা আমি হতে চাইতাম। তিনিও ছিলেন ব্লঁদ, খুব শক্তপোক্ত চেহারা আর দুটি চোখে বিপজ্জনক নীল রং। যা কিছু পাঠযোগ্য সেই সব বিষয়ে আধুনিক জ্ঞান অর্জনের জন্য এত সময় কখন পেতেন তা কেউ বুঝতে পারত না। উপেক্ষিত প্রদেশের প্রান্তে-প্রত্যন্তে যত কিছু সাহিত্যিক মণিমুক্তো বিস্মৃতির অবহেলায় পড়ে আছে তা প্রকাশ্যে আনার যে কাজে ব্রতী হয়েছিলেন জীবনের শুরুতে তা থেকে কখনও পিছু হটেননি। সৌভাগ্যের বিষয় ছিল যে তিনি সেই বিপথগামীদের মাঝে কোনোদিন গাড়ি চালাতে শেখেননি। নাহলে আমাদের আশঙ্কা ছিল যদি তিনি গাড়ি চালাতে চালাতে বই পড়ার লোভ সংবরণ করতে না পারেন!

বিপরীতে আলবারো সেপেদা সামুদিয়ো সবার আগে ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ চালক। যেমন চালিত করতে পারতেন গাড়িকে তেমনই শব্দদের। গল্প লেখার ইচ্ছে যখন হত তখন অসাধারণ সব গল্প লিখতেন। পাশাপাশি চলচ্চিত্রের বিদগ্ধ সমালোচক এবং নিঃসন্দেহে সমস্ত সমালোচকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী। তাছাড়াও দুঃসাহসিক বিতর্ক উসকে দেওয়ার প্রধান হেতু ছিলেন তিনিই। সিয়েনাগা গ্রান্দে থেকে আগত যাযাবরদের মতো দেখতে লাগত তাঁকে–রোদে পোড়া তামাটে বর্ণের ত্বক, কালো, কোঁকড়া, অবিন্যস্ত চুলে ভরা মাথা আর দুটো পাগলপারা চোখ। যে চোখ তাঁর হৃদয়ের সারল্যের ভাষ্য। তাঁর পছন্দের জুতো ছিল অতি সস্তার কাপড়ের চটি আর দু-ঠোঁটের ফাঁকে ধরা থাকত একটা বিরাট সিগার যেটা প্রায় কখনোই নিভত না। যে বছরে ‘এল নাশিয়োনাল’-এ তাঁর প্রথম দিকের সাংবাদিক লেখা ও গল্প প্রকাশিত হয়েছিল, সেই সময়টায় তিনি ছিলেন আমেরিকার নিউ ইয়র্কে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকের পাঠ নিচ্ছিলেন।

দলের একজন পরিব্রাজক সদস্য, দোন রামোনের মতোই এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হলেন আলফোনসোর বাবা হোসে ফেলিক্স ফুয়েনমাইয়োর–ঐতিহাসিক সাংবাদিক ও বিরাট মাপের লেখক। তাঁর একটি কবিতার বই ‘উষ্ণমণ্ডলীয় প্রেরণাদাত্রীরা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১০ সালে এবং দুটি উপন্যাস–‘কোসমে’ ও ‘চোদ্দজন জ্ঞানীর এক বিষণ্ণ অভিযান’ প্রকাশ পায় যথাক্রমে ১৯২৭-এ ও ১৯২৮-এ। কোনো বই-ই অর্থকরী সাফল্যের মুখ দেখেনি, কিন্তু বিশিষ্ট সমালোচকরা সব সময়েই হোসে ফেলিক্সকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসাবে গণ্য করেছেন, প্রদেশের উপেক্ষার অন্ধকার যাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের আগে আমি কারুর কাছ থেকে তাঁর সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারিনি। একদিন দুপুরে হাপি কাফেতে ঘটনাচক্রে শুধু বসেছিলাম তিনি আর আমি। মুহূর্তের মধ্যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম তাঁর প্রজ্ঞা ও কথা বলার সারল্যে। তিনি ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক। হাজার দিনের যুদ্ধের সময় একটি জঘন্য জেলে বন্দিও ছিলেন। রামোন বিনিয়েসের মতো তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল না, কিন্তু নিজস্ব স্বভাবগুণে ও ক্যারিবিয়ার সংস্কৃতির জন্য আমার অনেক কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগত তা হল তাঁর জ্ঞানবিতরণের এক আশ্চর্য ক্ষমতা। যেন মনে হত সেলাই করা বা গান গাওয়ার মতো একটা সহজ কাজ করছেন। তিনি ছিলেন এক অপরাজেয় কথক ও জীবনের শিক্ষক। তখনও পর্যন্ত আমি যতজনকে চিনতাম তাদের সবার থেকে তাঁর চিন্তার ধরন ছিল আলাদা। আলবারো সেপেদা আর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতাম তাঁর কথা শুনতে শুনতে, সর্বোপরি তাঁর মূলগত এক বিশ্বাসের জন্য। সেই বিশ্বাস হল জীবন ও সাহিত্যের মধ্যে মূলগত পার্থক্যটি ঘটে যায় শুধুমাত্র সঠিক ফর্ম না পাওয়ার ভুলে। অনেক পরে, মনে নেই কোথায়, আলবারো অব্যর্থ একটি কথা লিখেছিলেন: ‘আমরা সবাই হোসে ফেলিক্সের ফসল।’

আমাদের এই দল তৈরি হয়েছিল এক প্রকার স্বতস্ফূর্তভাবেই, প্রায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে এবং এক অবিনশ্বর তীব্র আসক্তির জন্য যা একনজরে বোঝা খুবই কঠিন। অনেকবার লোকে জিজ্ঞাসা করেছে আমাদের মধ্যে এত বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও কোনো বিষয়ে আমরা একমত হই কী করে আর সত্যি কথা না বলার জন্য আমরা কত রকমের উত্তরই না উদ্ভাবন করতাম। সব সময় আমরা যে একমত হতাম তা নয়, কিন্তু যুক্তিটা বুঝতে পারতাম। আর একটা ব্যাপারে আমরা সবাই সচেতন ছিলাম। আমাদের পরিমণ্ডলের বাইরের মানুষদের কাছে আমরা ছিলাম উদ্ধত, নার্সিসিস্টিক ও অ্যানারকিস্ট। তা ছিল প্রধানত আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে। আলফোনসোকে লোকে ভাবত গোঁড়া উদারপন্থী, গেরমানকে ভাবত অনিচ্ছুক মুক্ত চিন্তক, আলবারোকে আবেগসম্বল অ্যানারকিস্ট এবং আমাকে অবিশ্বাসী কম্যুনিস্ট ও এক সম্ভাব্য আত্মঘাতী। যাই হোক, এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ ছিল না যে আমাদের সবচেয়ে বড়ো ঐশ্বর্য ছিল চরম দুঃসময়ে আমরা ধৈর্য হারালেও রসবোধ হারাতাম না।

যে সামান্য কয়েকটি ব্যাপারে আমাদের মধ্যে মতদ্বৈততা তৈরি হত তা আমরা শুধুমাত্র দলের অন্দরেই আলোচনা করতাম। তবে মাঝে মাঝে সেই আলোচনার উষ্মা প্রায় বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যেত। কিন্তু যখনই আমরা টেবিল ত্যাগ করতাম কিংবা দলের বাইরের কোনো বন্ধু দেখা করতে আসত মুহূর্তের মধ্যে সব ভুলে যেতাম। লোস আলমেন্দ্রোস বারে সারা জীবনের মতো অবিস্মরণীয় এক শিক্ষা পেয়েছিলাম। আমি তখন সদ্য দলে এসেছি। একদিন রাতে আমি আর আলবারো ফকনারকে নিয়ে এক উত্তপ্ত আলোচনায় জড়িয়ে পড়লাম। সেই টেবিলে তখন উপস্থিত ছিলেন হেরমান ও আলফোনসো। তাঁরা একপাশে চুপচাপ নিথর হয়ে বসেছিলেন। সেটা যে কী অসহ্য একটা ব্যাপার! তাছাড়া জল না মিশিয়েই আগুয়ারদিয়েন্তে[৩] খেয়েছিলাম। তার উপরে রাগের প্রচণ্ড উত্তেজনা। সব মিলিয়ে এক সময়, ঠিক কখন তা মনে নেই, আলবারোকে চ্যালেঞ্জ করে বসলাম, রাস্তায় নেমে ঘুঁষির জোরে মীমাংসা হোক। দুজনেই টেবিল থেকে উঠে রাস্তায় যাওয়ার উপক্রম করছি, ঠিক তখনই হেরমান বার্গাসের নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল যা আমাদের গতি রুদ্ধ করে দিল আর পেয়ে গেলাম সারা জীবনের মতো এক শিক্ষা:

—‘যে হেরে গেছে সেই প্রথম উঠবে।’

সেই সময় আমাদের কারুর বয়সই তিরিশ পেরোয়নি। আমি ছিলাম দলের সবচেয়ে ছোটো সদস্য, ২৩ বছর পূর্ণ হয়েছে মাত্র। গত ডিসেম্বরে এখানে আসার পর থেকে এঁরা আমায় দলে জায়গা দিয়েছেন। কিন্তু রামোন বিনিয়েসের টেবিলে আমরা এমন ব্যবহার করতাম যেন আমরাই এই নব্য চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক। তাঁর সামনে আমরা সবসময় একসঙ্গে থাকতাম, একই বিষয়ে কথা বলতাম, সব কিছু নিয়ে ব্যঙ্গ করতাম এবং এই বিরোধিতায় আমরা এতটাই একমত ছিলাম যে অন্যরা ভাবত আমরা বুঝি একজন ব্যক্তি। 

একমাত্র মেয়ে যাঁকে আমরা দলের অংশ বলে মনে করতাম তিনি হলেন মেইরা দেলমার। মেইরা ইতিমধ্যেই কবিতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমরা সেই সামান্য সময়ে কথা বলতাম যখন আমরা আমাদের বদ-অভ্যাসের বাইরে থাকতাম। ওই শহরে যে সব বিখ্যাত লেখক ও শিল্পীরা আসতেন তাঁদের সঙ্গে মেইরার বাড়িতে সান্ধ্যকালীন আসরগুলো ছিল অবিস্মরণীয়। আরেকজন বান্ধবী যাঁর সঙ্গে আরও কম দেখা হত তিনি শিল্পী সেসিলিয়া পোররাস। তিনি মাঝে মাঝে কার্তাহেনা থেকে এখানে আসতেন ও আমাদের নিশি-অভিযানের সঙ্গী হতেন। মাতালদের কাফেতে বা সর্বনেশে বাড়িগুলোতে মেয়েরা গেলে যে বদনাম হওয়ার ভয় থাকে তিনি তার পরোয়া করতেন না।

আমাদের দল দিনে দু-বার মুন্দো বইয়ের দোকানে জড়ো হত। এই দোকানটা সাহিত্যিক আড্ডার একটা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সান ব্লাস স্ট্রিটের হট্টগোলের মধ্যে দোকানটা ছিল যেন শান্ত, নিষ্পন্দ এক পুকুরঘাট। বিশেষ করে সন্ধে ছ-টার সময় যখন সেই কোলাহলে পূর্ণ বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্রে নগরীর মধ্যভাগ নিজেকে উগরে দিত। সন্ধে হওয়া পর্যন্ত আলফোনসো আর আমি অধ্যাবসায়ী ছাত্রের মতো লিখে যেতাম ‘এল এরালদো’-র সম্পাদকীয় দপ্তরের লাগোয়া একটা অফিসঘরে বসে, তিনি লিখতেন তাঁর সরস সম্পাদকীয় আর আমি, আমার অপরিপাট্য সাংবাদিক প্রবন্ধ। প্রায়শই আমরা এক টাইপরাইটার থেকে অন্য টাইপরাইটারে ভাবের আদানপ্রদান করতাম, ধার নিতাম বিশেষণ ও চলত তথ্যের দেওয়া-নেওয়া যতক্ষণ পর্যন্ত না বুঝে ওঠা বেশ শক্ত হত কোন অনুচ্ছেদটি ঠিক কার লেখা।

টীকা:

১। এসপাসা বিশ্বকোষ– স্পেনীয় বিশ্বকোষ। ১৯০৮ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ৭২টি খণ্ড প্রকাশিত হয়। পরে আরও অনেক খণ্ড যুক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত মোট ১১৮টি খণ্ড হয়। এটির অন্য নাম ‘Enciclopedia universal ilustrada europeo-americana’।  

২। পাক (Puck)– বা রবিন গুডফেলো শেক্সপিয়রের ‘A Midsummer Night’s Dream’ নাটকের একটি চরিত্র।

৩। আগুয়ারদিয়েন্তে– একটি নিষিদ্ধ দেশি মদ।  

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *