কথাসাহিত্যিক কাজী রাফির সাক্ষাৎকার

কথাসাহিত্যিক কাজী রাফির সাক্ষাৎকার

শেয়ার করুন

মুহিম: সমাজ-সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘পাশে আছি’র পক্ষ থেকে আপনাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা, শুভ নববর্ষ!

কাজী রাফি: তোমাকেও নববর্ষের শুভেচ্ছা মুহিম, শুভ নববর্ষ।

মুহিম: কেমন আছেন? কেমন কাটল পহেলা বৈশাখ?

কাজী রাফি: এবার পহেলা বৈশাখ বেশ আনন্দে কাটল। দেশের বাইরে থেকে দীর্ঘদিন পর আমাদের এক ভাবী আর তার সন্তানরা এসেছেন। তিন পরিবার মিলে ঘুরলাম। তবে, আগামী ঈদসংখ্যার গল্পের জন্য সৃষ্ট চরিত্ররাও আমার সাথে ছিল।

মুহিম: দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু কালোত্তীর্ণ সাহিত্যকর্ম পেয়েছি আমরা। পহেলা বৈশাখ নিয়েও প্রতি বছর ক্রোড়পত্রগুলোর পাতা ভর্তি হতে দেখি। কিন্তু শিল্পের মানদণ্ডে কতটুকু সার্থক হয়ে উঠছে এসব গল্পকবিতা? আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারে আদৌ তেমন কিছু যোগ হচ্ছে তো?

কাজী রাফি: অনেক তরুণদের লেখায় প্রতিভার ছাপ দেখলেও মগ্নতার অভাব দেখি। তাদের পাঠ-পঠনের সময় হয়তো খেয়ে ফেলছে অন্তর্জালের জগৎ। এই জায়গাটায় তাদের সচেতনতা জরুরি। আর বিশ্বসাহিত্যের ছোটগল্পগুলোর পাশে আমাদের ছোটগল্পগুলো দেখো। উপন্যাসের ভাষায় ছোটগল্পকে ধরা যায় না। ছোটগল্প সৃষ্টির ভাষাটাই আলাদা হতে হয়। ছোটগল্পের মেজাজ, গড়ন এবং সৃষ্টির রহস্য পাঠককে যেন নতুন এক জগতের সন্ধান দেয়। এক সাক্ষাতকারে আমি বলেছিলাম, ‘‘ছোটগল্প যেন হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে চলন্ত ট্রেনে হঠাৎ এক ঝলক দেখেই চমকে ওঠার মতো হয়। ভ্রম হয়েও যা বোধকে জাগিয়ে দেয়। আসলে কবিতা মানুষের চলমান জীবনে নিত্য ভাবনা ও অনুভবের অনুষঙ্গ হলেও গল্পটা বোধের অনুষঙ্গ। কবিতা বাইরের জগৎকে অন্তর্লোকে পাঠাতে চায়। আর শিল্পমানোত্তীর্ণ একটা গল্প যেন পাঠকের অন্তর্লোক দিয়ে বাইরের জগৎটাকে দেখতে চায়।’’ এখানে আমাদের ছোটগল্প সৃষ্টির পরিসর আসলেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। অনেক কবিতার ভিড়ে উজ্জ্বল কিছু কবিতাও মাঝে মাঝে চোখে পড়ে।

মুহিম: একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবেই আপনাকে জানি আমরা। হাসান আজিজুল হক স্যার তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে একজন নতুন ঔপন্যাসিকের আবির্ভাব’ প্রবন্ধে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আপনার লেখনির। বলেছেন, “আমরা লেখকদেরকে চার শ্রেণিতে বিভাজন করতে পারি।… কিন্তু যাঁদের মতন আর কেউ হয় না, তাঁদেরকে বলে ‘জিনিয়াস’। আমি আজ প্রথমেই ঘোষণা করে দিই যে, ‘ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলাদেশে এবং বর্তমান বাংলা সাহিত্যে একজন জিনিয়াসের আবির্ভাব ঘটেছে। সেই জিনিয়াসের নাম কাজী রাফি।” (কালি ও কলম; দ্বাদশ বর্ষ, নবম সংখ্যা, কার্তিক ১৪২২)। ঠিক সূচনালগ্নেই উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের এমন স্বীকৃতিতে কেমন লেগেছিল আপনার?

কাজী রাফি: না, এটা ঠিক সূচনালগ্নে নয়। ২০১২ সালে একদিনের ঘটনা। হাসান আজিজুল হক স্যার আমার নাম্বার জোগাড় করে আমাকে ফোন করলেন। অচেনা নাম্বার বলে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হলো। তাঁর মতো এত বড় মাপের একজন মানুষ আমাকে ফোন করেছেন –তা বুঝতেই আমার সময় লাগল। তিনি কালি ও কলম পুরস্কার ২০১০ –এর অন্যতম একজন বিচারক হিসেবে আমার প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ পড়েছিলেন। বইটা নিয়ে সেদিন তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা শুনে আমার চোখ জলে ভিজে গিয়েছিল। আমি লেখালেখি যেন কখনোই না ছেড়ে দিই তা বলার জন্য ফোন করেছিলেন। কতবড় একজন মানুষ হলে এমন উদারতা দেখানো যায়! তাকে বলেছিলাম, ‘স্যার, আমি আপনার এই কথাগুলো আমৃত্যু মনে রাখব।’ তিনি বললেন, ‘তুমি জন্মেছ গল্পকার হয়ে। হৃদয়ে তার কষ মেখে। মনে রেখো। মনে রেখো। কাজী রাফি হয়ে ওঠো। পদ-পদবি মানুষের পোশাকি ব্যাপার। জীবনের নিত্য প্রয়োজনের বাইরে তোমাকে বেড়ে উঠতে হবে, বড় হতে হবে আত্মায়-সত্তায়। যেটা পেয়েছ, তা হারিয়ে ফেলো না। আমাদের ক্ষতি করো না। বাংলা সাহিত্য, এই যে আমার হাতের তালুটা আছে না, এর মধ্যে… একটা ডোবার মধ্যে আটকা পড়ে আছে। এখান থেকে এটাকে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত করাতে হবে। করবেটা কে? তরুণদেরই করতে হবে। তোমার সেই শক্তি আছে। ব্যবহার করো…।’’ এরপর স্যার আমার নতুন কাজ নিয়ে জানতে চাইলেন। ‘ত্রিমোহিনী’উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির কাজ একদম এগুচ্ছিল না। তার এক ফোনে আমি নতুন করে জেগে উঠলাম। প্রবল এক শক্তিতে আমার হৃদয়ের পলি ফসল ফলিয়ে গেল। ২০১৪ সালে প্রকাশের পর ৪৫৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসটা পড়ে স্যার আমাকে ফোন করলেন। আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, ‘তুমি পেরেছ, রাফি। সময় করে আমি উপন্যাসটি নিয়ে লিখব। ‘ত্রিমোহিনী’ নিয়ে আমাকে বলতেই হবে।’ তারপর ২০১৫ সালে ত্রিমোহিনী এবং কাজী রাফিকে নিয়ে তিনি তাঁর মূল্যায়নটুকু কালি ও কলমে লিখলেন। লেখাটা পড়ে আমার কান্না পেয়েছিল। কেন না, বাবা আমার এই উপন্যাসটি পড়ার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছিলেন (উপন্যাসটি লিখতে আমার সময় লেগেছিল ছয় বছর)। কিন্তু তা প্রকাশের ঠিক দুই মাস আগে এক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারিয়েছিলাম। লেখালেখি ছেড়েই দিয়েছিলাম প্রায়। কিন্তু একজন হাসান আজিজুল হক বাবাকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে দিলেন। আমার পিতার আসনেই তাঁকে বসালাম। তাঁকে আমার সাহিত্যপিতা মেনেছি বলে, লেখার এই জীবনটাকেই আমি বয়ে বেড়াই। বয়ে বেড়াতেই হয়। তাঁর ঋণ শোধবার নয়। হ্যাঁ, তার কাছ থেকে পাওয়া এই স্বীকৃতি আমার কাছে আজীবন আরাধ্য হয়ে থাকবে। তাঁর এই মূল্যায়ন যে কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তির চেয়ে অনেক বড় প্রাপ্তি বলে আমি মনে করি।

(আলাপচারিতার মধ্যেই) এবং স্যার যে নিরেট সত্য কথা বলেছেন, যোগ্যজনকেই যোগ্য বলে জানিয়েছেন, আপনার প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ই তো তার জ্বলজ্বলে প্রমাণ। হাসান স্যার ছাড়াও অনেক সাহিত্যবোদ্ধা–ভাষা মতিন, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দীকী, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ড. বেলাল হোসেন স্যার ছাড়াও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক রেজভি জামান সমধিক প্রশংসা করেছেন আপনার এই উপন্যাসটির।

মুহিম: কোনো সাহিত্যপুরস্কারই যদিও সাহিত্যিকের চূড়ান্ত স্বীকৃতি নয়, তারপরও সেটাও একধরনের স্বীকৃতি বটে। সেদিক থেকেও তো প্রাপ্তিতে প্রোজ্জ্বল আপনার সৃষ্টি। এই যেমন ‘সাসান্দ্রা’ (ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা) প্রকাশের বছরই পেয়েছে মর্যাদাসম্পন্ন ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার-১০’ এবং ‘এম এস ক্রিয়েশন সম্মাননা-১০’। আবার ২০১৩ সালে উপন্যাস ও ছোটগল্পে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘নির্ণয় স্বর্ণপদক’। এই যে সূচনাতেই এমন স্বীকৃতি। আমরা কি ধরে নিতে পারি না, বেশ প্রস্তুতি নিয়েই কলম ধরেছেন আপনি?

কাজী রাফি: আমি আসলে ভালো একজন পাঠক ছিলাম। বিশ্বসাহিত্যের চরাচরে আমার বিচরণ সেই অষ্টম শ্রেণি থেকে। তুমি জানলে হয়তো অবাক হবে, অষ্টম শ্রেণিতেই আমি ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডেসি’ পড়েফেলেছিলাম। সেটা এক ধরনের প্রস্তুতি বটে। কিন্তু হলো কি, জাতিসংঘের কাজে এক বছরের জন্য আফ্রিকায় গিয়ে অফুরন্ত সময়কে কাজে লাগানোর মানসে আমার আটাশ বছর বয়সে আমি প্রথম কলম ধরলাম। কোন এক ঘোরের মাঝে আট মাসেই সৃষ্টি হলো আমার প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’। বিশাল কলেবরের এই উপন্যাস লেখার সময়ই আমি লিখেছিলাম, ‘রূপডাঙ্গার সন্ধানে’, ‘নাট্যকার’সহ আরো পাঁচটা ছোটগল্প। উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে এত ভালোবেসে ফেলেছিলাম যে, এলমা-অথৈ-দিবাসহ অসংখ্য সেইসব চরিত্র আমার সাথেই বাস করত। শব্দের ডালা নিয়ে ময়ূরের মতো পেখম মেলেছিল আমার হৃদয়। হ্যাঁ, আমার বিস্তর পাঠ এই সৃষ্টিলোকে আলো হয়ে আমাকে পথ দেখিয়েছিল। উজ্জীবিত করেছিল। পুরস্কার সাময়িক আনন্দ দেয়, দায়বদ্ধতা তৈরি করে এবং পাঠকের কাছে একটা গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি করে। কিন্তু সৃষ্টির শক্তি দুর্বল হলে পুরস্কার মূল্যহীন তো বটেই বরং তা একসময় বোঝা হয়ে যায়। পাঠকের হৃদয় আর বোধকে উদ্ভাসিত করার সামর্থ্যের চেয়ে বড় কোনো পুরস্কার আর কি হয়?

মুহিম: ‘ধুসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ সৃষ্টির ভাবনাটুকু আমার মাথায় কেন এলো? এর উৎস অথবা প্রেরণা পেলেন কোত্থেকে।

কাজী রাফি:আফ্রিকায় বসে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম। তা ছিল এমনঃ ‘‘দশটি বিশালাকৃতির কন্টেইনার নিয়ে কার্গো ট্রাকগুলো জাতিসংঘের একটা সামরিক ক্যাম্প অতিক্রম করছে। প্রতিটি কন্টেইনারের গায়ে ইংরেজিতে লেখা, ‘গোল্ড’ এবং ‘পঁচিশ টন’ শব্দ দুটি। ফরাসিদের চিরশত্রু ব্রিটিশরা রাস্তার বামপাশে গাড়ি চালায় বলে তারা একই কাজের জন্য ডানপাশ বেছে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শত্রুতার জের ধরে এরা এখনো মননে-চিন্তায় একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। ব্রিটিশরা পা দিয়ে হাঁটছে এর বিকল্প হিসবে হাত দিয়ে হাঁটা সম্ভব হলে ফরাসিরা তাই-ই করতো। কিন্তু দেখো, শোষণের বেলায় এদের একে অন্যের সাথে কত সাদৃশ্য! কন্টেইনারের গায়ে ব্রিটিশদের ভাষা ইংরেজিতে ‘গোল্ড’ লিখতে এদের আর জাত যায় না। সাম্রাজ্যবাদ আর শোষণের বিস্তৃতিতে মোক্ষ এই ভাষাটা জায়গামতো তারা ঠিকই ব্যবহার করছে। ফ্রেঞ্চে কথা বলা আইভরিয়ানগণ ইংরেজি ভাষাটা পড়তে পারলেও এর অর্থ বোঝে না! নির্জন মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যে কোনো আইভোরিয়ানের চোখে এই শোষণ তাই আলাদা কোনো দ্যোতনা তৈরি করে না। তার আগুনের মতো লাল চোখ দুটোতে এত স্বপ্নহীনতা (নিজস্ব ভাষাহীনতা স্বপ্নহীনতা তৈরি করে) যে, তাতে প্রতিবাদের ভাষা ধিকিধিকি আগুন হয়ে নয়, বরং অধিকারহীনতার বিস্ময় হয়ে খেলা করে। ফরাসিরা সেজন্যই সবার আগে এই জাতির ভাষা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এখন আমি ভাষার মহান শক্তিটা উপলব্ধি করি। আর শ্রদ্ধাবনত হই সেইসব মহান আত্মার প্রতি যারা বাংলা ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। প্রয়োজন অনুভব করি শক্তিশালী কোনো গল্পের যা উপন্যাসে বিধৃত হয়ে সৃষ্টি হয় মহান কোনো উপন্যাস। ভাষাকে প্রাণদায়িনী করার জন্য শক্তিশালী উপন্যাসের চেয়ে আর কিছু বড় ভূমিকা রাখতে পারে না। ভাষার জীবনিশক্তি কবিতা হলে তার বহমানতা ধারণ করে উপন্যাস। আমি এই জাতির ভাষা হারানোর বেদনাটুকু আমার ভাষায় আমি ধারণ করতে চাই। তাই, দুঃসাহস করে আমি একটা উপন্যাস লেখাতে হাত দিয়েছি। জানি না, পারব কিনা।’’এই ছিল আমার প্রথম উপন্যাস লেখার উৎস।

মুহিম: অভিযোগ উঠছে, ‘তরুণরা পড়ে কম, লেখে বেশি। লেখার মানের দিকে না-তাকিয়ে প্রচারসর্বস্ব হয়ে পড়ছে তারা।’ আমিও নতুন একজন হওয়ায়, এ অভিযোগ কিন্তু আমার ওপরও বর্তায়। (হা হা…) তো একজন অগ্রজ হিসেবে আমার জন্য কী পরামর্শ থাকবে আপনার?

 

কাজী রাফি: এখনকার তরুণদের লেখায় আমি মেধার স্ফুরণ দেখি। তারা যে অস্থির আর এলোমেলো একটা সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে –এটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন। কোন কালে প্রচারণা ছিল না? এই যে, তুমি এত পড়ছ, তবু তোমার ফেসবুক ব্যবহারকে আমি একটা অজুহাত দেখিয়ে তোমাকে বাতিল করে দিলাম – এটা ঠিক নয়। তবে এটাও ঠিক, কেউ কেউ পড়াশোনাটা একদম করে না। তারা এটুকু বুঝতে চায় না যে, সাহিত্যপাঠ না করে তারা পিছন থেকে শুরু করছে। সাহিত্য অথবা সৃষ্টির জগৎ এত সহজ বিষয় নয় যে, দুই/চার হাজার লাইক দিয়ে তা বিচার্য। হাসান আজিজুল হকের কথায় বলতে হয়, ‘চোখের আকার-আকৃতি দিয়ে সৌন্দর্য বিবেচিত হতে পারে, সাহিত্য হয় না।’ সাহিত্য করতে হলে বাংলাসাহিত্য, বাংলাদেশের সাহিত্য এবং বিশ্বসাহিত্য কোথায় দাঁড়িয়ে আছে –তার শীর্ষবিন্দুটা একজন লেখককে শনাক্ত করে তবেই অগ্রসর হওয়া তার উচিত। ফেসবুকে পড়তে পড়তে এক সময় মানুষ বিরক্ত হবে এই কারণে যে, একই পাতায় গরু-ছাগল-ভেড়া; জাতীয়-ব্যক্তিগত-আন্তর্জাতিক বিষয়াদি এত বিভ্রান্তিকর স্ট্যাটাস আর রচনা, হাজার হাজার মানুষের সাজুগুজু করা ছবি, সিনেমা-বায়োস্কোপ-ব্যবসার এই জগাখিচুরি পাকানো জগৎ সময় কেড়ে নেওয়া ছাড়া কিছুই দিয়ে যায় না –একদিনমানুষের এই বোধ স্পষ্ট হবে। মানুষের পরিশেষে যাত্রা জ্ঞানের পথে বলে অ্যামাজনের বই বিক্রেতা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি। আর একটা বিষয়, আমাদের দেশে আমাদের অগ্রজগণ অকারণে এত লিখেন যে, তারা আমাদের নিয়ে ঠিক খোঁজও রাখেন না। রাখতে পারেন না। অথবা তা তারা চানও না। আমি মনে করি, এখানে আমাদের সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মুহিম: অনেক ধন্যবাদ। আসলে অনেকেই এভাবে বলেন না। যদি ভুল বুঝে না-থাকি, নতুনদের লেখার প্রতি কেমন একটা উন্নাসিকতা পোষণ করেন আমাদের অগ্রজগণ। ক্রমাগত বাংলা সাহিত্যে তো একেকটা মণিমাণিক্য যোগ করে চলেছেন আপনি। তারই সূত্র ধরে নতুন বছরে কী পেতে যাচ্ছি আমরা?

 

কাজী রাফি: আটলান্টিকের তীরে ক্যাসাব্লাঙ্কা শহরটা আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকেএখনো। এই শহরের প্রকৃতি, মানুষের জীবনাচরণ নিয়ে আমি খুব নস্টালজিক হয়ে উঠি। এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং ইউরোপ আর আফ্রিকা থেকে মানুষের অভিপ্রয়ানের বৈচিত্রময় ইতিহাস নিয়ে শহরটা যেভাবে আমার চেতনাকে, আমার কল্পলোককে আছন্ন করে আছে তা নিয়ে লিখছি। কালি ও কলম এবং আমাদের সময় ঈদসংখ্যায় গল্প দুটো যাবে। এছাড়াও বাংলা একাডেমির একটা গ্রন্থের জন্য মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা গল্প দিতে হবে। তা সৃষ্টির জন্য আমার ভাবনাকে এবং পরিশেষে হৃদয়কে অবারিত করার চেষ্টা করছি। এই গেলো, ছোটগল্পের কথা। আসি উপন্যাসের কথায়। ডলার এবং যৌনতার দামে বিক্রি হয়ে যাওয়া আফ্রিকার আরো এক অধ্যায়কে উন্মোচন করতে আমি ডুব দিচ্ছি আরো এক উপন্যাস সৃষ্টির ঘোরে। আফ্রিকা আমার ভাবনা এবং নস্টালজিয়ার এক উর্বর প্রান্তর। ২০১৬ সালে লেখা শুরু করে ২০,০০০ শব্দ লেখার পর বিরতি দিয়েছিলাম লেখাটায়। মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে তিউনেশিয়া, মিশরের সিনাই হয়ে সাহারা পর্যন্ত তোয়ারেগ অথবা মুর এবং আরবদের অভিপ্রয়ান এবং তাদের যাযাবর রক্তে লুকিয়ে থাকা অভিযোজনের সূত্র, মালি নামের এক রাষ্ট্রের মরুর বুকে লুকানো রেডিয়াম আর ইউরেনিয়াম নিয়ে খেলায় মেতে ওঠা বিশ্বটাকে আরো একটু পর্যবেক্ষণে এবং অধ্যয়নের জন্যই এই বিরতি। রাজনীতির ভূয়া মাঠ কীভাবে বিশ্বকে ভ্রান্ত ধারণায় পুষ্ট করতে মিডিয়াকে এবং জাতিসংঘকে ব্যবহার করে, নিউইয়র্কে বসে সিআইএ আর প্যারিসের কর্তারা লাস্যময়ীদের দিয়ে আফ্রিকার রাষ্ট্রনায়কদের লালসা মিটানোর অন্তরালে আল-কায়েদার সাথে কনফ্লিক্ট গ্রাউন্ড তৈরি করে, ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি কীভাবে কিনে নেয় একটা দেশের মানুষের সব অধিকার –আমি এই উপন্যাসে তা খুঁজব। কিন্তু এই উপন্যাসের জন্য দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ এবং ঔপন্যাসিকের প্রয়োজন এমন একজন নায়ক যিনি পরিক্ষীত। সুতরাং ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’র নায়ক অথৈ ছাড়া তার আর কোনো বিকল্প আপাতত নেই। সুতরাং অথৈ ফিরছে এই প্লটে এবং নিউইয়র্কের অধ্যান শেষে অথৈ ফিরছে আফ্রিকার এক মরুপ্রান্তরে যেখানে মরিভো হাশিমি নামের অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারী এক মানব সন্তান তার জন্য অপেক্ষারত। আর এসবের কিছুই না জেনে সাসান্দ্রার নায়িকা এলমা কৃত্রিম বাম হাতটুকু নিয়ে (নরখাদকদের বিষাক্ত তীরবিদ্ধ হয়ে যাওয়া বাম হাতটা হাসপাতালে কেটে ফেলতে হয়েছে) ফিরছে ছোট্ট অথৈকে নিয়ে আফ্রিকায় ফেলে আসা তাঁর স্মৃতিকাতরতা আর নস্টালজিয়ার কাছে।
মরিভো হাশিমি সাহারা প্রান্তরে জন্মগ্রহণ করা সেই জন, ফরাসিদের নির্বিচার রেডিয়াম উত্তোলনের প্রভাবে যার যৌনাঙ্গ সদৃশ এক অদ্ভুত সেন্সর জন্ম নিয়েছে তার মাথার পেছনে। মরিভো হাশিমিকে নিয়ে এলমাকে উদ্ধারে তাদের অভিযাত্রা কোন মানবিক বিপর্যয়ের প্রান্তে গড়াবে তা এখনো আমার কাছে স্পষ্ট নয়।এই উপন্যাসে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সব চর্চাকে আমি প্রশ্নের সম্মুখীন করাতে চাই। মানব জীবনের ভাঁজে ভাঁজে, খাঁজে খাঁজে ফেলে আসা নস্টালজিয়ার রহস্য আর সব কৃষ্টি-কালচারকে তলিয়ে দেখতে চাই। দেখতে চাই, অনিত্য এই জীবনের নিত্যতা যাঁদেরকে এত রসের ভাণ্ডে ডুবিয়ে রাখে যে যুদ্ধ-লুন্ঠন এবং সাম্রজ্যবাদের মোহ যাদের কিছুতেই কাটে না –তারা কোন রসায়নে সৃষ্ট? যাদের হাতে এই বিশ্বের প্রলয় একটা খেলার বিষয় মাত্র। তবে পাঠককে এই উপন্যাসে ঢোকার আগে নিশ্চিতভাবেই আমার প্রথম সৃষ্ট উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ পড়ে নিতেই হবে।

মুহিম: পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকত তাহলে আপনি সেই জন্মে কী হতে চাইতেন?

কাজী রাফি: পরজন্মে আমি একটা গানের পাখি হয়ে জন্মাতে চাই। শব্দের জঞ্জাল এড়িয়ে নির্জনতার মাঝে আমি আমার ভিতরের শব্দের সাথে আমার সুরের সম্মিলীন ঘটিয়ে উড়ে বেড়াতে চাই… সাগরের বালুকাবেলায়। লোকালয়হীন উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় বসে বসে লোকালয় থেকে আমার হৃদয়ে বয়ে আনা ভালোবাসার কুহেলিকাময় মায়াটুকুর বুক চিরে চিরে তা পান করে দেখতে চাই, স্রষ্টা মানুষের হৃদয়ে ‘অনুভব’ নামের বস্তুটায় কতটুকু অমৃত আর বিষের অনুপাত মিশ্রিত করেছেন যে, ভালোবাসলে কেন এমন মাঝে মাঝে মরে যেতেও ইচ্ছা করে? আমি মরে যাই, শব্দের খেলায় – ভালোবাসায়! হ্যাঁ, পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে সেই জন্মে আমি এমন সুরকে বুকে ধারণ করে আবার মরে যেতেই ভালোবাসব! ভালোবাসব কোনো এক সুরের মগ্নতাকেই…

মুহিম: সাহিত্যাকাশে আপনার দ্যুতি আরো বেশি প্রতিভাত হোক! অনিঃশেষ শুভ কামনা। আর আমাদেরকে এতক্ষণ সময় দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, প্রিয় কথাসাহিত্যিক।

 

কাজী রাফি: আমার কাজ নিয়ে, আমার সৃষ্টি নিয়ে তোমার এবং ‘পাশে আছি’র এই অপার আগ্রহ আমাকে উদ্দীপ্ত করবে, প্রেরণা জোগাবে। তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

  1. কাজী রাফির ভাষা খুবই আলাদা করে চেনা যায়। চেতনা আর অনুভূতির জগতকে মোচড় দেয় তার কল্পনা আর প্রখর পর্যবেক্ষণ। ভালোবাসি তাঁকে পাঠ করতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২