ঝাঁপরজ্জু – হামিম কামাল
সলিলের মৃত্যুশয্যা
রেবা, তুই ভালো থাকিস মা। তোর মায়ের খেয়াল রাখিস। ওর ওপর রাগ করে থাকিস না। সব সময় মনে রাখিস, তোর যেমন সাথী আছে, সেও তেমনই আমার সাথী। আমি যদি মরেই যাই, আমার কবর যেন বারইয়ার হাটে হয়। আমার ওই ভাগ্নের বাড়িতে। ওকে বলা আছে। ওরা আমাদের আত্মীয় না বলে অনেকে বিরোধিতা করবে। করুক। তুই অটল থাকিস। মনে হয় না খুব বেশিক্ষণ আমি আর আছি রে। আগে বুঝতাম না মানুষ এসব বলে কীভাবে। এখন মনে হচ্ছে, ভেতরটা যেভাবে ভাঙা পড়ে, তাতে খুব বোঝা যায়। সেই ভাঙার শব্দ যে শোনে, সে-ই জানে। তবু একটা অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তা কোনোদিন আমাদের পিছু ছাড়ে না। তোর মাকে পাঠিয়ে দে না একবার। ওর সাথে আমার চল্লিশটা বছর বোধহয় আর ক-টা দিনের জন্য পূরণ হল না।
দর্শনার্থী ঘর
একঘণ্টা পার হয়ে গেছে, আইসিইউতে ঢেকে রাখা আমার বাবার লাশটার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আমরা এখনও আসতে পারিনি। লাশ প্রথমে ঢাকার যেখানে থাকি সেখানে নেব নাকি সরাসরি দেশের বাড়িতে? মা ভাবছে আগে ঢাকার বাসায় নেবে। সেখানে রাতটা কাটাবে কারণ ওই এলাকায় আজ ত্রিশ বছর। ওখানকার মানুষ যারা আছে তাদেরও বাবাকে শেষবার দেখার অধিকার আছে।
‘রেবা? শুনে যা না মা!’
যা না!
আমি যাব না কোথাও। এখানেই বসে থাকব। একজন মানুষ এইমাত্র মারা গেছে। একটু নিঃশব্দে শোক করারও অবকাশ নেই। ডাক্তাররা এসে এসে দেখে ফিরে যাচ্ছে, কিছু বলতেও পারছে না, আবার সইতেও পারছে না। কী অদ্ভুত, তাই না? ছোটবেলা থেকে একদিন বাবা-মা মরে যাবে এই কল্পনা আসা মাত্র চমকে উঠতাম। মনে হত, না, এমন কখনও হবে না। শুরু হয়ে গেছে।
‘রেবা!’
মা ডাকছে।
ডাকুক না।
থেকে থেকে একটা অদ্ভুত অনুভব মনে আসছে। মনে হচ্ছে, বহু বছর পর আমার মৃত্যুশয্যায় মনে পড়বে, ছায়া ছায়া সন্ধ্যায় একদিন আমার বাবা মারা গিয়েছিল। বাবাকে নিয়ে আমার এ মুহূর্তের ভাবনায় অতীত আর ভবিষ্যত আছে কেবল। বর্তমান নেই।
ডাক্তারের ঘর
ভদ্রলোক একদম আমার বাবার বয়েসি। চেহারাতেও চোয়ালের দিকটায় কেমন বাবার মতো। তাই বুঝি মনে এত লাগল? ওহ্, শহরটা ভেঙে পড়ছে সেলোলাইসিসে। সামান্য এক পতঙ্গ, অথচ বারবার সে অসামান্য হয়ে আসছে। আমার বাবার সময়ে এসেছিল ম্যালনিরিয়া হয়ে। আর এখন… আমার পরিবারকে রক্ষা করো প্রকৃতি। গ্রামের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। তবে ভালো হলে কী হবে, খারাপ হতে সময় নেবে না। এই ভাইরাস দ্রুত নিজেকে বদলে নিচ্ছে।
বিবর্তনের ইস্যু। কারো কি চোখে পড়ছে? ডাক্তারদের অনেকেই তো বিবর্তন মানে না। সাধারণের ওপর আর কী দাবি করব!
লোকটার নাম … অদ্ভুত তো? আমার প্রিয় গীতিকারের নামে নাম। ওহ্, কী আগুন একেকটা গানে! আর ওই গানটা? আহ্বান, শোনো আহ্বান, আসে আহ্বান… মেঘে ঢাকা তারার কথা মনে পড়ে গেল আবার। আগুন একটা! কমলেশ্বর মুখার্জির সব দেখে ফেলতে ইচ্ছে করেছিল ওটা দেখার পর। আর কী কী আছে তার? রবিকে কতদিন ধরে বলছি সিনেমাটা দেখে একটু মানুষ হ।
ডেথ সার্টিফিকেট
হাসপাতাল আইডি : ডিএমইউ-০৬-০৬১৯
নাম : সলিল চৌধুরী।
বেড নং : ০৬
ঠিকানা : ৪৯২ অবন্তী, রূপোসনগর, ঢাকা।
মৃত্যুর কারণ : মাল্টিঅর্গান ফেইলইয়োর ডিউ টু মাস মেমব্রেনোলাইসিস
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
:পতঙ্গ এত ভয়ানক হয়া উঠল কবে, কখন? কখনও পাত্তা দিলাম না, আর সলিলটারে কাইড়ই লয়া গেল। কোন্ অবসরে এত ভয়ানক হয়া উঠল? সামান্য এক পতঙ্গই তো, না? মানুষের মতো মহৎ প্রাণ তার বলি হইল।
:পতঙ্গটা একা নয়। পতঙ্গবাহী ভাইরাসটাই মূলত ভয়ানক হয়ে উঠেছে। আর মানুষ আবার মহৎ কবে হল রে? শোন্ মেশকাত, তোকে আগেও একদিন বলেছিলাম। এই যে প্রকৃতিটা দেখছিস, এখানে মানুষ এই তোর ‘সামান্য’ পতঙ্গের সাথে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে। প্রতিযোগিতায় কখনও সে জেতে কখনও হারে। হিসাবটা এমন। সামান্য পতঙ্গ, মহান মানুষ… হিসাবটা এমন না।
:কী দারুণ কইলি, প্রতিযোগিতা। এই একটা শব্দই সব কিছু বইলা দিল। তুই তো উপপাদ্য প্রমাণ কইরা ফালাইলি। কিন্তু বন্ধু তো ফিরৎ আইল না।
:ভাবি একেকবার, পৃথিবীর কোথাও গিয়ে তাকে পাবো না। ভুল করেও কোনোদিন আর কল দিয়ে বলবে না, এই রে, আনিস নাকি। বাসায় আছিস? তোকে ভুল করে কল দিয়ে দিয়েছি। আর কী কাকতালীয় দ্যাখ, আমিও তোর বাসায় নিচেই।’ শালা জোকার ছিল একটা!
: জোকার একটা শালার পো শালা। মইরা গেল মায়রে বাপ।
: কাঁদছিস কেন? কথা তো কম শোনাসনি।
নগরপালের কক্ষ
৩১ জুলাই, —
মাননীয় উপদেষ্টা। অসময়ের আম খেয়ে আমাশয় বাঁধিয়ে বসে থাকা বিশেষ করে আপনাকে শোভা পায় না। বিশেষত জাতির এই দুর্দশাগ্রস্ত দিনে। সে যাক।
আপনি জানেন, কোনো রাসায়নিকই পতঙ্গটিকে আটকাতে পারছে না। আমি আপনাকে একটা কথা বলি সাহেব। একান্ত নিজস্ব অনুধাবন আমার। আমরা দেখছি গ্রামে সেলোলাইসিসের প্রকোপ বেশি নয় শহরের তুলনায়। মৃত্যুর অনুপাতটা ৪৯ : ১। বেশ চোখে পড়ার মতো, তাই না? এর কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে, গ্রামে একটা তুলনামূলক সম্পূর্ণ খাদ্যচক্র বজায় আছে, শহরে যেটা নেই। গাঁয়ে ব্যাঙ আছে। সেই ব্যাঙ কীটপতঙ্গ ধরে ধরে খেয়ে ফেলে। শহরে এরা নেই। মানে নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে…
প্রস্তাবটা হাস্যকর লাগছে? লাগলেও কী আর করা। জৈবিক সমস্যার জৈবিক সমাধান। কিন্তু আমারও যে একটু ভয় ভয় লাগছে না তা নয়। এটা করা হলে লোকে আমার নাম দেবে ব্যাঙ রাজপুত্র। নাহ্, এত ভালো নাম ওরা দেবে না। আরও শোচনীয় কিছু দেবে।
অজ্ঞাত দৈনিকের বার্তাকক্ষ
: শিরোনাম দাও, নগরপালের দায়িত্বে ব্যাঙ বাহাদুর
: গড়পড়তা। আরও ভালো কিছু চাই।
: তাহলে ‘কীট’ ঠেকাতে আসছে ১০ হাজার ব্যাঙ?
: (পাশের টেবিল থেকে) আত্মঘাতী উদ্যোগ বলে সাব্যস্ত করলে কেমন হয়?
: আপনি ভাই সবটাতেই সিরিয়াস। এ উদ্যোগ আত্মঘাতী এ কথা আমরা এখনই বলি কী করে?
: আমরা বলব না তো। কোট-আনকোটে রাখব। কাউকে দিয়ে বলাব।
: না, বিপদ হতে পারে।
: আপনি না করলে বলাব না।
: চলুন বুদ্ধির গোড়ায় বরং ধোঁয়া দিয়ে আসি।
: চলেন চলেন। এভাবে মাথা খেলছে না আসলে। ফেলুদা দেখতেন নাকি খুব?
: দেখিনি তেমন। পড়েছি বেশি।
নগরপালের কক্ষ
০৭ সেপ্টেম্বর —
মাননীয় উপদেষ্টা, লোকে আমার নাম দিয়েছে ব্যাঙ। স্রেফ ব্যাঙ। এর জন্যে কিনা দিনরাত খেটে মরছি! ক’দিন হল আমার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। চেয়ারে বসতে বসতে সেদিন মাসল স্প্যাজম হল। তবু নিরুপায়। দপ্তর ছাড়তে পারি না। পথে যখন নেমেছি এর শেষ দেখে ছাড়ব।
কীট দূর হয়েছে। সেলোলাইসিসও আর নেই। কিন্তু শহর আজও উপদ্রুত জনপদ। মানুষের দোষ দেব কী। শহর ব্যাঙে ছেয়ে গেছে, আপনি জানেন! টয়লেটে বসতেও ভয় হয়। সারাক্ষণ মনে হয় ভেতর থেকে ঝাঁপ দিয়ে এই বুঝি গুহ্যদেশ কামড়ে ধরল। আমি নিরুপায়, ফাঁকা মস্তক। আপনার পরামর্শ প্রত্যাশিত। বিপদে আপনার মাথা আমার চেয়ে অনেক ভালো কাজ করে। কিন্তু নগরপালের দায়িত্বে বসে আছি কিনা আমি। বাংলাদেশে আসলে যোগ্য লোক তার পদ পায় না। দুঃখিত উপদেষ্টা সাহেব। একটু মশকরা করে ফেললাম। মনমেজাজ ঠিক নেই।
যাক, এসব আলাপ পরেও করা যাবে। এখন বলুন …
নাচোলের এক শ্রেণিকক্ষ
: ব্যাঙের পর এল সাপ। বলো তো, এত এত সাপের বিষ ভাঙল কোন্ সাপুড়ে?
: বাবুরাম সাপুড়ে, ম্যাডাম।
: হা হা হা। ঠিক আছে। যেমন প্রশ্ন করেছি, তেমন উত্তর দিয়ছ। সাপগুলো বিষধর ছিল না। আবার ঝোপঝাড় ভেঙে ধরে আনা নির্বিষ সাপও ওগুলো ছিল না। ছিল ভয়ংকর।
: কী সাপ, মিস?
: এঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছিল অজগর সাপের জিনে। জিন কী, সেখানে আবার কী করে ইঞ্জিনিয়ারিং করে, এসব তোমরা আরেকটু বড় ক্লাসে পড়বে। জিনেটিক এঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বড় হয়ে কে পড়তে চাও? কী কাণ্ড, সবাই পড়তে চাও? বেশ।
: ম্যাডাম, ব্যাঙ খাওয়া শেষ করে অজগরগুলো তো মানুষ খেতে শুরু করল?
: মানুষ খাওয়ার ক্ষমতা ওদের ছিল না। বললাম না, ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে! সাপগুলোকে এলাকার কুকুর বেড়ালগুলো ভয় করত। ইঁদুর, ব্যাং, ছোটো পাখি ছাড়া ওরা কিছু খেতে পারত না, কিন্তু ওদের পেটে আস্ত হরিণ খাওয়ার খিদে লেগে থাকত। ব্যাঙ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইঁদুর, পাখির এসব খাবারের প্রতিযোগী ছিল পথের বেওয়ারিশ বেড়াল কুকুর। সাপগুলোর মেজাজ বিগড়ে থাকত। একদিন তারা মেজাজ দেখাতে শুরু করল। শ্বাস বন্ধ করে বেড়াল কুকুর মারতে শুরু করল ওরা। পথে ঘাটে কুকুর বেড়াল মরে পড়ে থাকত। নগরপাল আবার বিপাকে। কোনদিন মানুষকে আক্রমণ করে বসে। বাংলাদেশ সরকার চীনের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের দেশ কি আমাদের সাপ কিনবে?’ চীনা রাষ্ট্রদূত বলল, ‘আমি আলাপ করে জানাচ্ছি, মহাশয়া।’ সরকার বলল, ‘বেশ, জানাও।’ ক’দিন পর সে বলল, ‘না মহাশয়, আমার দেশ জিন এঞ্জিনিয়ারিং করা ত্রুটিপূর্ণ সাপ কিনতে রাজি নয়। প্রাকৃতিক সাপের যোগান আমাদের যথেষ্টই আছে। চাষবাসও হচ্ছে, বেচাবিক্রিও ভালো। আমি দুঃখিত মহাশয়া!’
: মিস, বাথরুম।
: যাও। তো, এরপর সম্পূর্ণ নতুন, অকল্পনীয় এক বিপদ এসে হাজির।
(ঢং ঢং ঢং)
: ঘণ্টা পড়ে গেল। বাকিটা কাল। বাড়ির কাজ যে আনবে না তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখব। গল্প সে শুনতে পারবে না।
জানকী নদীর ধার
: দারুণ ম্যাডাম ছিলেন তো তোমাদের! আচ্ছা, কী বিপদ হল? নগরপাল কিছু করেছিল?
: তোমাকে সবচেয়ে রুপসী দেখায় যখন প্রশ্ন করো। চোখে, ভুরুতে কী যেন হয়ে যায়। না, মানুষকে আনতে হয়নি। ওনারা নিজ থেকেই এসেছিলেন।
: কারা?
: সাপখেকো তাতারে ঈগল। লাখে লাখে, ঝাঁকে ঝাঁকে।
: এত তাতারে ঈগল ছিল কোথায়?
: জানকীর ওপারে কতদূর গেছ?
: বেশিদূর যাইনি। কেন বলো তো?’
: ওপারে বহুদূরে এক পাহাড় আছে। ধূমকল পাহাড়। সেখানে কবে কখন ওরা এমন বাড়ল কেউ জানত না।
ভীষণ ভালো লাগলো। ❤
লেখা সার্থক হলো। ভালোবাসা জানবেন।