|

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১৪ )

শেয়ার করুন

পর্ব – চোদ্দ

এলবিরা কাররিয়ো ছিলেন এস্তেবান মামার যমজ বোন। তিনি শুধু হাত দিয়ে আখ ভেঙে দুমড়িয়ে-মুচড়িয়ে আখের রসের মেশিনের মতো তার থেকে রস বের করতে পারতেন। মুখের উপর সরাসরি রূঢ় কথা বলে দেওয়ার স্বভাব ছিল তাঁর, এ বিষয়ে বেশ খ্যাতিও ছিল। কিন্তু একথা কেউ বলত না যে কী কোমল স্নিগ্ধতার সঙ্গে তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতেন! আমার এক বছরের ছোটো ভাই লুইস এনরিকে ছিল তাঁর সবথেকে প্রিয়। সত্যি বলতে কি, তিনি ছিলেন একই সঙ্গে এনরিকের অভিভাবিকা ও বদমাইশির সঙ্গী। এনরিকে তাঁর এক অদ্ভুত নামও রেখেছিল—তিয়া পা। এই তিয়া পা’র বৈশিষ্ট্যই ছিল অসম্ভব সব সমস্যার আমদানি করা। তিনি আর এস্তেবান মামা সর্বপ্রথম কাতাকার বাড়িতে আসেন। এখানে এসে মামা মেতে উঠেছিলেন বিভিন্ন লাভজনক ব্যবসা নিয়ে। কিন্তু তিয়া পা বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন এবং নিজের অজান্তেই বাড়ির একজন অপরিহার্য সদস্যা হয়ে উঠেছিলেন। যখন প্রয়োজন হত না তখন তাঁকে কেউ দেখতে পেত না। কিন্তু প্রয়োজন পড়লেই তিনি যে কোথা থেকে কেমন করে এসে হাজির হতেন তা কেউ বুঝতে পারত না। তাঁর কষ্ট হলে তিনি জোরে জোরে কড়ায় খুন্তি নাড়তেন আর একা একা কথা বলে যেতেন। তখন বেশ উঁচু গলায় বলে দিতেন সেইসব জিনিস কোথায় আছে যেগুলো হারিয়ে গেছে বলেই সবাই ধরে নিয়েছিল। পরিবারের বয়স্কদের সবাইকে কবর দেওয়ার পরেও তিনি সেই বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে একটু একটু করে বাড়িটা আগাছায় ভরে উঠেছে। এমনকি জন্তু-জানোয়াররাও ঘুরে বেড়াচ্ছে শোবার ঘরে। আর মাঝরাতের পর থেকে তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুলত পাশের ঘর থেকে আসা প্রেতপুরীর এক বিকট কাশি। 

ফ্রান্সিসকা সিমোদোসেয়া–তিয়া মামা–আমাদের বিরাট পরিবারের মাথা ছিলেন। তিনি ঊনআশি বছর বয়সে কুমারী অবস্থায় মারা যান। তাঁর আচার-আচরণ ও ভাষা ছিল সবার থেকে আলাদা। কারণ তিনি প্রদেশের সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ছিলেন না, বরং তা পেয়েছিলেন সাবানাস দে বোলিবারের[১] সামন্ততান্ত্রিক স্বর্গরাজ্য থেকে। তাঁর বাবা হোসে মারিয়া মেহিয়া বিদাল খুব ছোটো বয়সে রিওয়াচা থেকে সেখানে চলে গিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিল তাঁর নিজস্ব স্বর্ণকারের দক্ষতা। তিয়া মামার মোটা, ঘন কালো চুল ছিল হাঁটু পর্যন্ত লম্বা। অনেক বয়স হওয়ার পরে তবে তাঁর চুলে পাক ধরেছিল। সপ্তাহে একবার সুগন্ধি জলে তিনি সেই চুল পরিষ্কার করতেন। তারপর নিজের শোবার ঘরের দোরগোড়ায় বসে প্রায় পুজো করার মতো মনযোগ দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চুল আঁচড়াতেন। আর তার সঙ্গে খুব কড়া তামাকের একটার পর একটা সিগারেট খেতেন জ্বলন্ত দিকটা মুখের মধ্যে পুড়ে, ঠিক যেমনভাবে উদারপন্থী বিপ্লবীরা সিগারেট খেতেন যাতে অন্ধকার রাত্রে শত্রুপক্ষ তাঁদের সিগারেটের আগুন দেখতে না পায়। তাঁর পোশাকের ধরনও ছিল আলাদা–লিনেনের ব্রা ও সায়ার মতো এক প্রকার অন্তর্বাস পরতেন আর পায়ে থাকত ভেলভেটের চটি। 

আমার দিদিমার মুখের বিশুদ্ধ ভাষার বিপরীতে তিয়া মামার মুখ ছিল খুব আলগা। আর পাঁচজনে যেমন গালাগালি দেয় তেমন গালাগালি দিয়ে কথা বলতেন। এমনকি যে কোনো অবস্থায় যে কোনো লোকের সামনে তিনি একই ভাষায় কথা বলতেন। আর যা উচিত মনে করতেন তা মুখের উপর বলে দিতেন। এমনকি আমার মা সান্তা মার্তার যে বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন সেখানকার এক সন্ন্যাসিনীকে পর্যন্ত সামান্য কী একটা অভদ্রতার জন্য সোজাসুজি বলে দিয়েছিলেন: ‘আপনি হলেন সেই ধরনের মহিলা যারা জল আর জলপাইকে এক মনে করে।’ তবে সেসব কথা এমনভাবে বলতেন যে কখনোই খুব রূঢ় বা অপমানজনক বলে মনে হত না।

জীবনের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে তিয়া মামা সমাধিক্ষেত্রের চাবির দায়িত্ব সামলেছেন। মৃত্যুর শংসাপত্র পূরণ করা ও হস্তান্তর করার অধিকারীও ছিলেন তিনি। তাছাড়াও বাড়ির সমবেত প্রার্থনা তিনি-ই পরিচালনা করতেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তিয়া মামাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি যাঁর হৃদয় ব্যর্থ প্রেমের বেদনায় কখনও বিষণ্ণ হয়নি। সেটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম সেই দিন রাতে, যেদিন ডাক্তার তাঁকে ক্যাথিডার পরাতে গেলে তিনি বারণ করেছিলেন এবং ডাক্তারকে বলেছিলেন: ‘আপনার জানা দরকার যে সারা জীবনে আমি কোনো পুরুষের সঙ্গ করিনি।’ তখন অবশ্য কথাটার মানে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। 

সেদিন থেকে মাঝে মাঝেই তিয়া মামাকে এই কথাটা বলতে শুনতাম, কিন্তু কখনোই আমার মনে হয়নি যে তিনি তা গর্ব করে বা দুঃখের সঙ্গে বলছেন। বরং মনে হত সেটা এমন একটা সাধারণ ঘটনা যার বিশেষ কোনো ছাপ তাঁর জীবনে ছিল না। বরং তিনি ঘটকের কাজে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তবে আমার বাবা-মায়ের প্রেমে সাহায্য করতে গিয়ে নিশ্চয়ই খুব সমস্যায় পড়েছিলেন, কেন-না মিনার বিশ্বাসভঙ্গ না করে এই দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করা সহজ কাজ ছিল না।   

আমার মনে হয় তিনি বড়োদের চেয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তাই সারা এমিলিয়াকে অনেকদিন দেখাশোনা করেছেন। তারপর সারা যখন কাইয়েখা প্রকাশনীর বই ছিল যে ঘরে সেই ঘরে একা থাকতে শুরু করল তখন থেকে তিনি আমাকে আর আমার বোন মার্গোতকে কাছে টেনে নিলেন। অবশ্য দিদিমা ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর রাখতেন আর দাদু দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমাকে পুরুষ হিসাবে গড়ে তোলার। 

আমার সেই সময়ের স্মৃতির মধ্যে সবচেয়ে অস্থির হল পিসিঠাকুমা পেত্রার স্মৃতি। তিনি আমার দাদুর সবচেয়ে বড়ো বোন। অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রিওয়াচা ছেড়ে চলে এসেছিলেন দাদু-দিদিমার সঙ্গে থাকবেন বলে। আমাদের বাড়িতে থাকতেন অফিসের লাগোয়া একটা ঘরে। পরে সেই অফিস ঘরে রুপোর কাজ হত। অন্ধত্বের অন্ধকারের মধ্যেই কারুর সাহায্য ছাড়া একা একা ঘুরে বেড়াবার এক অদ্ভুত দক্ষতা তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁর কথা এত স্পষ্ট মনে আছে যে মনে হয় যেন গতকালের সব ঘটনা। লাঠি ছাড়াই তিনি হাঁটতেন, ধীরে কিন্তু দ্বিধাহীন পদক্ষেপে, যেন সবকিছু দেখতে পাচ্ছেন এমনভাবে। আসলে ভিন্ন ভিন্ন ঘ্রাণ তাঁকে পথ দেখাত। নিজের ঘর চিনে নিতেন সংলগ্ন ঘরের রুপো তৈরির মিউরিটিক অ্যাসিডের গন্ধ দিয়ে। বারান্দা চিনতেন বাগানের জুঁই ফুলের গন্ধে। দাদু-দিদিমার শোবার ঘর থেকে আসত উড অ্যালকোহলের[২] গন্ধ যা ওঁরা দুজনেই ঘুমোবার আগে গায়ে মাখতেন। তিয়া মামার ঘর চিনে নিতেন মূর্তির সামনে রাখা প্রদীপের তেলের গন্ধ শুঁকে আর বারান্দা শেষ হয়ে গেছে বুঝে নিতেন রান্নাঘরের সুস্বাদু খাবারের গন্ধে। তিনি ছিলেন রোগা আর খুব শান্ত। তাঁর গায়ের রং ছিল ঝরে পড়া লিলি ফুলের মতো আর পিঠ ছাপিয়ে কোমর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া তাঁর চুল ছিল মুক্তোর মতো উজ্জ্বল। তিনি নিজেই সেই চুল আঁচড়াতেন ও বাঁধতেন। কিশোরীদের মতো সবুজ স্বচ্ছ চোখদুটো তাঁর মনের অবস্থা অনুযায়ী রং পালটাত। যাই হোক, এই যে তাঁর হাঁটাচলা তা ছিল খুব কম সময়ের জন্য, কারণ সারাদিনই তিনি তাঁর ঘরে বসে থাকতেন। ঘরের দরজাটা আধভেজানো আর তার মধ্যে প্রায় সব সময়েই তিনি একা। কখনও কখনও মৃদু স্বরে গান গাইতেন। নিজেকেই শোনাতেন সে গান। তাঁর গলার সঙ্গে মিনার গলার স্বরের এত মিল ছিল যে কেউ কেউ ভুল করত। কিন্তু তাঁর গানগুলো ছিল আলাদা আর অধিক বিষণ্ণ। কাউকে একটা তাঁকে বলতে শুনেছিলাম যে সেই গান ছিল রিওয়াচার মেলোডি, কিন্তু বড়ো হয়ে জানতে পেরেছিলাম যে তা নয়, তিনি নিজেই সেগুলো গাইতে গাইতে নির্মাণ করতেন। দু’-তিনবার সকলের অলক্ষে তাঁর ঘরে ঢোকার প্রবল ইচ্ছা সংবরণ করতে পারিনি, কিন্তু কোনোবারই তাঁকে দেখতে পাইনি। অনেক বছর পরে স্কুলের ছুটিতে বাড়ি এসে মাকে বলেছিলাম আমার এই স্মৃতির কথা। কিন্তু তিনি তৎক্ষণাৎ আমার ভুল ধরিয়ে দেন। বাস্তবিক তিনি ঠিকই বলেছিলেন আর তাঁর যুক্তিও খুব সহজেই সঠিক বলে প্রমাণ করে দেওয়া যেত, কেন-না পেত্রাঠাকুমা যখন মারা যান তখন আমার দু’ বছরও বয়স হয়নি।

ওয়েনেফ্রিদা ঠাকুমাকে আমরা নানা বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে হাসিখুশি আর ভালো মানুষ। কিন্তু তাঁর মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকার সময়টার কথাই শুধু আমার মনে আছে। তাঁর বিয়ে হয়েছিল রাফায়েল কিন্তেরো ওর্তেগার সঙ্গে–আমাদের কিন্তে তিয়ো। তিনি ছিলেন গরিবদের উকিল। বোগোতা থেকে পনেরো লিগ মতো দূরে চিয়া শহরে তাঁর জন্ম। এই শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বোগোতার সমান উচ্চতায় অবস্থিত। কিন্তু ক্যারিবিয়ার জল-হাওয়ার সঙ্গে এমন সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন যে কাতাকার মতো অসহ্য গরমের দেশে ডিসেম্বরের হালকা শীতের রাতেও তাঁর গরম জলের বোতল লাগত ঘুমোবার আগে পায়ে দেওয়ার জন্য। দাদুর পরিবার যখন মেদার্দো পাচেকোর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে কাটিয়ে উঠেছে তখনই শুরু হয় কিন্তে তিয়োর দুর্ভাগ্য। একটি মামলায় বিপরীতপক্ষের এক উকিলকে তিনি মেরে ফেলেছিলেন। আসলে তিনি খুবই শান্ত প্রকৃতির ও ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ তাঁকে এমনই ক্রমান্বয়ে আক্রমণ করতে থাকে যে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া ছাড়া তাঁর উপায়ান্তর ছিল না। তিনি এমন ছোটোখাটো ও রোগা ছিলেন যে বাচ্চাদের জুতো পরতেন আর রিভলবারটা জামার নীচে এমন বেঢপ হয়ে ফুলে থাকত যেন মনে হতো সেটা একটা কামান। এই নিয়ে বন্ধুরা তাঁর সঙ্গে খুব মস্করা করত। আমার দাদু তাঁকে হত্যা করা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁকে বলেছিলেন সেই বিখ্যাত কথা: ‘আপনি জানেন না একটা মৃত্যুর ভার কী দুর্বিসহ।’ কিন্তু কিন্তে তিয়োর কিছু ভাবার মতো অবসর ছিল না যখন কোর্টের ভেতরের ঘরে তাঁর শত্রু পাগলের মতো চিৎকার করে তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়াল ও বিশাল দেহ নিয়ে ছুটে এল কিন্তে তিয়োর দিকে। ‘আমি নিজেই বুঝতে পারিনি কখন রিভলবারটা বার করেছি আর কেমন করেই বা চোখ বন্ধ করে দু’ হাতে ধরে সেটাকে চালিয়েছি’, আমাকে বলেছিলেন কিন্তে তিয়ো, একশো বছর বয়সে মারা যাওয়ার কিছু আগে। ‘যখন চোখ খুললাম’, আমাকে বললেন, ‘তখনও সে সোজা দাঁড়িয়ে ছিল, তারপর সেই বিশাল দেহ নিয়ে কীরকম যেন বিবর্ণ হয়ে গেল আর ধীরে ধীরে পড়ে যেতে লাগল। শেষে বসে পড়ল মাটির উপর।’ তারপর কিন্তে তিয়ো বুঝতে পারলেন যে তিনি ওই মানুষটার কপালের ঠিক মাঝখানে গুলি করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম শত্রুকে ওইভাবে পড়ে যেতে দেখে আপনার কী মনে হয়েছিল এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন:

—‘বিরাট এক স্বস্তি!’

তাঁর স্ত্রী ওয়েনেফ্রিদা সম্বন্ধে শেষ যে ঘটনাটা আমার মনে পড়ে তা হল এক প্রচণ্ড বৃষ্টির রাতে এক মহিলা ওঝা এসে তাঁকে ঝাড়ফুঁক করছে। সচরাচর যেমন ওঝা দেখা যায় সেই মহিলা ঠিক তেমন ছিল না। বেশ আধুনিক পোশাক পরা ও ভদ্র সভ্য। সে এক গোছা বিছুটি পাতা নিয়ে শরীর থেকে সব কুপ্রভাব কাটিয়ে দিচ্ছিল। এই কাজটা করার সময় গানের মতো করে সে একটা মন্ত্র পড়ছিল। তার সুরটা ছিল অনেকটা ঘুম পাড়ানি গানের মতো। হঠাৎ নানার প্রচণ্ড ফিট হয়ে শরীরটা বেঁকে-চুড়ে যেতে লাগল আর বিছানার চাদরের মধ্যে থেকে প্রায় মুরগির আকারের একটি বিরাট বড়ো পাখি বহুবর্ণরঞ্জিত পাখা মেলে বেরিয়ে এল। পাখিটা পালানোর সময় ওঝা মেয়েটি হাতের কায়দায় তাকে ধরে সঙ্গে করে আনা একটা কালো কাপড়ে মুড়িয়ে ফেলল। তারপর পেছনের দিকের উঠোনে একটা আগুন জ্বালাতে বলল ও কোনো মন্ত্রতন্ত্র ছাড়াই পাখিটাকে সোজা আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তবুও নানার অসুখ সারল না।

একটুখানি পরেই অবশ্য উঠোনের সেই আগুনটা ফের জ্বলে উঠেছিল। একটা মুরগি তখন একটা অদ্ভুত ডিম পাড়ল। ডিমটা দেখতে ঠিক পিং পং বলের মতো আর তার একদিকে ফ্রিজিয়ার টুপির মতো একটা কিছু লেগে আছে। আমার দিদিমা সেটা দেখেই চিনতে পারলেন: ‘এটা বাসিলিস্ক সাপের[৩] ডিম।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডিমটা সেই আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন।

সেই সময়ে দাদু-দিদিমার যে বয়সের চিত্র আমার স্মৃতিতে ধরা আছে তা ভিন্ন অন্য কোনো বয়সের চেহারায় আমি তাঁদের কল্পনা করতে পারি না। বার্ধক্যের ঊষালগ্নে তোলা তাঁদের ছবিগুলোতেও সেই একই চেহারা ধরা আছে। সেই ছবির প্রতিলিপি প্রবাহিত হয়েছে চার প্রজন্ম ধরে, যেন সে এক অবশ্য করণীয় কর্তব্য। আর প্রতিবারই আরও বেশি বিবর্ণ, আরও বেশি মলিন হয়ে গেছে তারা। সর্বোপরি দিদিমা ত্রাঙ্কিলিনার ছবি। তাঁর মতো সরল বিশ্বাসী ও অনুভূতিপ্রবণ মহিলা আমি আর জীবনে খুঁজে পাইনি। দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ রহস্যও তাঁর কাছে ভয়ংকর হয়ে দেখা দিত। প্রতিদিন কাজ করার সময় লঘু চাপল্যে তিনি পুরোনো দিনের প্রেমের গান গাইতেন। কিন্তু গানের মাঝখানে হঠাৎ চিৎকার করে উঠতেন, যেন কোনো আসন্ন বিপদ ঠেকাচ্ছেন: 

—‘জয় মা মেরী!’

কারণ শুধু তিনি-ই দেখতে পেতেন রকিং চেয়ারগুলো একা একাই দোল খাচ্ছে, আঁতুর ঘরে অপদেবতারা চুপিসারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাগানের জুঁইফুলের গন্ধ আসলে অদৃশ্য কোনো ভূত, মেঝের উপর ঘটনাচক্রে পড়ে থাকা একটা দড়ি যে আকৃতি নিয়েছে তা হতে পারে লটারির বাম্পার পুরষ্কারের নম্বর কিংবা চক্ষুহীন যে পাখিটা খাবারের জায়গায় উড়ে বেড়াচ্ছে তাকে শুধুমাত্র ‘লা মাগনিফিকা’[৪] মন্ত্র পড়ে তাড়ানো যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রদেশ থেকে যেসব গান তাঁর কাছে এসে পৌঁছায়, সেই গানে বর্ণিত চরিত্র বা জায়গার সংকেত তিনি উদ্ধার করতে পারেন গোপন চাবিকাঠি দিয়ে। পরে বা অনতিবিলম্বে যেসব দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তা তিনি দেখতে পেতেন, ভবিষ্যৎবাণী করতেন রিওয়াচা থেকে সাদা টুপি পরে কে আসবে আর মানাউরে থেকেই বা কলিকের ব্যথা নিয়ে কে আসতে পারে যার নিরাময় সম্ভব একমাত্র টার্কি শকুনের পিত্তরস দিয়ে। এখানে বলে রাখি, পেশাদারি গণৎকার হওয়া ছাড়াও মিনা গোপনে গোপনে জড়িবুটির ওষুধও দিতেন।

দিদিমার নিজের বা অন্যদের স্বপ্ন আমাদের প্রত্যেকের দৈনন্দিন আচার-আচরণের নির্ধারক ছিল এবং বাড়ির জীবন যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করত। সেই স্বপ্নদের দিদিমা ব্যাখ্যা করতেন তাঁর নিজস্ব প্রক্রিয়ায়। সে যাই হোক, কোনো পূর্বলক্ষণ ছাড়াই একদিন তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন। যেই না তিনি বিছানার চাদরটা হেঁচকা টানে তুলতে গেছেন সেই রিভলবার থেকে গুলি ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। কর্নেল সব সময় বালিশের নীচে রিভলবারটা রেখে দিতেন যাতে ঘুমের সময় হাতের নাগালে থাকে। গুলিটা ছাদের যেখানে গিয়ে বিঁধেছিল তার থেকে এটা স্পষ্ট ছিল যে গুলিটা চলে গিয়েছিল দিদিমার মুখের খুব কাছ দিয়ে। 

আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক সকালবেলা যে অত্যাচারটা আমায় সহ্য করতে হত তা হল মিনা আমার দাঁত মেজে দিতেন আর তখন নিজের দাঁতগুলো জাদুকরের মতো মুখ থেকে খুলে পরিষ্কার করতেন। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আবার সেগুলো খুলে একটা জলের গ্লাসে রেখে দিতেন। আমার নিশ্চিত ধারণা ছিল যে ওই নকল দাঁতটা আসলে তাঁর স্বাভাবিক দাঁত আর তিনি তা খোলা-পরা করতে পারতেন গুয়াহিরোদের এক বিশেষ কৌশলের বলে। তাই তাঁকে বলতাম মুখটা হাঁ করে আমায় দেখাতে যাতে চোখ, মাথা, নাক ও কানের পেছন দিকটা দেখতে পাই। কিন্তু টাকরা ছাড়া আর কিছুই দেখতে না পেয়ে খুবই হতাশ হতাম। তাছাড়া কেউই সেই আশ্চর্য রহস্য আমার কাছে উদ্ঘাটিত করেনি আর তাই বেশ অনেকদিন ধরে আমি জোরাজুরি করতাম যাতে দাঁতের ডাক্তারকে বলে আমার দাঁতগুলোও দিদিমার মতো করে দেওয়া হয়। তাহলে তিনি যখন আমার দাঁত মাজবেন তখন আমি রাস্তায় গিয়ে খেলতে পারব।  

আমার আর দিদিমার মধ্যে এক ধরনের গুপ্ত সংকেত ছিল। সেই সংকেতের মাধ্যমে আমরা দুজন এক অদৃশ্য বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। দিনের বেলায় তাঁর সেই রহস্যময় জগৎ আমার বেশ ভালোই লাগত। কিন্তু রাত হলেই তা আমায় ভয়ে আচ্ছন্ন করে দিত। অতি সাধারণ নিখাদ এক ভয়–অন্ধকারের ভয়। যে ভয় আমাদের অস্তিত্বের চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন। সেই ভয় আমাকে সারা জীবন ধরে তাড়া করে বেড়িয়েছে সারা বিশ্বের সর্বত্র, নির্জন রাস্তা থেকে সাধারণ নাচের আসর পর্যন্ত। দাদুর ওই বাড়িতে প্রতিটি সাধুর একটা করে ঘর ছিল আর প্রতিটা ঘরের ছিল নিজস্ব মৃত মানুষ। কিন্তু ‘মৃত মানুষের বাড়ি’ বলে ঘোষিত যে বাড়িটা আমি চিনতাম তা হল আমাদের এক প্রতিবেশীর এবং সেই বাড়ির একমাত্র মৃত মানুষটিকে প্রেতাত্মা সংক্রান্ত এক সভায় সনাক্ত করা হয়। জানা যায় জীবদ্দশার তার নাম ছিল আলফোনসো মোরা। তার কাছের একজন মানুষ ব্যাপ্টিজম ও মৃত্যুর শংসাপত্রে আলফোনসোর নাম খোঁজার বহু চেষ্টা করে। কিন্তু একই নামের অন্য অনেক মানুষের সন্ধান পেলেও আমাদের এই মৃত মানুষটির কোনো চিহ্ন সেই কাগজপত্রে পাওয়া যায় না। বহু বছর ধরে ওই বাড়িতে একজন পুরোহিত বাস করতেন এবং শেষে গুজব রটে যায় যে ওটা আসলে ফাদার আঙ্গারিতারই ভূত। তাঁর ভূতই রাতে ঘুরে বেড়ায় আর যারা তার দিকে নজর রাখে তাদের ভয় দেখায়।

টীকা:

১। সাবানাস দে বোলিবার: কলোম্বিয়ার বোলিবার রাজ্যের একটি সমভূমি অঞ্চল। গাবোর জন্মস্থান আরাকাতাকার নিকটবর্তী এই অঞ্চল। 

২। উড অ্যালকোহল: Methanol (CH3OH) বা Methyl alcohol নামেও পরিচিত। এটি একটি জৈব রাসায়নিক তরল যা বর্ণহীন ও দাহ্য।

৩। বাসিলিস্ক সাপ: ইউরোপীয় উপকথায় সাপেদের রাজা, যার একবার দৃষ্টিপাতেই মৃত্যু ঘটে।  

৪। লা মাগনিফিকা: একটি প্রার্থনা। গ্রাম্য কৃষকদের মধ্যে প্রচলিত, তবে গির্জা দ্বারা অনুমোদিত নয়। 

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *