কিউবার শিল্প-সাহিত্যের স্বাধীনতা নিয়ে ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎকার – মোজাফ্‌ফর হোসেন

শেয়ার করুন
ভূমিকা ও অনুবাদ : মোজাফ্‌ফর হোসেন

[কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক বহু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে, যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রারাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব থেকে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন। ২৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে ৯০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন তিনি।

বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করা নেতাদের তালিকায় ফিদেল কাস্ত্রো আছেন তিন নম্বরে। ১৯৫৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কিউবার প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন কাস্ত্রো। ২০০৬ সালের ৩১ জুলাই অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হলে ছোটোভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পাঁচ দশক ধরে কিউবার নেতৃত্ব দেওয়ার এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ও কিউবা থেকে বিতাড়িত বিভিন্ন সংগঠন থেকে অন্তত পাঁচ শতাধিক বার তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা গেছে। এ নিয়ে মজা করে ফিদেল বলেছেন, “হত্যার চেষ্টা এড়িয়ে যাওয়ার যদি কোনো অলিম্পিক ইভেন্ট থাকত, তাহলে নির্ঘাত তাতে আমি স্বর্ণপদক জিততাম।”
ফিদেলকে উৎখাতের নানা পরিকল্পনার সঙ্গে কিউবার উপর যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ দশকের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পরও তিনি বহাল তবিয়তেই ছিলেন। জাতিসংঘে সবচেয়ে দীর্ঘ ভাষণ দেওয়ার রেকর্ডটি কাস্ত্রোর দখলে। ১৯৬০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ৪ ঘণ্টা ২৯ মিনিট ধরে ভাষণ দেন তিনি। কাস্ত্রোর সবচেয়ে দীর্ঘ ভাষণের রেকর্ড ৭ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। ১৯৯৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আরও পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ওই ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কাস্ত্রোর সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোট নিরপেক্ষ শীর্ষক চতুর্থ সম্মেলনে দেখা হয় তাঁদের। বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে ফিদেল কাস্ত্রো সেদিন বলেছিলেন, “আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি। শেখ মুজিবকে দেখলাম। ব্যাক্তিত্ব ও সাহসে মানুষটি হিমালয়। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।” বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন কাস্ত্রো। উক্ত সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “পৃথিবী আজ দুইভাগে বিভক্ত। একভাগে শোষক শ্রেণি, আরেকভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।” এই ভাষণের পর কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “তুমি আজ যে ভাষণ দিয়েছ, তারপর থেকে সাবধানে থেকো। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।” ফিদেল কাস্ত্রোর সেই সাবধানবাণী নির্মম সত্য হয়ে ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। শোকাবহ ১৫ই আগস্টের পর বন্ধুর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে ফিদেল কাস্ত্রো এক শোকবার্তায় বলেন, “শেখ মুজিবুরের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।” বাংলাদেশ সরকার এই বরেণ্য নেতাকে ২০১৩ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’-য় ভূষিত করে।

কাস্ত্রো প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি নানা কারণে সমালোচিতও হয়েছেন। বিশেষ করে কিউবাতে সাংবাদিক-লেখক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না-থাকা নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছে। তবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কাস্ত্রোর একটা রাজনৈতিক ভিশন ছিল। সে-সব নিয়ে এই সাক্ষাৎকারে খোলামেলা আলোচনা করেছেন কাস্ত্রো। ১৯৫৯ সালে মার্কিন সাংবাদিক লী লকউড্ ফিদেল কাস্ত্রোর দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, সেখান থেকে কিউবার শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক নির্বাচিত এই অংশটুকু স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয় প্যারিস রিভিউতে।]

প্রশ্ন : কিউবার শিল্পকলার ওপর দেশটির প্রশাসনের কি কোনো নিয়ন্ত্রণনীতি আছে—বিশেষ করে সাহিত্যে?
কাস্ত্রো : শিল্পের একেকটা ক্ষেত্র একেক ধরনের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। যেমন ধরুন, চলচ্চিত্র চিত্রকলা থেকে আলাদা। চলচ্চিত্র হল আধুনিক শিল্পক্ষেত্র, এখানে একইসঙ্গে বহু ধরনের উপাদান কাজ করে। একটা সিনেমা নির্মাণ করা আর একটা ছবি আঁকা কিংবা বইলেখা এক কথা নয়। তবে, আপনি যদি জানতে চান, শিল্পের এসব ক্ষেত্রে কিউবা সরকারের নিয়ন্ত্রণনীতি আছে কিনা, আমি বলব ‘না’।

প্রশ্ন : এটা বিস্ময়কর বটে, কিউবার চিত্রশিল্পী, ভাস্কর্যশিল্পীরা যতখানি স্বাধীনতা পান অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিল্পীরা তা মোটেও পান না। তবে বোধহয় সাহিত্যিকরা এতটা স্বাধীনতা পান না?
কাস্ত্রো : কারণ সাহিত্যের সঙ্গে প্রকাশনার বিষয়টি জড়িত। এটা অর্থনৈতিক সমস্যা। পাঠ্যবই মুদ্রণের মতো পর্যাপ্ত রিসোর্স নেই আমাদের। কাগজের সংকট আমাদের মুদ্রণশিল্পের সীমাবদ্ধতাগুলোর একটি। তার মানেই এটা নয় যে, কোনো রাজনৈতিক প্রভাব এখানে নেই। আমরা যে সকল বইয়ের সামাজিক বা নৈতিক মূল্য আছে বলে বিশ্বাস করি না, তা প্রকাশের সুযোগ পায় না।

প্রশ্ন : তার মানে কোনো উপন্যাসিক প্রতিবৈপ্লবিক সেন্টিমেন্ট নিয়ে উপন্যাস লিখলে সেটি প্রকাশিত হবে না?
কাস্ত্রো : বর্তমানে, ‘না’। তবে একদিন নিশ্চয় হবে যখন সব ধরনের সম্পদ পর্যাপ্ত হবে; অর্থাৎ যখন এ ধরনের বই পাঠ্যবই বা বিশ্বসাহিত্যে সর্বজনীন মূল্য আছে এমন বইয়ের ক্ষতি করে প্রকাশিত হবে না। তখন নিশ্চয় ব্যাপক বিষয়ের ওপর লেখা বই প্রকাশের যথেষ্ট সাধ্য আমাদের থাকবে। তখন একজন যে কোনো বিষয়ের ওপর তার নিজের মতামত তুলে ধরতে পারবেন। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সবধরনের আলোচনায় অংশ নিতে চাই। কেন? কারণ আমি মুক্তচেতা মানুষে বিশ্বাস করি। আমি সুশিক্ষিত নাগরিকে বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি চিন্তাশীল, ভয়ভীতি ঝেড়ে প্রথার বিপরীতে চলা মানুষে। আমি বিশ্বাস করি, যে কোনো মতাদর্শ সেই মতাদর্শ দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত এবং রক্ষিত থাকবে। আমি বইকে কালো তালিকাভুক্তি, চলচ্চিত্র নিষিদ্ধকরণ—এসবের বিপক্ষে। আমরা ভবিষ্যতে কোন্ ধরনের আদর্শিক জনগণ চাই? যে কোনো বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো পর্যাপ্ত শিক্ষিত, সত্যের পথে নির্ভীক। উদাহরণস্বরূপ, আমরা নিজেদের নিয়ে যেমন করে ভাবি— আমরা মনে করি, আমাদের মৌলিক বিশ্বাসের কোনো নড়চড় না করেও আমরা যে কোনো ধরনের বই পড়তে পারি, যে কোনো বিষয়বস্তুর ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র দেখতে পারি। এবং কোনো বই বা চলচ্চিত্রে যদি যৌক্তিক কিছু থাকে তবে সেটা আমরা আমাদের মানসগঠনে কাজে লাগতে পারি। আমরা নিজেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, কতটুকু গ্রহণ করব আর কতটুকু বর্জন করব। আমাদের দেশের সকল নারী-পুরুষ ভবিষ্যতে এই বিচক্ষণতা অর্জন করুক! আমরা এই ধরনের জনগণ তৈরির জন্য কাজ করছি।

প্রশ্ন : তাহলে কি বর্তমানে এই পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব নয়?
কাস্ত্রো : সেটা মনে করলে আকাশ-কুসুম কল্পনা করা হবে। প্রথমত, আমরা যে ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যার ভেতর আছি; এবং দ্বিতীয়ত, আমরা যে ধরনের সংগ্রামের ভেতর আছি, তাতে এটা ভাবা যায় না।

প্রশ্ন : তবে কি ঐ ‘সংগ্রাম’-এর অংশ হিসেবে বা দোহাই দিয়ে কিউবার সংবাদমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একপেশে লিখে যাচ্ছে?
কাস্ত্রো : আমি আপনাকে বলব না যে, আমরা সেটা করি না। সত্য হচ্ছে, আমরা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যা কিছু বলি সবটাই সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে ধরে নিয়ে বলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা হয় বা তাদের পক্ষে যায় এমন কিছু এখানে প্রকাশিত হয় না। আমরা মনে করি, আপনার দেশও আমাদের বিষয়ে অনুরূপ ভাবে এবং কাজ করে। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের সঙ্গে যা করা হয়েছে বা হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যা কিছু ঘটে আমরা সবসময় তার বাজে সম্ভাবনা দাঁড় করাই। একমাত্র পার্থক্য হল, আমরা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে মিথ্যা লিখি না। মানে আমরা নেতিবাচক বিষয়ের ওপর জোর দিই, যে সকল বিষয় ইতিবাচকভাবে দেখা যেতে পারে, সেগুলো সচেতনভাবে এড়িয়ে যাই। কিন্তু আমরা কোনো অবস্থাতেই আপনার দেশ নিয়ে কোনো ‘মিথ্যা’ আবিষ্কার করি না।

প্রশ্ন : কিন্তু আমাদের মন্দ দিকগুলোর দিকেই কেবলমাত্র আলোকপাত করার ফলে আপনারা যে বিকৃত-তথ্য তুলে ধরেন সেটা মিথ্যার সমতুল্যই।
কাস্ত্রো : সেটা নির্ভর করছে আপনি ‘মিথ্যা’ বলতে কি বোঝাচ্ছেন তার ওপর। আমি একমত যে, এটা একধরনের বিকৃতকরণ। মিথ্যা হল সচেতনভাবে যা ঘটেনি তা প্রকাশ করা। মিথ্যা এবং বিকৃতকরণের ভেতর স্পষ্টতই পার্থক্য আছে, যদিও কোনো সন্দেহ নেই এ-দুটো কখনও কখনও একইরকম নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। এটা আদর্শ পথ না। কিন্তু এই বাস্তবতা আমাদের সৃষ্টি না। যদি বিশ্ব শান্তিময় জায়গা হিসেবে থাকত, যেখানে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে, তাহলে এমনটি ঘটত না। আমরা এই পরিস্থিতির জন্য মোটেও দায়ী নই।

প্রশ্ন : কিন্তু আপনি যদি এই বিকৃতকরণ প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেন, যার ফলে আপনার দেশের জনগণের ভেতর কেবল বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব সৃষ্টি হবে, তাহলে কীভাবে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে?
কাস্ত্রো : ফের বলছি, আমরাই কেবল এসবের জন্য দায়ী নই। যুক্তরাষ্ট্রই কিউবার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

প্রশ্ন : আমার উল্লিখিত প্রশ্নের সঙ্গে আপনার এই উত্তরের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হচ্ছে না!
কাস্ত্রো : আমি খোলামেলাভাবে আমাদের অবস্থানটা তুলে ধরে আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। আমি এভাবেই সরল সত্য বলি, যুক্তরাষ্ট্রের কয়জন নেতা সেটা করেন?

প্রশ্ন : নিশ্চয় আপনি খোলা মনের মানুষ। আমার নিজের মত হল, যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বিকৃত-তথ্য পরিবেশনের চেয়ে সবধরনের জ্ঞানচর্চার পথ আপনাদের সমাজে খোলা রাখলে ক্ষতির চেয়ে বরং উপকারই হবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, সম্প্রতি আমাদের সরকার দেশটির কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্যে অনেক কাজ করছে। কাজেই কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ ক্যালিফোর্নিয়ায় বিদ্রোহ করছে এটা প্রকাশ করার পাশাপাশি কিউবার সংবাদমাধ্যম এই সত্যটাও তুলে ধরতে পারে।
কাস্ত্রো : আমার যতদূর মনে পড়ে ঐ আইনের কথা আমাদের এখানে ছাপা হয়েছে। যদিও খুব স্বাভাবিকভাবেই এটা নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ ও মতামত আপনাদের সঙ্গে মিলবে না। আমরা মনে করি, এই বৈষম্যের সমস্যাটি সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে উৎসারিত। শ্রেণিভিত্তিক সমাজে মানুষ মানুষের দ্বারা শোসিত হবেই।
এটা পরিস্কারভাবে জটিল একটা সমস্যা। আমরা নিজেরাও বৈষম্যমূলক সমাজকাঠামোর ভেতর দিয়ে এসেছি। এখানে বৈষম্য দূর হয়েছে যখন সুবিধাভোগী শ্রেণির বিলোপ ঘটেছে। এটা সামাজিক বিপ্লব ছাড়া সম্ভব হত না। আমার মনে হয় না এ ধরনের বিপ্লব আমেরিকায় হওয়া সম্ভব। এই মুহূর্তে সেটা প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক হবে। হয়তো কখনোই সে রকম কোনো বিপ্লব ওখানে হবে না; তবে হয়তো বৈপ্লবিক কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। আমি নিশ্চিত, উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আগামী পাঁচশ’ বছরের ভেতর উত্তর আমেরিকার সমাজ কোনো অবস্থাতেই আজকের এই অবস্থানে থাকবে না। আশা করা যায়, তখন আর সেখানে কোনো বৈষম্য-শ্রেণিভেদ থাকবে না।

প্রশ্ন : তাহলে আপনি যুক্তরাষ্ট্রের বৈপ্লবিক পরির্বতন নিয়ে কিছু বলছেন না কেন? কেন কিউবার জনগণকে সামগ্রিক চিত্রটা দেখাচ্ছেন না?
কাস্ত্রো : কারণ সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ইতিবাচকভাবে দেখার মতো কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়নি। বরং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চাদমুখিই হয়েছে। আমাদের সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতিতে এগিয়ে গেছে উগ্র-প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে।

প্রশ্ন : আমরা তো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলছি না?
কাস্ত্রো : সত্যি বলতে এই নীতিটাই আমাদের সবচেয়ে ভোগান্তির ভেতর ফেলে দেয়।

প্রশ্ন : যেহেতু এই বিষয়ে কথা বলতে হচ্ছে, আমারও মনে হয় যে, যদি কিউবার কেউ সামান্যতম ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে, তাহলে তার লেখা কিউবার প্রেসগুলো ছাপবে না। প্রকৃতপক্ষে, কিউবার প্রেসে কোনো সমালোচনার স্থান নেই বললেই চলে। একে সরকারের একটা হাতিয়ার হিসেবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে।
কাস্ত্রো : হুম। আপনি যা বললেন তা মিথ্যে নয়। কিউবার প্রেসে সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ নেই বললেই চলে। সমাজতন্ত্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত এমন কেউ এখানকার গণমাধ্যমে লিখতে পারবেন না;— তবে আমরা এটা অস্বীকার করছি না, আমরা প্রেসের স্বাধীনতা নিয়ে আমেরিকার মতো মিথ্যে বুলি ছাড়ি না, সেখানে প্রকৃতপক্ষে প্রেস স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, কিন্তু আপনারা বলেন আছে। আমি স্বীকার করছি, এটা আমাদের প্রেসের একধরনের সীমাবদ্ধতা। আমি মনে করি না যে, এই বাক-স্বাধীনতা না থাকার বিষয়টি স্বাস্থ্যকর। সমালোচনা সবসময় দরকারি এবং ইতিবাচক অস্ত্র, তবে আগে আমাদের সেটার সঠিক ব্যবহার করা জানতে হবে।

প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় না, সমালোচনার সুযোগ থাকলে কিউবার লেখকরা গঠনমূলক সমালোচনা করে সমাজগঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারতেন?
কাস্ত্রো : গঠনমূলক সমালোচনা? নিশ্চয়। কিন্তু সেটা যদি শত্রুপক্ষের কিংবা প্রতিবিপ্লবীদের কণ্ঠস্বর বা কেনা দাস হয়ে করা হয় তবে কোনো কাজে আসবে না।

প্রশ্ন : কে সেটা নির্ধারণ করবে, কোন্ পরিস্থিতিতে কোন্ সমালোচনা গঠনমূলক, কোন্‌টা প্রতিবিপ্লবী?
কাস্ত্রো : বেশ। আমরা একটা সংগ্রামের ভেতর আছি, অনেকটা প্রকাশ্যযুদ্ধে লিপ্ত; এবং উদাহরণস্বরূপ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছে, তারা কোনো বিবেচনা ছাড়াই দেশবিরুদ্ধ সব চেতনাকে দমিয়ে দিয়েছে। যখন আপনারা নাজি বাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, তখন আপনাদের এই কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে।

প্রশ্ন : কিন্তু আপনি প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন— আমি জানতে চাচ্ছি, কে নির্ধারণ করবে?
কাস্ত্রো : এই পরিস্থিতির ভেতর দল নির্ধারণ করবে, রাজনৈতিক শক্তি, বিপ্লবী ক্ষমতা। স্বাভাবিকভাবেই আমরা যখন এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠব তখন প্রেক্ষাপটও বদলে যাবে।


প্রশ্ন : কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কিউবার সমাজে কোনো প্রকার সমালোচনা করার সুযোগ নেই—সাহিত্য কিংবা গণমাধ্যম—কোথাও নেই।
কাস্ত্রো : মানছি। তবে আমাদের মনোযোগ দেওয়ার আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র আছে—আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে হয়। কারণ কোটি কোটি জনতা তাদের লেখা পড়ে এবং তাদের কথা শোনে। আমরা যদি উদার সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি করতে পারি, তবে তাদেরও সেইভাবে গড়ে তুলতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই আধুনিক সমাজগঠনে সাংবাদিকদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
তবে আমাদের দেশের যে পরিস্থিতি, সেখানে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল দেশের রাজনৈতিক ও বিপ্লবী লক্ষ্য অর্জনে সহযোগিতা করা। আমাদের একটা লক্ষ্য আছে, উদ্দেশ্য আছে, যা পূরণ করতে হবে, একটা কর্মপরিকল্পনা আছে, যার মধ্যে দিয়ে সাংবাদিকদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হয়। এর মধ্যে দিয়ে আসলে সব ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমি এটা অস্বীকার করছি না।

প্রশ্ন : কিন্তু সব ধরনের সমালোচনা দমিয়ে রাখার ভেতর কি কোনো বিপদ লুকিয়ে থাকছে না?
কাস্ত্রো : সহমত পোষণ করছি। আমি বলছি না যে, সর্বত্র সমালোচনার পথ রুদ্ধ করে রাখা খুব ভালো কোনো কাজ। উলটে এটা বিপদজনকই হতে পারে।

প্রশ্ন : এই পরিস্থিতি সৃষ্টি পেছনে কোন্ ইস্যুকে আপনি দায়ী করবেন?
কাস্ত্রো : আমার মনে হয়, অনেককিছুই এর পেছনে জড়িত। তবে দেশের বর্তমান শোচনীয় অবস্থায় টিকে থাকতে হলে প্রায় সব ধরনের কাজেই রাষ্ট্রীয় পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। এটা টিকে থাকার প্রশ্নে।


প্রশ্ন : এই পরিস্থিতি তৈরির পেছনে প্রতিবিপ্লবীদের প্রতি আপনার একরোখা আচরণও কিছুটা দায়ী হতে পারে। এমনও তো হতে পারে যে, রাষ্ট্রীয় দমননীতি একটা প্রতিষ্ঠিত ফর্মে দাঁড়িয়ে গেলে, একজন বুদ্ধিজীবী ভয়ে ভয়ে থাকবেন যে তার ভিন্ন মতকে প্রতিবিপ্লবী বলে চালিয়ে দেওয়া হতে পারে। জনগণের মাঝে আপনার যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠছে, তাতে করে কোনো ব্যক্তির ভালো পরামর্শ থাকলে সেটা অশ্রুত থেকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আপনি নিজের ছাড়া আর কারো কথা শুনবেন না?
কাস্ত্রো : আমি স্বীকার করছি, এইসব ক্ষেত্রে আমাদের ভবিষ্যতে আরো ভাবতে হবে। অন্য এতসব বিষয় আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে যে, নিজেদের ভেতর এই প্রাসঙ্গিক ভাবনার সময় হচ্ছে না।


প্রশ্ন : দেশে সমালোচনার সংস্কৃতি না থাকার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে আমি দেখেছি, শিশুদের শেখানো হচ্ছে কোনো প্রশ্ন না উঠিয়ে আপাতবিষয়কে সত্য বলে গ্রহণ করা। আপনার কি মনে হয় না, দেশের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিজীবী তৈরিতে এই শিক্ষা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে?
কাস্ত্রো : আমার মনে হয়, শিক্ষার বিষয়টি শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। এটা কোনো পলিসির বিষয় নয়। শিশুদের অবশ্যই ভাবতে, চিন্তা করতে শেখাতে হবে। যাই হোক, আপনি কিছু মূল্যবান পর্যবেক্ষণের কথা শুনিয়ে ভালোই হল, আমরা নিশ্চয় এ নিয়ে ভাবব। আমাদের প্রধান ভাবনা ছিল উচ্চশিক্ষার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক গড়ে তোলা। মনে রাখতে হবে আমরা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতির ভেতর নেই। শ্রেণিসংগ্রাম, চেতনার সংঘাত—এসব পরিস্থিতির কারণে এই অবস্থা হয়েছে।
এটা ঠিক, আমরা শুরুর দিকে এসব নিয়ে ভাবিনি। আমাদের ভাবতে হয়েছে যেখানে বাচ্চাদের অক্ষরজ্ঞান দেওয়ার কেউ নেই সেখানে কীভাবে একটি স্কুল চালু করা যায়। শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক স্তরের বিষয়বস্তু নিয়ে আমরা শুরুতে ভেবেছি। আমাদের এখন অনেককিছুই নতুন করে ঠিক করতে হবে, কিন্তু সমস্যা হল দক্ষ লোকের ভীষণ অভাব। আমি মনে করি, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষিত করা তোলা যৌক্তিক একটি বিষয়। অবশ্যই তাদের ভেতর কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে না দিয়ে এমনভাবে শিক্ষিত করতে হবে যেন তারা মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারে।


প্রশ্ন : কিন্তু আমি লক্ষ করেছি, তেমনটি করা হচ্ছে না। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে দেশের সংবাদমাধ্যম যে একপেশে খবর পরিবেশন করছে, সেটাই তাদের হুবহু পড়ানো হচ্ছে। একেবারে শিশুশ্রেণি থেকে এমন একপেশে শিক্ষা অর্জন করা জেনারেশন যখন বড়ো হয়ে উঠবে তখন কী দাঁড়াবে?
কাস্ত্রো : তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে খুব বাজে ধারণা থাকবে, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। একইভাবে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র বিষয়ে শিশুদের ভুলশিক্ষা দিয়ে বড়ো করে তোলা হচ্ছে।
ভবিষ্যতে কোনো একটা সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কিউবা পুনরায় বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হবে। যখন সেটা ঘটবে তখন কি আপনাকে এর দায় নিতে হবে না?
এই প্রশ্নের উত্তর এত সহজে দেওয়া সম্ভব নয়। এই প্রথম এইরকম একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম আমি, তাও আবার একজন উত্তর আমেরিকার নাগরিকের কাছ থেকে। আমি বলতে পারি, আমরা সচেতনভাবেই এই বিষয়ে অবগত হতে চাইনি। অংশত কারণ আমেরকিা সম্পর্কে আমাদের ভেতর একটা হতাশা আছে। ওখানে জনগণ সত্যিকার অর্থে এই পরিস্থিতির বদল চায় কিনা আমাদের সন্দেহ আছে।
হতে পারে, আমরা নিজেরাই হয়তো বুঝতে পারিনি, উত্তর আমেরিকার জনগণের ভেতর সাদা-কালোয় কতটা গভীর সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ আমেরিকার সরকারের প্রতি আমাদের ন্যূনতম বিশ্বাস নেই। যে কারণে আমেরিকার জনগণ সম্পর্কে আমাদের ভেতর একটা নেতিবাচক মনোভাব জিইয়ে আছে। তবে আমরা সচেতনভাবে সেটা চাইনি। হতে পারে আপনার এই বইটি প্রকাশিত হলে আমাদের সংবাদকর্মীরাও এই প্রশ্নগুলো করবেন। আমি নিজে তাদের কাছে আমার উদ্বেগ তুলে ধরে এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে বলব। এর কারণ আপনি যা বললেন তার অনেককিছু আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে—কোনো একদিন, আমি মনে করি না খুব শীঘ্র, বরং আরও অনেক অনেক বছর পর হয়তো দুই দেশের ভেতর ভালো সম্পর্ক তৈরি হবে।

প্রশ্ন : আমার মনে হয়, আমরা যৌথপ্রয়াসে সেই সময়টা কমিয়ে আনতে পারি, অনর্থক কোনো কারণ ছাড়াই সংহতিটা আরো দীর্ঘস্থায়ী করার চেয়ে।
কাস্ত্রো : যৌক্তিক বটে। চলুন দুপুরের আহারটা সেরে ফেলি।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *