ইনবক্স আর কমেন্ট বক্স – মুহিম মনির

শেয়ার করুন

এ পর্যন্ত পঠিত আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পগ্রন্থগুলোর একটি, আল মাহমুদের ‘পানকৌড়ির রক্ত’। এই বইয়ের নাম গল্পটি আমি প্রায়ই পড়ি। পড়ে আমার পাঠতৃষ্ণা মেটাতে চাই; কিন্তু মেটে না। তাই আবার পড়ি; বারবার পড়ি। অথচ মাত্র ক’মাস আগেই প্রথমবারের মতো এই অসাধারণ বইটির খোঁজ পেয়েছিলাম। সর্বপ্রথম যিনি আমাকে বইটি পড়তে বলেছিলেন, আজকের এ লেখাটি তাঁকে নিয়েই লিখছি। তিনি আমার অন্যতম প্রিয় কবি, কাজী জহিরুল ইসলাম। যাঁর ‘থাবড়া হামিদ’, ‘সূর্যাস্তের পরের ফিরিস্তি’, ‘রাস্তাটি ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে’, ‘জালালুদ্দিন রুমির কবিতা’ (ভাষান্তরিত) পড়ে বেশ অভিভূত হয়েছি। অভিভূত হয়েছি তাঁর ‘দেহকাব্য’ পড়ে।
আমার এই প্রিয় কবির সঙ্গে পরিচয় ঘটে ফেসবুকে। ম্যাসেঞ্জার বলছে, দিনটি ছিল ৯ই অক্টোবর ২০১৬। তারপর শব্দঘর সাহিত্যপত্রিকার নভেম্বর-১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর প্রচ্ছদরচনাটি পড়ে ইনবক্সে আমার পাঠোপলব্ধি জানাই। সেটা ছিল ২১শে নভেম্বর ২০১৬। এ লেখায় আমার সেই পাঠোপলব্ধিটি তুলে দিচ্ছি,
“গতকাল এ-মাসের ‘শব্দঘর’ পত্রিকাটি হাতে পেয়েছি। পড়েও ফেলেছি বেশ কয়েকটি লেখা। তবে সবার আগে পড়েছি আপনার লেখাটি: ‘বেলাল চৌধুরীর কবিতা: জীবন খোঁজো শিল্পের তরী বেয়ে।’ শব্দে-শব্দে সাজিয়ে একজন স্বনামধন্য কবিকে উপস্থাপন করেছেন আরেকজন প্রথিতযশা কবি। কথা ও কবিতার রঙতুলিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে এই শৈল্পিক লেখাটি। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। একইসঙ্গে আমার নির্মল আনন্দের সুগন্ধমাখা একরাশ শুভেচ্ছাও রইল আপনার জন্য। আপনার এই লেখাটি সত্যিই আমার বেশ ভালো লেগেছে। মিষ্টি তো মিঠা-ই লাগবে–এটা কে না জানে? আরেকটি কথা: লেখাটি পড়ার পর থেকে আমার মন ফিসফিস করে মনকেই কী বলছে, জানেন? বলছে: ‘জীবন খোঁজো রে মন শিল্পের তরী বেয়ে।”

কিছুক্ষণ বাদে কবির রিপ্লাই আসে। চলতে থাকে কিছু কথা। তিনি বলেন,
‘অনেক ধন্যবাদ। জেনে খুব ভালো লাগলো।’
‘আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার। স্যার, শব্দঘরের আগামী সংখ্যাগুলোতেও আপনার লেখা পাব তো?’
‘গত চার/পাঁচ সংখ্যায় নিয়মিত লিখছি। আশা করছি আগামী সংখ্যাগুলোতেও লিখবো।’

এরপর থেকে শব্দঘরের প্রায় প্রতিটি সংখ্যাই সংগ্রহে রাখতে শুরু করি। সব সংখ্যাতেই যে তাঁর লেখা পেয়েছি, তা নয়। তবে সেই যে শুরু হল; তারপর থেকে একটু একটু করে সমৃদ্ধ হতে থাকল আমাদের ইনবক্স। এ-ফাঁকে আমারও ইচ্ছে জাগল নিজের ফেসবুক ওয়ালে আমিও কিছু একটা লিখি। যেই ভাবা সেই কাজ। ১৫ই ডিসেম্বর-১৬ একটি ম্যাসেজ লিখে ক’জন প্রিয় মানুষের কাছে পাঠালাম। কবিকেও পাঠালাম সেই ম্যাসেজটি।

‘স্যার, আমি একটু-আধটু লেখালেখি করার চেষ্টা করি। গেল কয়েক মাস ধরে একটি উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। এত দিনে কিছুটা এগিয়েছিও। এখন সেই পাণ্ডুলিপিটি থেকে একটু-একটু করে আমার টাইমলাইনে পোস্ট করার ইচ্ছে পোষণ করছি। স্যার, আমার এই সিদ্ধান্ত-নেয়াটা সঠিক হবে কি না, দয়া করে যদি একটু জানাতেন!’

কবির রিপ্লাই এলো, ‘অবশ্যই সঠিক হবে। তুমি অন্যদের মতামত জানতে পারবে।’ আর সেদিনই আমার এক স্ট্যাটাসে কবি মন্তব্য করলেন, ‘তোমার জন্য অনেক শুভকামনা রইলো মনির। শুদ্ধ বাংলা গদ্য তোমার আয়ত্তে আছে। কাজেই কথাসাহিত্য তোমার হাতে প্রাণ পাবে, এ বিশ্বাস আমার আছে।’ আমি ছোটমানুষ; বড় মানুষদের এমন ভালোবাসায়, অনুপ্রেরণায় আমি মুগ্ধ না-হয়ে পারি নি। তাই পরদিনই ‘শালুকফোটা সন্ধ্যায়’ শিরোনামের প্রথম কিস্তিটি পোস্ট করি।

কবি কাজী জহিরুল ইসলাম জানালেন, ‘লিখে যাও, এখনি কিছু বলছি না।’

তাই বলে যে তিনি কিছুই বলেন নি, তাও না। ইনবক্সে আমাদের কথা চলতে থাকে। একসময় ‘কী এসেন্সের’ ধারণাও পাই তাঁর কাছ থেকে। যে-ধারণাটি আমার লেখার ধরনে একটা পরিবর্তন আনে। একটু একটু করে আমি পরিচিত হতে থাকি গদ্যের গতির সঙ্গে। আর এ-কারণে অকপটে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি তাঁর প্রতি।

আবার আগের কথায় ফিরে যাই! ১৮ই ডিসেম্বর ২০১৬ কথাপ্রসঙ্গে কবি তাঁর ‘থাবড়া হামিদ’ ঔপন্যাসিকাটির কথা জানান। শব্দঘরের অনলাইন লিংক আমাকে ট্যাগও করেন তিনি। লিংকটি পাওয়ামাত্র আমার ঢুলুঢুলু চোখের ঘুম হারিয়ে যায়; পড়তে থাকি তাঁর ‘থাবড়া হামিদ।’ পড়া শেষে একটি তাৎক্ষণিক পাঠপ্রতিক্রিয়াও লিখি কমেন্ট বক্সে।

থাক, এত কথা বলার এখতিয়ার আমার নেই। আমি বরং ‘থাবড়া হামিদ’-এর পাঠোপলব্ধি জানিয়েই এ-লেখা শেষ করি। এই উপন্যাসিকাটি পড়তে পড়তে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে, এটি হুমায়ূন আহমেদ-এর লেখা নয়। এতটাই উজ্জ্বল প্রতিফলন! যেন হুমায়ূন আহমেদ-এর আত্মা ভর করেছে কাজী জহিরুল ইসলাম-এর কলমে। যেন নতুন একজন হুমায়ূনকে পেয়ে গেছি আমরা। হ্যাঁ, এতটাই দক্ষতায় হুমায়ূন-সৃষ্টির সূতিকাগারকে উন্মোচিত করে ফেলেছেন কাজী জহিরুল ইসলাম তাঁর ‘থাবড়া হামিদ’-এর আলোয়। তাই খুব স্পষ্ট করেই বলা যায়, সম্ভবত হুমায়ূন-স্টাইলে প্রতিচ্ছবি আঁকতে গিয়ে কাজী জহিরুল ইসলাম আমাদেরকে একেবারেই চমকে দিয়েছেন। প্রতিফলিত করেছেন হুমায়ূন-সৃষ্টি’র অন্তঃসার; ধর্মীয় সংলাপের ফাঁকফোকর। তিনি যেন তাঁর প্রশংসনীয় লেখনী-শক্তির মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরীর এ-কথাটিকেই পুনরুজ্জীবিত করেছেন–‘যিনি গড়তে পারেন, তিনি শিবও গড়তে পারেন; বাঁদরও গড়তে পারেন’। শেষ করার আগে শুধু বলব: সব্যসাচী সাহিত্যিক কাজী জহিরুল ইসলাম-এর ‘থাবড়া হামিদ’ যেন একটি প্রতিফলক। যাতে প্রতিফলিত হয়েছে হুমায়ূনীয় স্টাইল। যেন নতুন এক হুমায়ূনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে বাংলাসাহিত্যের আঙিনায়। তবে হ্যাঁ, শিল্পমান-সমৃদ্ধ রচনার এই কুশলী স্রষ্টা তাঁর এই উপন্যাসিকাটিতে সম্ভবত পরোক্ষভাবে এ-কথাটিই বলতে চেয়েছেন: “জীবন খোঁজো রে মন, শিল্পের তরী বেয়ে।” পর ব র্তীতে জেনেছি, এক বন্ধুর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে হুমায়ূন স্টাইলে এই উপন্যাসটি লিখেছেন।

এর দুদিন পরে, ২১শে ডিসেম্বর ২০১৬,  তিস্তা নিউজ২৪-এ কবির একটি অনবদ্য সাক্ষাৎকার পড়ি। পড়ে আবার একটি নাতিদীর্ঘ মন্তব্য না-করে থাকতে পারিনি। সেই মন্তব্যটিও এখানে তুলে দিচ্ছি–
‘একটি ভালো কবিতার শরীর কাঁচা রমণীর গায়ে জ্বলে ওঠা আগুনের মতো দীপ্তিমান।’ অগণিত ভালো কবিতার কবি কাজী জহিরুল ইসলাম – এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারটি নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ সাক্ষাৎকার। যে-সাৎক্ষাৎকারে কবি স্পষ্ট করে সহজ-সরল-সাবলীল ভাষায় কবিতার অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুটি তুলে ধরেছেন। তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন–‘…পরিকল্পনা করে তো কবিতা লেখা যায় না।’ সারাটি জীবন কবিতার সঙ্গে থাকতে-চাওয়া এই কবি আরও বলেছেন–‘কবির তৃপ্তিটাই কবিতায় মূখ্য; আর সব গৌণ।’ এ-সাক্ষাৎকারটি পড়ে আমরা জানতে পারি–‘প্রকৃত কবিতা কবি লেখেন না; তাঁকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নেয়।’ তা আর যা-ই হোক; আমরা বিশ্বাস করি: আমাদের প্রিয় কবি কাজী জহিরুল ইসলাম আজীবন আমাদেরকে অসংখ্য সুন্দর-সুন্দর কবিতা উপহার দিয়ে যাবেন। আর সে-বইটিও উপহার দিবেন, যে-বইটি এখন পর্যন্ত কেউ লেখেন নি। কেননা, ‘হয়তো এটাই সাহিত্যের মূল লক্ষ্য, সেই লেখাটি লেখা, যা এখনও কেউ লেখে নি।”

এ মন্তব্য করার পরদিনই তিস্তা নিউজের সম্পাদক আমার কাছে লেখা চান। আমি লেখা পাঠানো-না-পাঠানোর পরামর্শ চাই কবির কাছে। তিনি পাঠাতে বললে আমি সেখানে একটি লেখা পাঠাই। কিন্তু, আমার ধারণা, সেটি আদতে কোনো ‘লেখা’ হয়ে ওঠেনি। কবি ইনবক্সে সে-লেখাটির কয়েকটি দুর্বলতা আমার সামনে তুলে ধরেন। কবি যে আমার লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন, সেটা জেনে বেশ খুশি হই; উজ্জীবিত হই নতুন করে। এবং এই উৎসাহে লেখা ছোটগল্পটি প্রকাশিত হয় সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির অন্তর্জাল তীরন্দাজের ঈদসংখ্যা-১৭তে। প্রকাশের পর আমার এই নতুন করে লেখা প্রথম ছোটগল্পটির কপালে কিছু প্রশংসাও জোটে। এ ভালোলাগা থেকে গল্পটির লিংকটি কবির ইনবক্সে পাঠালে কবি বলেন, “পড়েছি। তুমি আল মাহমুদের পানকৌড়ির রক্ত বইটা পড়েছো? না পড়লে একবার পড়ো। তোমার মধ্যে গল্প আছে।”
আমি সেই গল্পটিই খুঁজছি প্রিয় কবি। সেই খোঁজে একের-পর-এক বাক্য বুনে যাচ্ছি আমার লেখার খাতায়। আপনার শুভ জন্মের এই অর্ধশতবার্ষিকীতে আমার কাঁচা কাঁচা শব্দের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন দেহকাব্যে’র কবি, কাজী জহিরুল ইসলাম। সুদীর্ঘ হোক আপনার এই পথচলা; আরো সমৃদ্ধ হোক আমাদের ইনবক্স আর কমেন্ট বক্স।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *