|

ফাতিমা বাড়ি ফেরে নাই – মাহমুদ আল রিমাওই অনুবাদ: নয়ন বসু

শেয়ার করুন

[লেখক পরিচিতি: মাহমুদ আল রিমাওই, একজন প্রখ্যাত প্যালেস্তানীয় লেখক। বেইত রিমার পশ্চিম উপকূলে ১৯৪৮ সালে তার জন্ম। ষাটের দশকের শেষদিক থেকে বিভিন্ন আরবি সংবাদপত্রে তিনি সাংবাদিকতা করেন। ২০০৭ থেকে জর্ডনীয় সংবাদপত্র আল-রাই-এর তিনি প্রধান সম্পাদক। বিগত কয়েক দশকে তার বহু গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে যার মধ্যে বেশ কিছু ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় অনূদিত।]

প্যারিস আর ম্যারাকেচ এই দুই শহরকে যে রাস্তা দিয়ে জোড়া হয়েছে, সেটা যে সবসময় গাড়ি ও মানুষের ভিড়ে থিকথিক করছে তা নয়। সারাদিনে শুধু একটি বাস ওই রাস্তা দিয়ে প্যারিস থেকে আসে। ম্যারাকেচ বাস স্টপে থামলে সেখানে যাত্রীরা বাস থেকে নেমে, যে যার নিজেদের গন্তব্যের দিকে যায়—কেউ অন্য বাস ধরে আগাদির শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়, বা অন্য রাস্তা ধরে।  এই বাসটার বয়েস যে খুব বেশি তা নয়; পাঁচ বছর আগে এটি প্রথমবার যাত্রা শুরু করেছিল। যেটা চোখে পড়ার মতো সেটা হল তার আকার। বৃহৎ আকারের এই বাস যখন রাস্তা দিয়ে চলে যেন মনে হয় চিতা বাঘ শিকারের পিছনে দৌড়োচ্ছে। দুরন্ত তার গতিবেগ। মসৃণ তার ইঞ্জিন। দিন-রাত এক করে একটা দেশ থেকে অন্য দেশ, একটা বর্ডার থেকে অন্য বর্ডার পেরিয়ে এই বাস এগিয়ে যায় স্বমহিমায়।

এই বাসটি, সঙ্গে নিয়ে চলে অনেক আবেগ, না পাওয়া ভালোবাসা, বহু পুরোনো স্মৃতি, আর অনেকদিনের চেপে থাকা রাগ আর অভিমান। আর অবশ্যই সঙ্গে যায় বিভিন্ন রকমের বাক্স-প্যাঁটরা, রংবেরঙের ব্যাগ, জিনিসপত্র।এই বাসের গতিবেগ যে মানুষটির হাতে, সেই চালক সাহেব বসেন চালকের কেবিনে; তার আর যাত্রীদের মাঝে একটা মোটা কালো কাঁচের দেয়াল। চালক সাহেবের কণ্ঠস্বর খুব ধীর ও স্থির যা শোনা যায় শুধুমাত্র বাস স্টপে থামার আগে। সামনে স্টপ আসছে এই বার্তা তিনি কেবিনে বসে অন্তর্ভাষ যন্ত্রের মাধ্যমে যাত্রীদের উদ্দেশে পৌঁছে দেন। ওই অন্তর্ভাষ যন্ত্রটি চালু হলে তার থেকে এক অদ্ভুত অথচ মিষ্টি সুর ভেসে আসে এবং তা সকল যাত্রীকে মুগ্ধ করে।  

চালক সাহেব নিজের জগতেই থাকেন। তার চলাফেরা ও গতিবিধির মধ্যে সর্বক্ষণ যেন একটা শান্তির বার্তা। মাথায় থাকে একটা ছাই রঙের টুপি। সেই জন্যেই হয়তো তার শরীরের তুলনায় বড়ো মাথাটা খালি চোখে ধরা পড়ে না। যখন দূরের পথ অতিক্রম করতে হয়, তখন অনেকটা রাস্তা চলার পর সে বাসটাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে  বিশ্রাম নেয়। বিশ্রামের সময় মুখের উপর টুপিটা রাখে সূর্যের আলো আটকানোর জন্য। এই সময় যাত্রীরাও বাস থেকে নেমে নিজেদের কোমর আর পা ছাড়িয়ে নেয়। তারপর আবার যাত্রা শুরু।

বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন জাতির মানুষ এই বাসে যাত্রা করে।  ফ্রান্স, মরক্কো, আফ্রিকা… নানা রকমের মানুষ, এদেরই মাঝে একটি জায়গা থাকে ফাতিমার জন্য। ফাতিমা হল  আয়েশার একমাত্র মেয়ে। ম্যারাকেচ বাস স্টপে আয়েশা তার মেয়ের জন্য গত পাঁচ বছর ধরে অপেক্ষা করছে। কিন্ত ফাতিমার বাস আজ পর্যন্ত আসেনি। বাস যাত্রীদের মধ্যে অনেক ফাতিমা আছে যারা বাড়ি ফেরে। পাশাপাশি, অনেক আয়েশা আছে যারা নিজের মেয়ের জন্য বাস স্টপে অপেক্ষা করে। কিন্তু একে অপরকে চেনে না।     এই দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষার ফলে যে অবসাদ, সেটা এতদিনে আয়েশা’র চোখ ও মুখে ফুটে উঠেছে। বয়েসের ছাপ যে মুখে পড়েছে সেটা বোঝা যায়। মাথার চুলে যে পাক ধরেছে সেটা তার হিজাবের ভিতর থেকে মাঝে মাঝেই উঁকি দেয়। সে সারা দিন মাথা নীচু করে বাসগুলোর দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। মাথা তুলে কারুর দিকে তাকায় না। দৃষ্টি শুধু সামনের দিকে। আশেপাশে কী হচ্ছে তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই আয়েশার।

স্টেশনের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু এই আশায় যে ফাতিমার বাস যেকোনো মুহূর্তে আসবে। সে বুঝতে পারে না যে এত দেরি হওয়ার সঠিক কারণটা। তার মাথায় ঢোকে না একটা বাসের প্যারিস থেকে ম্যারাকেচ আসতে এত সময় কেন লাগছে। এর থেকে তো যদি তার মেয়ে উট বা ঘোড়ার গাড়ি করে আসত, এতদিনে নিশ্চয় পৌঁছে যেত। কিন্তু পাঁচ বছর কেটে গেলেও কেন ফাতিমা এখনও এসে পৌঁছাল না?

মাঝ রাস্তায় কি বাসটা খারাপ হয়ে গিয়েছে, নাকি বাসের ট্যাংকে তেল ফুরিয়ে গিয়েছে? চালক সাহেবের কি মাঝপথে শরীর খারাপ হল, নাকি তার পরিবারের কারুর কিছু অঘটন হয়েছে যার খবর পেয়ে সে মাঝপথেই বাস থামিয়ে বাড়ি চলে গেছে? সে কি রাস্তায় পথ হারিয়ে ফেলে বাসটাকে অন্য কোনো অজানা দেশে বা শহরে নিয়ে গিয়ে উঠেছে? নাকি রাস্তায় কোনো গবাদি পশুকে ধাক্কা মারার জন্য সেই পশুর মালিকের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?

এই সব প্রশ্নের উত্তর  আয়েশার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সে আর কতটুকুই বা জানে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কত কিছুই তো ঘটে যাচ্ছে সারাদিনে। কিন্তু তার মধ্যেই সে উত্তর খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করে। তবে এর মাঝে তার দৃঢ় আশা যে ফাতিমা একদিন তার কাছে ফিরে আসবেই। সে জানে তার কপাল খারাপ, যে জিনিস শুভ সেটা তার জীবনে খুব কমই হয়, তাই সেই কারণেই হয়তো ফাতিমার এই দেরি? কিন্তু ফাতিমা আসবে।
এই মুহূর্তে যদি ফাতিমা তার সামনে এসে হাজির হয়, তাহলে হয়তো সে তার মেয়ের হাত ধরে এই বাস স্টপ থেকেই সোজা চলে যাবে আগাদির শহরে, যেটা মরক্কোর সেরা শহরগুলির মধ্যে একটা, যেখানে আছে তাদের নিজেদের বাড়ি। আছে পুরোনো স্মৃতি। বলা বাহুল্য, আয়েশা মন থেকে চায় না যে তার মেয়ে পায়ে হেঁটে এতটা পথ আসুক, সে চায় না তার মেয়ে একজন জীর্ণ ও ক্ষুধার্ত ভিখারির মতো এসে তার সামনে দাঁড়াক। তার মন চায়, তার একমাত্র মেয়ে যেন রানির মতো মাথা উঁচু করে, সুন্দর পরিপাটি জামাকাপড় পরে তার সামনে এসে দাঁড়ায় আর চোখে-মুখে যেন বাড়ি ফেরার আনন্দ ঝকমক করে। 

অনেকদিন হয়ে গেল আয়েশা তার মেয়ের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে। কিন্তু তবুও তার চোখে-মুখে একটুও অস্থিরতা নেই। আজকাল অপেক্ষা করতে করতে সে মাঝে মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে, তার ওই ছেঁড়া, ফিকে হয়ে যাওয়া কম্বলটা মুড়ি দিয়ে ঘুমোয়। হঠাৎ যখন তার ঘুম ভাঙে, সে মনে করতে পারে না ঠিক কতক্ষণ সে ঘুমিয়ে ছিল। এই সময় যদি তার খিদে পায়, পুটলি থেকে একটা লেবু আর বাসি রুটি বের করে সেটা সময় নিয়ে খায়। তারপরও খিদের আগুনে পেট জ্বালা করলে, এক ঘটি জল খেয়ে সেই জ্বালা নেভায়। এসব করার পরেও সময় যেন কাটতেই চায় না। নিজের সামনে পড়ে থাকা জিনিসগুলো এক এক করে গুনতে থাকে… কটা আছে? দশ নাকি কুড়ি? গোনা শুরু করে কিন্তু পাঁচ কী ছয় অব্দি গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গোনায় ভুল করে। বিরক্ত হয়ে আবার পথের দিকে চেয়ে বসে থাকে।

ফাতিমা যখন ম্যারাকেচ বাস স্টপে এসে পৌঁছবে, তার চোখ মায়ের দিকে নিশ্চয় যাবে, তখন সে দেখবে তার মায়ের এই করুণ দশা, কোনো মতে দিন চলছে তার মায়ের। অচেনা মানুষের দয়ায় বেঁচে আছে। কখনও রুমাল, কখনও দেশলাই, বা কখনও মিষ্টি লজেন্স বিক্রি করে যে রোজগার হয় তাতে দুবেলা খাওয়া জুটে যাচ্ছে কোনোভাবে। তার ভুলো মনের জন্য ব্যবসার অনেক ক্ষতিও হয়। 

কিন্তু কিছুই যেন তাকে নাড়া দেয় না আর। সে সব ভুলে যেতেই তো চায়। দশ বছর আগে তার স্বামী মারা গেলে পড়ে, তার ছোটো ছেলে, আহমেদ, বাড়ি ছেড়ে চলে যায় বেলজিয়াম। গত দশ বছরে আহমেদ বেলজিয়াম থেকে একবারের জন্যও বাড়ির কোনো খবর নেয়নি, দেখতে আসা তো দূরের কথা। তারপর থেকে আয়েশা ঘরবাড়ি ছেড়ে এই বাস স্টপে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আহমেদের থেকে খুব বেশি কিছু আশা করে না আয়েশা, তাই দশ বছরে ছেলে কোনো খবর নেয়নি জেনেও একটুও রাগ বা অভিমান নেই তার।

“কিন্তু, ফাতিমা তো এরকম নয়, সে কেন খবর নেবে না?” মনে মনে ভাবে আয়েশা। একটা সময় ফাতিমা নিয়মিত চিঠি লিখত, এখন অনেকদিন তার থেকে কোনো চিঠিও আসেনি। আয়েশা পড়তে জানে না, কিন্তু চিঠিতে তার মেয়ে ভালো কথাই লিখবে এটাই তার বিশ্বাস। মেয়ের চিঠি পেলে সে খুশি হত, এইটুকু ভেবে আশ্বস্ত হতে পারত যে মেয়ে বেঁচে আছে।

আজকাল মাঝে মাঝেই আয়েশা নিজের মৃত্যু কামনা করে, বেঁচে থাকার কোনো মানে সে খুঁজে পায় না। মেয়েকে একটিবার দেখার ইচ্ছাই যেন তাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে।           

***

ফাতিমা জানে তার মা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এবং অপেক্ষা করে আছে তার বেড়ে ওঠার শহর, আগাদির। অপেক্ষা করে আছে তার প্রতিবেশীরা, তার ছোটোবেলার খেলার মাঠ, তার স্কুল, তার পাড়ার দোকান, সেই ধবধবে সাদা বিড়ালটাও তার জন্য অপেক্ষা করে আছে সে জানে। আর অপেক্ষা করে আছে সেই চেনা সূর্যোদয় এবং তার বাবা (ঈশ্বর তাকে অকালে তুলে না নিলে আজ ফাতিমাকে এত দুঃখ ও কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হত না, তার বাবা নিশ্চয় সর্বশক্তি দিয়ে তাকে রক্ষা করতেন)।

ফাতিমা তার মায়ের বর্তমান অবস্থার কথা জানে না। সে জানে না যে তার মা আগাদির শহরে তাদের বিশাল বাড়িটা ছেড়ে, স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন ছেড়ে, ম্যারাকেচ বাস স্টপে এসে আশ্রয় নিয়েছে, শুধু একটিবার তার মেয়েকে চোখের দেখা দেখবে বলে। 

ফাতিমার মন কেমন করে বাড়ির জন্য। তার কান্না পায়। চোখ ভিজে যায়। কিন্তু বাড়ির ওই শৃঙ্খলার জীবনে সে আজ ফিরে যেতে নারাজ।  
ফাতিমার নিজেকে অনাথ মনে হয়। তার মা এবং মাতৃভূমি থেকে অনেক দূরে, সুদূর প্যারিস শহরে বসে তার মনে অবসাদের মেঘ ভেসে আসে।    
আজ থেকে দশ বছর আগে তার বাবা মারা যায়। বাবা মারা যাওয়ার চার বছর পর সে ফ্রান্স চলে আসে মোস্তফার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করার আশায়। মোস্তাফার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়  ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ফোনে কথা বলা শুরু। তারপর প্রেম। এবং আঠারো বছর বয়েসে মোস্তাফাকে বিয়ে করে ফাতিমা। সেই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি, কুড়ি মাসের মাথায় তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

মোস্তফা ছিল অত্যন্ত স্বার্থপর একজন মানুষ। নিজের ভালোমন্দ চিন্তা করেই তার দিন কেটে যেত। তার স্ত্রীকে কোনোরকম আর্থিক সাহায্য করা তো দূরে থাক, উলটে ফাতিমা যে টাকা রোজগার করত সেটাও কেড়েকুড়ে নিয়ে নিত। বিবাহবিচ্ছেদের পর অনেক পুরুষ, কেউ তার নিজের দেশের আবার কেউ ভিনদেশের, ফাতিমার দিকে আকৃষ্ট হয়েছে ঠিকই কিন্তু ফাতিমার মন কেউ জয় করতে পারেনি।

ফ্রান্স দেশে আসা থেকে ফাতিমা অনেক রকমের কাজ করেছে। যখন যেটা পেয়েছে পেটের দায়ে মুখ বুজে সেটাই করেছে। বিবাহবিচ্ছেদের আগে থেকেই তাকে কাজ করতে হয়েছে। তার স্বামী একটা টাকাও কোনো দিন দিত না, তাই নিজের পেট চালানোর ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হত। কিছু মাস এখানে, কিছু হপ্তা ওখানে, এইভাবে কাজ করেছে ফাতিমা। হোটেল, চিনির কারখানা, টেলিফোনের দোকান, কসাইখানা, ইত্যাদি এরকম নানা জায়গায় কাজ করেছে। একবার এক ফরাসি দম্পতির বাড়িতেও কিছু মাস কাটিয়েছে, ওই পরিবারের দৈনন্দিন টুকটাক ছোটো-বড়ো কাজ করে দিত ফাতিমা। গত কয়েক বছর এইভাবেই কেটেছে তার। বর্তমানে সে একটা বাস স্টপে দারোয়ানের কাজ করে।    বেশ অনেকদিন হয়ে গেছে এই বাস স্টপে দারোয়ানের কাজ করছে ফাতিমা, আজ পর্যন্ত কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। তার সঙ্গে আরও আটজন আছে, তারা একসঙ্গে কাজ করে। মালিক আশ্বাস  দিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি তার পদোন্নতি হবে। ফাতিমা নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে, এই চাকরি ছেড়ে তার অন্য কোথাও যাওয়ার উপায়ও তো নেই। এর আগে অনেক জায়গায় অনেক রকমের কাজ সে করে দেখেছে, কোনোটাই স্থায়ী ভাবে করতে পারেনি সে।

“তোর জীবন এখানেই, এটাই তোর বাস্তব, এটাই তোর ভবিষ্যৎ …”, ফাতিমা নিজের মনে এই কথা গুলো বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।  
তার ইচ্ছা আছে একবার বাড়ি যাওয়ার, সবার জন্য উপহার নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সে আবার ফিরে আসবে এখানে, তার কর্মভূমিতে। ফ্রান্সে। কারণ এই দেশ তাকে থাকতে দিয়েছে। নিজের পরিচয় দিয়েছে। নতুন বন্ধু দিয়েছে, যদিও সে জানে তারা কেউ সারাজীবনের জন্য নয়, তাও এখানে এরাই তো তার কাছের মানুষ।  বাস স্টপের হলঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ফাতিমা বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে আগত যাত্রীদের দেখে। তাদের নতুন জামা, নানা রঙের ব্যাগ দেখে সে বেশ মজা পায়।

“অনেক মানুষ এখানে রোজ আসা-যাওয়া করে, এদের আবেগ একদম স্বচ্ছ।” ফাতিমা মনে মনে ভাবে।  কেউ তাদের প্রিয়জনকে অনেকদিন পর দেখতে পেয়ে যেমন আনন্দিত, আবার উলটোদিকে কারুর মুখ ম্লান নিজের প্রয়োজনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হতে চলেছে এই ভেবে। আবার কবে দেখা হবে কেউ জানে না।

এই সকল মানুষের ভিড়ে ফাতিমা নিজের দেশের মানুষের মুখ দু-একটা খোঁজার চেষ্টা করে… সেটাই তাকে লড়ে যাওয়ার মানসিক শক্তি যোগাবে।তার নিজের লোককে স্বাগত বা বিদায় জানানোর নেই।  মোস্তাফা তাকে ভুলে গিয়েছে (সেও প্রতিদিন ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে), তার দাদা, আহমেদের কোনো খবর নেই। ঈশ্বরই জানে বেলজিয়ামে কী এমন আছে যেটা পেয়ে সে তার একমাত্র বোনকে ভুলে গেছে।হঠাৎ তার মায়ের কথা মনে পড়ে। মা ছাড়া ফাতিমার এই পৃথিবীতে কেউ নেই। কিন্তু তাও সে ফিরে যেতে চায় না। ফিরতে চায় না সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে। সে এগিয়ে যেতে চায়। তার সব স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। সে মনে মনে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চায় এরকমটা ভাবার জন্য, এতটা স্বার্থপরের মতো চিন্তা করার জন্য সে নিজেকে দোষী মনে করে।

সে কারুর জন্য অপেক্ষা করতে চায় না আর। এই মুহূর্তে সে একটা বাসে উঠে অনেক দূরে কোথাও যেতে চায়। চালকের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে যতদূর যাওয়া যায়, নিয়ে যাওয়ার। তবে সেটা কোনো চেনা শহরে নয়, এক অজানার উদ্দেশ্যে।  

“নিজেকে অবাস্তব স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে ফেলিস না, ফাতিমা। নিজেকে হারিয়ে ফেলিস না।” সে নিজেকে নিজেই বকুনি দেয় আবেগের তাড়নায় বয়ে যাওয়ার জন্য।
“এটা আমরা কোথায় এসে পড়লাম, সানো?” ফাতিমা হঠাৎ তার সহকর্মীর দিকে এই প্রশ্ন ছুড়ে দিল। তবে সানো জানে কীভাবে ফাতিমার এইসব প্রশ্ন সামলাতে হয়। তাই সে একদম অবাক না হয়ে উত্তর দেয়, “ফ্রান্স, প্যারিস শহরে। কেন, তোমার কী মনে হয়?”
“আমরা আছি একটা বাস স্টপে।” ফাতিমা পালটা উত্তর দেয়। “আমি ফ্রান্স এসেছিলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে, বাস স্টপে দারোয়ানের কাজ করতে নয়।”

সানো কথা বাড়ায় না। দুজনে চুপচাপ কাজে ফিরে যায়।  এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ফাতিমা বাস স্টপের দারোয়ানের চাকরিটা ছেড়ে দেয়, তারপর নিজের অল্প কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে যে ঘরে সে থাকছিল, আরও দুজন মহিলার সাথে, সেটাও ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ওই দুজন মেয়ে তাকে আটকানোর অনেক চেষ্টা করে কিন্তু সে কোনো কথা শোনে না। শুধু যাওয়ার আগে বলে যায়: “আমি তোমাদের কোনোদিন ভুলব না, তোমরা আমার বোনের মতো। যেখানেই থাকি, তোমরা আমার মনে সবসময় থাকবে। ভালো থেকো।”

ঈশ্বর ছাড়া কি কেউ জানে ফাতিমা কোথায় গেল? সে কি অন্য কোনো চাকরি পেয়েছে? নাকি সে তার স্বামীর কাছে আবার ফিরে গেছে? নাকি সে নিজের জীবনের আগামী দিনগুলো ইসলাম ধর্মের প্রচারের জন্য সঁপে দিয়েছে? নাকি কোনো ফরাসি প্রেমিকের ভালোবাসার ডাকে সারা দিয়ে তার সঙ্গে অন্য কোনো শহরে পালিয়েছে? নাকি সহজ আয়ের লোভে দেহ ব্যবসায় নিজেকে সমর্পণ করল ফাতিমা? সে কি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সবার থেকে অনেক দূরে চলে গেল?  

তাহলে, ফাতিমা গেল কোথায়?

সেই প্রশ্নের উত্তরটা দেয়া যাক এইবার: ফাতিমা নিজের অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়ে বাসে চেপে ম্যারাকেচ শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেখানে পৌঁছে বাস স্টপে সে তার মাকে দেখতে পায়। আগামী দিনের জীবন মায়ের সঙ্গে কাটাবে এই ভেবে সে এগোতে থাকে আয়েশার দিকে। মা ও মেয়ে অনেক বছর পর সামনাসামনি হয়। ফাতিমা কাঁপা গলায় মা! মা! মা! বলে ডাকে। কাঁধে হাত রেখে মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তবে আয়েশা চিনতে পারে না নিজের মেয়েকে, নিজের মনে মনে মাটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে থাকে। আশেপাশের লোক তাকিয়ে দেখে, তারা ভাবে এতদিন পর মা-মেয়ে একসঙ্গে হয়েছে। কিন্তু সেই মুহূর্তটা যেটার জন্য এত অপেক্ষা সেটা যেন আসতেই চাইছে না। মা-মেয়ে এতদিন পর দেখা হওয়ার পর এই আবেগতাড়িত মুহূর্ত…

ফাতিমা নিজের পরিচয় দেয় না। তার মায়ের মাথা তুলে তার দিকে তাকাতে বলে না। বলে না সে এতদূর শুধু তার মা’র সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে কিছুই বলে না। কিছু না বলে ফাতিমা সেখান থেকে চলে যায়। 

সেখান থেকে ফাতিমা চলে যায় মরক্কোর একটি নামকরা শহর টাঙ্গাইর-এ। টাঙ্গাইর একটি সুন্দর সাজানো শহর যেখানে বিভিন্ন ধর্মের ও জাতির মানুষ বসবাস করে। সেখানে সে নিজের একটা বাড়ি করেছে। তার নিজের একটা দোকানও করেছে যেখানে সে জামাকাপড়ের নকশা বা ডিজাইন তৈরি করে। সেখান থেকে যা আয় হয় খুব ভালোভাবে চলে যায় তার। ফাতিমা ভালো আছে, ঠিক যেমনটা সে থাকতে চেয়েছিল।
এদিকে প্যারিস থেকে সেই বাস নিয়ম করে রোজ আসে, ঠিক যেমন প্রকৃতির নিয়ম মেনে বাতাস বয়ে যায়, সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে আর পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। সেই একইরকম ভাবে, নিয়ম মেনে রোজ আয়েশা তার মেয়ের অপেক্ষায় ঠায় বসে থাকে… 

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *