জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১৯ )

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১৯ )

শেয়ার করুন

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব – উনিশ 

যতদূর মনে পড়ে সেই সময়ে ভ্রাম্যমাণ অ্যাকর্ডিয়ান বাদকদের গানের প্রতি ভালো লাগার মধ্যে দিয়েই সঙ্গীতের প্রতি আমার আগ্রহ প্রকাশ পায়। কিছু গান আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কেন-না রান্নাঘরে মেয়েরা ওই গানগুলো চুপিচুপি গাইত। দিদিমা তো ওইসব গান পছন্দ করতেন না, তাঁর কাছে ওগুলো ঠিক ভদ্রলোকের গান ছিল না। তবে আমার গান গাওয়ার প্রেরণা ছিল কার্লোস গার্দেলের[১] তাঙ্গো[২], নিজেকে উপলব্ধি করার জন্য প্রয়োজন ছিল যে গানের। সেই তাঙ্গো অবশ্য তখন অর্ধেক পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এমনকি আমি কার্লোস গার্দেলের মতো পোশাক পরতাম–পশমের টুপি ও সিল্কের স্কার্ফ। আর আমাকে খুব বেশি অনুরোধ করতে হত না, তার আগেই গলাকে সবচেয়ে উঁচু পর্দায় তুলে একটা তাঙ্গো গাইতে শুরু করে দিতাম। একদিন সকালে তিয়া মামা আমাকে ঘুম থেকে তুলে বললেন যে মেদেজিনে[৩] দুটো বিমানের সংঘর্ষে কার্লোস গার্দেল মারা গেছেন। এর কয়েক মাস আগে একটি চ্যারিটি অনুষ্ঠানে আমি এচেবেররি পরিবারের দিদিদের সঙ্গে ‘পাহাড়ি ঢাল’[৪] গানটি গেয়েছিলাম। এঁরা পুরোপুরি বোগোতার মেয়ে ও মাস্টারদের মাস্টার। কাতাকার অসংখ্য চ্যারিটি অনুষ্ঠান ও স্বদেশী স্মৃতি-উদযাপনে তাঁরাই ছিলেন প্রধান আকর্ষণ। সেই অনুষ্ঠানে আমি এত ভালো গান গেয়েছিলাম যে অ্যাকর্ডিয়ানের বদলে যখন পিয়ানো শিখতে চাইলাম তখন মা রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি দিদিমা সেই আবদার নাকচ করে দেওয়া সত্ত্বেও। 

সেই অনুষ্ঠানের রাতেই মা আমাকে এচেবেররি দিদিদের কাছে নিয়ে যান যাতে আমি গান শিখতে পারি। আমরা একটা ঘরের এক প্রান্তে বসেছিলাম আর তার অন্য প্রান্তে রাখা ছিল পিয়ানোটা। মা যখন তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত, আমি প্রায় রাস্তার কুকুরের মতো মনোযোগ সহকারে সেটা দেখছিলাম আর হিসেব করছিলাম আমার পা প্যাডেল অবধি পৌঁছাবে কিনা। মনে দ্বিধা ছিল আমার সবকটা আঙুল দিয়ে এক রিড থেকে অন্য রিডের মধ্যেকার ফাঁক পূরণ করতে পারব কিনা। স্বরলিপিটাও শিখতে পারব কিনা সন্দেহ হচ্ছিল। তবে সেই দু’ঘণ্টা ধরে যে কথাবার্তা হল তাতে আমি খুবই আশান্বিত হয়েছিলাম। কিন্তু শেষ অবধি কিছুই হল না। শিক্ষিকারা বললেন পিয়ানো খারাপ হয়ে পড়ে আছে। কবে ঠিক হবে জানা নেই। তাই গান শেখার বিষয়টা মুলতুবি রইল পিয়ানো সারাইয়ের লোক আসা পর্যন্ত। তারপর আমার প্রায় অর্ধেক জীবন কেটে যাওয়া পর্যন্ত সে নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করল না। যাই হোক, একদিন মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎই উল্লেখ করেছিলাম পিয়ানো শিখতে না পেরে সেদিন কত দুঃখ হয়েছিল তার কথা। সব শুনে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন:

—‘আরও দুঃখের যেটা এর মধ্যে খারাপ কিছু ছিল না।’

তখন আমি জানতে পারলাম যে মা-ই নিজে শিক্ষিকাদের সঙ্গে কথা বলে পিয়ানো খারাপ হয়ে যাওয়ার গল্পটা বানিয়েছিলেন যাতে তিনি যেমন করে ‘প্রেসেনতাসিয়োন’ স্কুলে পাঁচ বছর ধরে অনর্থক পিয়ানোর ক্লাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন, আমাকেও সেই অত্যাচার সহ্য করতে না হয়। এর একমাত্র সান্ত্বনা ছিল এই যে কাতাকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত মন্তেস্বরী স্কুলে শিশুদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের উন্মেষ ঘটানোর জন্য শিক্ষিকারা অনেক কিছু শেখাতেন এবং তার মধ্যে গান ছিল অন্যতম। আধিকারিক রোসা এলেনা ফেরগুসনের বিশেষ পারদর্শিতার ফলে সেই স্কুলে পড়াশোনা করা ছিল বেঁচে থাকার মতোই আনন্দদায়ক। ওইখানে আমি গন্ধকে প্রাধান্য দিতে শিখেছিলাম। অতীতের স্মৃতি উস্কে দেওয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে এই গন্ধের। রসনাকে এমন শান দিয়েছিলাম যে জানলার স্বাদের পানীয়, তোরঙ্গর স্বাদের পুরোনো পাউরুটি ও প্রার্থনার স্বাদের উষ্ণ পানীয় পর্যন্ত খেয়ে দেখেছিলাম। এই সমস্ত ব্যক্তিগত আনন্দানুভূতি ঠিক তত্ত্ব দিয়ে বোঝানো যায় না। একমাত্র যে নিজে পরখ করেছে সে-ই তা নিমেষে বুঝে নিতে পারে।

আমার মনে হয় শিশুদের মধ্যে বিশ্বপৃথিবীর সৌন্দর্য্যের বোধ ও জগৎ-জীবনের গূঢ় রহস্যের প্রতি কৌতূহল জাগানোর জন্য মন্তেস্বরী শিক্ষাব্যবস্থার কোনো বিকল্প হয় না। যদিও স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বোধকে অনুপ্রাণিত করে বলে এই ব্যবস্থার অনেক সমালোচনা করা হয়ে থাকে এবং আমার ক্ষেত্রে সম্ভবত তা যথেষ্ট কার্যকরীও হয়েছিল। তবে অন্যদিক থেকে দেখলে আমি কিন্তু ভাগ করতে, স্কোয়ার রুট বের করতে বা বিমূর্ত ধারণার কিছুই আয়ত্ত করতে পারিনি। তখন এত ছোটো ছিলাম যে ক্লাসের মাত্র দুজন সহপাঠীর কথা মনে আছে। একজন হুয়ানিতা মেনদোসা–সাত বছর বয়সে টাইফাস রোগে মারা যায়, স্কুল শুরুর অল্প দিনের মধ্যেই। মাথায় মুকুট ও ওড়না পরে কনের সাজে কফিনে শোয়ানো তার সেই রূপ আমি সারা জীবনেও ভুলতে পারিনি। অন্যজন হল গিয়েরমো বালেন্সিয়া আবদালা, স্কুলের প্রথম টিফিন পিরিয়ড থেকে আমার বন্ধু এবং আমার সোমবারের খোঁয়াড়ি কাটানোর অভ্রান্ত চিকিৎসক। 

আমার বোন মার্গোতের নিশ্চয়ই ওই স্কুল ভালো লাগত না। অবশ্য সে আমাকে এরকম কিছু বলেছে বলে মনে পড়ে না। একেবারে নীচের ক্লাসের একটা চেয়ারে গিয়ে সে বসত আর সেখানেই চুপ করে বসে থাকত। টিফিনের সময়েও সেখান থেকে নড়ত না। একই দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকত ছুটির ঘণ্টা বাজা পর্যন্ত। সেই সময় কোনোভাবেই জানতে পারিনি যে বাড়ি থেকে আসার সময় সে লুকিয়ে তার এপ্রনের পকেটে করে বাড়ির বাগানের মাটি নিয়ে আসত ও ক্লাসে যখন একা বসে থাকত সেই মাটি মুখে দিয়ে চিবাতো।

একেবারে শুরুর সময় বর্ণমালা শিখতে আমায় বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ‘এম’ অক্ষরটির উচ্চারণ হবে ‘এমে’[৫], এটা আমার একটুও যুক্তিপূর্ণ মনে হয়নি। তার সঙ্গে আবার ‘আ’-কার লাগালে সে ‘এমেয়া’ না হয়ে হবে ‘মা’। এভাবে পড়তে শেখা আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়েছিল। তারপর যখন মন্তেস্বরী স্কুলে পড়তে যাই শিক্ষিকা আমাকে অক্ষরের নামের বদলে ব্যঞ্জনবর্ণের ধ্বনি শিখিয়েছিলেন। এরপরে আমি জীবনের প্রথম বই পড়তে পারি। বইটা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম বাড়ির ভাঁড়ারঘরে একটা তাকের ধুলোময়লার মধ্যে। বইটা ছেঁড়া, পেছনের পাতাগুলোও ছিল না। কিন্তু সেটাই আমি এত মন দিয়ে পড়তাম যে আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে সারার প্রেমিক আমাকে দেখে এক অব্যর্থ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন:
 
‘আরে! এ ছেলে যে দেখছি একদিন লেখক হবে।’

যে মানুষটি আমার সম্বন্ধে এই কথা বললেন, তিনি নিজে একজন লেখক, লেখনী-ই তাঁর পেশা। সুতরাং তাঁর কথাটি আমার মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করল। এর বহু বছর পরে জেনেছিলাম ওই বইটার নাম হল ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’। যে গল্পটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল তা আকারে বেশ ছোটো আর খুবই সহজ। সেই গল্পটা বাকি জীবনেও আমার সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প বলে মনে হয়েছে। অবশ্য এখন আর নিশ্চিত নই যে তখন ওই গল্পটাই পড়েছিলাম কিনা। আর এটা এমন একটা ব্যাপার যা অন্য কারুর কাছ থেকে নিশ্চিতভাবে জানতে পারব না। গল্পটা এইরকম: এক জেলে তার প্রতিবেশিনীকে বলল যে যদি তাকে জালের সীসাটা ধার দেয় তাহলে সে তার ধরা প্রথম মাছটা তাকে দেবে। তারপর ওই প্রতিবেশিনী যখন ভাজার জন্য মাছটা কাটল তার পেটের ভেতর থেকে একটা বাদামের মাপের হীরা বেরিয়ে এল।

আমি সবসময়েই পেরুর যুদ্ধের সঙ্গে কাতাকার অবক্ষয়ের একটা সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি। কারণ শান্তি ঘোষণার পর থেকেই আমার বাবা এমন এক অনিশ্চয়তার গোলকধাঁধায় নিজেকে হারিয়ে ফেললেন যে আরাকাতাকা ছেড়ে শেষ পর্যন্ত পরিবার নিয়ে তাঁর নিজের শহর সিন্সেয়[৬] চলে গেলেন। তাঁর সেই খুঁজে ফেরার যাত্রায় সঙ্গী ছিলাম আমি আর ভাই লুইস এনরিকে। নতুন জায়গায় জীবনের সেই নতুন অধ্যায় বাস্তবে আমাদের কাছে ছিল এক অভিনব শিক্ষার পর্ব। কাতাকা আর সিন্সের মধ্যে সংস্কৃতিগত এত প্রভেদ ছিল যে মনে হয়েছিল যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি গ্রহ। ওখানে পৌঁছানোর পরের দিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হল কাছের একটা খামারে। সেখানে আমরা অনেক কিছু শিখলাম: গাধার পিঠে চড়া, গরুর দুধ দোয়ানো, বাছুরকে বলদ করা, তিতির পাখি ধরার ফাঁদ পাতা, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা এবং ছেলে আর মেয়ে কুকুর কেন জোড়া লেগে থাকে তার কারণ। এই নতুন জগতকে আবিষ্কার করতে লুইস এনরিকে সারাক্ষণ আমার থেকে কয়েক পা এগিয়ে থাকত। এই জগতের দ্বার মিনা আমাদের কাছে নিষেধের বেড়াজালে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। বিপরীতে আমার ঠাকুমা আর্হেমিরা কিন্তু কোনোরকম বিদ্বেষের ভাব না রেখেই এসবের কথা আমাদের বলতেন। সেখানে এতজন কাকা-কাকিমা ছিলেন, এতজন তুতো ভাই-বোন, তাদের গায়ের রঙেও এত ভিন্নতা আর অদ্ভুত সব পদবীর কত যে আত্মীয়স্বজন ও তাদের কত ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণের টান যে বিস্মিত হওয়ার আগে বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম। তবে পরে বুঝতে পারলাম এও এক ধরনের ভালোবাসার পথ। আমার ঠাকুরদা দোন গাব্রিয়েল মার্তিনেস ছিলেন একজন বিখ্যাত স্কুলমাস্টার। তাঁর কাছে গেলে তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করলেন তাঁর বাড়ির উঠোনে। সেখানে ছিল বিরাট বড়ো বড়ো আমগাছ। সেই গাছের ফল আকারে ও স্বাদে এলাকার মধ্যে খুবই নামকরা। গাছে ফল ধরতেই তিনি প্রতিদিন তাদের গুনতেন। তারপর একটা একটা করে নিজে হাতে পেড়ে বেশ ভালো দামে বিক্রি করতেন–প্রতিটি আম এক সেন্তাভো। তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ সুন্দর কথাবার্তার পর চলে আসার সময় একটা পাতায় ছাওয়া গাছ থেকে একটা আম পেড়ে তিনি আমাদের দুজনের জন্য দিলেন। 

বাবা আমাদের বুঝিয়েছিলেন যে সিন্সেয় যাওয়াটা দরকার ছিল পারিবারিক ঐক্যের জন্য। কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আসলে তাঁর গোপন উদ্দেশ্য হল সেখানকার বড়ো রাস্তার মোড়ে একটা ফার্মেসি খোলা। আমার ভাই আর আমি লুইস গাব্রিয়েল মেসার স্কুলে ভর্তি হলাম। ওই স্কুলে আমরা অবাধে ঘুরে বেড়াতাম আর অন্যদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতাম। শহরের বড়ো রাস্তার ধারে একটা বেশ বড়ো বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। বাড়িটা দোতলা, রাস্তার দিকে একটা টানা বারান্দা ছিল, তাতে সার দেওয়া নিঃসঙ্গ শোবার ঘরগুলোয় রাতে গান গাইত একটা আলকারাবান পাখির[৭] ভূত। 

ঠিক যখন আমার মা ও বোনেদের সিন্সেয় সানন্দ অভ্যর্থনার জন্য সব কিছু প্রস্তুত, হঠাৎ টেলিগ্রামে খবর এল যে দাদু নিকোলাস মার্কেস মারা গিয়েছেন। তাঁর গলায় একটা কষ্ট হচ্ছিল। ডাক্তাররা বললেন ক্যান্সার হয়েছে এবং একেবারে শেষ পর্যায়। এমনকি সান্তা মার্তায় গিয়ে মারা যাবেন সেই সময়টুকু পর্যন্ত ছিল না। আমাদের মধ্যে একমাত্র আমার ভাই গুস্তাবো তাঁকে মারা যেতে দেখেছিল, তখন তার বয়স মাত্র ছ’ মাস। তাকে কেউ একজন দাদুর মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিয়েছিল, যাতে তিনি বিদায় জানাতে পারেন। মৃত্যুপথযাত্রী দাদু তাকে শেষবারের মতো আদর করেছিলেন। এর বহু বছর পরে তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওই অকল্পনীয় মৃত্যুর ঠিক কী অর্থ ছিল আমার জীবনে। 

তারপর বাবা-মা সিন্সেয় ফিরে গেলেন, কিন্তু শুধু সন্তানদের নিয়ে নয়, তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দিদিমা মিনা, তিয়া মামা ও তাঁদের দেখাশোনার জন্য তিয়া পা। তবে নতুন জায়গায় আসার আনন্দ ও বাবার পরিকল্পনার ব্যর্থতা প্রায় একই সঙ্গে ঘটেছিল। ফলত বছর পূর্ণ হবার আগেই আমরা আবার সদলবলে কাতাকার পুরোনো বাড়িতে ফিরে এলাম ‘টুপি ঝাড়তে ঝাড়তে’[৮]। এই কথাটা মা বলতেন এইরকম হতাশ পরিস্থিতিতে পড়লে। তবে বাবা বাররানকিয়ায় থেকে গেলেন কীভাবে তাঁর চতুর্থ ফার্মেসি খোলা যায় তার হালচাল বুঝে নিতে। 

সেই সময়ে কাতাকার বাড়িতে থাকার ভয়ংকর দিনগুলোর সর্বশেষ স্মৃতি হল উঠোনে আগুন জ্বালিয়ে দাদুর সমস্ত জামা-কাপড় পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। তাঁর সেই যুদ্ধের সময়ের লিকিলিকে[৯] ও সাধারণ সময়ে ব্যবহৃত সাদা লিনেনের পোশাক যেন তাঁরই প্রতিভূ। তাই মনে হচ্ছিল পোশাকগুলো যখন পুড়ছে তখন তিনি সেগুলোর মধ্যে জীবন্ত উপস্থিত রয়েছেন। সেকথা সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল যখন বিভিন্ন রঙের তাঁর কাপড়ের টুপিগুলো পুড়ছিল। এই টুপি ছিল তাঁর পরিচয়, তাই দিয়ে তাঁকে দূর থেকেও চেনা যেত। তাদের মধ্যে থেকে ঠিক চিনে নিয়েছিলাম আমার চেককাটা স্কটিশ টুপিটা। ভুল করে তা পোড়ানো হয়েছিল। তখন এমন একটা অনুভূতি হল যে আমি শিউরে উঠলাম, বোধ হল আগুনে পোশাক পুড়িয়ে ফেলার এই ধ্বংসযজ্ঞ দাদুর মৃত্যুতে আমাকে একটি বিশেষ ভূমিকা অর্পণ করল। আজ সেটা আরও স্পষ্ট দেখতে পাই–দাদুর সঙ্গে আমার সত্তার একটা অংশেরও মৃত্যু হয়েছিল সেদিন। তবে এটাও নিঃসন্দেহে বুঝতে পারি যে সেই সময়েই আমি একজন প্রাথমিক স্কুলের লেখক হয়ে উঠেছিলাম, শুধু লিখতে শেখাটুকুই যা বাকি ছিল।

বাড়ি বিক্রি করতে না পেরে মায়ের সঙ্গে যখন সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম তখন হবহু এই রকমের মনোভাব আমাকে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার রসদ জুগিয়েছিল। ফেরার ট্রেন যে কোনো সময় চলে আসতে পারে, তাই আর কারুর সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবতেও পারলাম না, আমরা সোজা স্টেশনে চলে এলাম। মা বললেন, ‘আরেক দিন হাতে সময় নিয়ে আবার আসব।’ আর কোনোদিন আসব না বললে শ্রুতিকটু শোনায়, তাই মা ও-কথা বলেছিলেন। আর আমার কথা বললে, আমি তখনই জানতাম যে বাকি সারা জীবনের জন্য এই বেলা তিনটের ঝড় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। 

স্টেশনে শুধুমাত্র আমরা দুজন ভূতের মতো বসেছিলাম। অবশ্য ওভার অল পরে একজন রেলকর্মী ছিল যে টিকিট বিক্রি ও অন্যান্য কাজ করছিল যা করতে সেই সময়ে প্রায় কুড়ি-তিরিশ জন দক্ষ লোকের দরকার হত। এক নিষ্করুণ গরমে চারদিক ঝলসে যাচ্ছিল। রেললাইনের অপর পারে কলা কোম্পানির নিষিদ্ধ নগরীর অবশিষ্টাংশ পড়ে রয়েছে–বড়ো বড়ো প্রাসাদের মতো পুরোনো বাড়ি, উধাও হয়ে গেছে তাদের লাল টালির চাল, ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে শুষ্ক পাম গাছ, হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষ এবং রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে জরাগ্রস্ত বাদাম গাছের মধ্যে পরিত্যক্ত মন্তেস্বরী স্কুল ও স্টেশনের সোজাসুজি তার নুড়ি বিছানো ছোট্ট চত্বর, কিন্তু তার প্রাচীন গৌরবের আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। 

প্রতিটি জিনিসের দিকে একবার মাত্র তাকাতেই লেখার জন্য এক অপ্রতিহত আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বুঝি লিখতে না পারলে মরেই যাব। এই যন্ত্রণা আমার আগেও হয়েছে, কিন্তু সেই দিন সকালে আমি প্রথম বুঝতে পারলাম আসলে সেটা প্রেরণার সম্মোহন। প্রেরণা শব্দটা অসম্ভব খারাপ, কিন্তু এ এমন এক সত্য যা পথের সব কিছু মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভস্মে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে।

টীকা:

১। কার্লোস গার্দেল: ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া আর্হেন্তিনার গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও অভিনেতা, জন্ম ১১ ডিসেম্বর ১৮৯০ ও মৃত্যু ২৪ জুন ১৯৩৫। তাঙ্গো গানের ইতিহাসে তিনিই সবথেকে উল্লেখযোগ্য নাম। জীবনের মধ্যপথেই একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয় এবং গোটা লাতিন আমেরিকা তাঁকে ‘ট্রাজিক হিরো’ হিসেবে মনে রেখেছে।  

২। তাঙ্গো: লাতিন আমেরিকার একটি বিশেষ ধরনের সঙ্গীত যা আর্হেন্তিনা ও উরুগুয়াইয়ের ইউরোপ ও আফ্রিকার অভিবাসীদের মধ্যে থেকে উদ্ভুত। এটি শুধু বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে দিয়ে অথবা গান হিসাবে গাওয়া হয়। 

৩। মেদেজিন: কলোম্বিয়ার আন্তিয়োকিয়া রাজ্যের রাজধানী ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।

৪। পাহাড়ি ঢাল: কার্লোস গার্দেলের একটি তাঙ্গো গান, ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত, মূল নাম – ‘Cuesta abajo’। 

৫। এমে: স্প্যানিশ বর্ণমালার ‘M’ অক্ষরটির উচ্চারণ এমে। 

৬। সিন্সে: দক্ষিণ কলোম্বিয়ার একটি শহর, সুক্রে রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। আরাকাতাকা থেকে এই শহরের দূরত্ব ১৮২ কিলোমিটার। 

৭। আলকারাবান: একটি পাখির নাম, ইংরাজিতে stone-curlew, বরিউনিডের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং এটি সারা বিশ্বে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও শীতপ্রধান অঞ্চলে পাওয়া যায়।
 
৮। টুপি ঝাড়তে ঝাড়তে: সেই সময়ে কলোম্বিয়ার ক্যারিবীয়া অঞ্চলে প্রায় প্রত্যেকেই টুপি ব্যবহার করতেন আর টুপিগুলো সাধারণত বেত দিয়ে তৈরি হত। আর তখন রাস্তাঘাট খুব একটা ভালো ছিল না, তাই পথে খুব ধুলো থাকত। সেই জন্য অনেকটা পথ পার হতে গেলে টুপির উপর ধুলোর আস্তরণ পড়ে যেত ও তা ঝেড়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হত। সিন্সেতে বাস করতে না পেরে সবাই মিলে আরাকাতাকায় প্রত্যাগমনের হতাশাকে গার্সিয়া মার্কেসের মা এভাবেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। 

৯। লিকিলিকে: ভেনেসুয়েলার জাতীয় পোশাক। এটি এক ধরনের সুতির শার্ট। সাধারণত সাদা, বেজ ও ধূসর রঙের হয়, তবে এখন অন্যান্য রঙের লিকিলিকেও পাওয়া যায়।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২