ঘুণমাটি – বনমালী মাল (পর্ব ২)
৪.
কবির সঙ্গে চপলার দেখা হয় প্রতিদিন—প্রতি গড়িয়ে পড়া বিকেলে। এই সময়টায় কবি চপলার রূপে অন্ত্যমিলের খোঁজ পায়। রামচকের কাছে চপলা সংসারী, গাঢ় এক কিশোরী। ফ্রক পরা, কেবল সুতির গামছা জড়ানো ঘাট থেকে উঠে আসা নিরেট ভেজা চপলা ঘোমটা মাথায় কুঁচি দেওয়া শাড়ি পরলেও রামচক অবাক হয়ে লালা ফেলে না। ভেবে দেখতে গেলে চপলা নীলাভ সবুজ ঘাসফড়িংয়ের মতো মুঠোর বিপরীতে দৌড় দিতে চায়। না ভাবলে, চপলা চপলাই। রামচক তাকে দেখে স্বাভাবিক নেশার ঘোরে। নেশা করে তাকে নিয়ে। নেশা কাটে চপলার হাত ধরেই। শুধু চপলা নয়, রামচকের আর পাঁচজন কিশোরী-যুবতী-বিবাহিতা-মাঝবয়সি তারা কেউই চপলার থেকে আলাদা নয়। দেহ তাদের কাছে আলাদা কিছু নয়। মন বা পেচ্ছাবের মতো তা আকর্ষণীয় বা ঘৃণ্য হতে পারে। রামচকের সকল পুরুষ কোনোদিন একযোগে একগুচ্ছ নারীর কামনার ফুল হতে পারে। তবে এই নিয়ে কারো কোনো সতর্কতা বা জুতো পরে কাঁটা বাঁচানোর কোনো তাগিদ নেই। কখনও ছিলও না। একদিন চপলা বা রামচকের অন্য কোনো মেয়ের পাছার দিকে দৃষ্টি গেলে, সেটা খবর হয়ে যায় না। স্তনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা পেটের খোলা অংশে থর জমে যাওয়া নিয়ে হাসি ঠাট্টা হয় না। কোনো মেয়ের হাত একলা রাতে একলা পুরুষের ঠোঁটে বা এমনিতে যা ভাবা যায় না, সেই জায়গায় পড়লেও, তা নিয়ে বিচার বসে না বা ঢি ঢি হয় না। যৌনতা এখানে স্বাভাবিক। হাগা মুতার মতো, হাত দিয়ে খাবার তোলার মতো। একটা মোলায়েম ঘাস বিছানো সমতল ভূমির ওপর দিয়ে আবরণহীন জ্যোৎস্নার গড়িয়ে চলা দেখতে দেখতেই শামুকের পর শামুক ঘরছাড়া হয়। পরদিন কুঁরগির তীরে তীরে জমা হয় কত কত শিশু শামুকের বিছানা।
সন্ধ্যা। এক পশলা বৃষ্টি বয়ে গেছে। বাতাস এখনও ঘোঁত খাচ্ছে কবির জানালায়। মহাকাব্যের চরিত্র খুঁজছে কবি। অন্ধকার হাতড়ে। কোনো পৌরাণিক চরিত্র নয়। অতএব কাহিনীর ধরাবাঁধা নেই।—যদি ইতিহাস নিয়ে লেখা হয়!
—হতে পারে। —হবেই। কিন্তু চপলার সেই উন্মুক্ত ঝোলানো হাঁটু জপমালার মতো অন্ধকার খণ্ডিত করে করে ভাবাচ্ছে তাকে। সে চপলাকে ভালোবাসে। মনে-শরীরে।
বেলা বয়ে যাওয়া বয়স কবির নয়। এই বর্ষায় কুঁরগি যদি পোয়াতি না হয়, বান না আসে, তবুও কবিকে একটা বানের হিসেব রাখতেই হয়। যে বছর তার জন্ম। একটা চলতি হিসেবে কবি এখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। অকৃতদার। পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি লিখতে লিখতে গোঁফ দাড়িতে পাক ধরেছে। বেঁটে চেহারা। আনমনা ভাব সর্বক্ষণ। ঘর থেকে বেরিয়ে আঙিনার ঘাস মাড়িয়ে যাওয়াটা সে খুব মন লাগিয়ে করে। তারপর প্রতিবার ঘাসের এমন উঠে দাঁড়ানো নিয়ে ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে বাকি রাস্তাটা পুড়িয়ে দেয় সে। প্রতিবার তার মনে হয়েছে, সিসিফাস যেন তার মুক্তো-ঘাম ফেলে রেখে গেছে এইসব ঘাসে। প্রেম বুঝতে পারার পর থেকে কবি একটাও প্রেম করেনি?ভুল। অনেকবার। মেয়েরই প্রেমে। প্রতিবার প্রেম। কাব্যের খাতিরে বিচ্ছেদ। প্রেমের খাতিরে স্তন কচলানো।আবার প্রেম।রামচক স্বাভাবিক। নির্লিপ্ত। প্রেম থাকবে। পিঠে চেপে থাকবে যৌনতা। পেট ভর্তি থাকবে সমাজে। পুষ্টির জন্য রেখে বাকিটা বেরিয়ে যাবে। বলাই কবি নন্দবাবা মায়া কুঁরগির রাজহাঁসগুলোও জানে সেকথা। মানেও।
কালো ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে কবি। চপলা তাকে চেপে ধরেছে ক্রমশ। পড়ে থাকে মহাকাব্য লেখার সরঞ্জাম। মাথা থেকে উদুম করে ঝেড়ে ফেলেছে চরিত্রের খোঁজ। এখন কতগুলো ঘাস আর মাটি মাড়িয়ে পুকুরের পাড় ধরা। ক্ষীণ বৃষ্টির ফোঁটা গাছের পাতায় জমা হয়ে একসাথে ঝরে পড়ছে। —গর্ত হচ্ছে নিশ্চই।
—চিহ্ন!—সব চিহ্ন আখেরে একটা গর্তই তো তৈরি করে।খালি গা। পা পড়ছে ভাঙা গদ্যে। টুকরো টুকরো হচ্ছে স্নায়ু। এক দু ফোঁটা জল জেগে উঠে বয়ে যায়।
—রাজহাঁস!
—তীক্ষ্ণ স্রোত!—উন্মুক্ত হাঁটু!—হাঁ করা সাদা বিড়াল।—চপলা এখন অন্ধকার।—চপলা এই ধ্রুবতারা।আকাশের দিকে তাকিয়ে কবি বুঝল ভুল করেছে। ধ্রুবতারা নেই। কাঁঠাল গাছে মেঘে জড়াজড়ি। আর এক-পা, দু-পা, তিন-পা। প্রথম সিঁড়ি। দুই। তিন। চার। দুয়ার।—চপলা! চপলা! চপলার ঘরের ঈশান কোণ দিয়ে একটা বিড়াল লেজ দেখিয়ে গেল এইমাত্র। কেউ এসেছিল চপলার দুয়ারে। তবুও আরও আঁধার ভেদ করতে কবি গভীরে এগিয়ে চলে। চপলা যেন প্রতীক্ষাই করছিল। কিন্তু কার! একজনের প্রতীক্ষার জায়গায় এভাবেই অন্যজন জায়গা করে নেয়। কবির উষ্ণ ভেজা হাতে লেপ্টে যাচ্ছে কতগুলো ভেজা ভেজা চুল। চপলার গায়ে ঘাম থেকে জল আবার জল থেকে ঘামের খেলা চলছেই। কবির মনে এই ঘামঘন মুহূর্তেও মহাকাব্য রচনার একটা বিষয় ঘোঁত খাচ্ছে। যে কাহিনিতে চপলা প্রধান নারী চরিত্র। একটা ভিজে বাতাসের ঝাপটা চপলার দুয়ার ভিজিয়ে গেল। উঠোনে তুলসী গাছের ফাঁদ ভিজে নেতিয়ে পথ নষ্ট। অনেকদিন পর আজ একটা সন্ধ্যা আবিষ্কার হল কবির। বাইরে ক্লান্ত বেনো বাতাস। গাছেদের শেষ সঞ্চয়টুকু ঝরে পড়ছে।চিহ্ন! চিহ্ন!চার। তিন। দুই। এক। কবির বাম পা আঠালো মাটি ছাড়িয়ে নেমে যাচ্ছে রাস্তার দিকে।
৫.
সকালে সবার আগে গোবর জল ছড়িয়ে শাঁখ বাজে পঞ্চুর বৌয়ের গলায়। লম্বা একটা ফুঁ আগের সন্ধ্যা থেকে জমিয়ে রাখে সে। পঞ্চু কাল সারা সন্ধ্যা কাটিয়েছে কাদা চটকে চটকে। বউ এখন কুঁয়োর পাশে। মেটে আলো এখনও পুড়তে শুরু করেনি। মেটে রং চিটে আছে পঞ্চুর বৌয়ের খালি হাঁটু অবধি। কুঁয়ো থেকে এক ভাঁড় জল নিজেকে আর মালিককে বাঁচিয়ে পায়ে এসে পড়ে। লাল ব্লাউজের ঢাল খর হতে হতে একটা ডাঁটো স্তন উঠে আসে। ঝুঁকে প’ড়ে পা দুটো ঘষে মালিনী।
পঞ্চু এক কুড়ি উপড়ানো মাটির খুরি ডিঙিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে উঠোনে নামে। এক প্রস্থ খামারের এককোণে কুঁয়ো। অন্য কোণে কাদা মাটির চাঁড়। কাঁধে ফেলানো গামছা হাতে নিয়ে ভোর ঝাড়তে ঝাড়তে সে এগিয়ে যায় কাদার দিকে। রাতের ঘুম লেগে আছে চোখে। হাঁটু না ভেঙে ঝুঁকে পড়ে কাদার ওপর।—পলিটা কম হয়ে গেছে।—ল্যাদল্যাদে।—দু’ ভাঁড় জল দিয়ে যা।উবু হয়ে বসে সে। কাল রাত অব্দি কাদা মাখতে মাখতে যে ভাবনাটা উঁকি দিয়েছিল, ভাঙা ভাঙা চোখ হঠাৎ বড়ো জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। উবু হয়ে ভাবনাটা ভাঙতে থাকে সে।—খুরি সরা মালসা কুঁজো হাঁড়ি কলসি—সংসারে মালিনী আছে—অভাব নেই। তবু…—কুঁরগি পেরিয়ে বাইরে দাম পাবে হাতগুলো।নিজের হাতগুলোর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে পঞ্চু।দুহাতে ভাঁড় ভর্তি করে জল নিয়ে আসে মালিনী। কাপড় ভিজে সপসপে হয়ে শব্দ তোলে। কমলা রোদ তার শরীরখানা বিছিয়েছে উঠানে। ভিজে ছায়া ফেলে মালিনী এসে দাঁড়ায় পঞ্চুর পিঠে। ভাবনায় জল পড়ল বুঝি! না। পঞ্চু পায়ের পেশী টানটান করে চেয়ে আছে কাদার মাঝে জমে থাকা জলের দিকে। ভেসে ওঠে মালসার ভেতর মুকুটধারী পঞ্চু। শ্রীযুক্ত পঞ্চানন পাল। উজ্জ্বল চোখ। গায়ে জরির কাজ করা পশমের উত্তরীয়। হাতগুলো হীরার মতো চকচক করছে। তার ধ্যান ভাঙল মালিনীর ডাকে। এতক্ষণ যে পঞ্চু জমা জলের ওপর হাত দিয়ে কাদার প্রস্তুতি দেখছিল, সেই হাত শূন্যে ঝুলে আছে মরা পাখির খিঁচে যাওয়া পায়ের মতো। হীরার মতো চকচক করছে না সেই হাত। পেশির উপর শিরার রেখা স্পষ্ট। মালিনীর ছায়া এসে পড়ে তার শূন্য হাতের মুঠোয় তারপর মুকুট পরা পঞ্চুর সাথে মিলে গিয়ে ভাবনাকে ছাই করে দেয়।—দুটা দেখি মুঠা খানেক… না…—মালসা খানেক… হুমম…—পলি।ভাবনা পাকাচ্ছে পঞ্চু। যেন তর্জনী আর বুড়ো আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে শান দিচ্ছে সরা মালসার মুখের বেড়িতে। সকালের রোদের সাথে জড়িয়ে সেই এএক মন তীব্র আর অসহ্য হয়ে পড়ছে। —কুঁরগি পেরিয়ে…—রাজহাঁসের মোলায়েম পিঠ ছুঁয়ে…—অন্য গ্রাম কিংবা শহর—পশ্চিমে বা উত্তরে—সরা খুরি মালসা কুঁজো প্রয়োজনে মূর্তিও গড়বে সে—হায় মূর্তি…
৬.
মূর্তি গড়ার কথা পঞ্চু শুনেছে নন্দবাবার কাছ থেকে। সুতির চেক চেক লুঙ্গি পা অবধি ঝেঁপে পরা অভ্যেস নন্দবাবার। নন্দলাল পাহাড়ি। গ্রামের পাঠশালার গুরুমশাই। কাজে-কর্মে সকাল-সন্ধ্যায় ছেলে পড়িয়ে যেটুকু সময় বাঁচে, সেই সময়টুকুর গায়ে বই মেলে ধরে আর বিশুদ্ধ রামচকের বিশুদ্ধ স্বপ্ন দেখে। ঘুণপোকা, যারা কুঁরগির ওপ্রান্তে সার বেঁধে লালা ঝরাচ্ছে, নন্দবাবার বয়স্ক স্বপ্নভূমিতে আতঙ্ক জাগায়। কতগুলো বিভিন্ন বয়সের মানুষ তাদের ভিন্নতা হারিয়ে অজস্র হাতে আহ্বান জানাচ্ছে ঘুণপোকাদের। জোনাকি আর শালিকের মৃতদেহ মাড়িয়ে মেয়ে আর পুরুষেরা উন্মাদ নৃত্য করছে। স্বপ্ন থামে। স্থির চোখ নিশ্চুপ পড়ে থাকে সামনে। এই-ই শেষ নয়। নন্দবাবা এই মুহূর্তগুলোতে আটকে রাখে না নিজেকে। বইয়ের পাতা উলটে মৃদু হাসি খেলে যায় তার ঠোঁটে।
একদিন ঘোড়া মাঠে বসে জোনাকির দপদপ আলো লুকিয়ে অনেক শ্বাস আর সাহস বেঁধে নন্দবাবা কিছু কথা শুনিয়েছিল পঞ্চুকে। কাল সন্ধ্যা থেকেই ভাদ্রের শিশিরের মতো সেই সন্ধ্যা মাথা কুরছে পঞ্চুর। তবু সেই সন্ধ্যার মাঝে মাথাটা ক্রমে গুঁজে দিচ্ছে পঞ্চু। স্পষ্ট মনে পড়ছে।বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে এক ঝাঁক জোনাকি ঝাপসা ক’রে খালি গায়ে বাম হাতটা বুলিয়ে নেয় নন্দবাবা। ডান হাতের দু’ আঙুলের কোমর জড়িয়ে আগুন। নিস্তেজ। মুখ নীচু পঞ্চু। অন্ধকার জড়ানো ভারী শরীরটাকে একটু নাড়িয়ে পা-গুলো সামনে মেলে দিতে দিতে নন্দবাবা একটা চাপা খাটো শ্বাস ছাড়ে। বিড়িটা মুখের সামনে এনেও কী এক বয়ে যাওয়া মুহূর্ত স্মরণ ক’রে ডানহাতটা ঘাসের ওপর নেমে আসে। চেটো নীচে। আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্ধকার মাখছে আগুন। ঠোঁটের মাঝে এসে যৌবন পেল আগুনটা।
—আমি কুঁরগি পেরিয়েছি দুবার। রামচক কোনোদিন ওপারে যায়নি। রামচকের দু একজনের যদিও বা কখনও সাধ হয় বাহির দেখার, উপায় থাকে না। পরিবার আত্মীয় বলাই কিংবা আমি পরামর্শ দিয়ে বিরত করি। রামচকের বাইরের মানুষজন আর আমরা শত্রুর মতো। সে অনেক আগের কথা, যখন রামচক সবার থেকে আলাদা হয়ে যায়। কত কত পূর্বপুরুষ আগে কুঁরগির রাজহাঁসগুলো মিলিত হতে হতে পালক ছড়িয়েছিল জলে আর ডাঙায়। সেই থেকে রামচকের সীমানা মুদে মিইয়ে আছে…
পঞ্চু দু’ হাত ঘাসের ওপর ভর দিয়ে নিজেকে হেলিয়ে রেখেছিল। নন্দবাবার স্রোতহীন নির্লিপ্ত কথা শুনে তার দেহ পেছনের হেলান থেকে সরে এসে ঠায় সোজা হয়ে বসে। হাতগুলো ভারমুক্ত হয়। কী ভীষণ এক বরফজল স্পষ্ট ছল ছল শব্দ তুলে নেমে যাচ্ছে পঞ্চুর আঙুল বেয়ে।
—কুঁরগির ওপার বড়ো খসখসে। তুলির রং ধরে না। আঁচড়ে বাতুলতা থাকলেও কিছু ক্ষত থেকে যায় দাঁত উঁচিয়ে। ওরা মূর্তি গড়ে। দেবতার। পুজো করে। হিংসা হানাহানিও। সারাক্ষণ শুয়োরের পাল ঘোঁত খাচ্ছে। কাদা মাখা কপাল উঁচিয়ে একে অন্যে সে কী এগিয়ে চলার হুড়োহুড়ি!
পঞ্চানন পাল এক মনে শুনছে আর একটা জোনাকির জ্বলা-নেভা দেখছে। মাটির কাজ করতে করতে সে ধৈর্য আর নরম দৃষ্টি উপহার দিতে পেরেছিল নিজেকে। নন্দবাবার সব কথা সে বুঝতে পারছে না। বোঝা সম্ভব নয়। উদাস অথচ কিছুটা ভয়ার্ত চোখে জোনাকি আর অন্ধকারের খেলা দেখতে দেখতে নন্দবাবার অস্থিরতা অনুভব করতে পারছিল শুধু। কালো মুখ মাঝে মাঝে বিড়ির মৃদু আলোয় মায়া লেপে দিচ্ছে।
—আমি পাঠশালায় কোনোদিন রামচক ছাড়া অন্য কোনো পৃথিবীর কথা ওদের বলিনি। কুঁরগিতেই গোটা পৃথিবী শেষ। রাজহাঁসগুলো এই গ্রহের সীমানা আঁকে। ওদের পায়ের আর নরম পালকের সাধ জাগনো গণ্ডি আমাদের কাছে মাননীয়। ওর ভেতরে মানুষে মানুষে কত সুখাসুখি। ওর বাইরে গভীর অসুখী খাদ। অন্ধকার হাঁ করে সেই খাদ সবকিছু গিলতে আসে।
যদিও নন্দবাবা জানে শুধু, রামচকেরও একটা ইতিহাস আছে। তারও আগে রামচকের একটা পুরাণ ছিল। সেখানে ন্যায়-অন্যায়ের বিরোধ ছিল কিন্তু নন্দবাবা সেগুলোকে নিয়ে ভাবে না, কাউকে বলেও না। বলাই জানে কিছু কিছু। একটা বিশুদ্ধ রামচকের স্বপ্নে এইসব শূন্যস্থান আর প্রশ্নচিহ্নের কোনো স্থান নেই।
পঞ্চুর মাথায় সন্ধ্যা পড়ার পর থেকেই অগুনতি অন্ধকার আর ঝাউফুল ঝরে পড়ছে। তার অবুঝ তাকানো চোখ এঁকে চলছে কোনো এক অসহায়তার বৃত্তান্ত। চাকা বসে গেছে মাটিতে। ভালোবেসে? তুলতে তাকে হবেই। সে তুলবেই। মিইয়ে পড়া আগুন বোধহয় একটু ছ্যাঁকা দিয়ে নন্দবাবার আঙুল থেকে খসে পড়ল। এবার উঠতে হবে তাদের। তাড়া নেই কিছুর, তবু দুজনে যেন আর কথা পাচ্ছিল না। সময় আর অন্ধকার খুঁড়ে ফেঁড়ে নিঃস্ব হয়ে বসে আছে দুজন। এই সময় গোলাপের সজ্জার মতো গভীর জটিল। সুন্দর অথচ দুর্বোধ্য। এই ঘোড়ামাঠে সময়কে পায়ে বেঁধে ফেলে রেখেছে তারা।
(ক্রমশ)