একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি – জিললুর রহমান ( পর্ব ৫, অন্তিম পর্ব )
সব কটি পর্ব পড়তে উপরের একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি ট্যাগে ক্লিক করুন।
প্রত্যাবর্তন পর্ব
১১০.
কারখানা শ্রমিক পাভেল রাশিয়ায়
ওদিকে চে গেভারা ফিদেল কিউবায়
লেনিন গোর্কি বা মায়াকোভস্কির
কোথাও দেখা নেই স্বর্গ নরকের
কোথায় রাখা যাবে বুঝে না দেবদূত
তাই তো কবরেই পড়ছে মেঘদূত
লোকের বুকে বুকে বিপ্লবীর ঠাঁই
১১১.
ভোরের আলো খুব হালকা ফুটেছিল
পাখায় বোররাক অনেক গতি দিল
গতি কি আত্মার আলোর বেশি হবে
কে জানে আশমানি ব্যাপার কেবা ক’বে
হঠাৎ পৌঁছাই নিজের বিছানায়
দেখেছি হাতে ধরে আগের ওম পাই
তখন আসে ঘুম আজানও দিয়ে দিল
১১২.
এমন কত কাল পেরিয়ে চলে যায়
এমন কত ক্ষণ কোথাও স্থির রয়
সাতটি আশমান দেখেছি ঘুরে ঘুরে
মনটা হয়েছিল কখনও ফুরফুরে
কখনও বিষণ্ন করেছি বমি বোধ
নরক দর্শনে কখনও নির্বোধ
নরকে সময়ের হিসেব মেলা দায়।
১১৩.
এ ছিল ঘোরতর অধিক স্বপ্নের
কোরানে বলা আছে কথা তো নফসের
আত্মা দেহটার পৃথক কিছু হলে
হাসর ময়দানে ছিন্ন দেহ তবে
কবর থেকে তুলে আবার হবে দেহ
বিচারে তারপরে স্বর্গে যাবে কেহ
কিংবা হবে কীট তপ্ত নরকের
১১৪.
তবে কি আত্মা গ্রিসের কল্পনা
কিংবা ভারতের শংকর-ধারণা
তবে কি জীবনের ব্যাপার নফসের
যে কিনা কলুষিত হতেও পারে ঢের
জীবন জুড়ে শুধু স্বপ্ন খেলা করে
স্মৃতিও স্বপ্নের আদলে ঘুরে ফেরে
কলব নফসের অবোধ্য দ্যোতনা
১১৫.
এটুকু বুঝে পাই পৃথিবী সুন্দর
প্রেমই মূলকথা এটুকু অনুভব
স্বপ্ন পূরণের মূলতত্ত্বটাও
জীবনে প্রেম আর জীবেতে প্রেম দাও
প্রেমেই জ্বলে বুক ধরা দেয় মাশুক
প্রেমেই আশেকের আগুন উৎসুক
আত্মা নফস ও প্রেম তো একাকার
১১৬.
যখন ভাঙে ঘুম যখন টের পাই
সত্যি না কি সব স্বপ্নে তড়পাই
বধূটি শুয়ে ছিল শিশুরা ঘুমে কাদা
আস্তে বলি ডেকে মেরাজ কথকতা
বধুয়া শুনে বলে ঘটনা ছিল ঠিকই
নামটা তাই তার হয়েছে সিদ্দিকী
ক্লান্তি বোধ হয়, আবার শুয়ে যাই।
১১৭.
যখন ঘুমঘোর ভাঙলে দেখি ভোর
পৃথিবী স্বর্গের চেয়েও সুন্দর
যখন হিমালয় সূর্য রঙে লাল
আস্ত কমলাটা উঠল মেরে ফাল
আকাশে মেঘে মেঘে রঙের বন্যায়
মনটা ডুবে গেল বুকের কন্যায়
মায়ার পৃথিবীতে থাকুক মায়া ঘোর
প্রত্যাগমনের ভোরে
১১৮.
স্বর্গ নরকের শুলুক সন্ধানে
নেই তো প্রয়োজন ঘোরার আশমানে
মানুষে ভেদাভেদ যেদিন উঠে যাবে
সেদিনে পৃথিবীতে স্বর্গ বিরচিবে
ভরো না ধরণীটা কেবল ছলনায়
শ্রমের হাতগুলো উঁচুতে ধরা চাই
স্বর্গ আমাদের ঘুরছে হাতে হাতে
১১৯.
এই যে পৃথিবীর আলো হাওয়া জল
এখানে নদী বহে ভীষণ কলকল
এমন কোথাও কি মিলবে আসমানে
এমন ভরে মন পক্ষীদের গানে
এখানে পাহাড়ের গা বেয়ে নামে ঝিরি
কোথাও পাঙখোয়া টানছে বসে বিড়ি
পৃথিবী ছাড়া সুখ নেই রে ও—পাগল!
শেষের পরে
১২০.
যখন ভাসমান বুকটা বন্যায়
মনটা পুড়ে খাক অজানা কান্নায়
কেবল জাগে প্রেম মানব সত্তায়
জাগল বুঝি প্রাণ রুগ্ন আত্মায়
খাবার দুটো মুখে সকলে যেন পায়
দাঁড়াবে রুখে দৃঢ় প্রতিটি অন্যায়
মিছিলে খুঁজে ফিরি সকল কন্যায়
১২১.
কে চায় বনলতা? কেউ সুরঞ্জনা!
কেউ তো মরীচিকা খুঁজেই ফানাফানা।
যেদিন ট্রাম তলে জীবন কাটা পড়ে,
ছুটেছে আনন্দ পৃথক লাশঘরে।
জন্ম লয় বোধ তুচ্ছ সব কাজ
শূন্য পড়ে রয় প্রাণের আহ্লাদ
হয়তো আজও কেউ খুঁজছে সুচেতনা…
১২২.
শুনেছি লজ্জায় নারীরা লাল হয়
পুরুষ লাজে নত হলেই বিস্ময়
যদিও জেন্ডার এখন তালে গোলে
তবুও প্রবাদেরা মাতেই কলরোলে
আমিই অনিত্য, নিত্য কিছু নেই
বন্ধু খুঁজে ফিরি ধূসর জগতেই
মায়ার পৃথিবীতে জড়াই মায়াতেই
১২৩.
কতটা ধানে ভাই কতটা চাল হয়!
স্বর্গে যারা থাকে তাদের জানা রয়?
কতটা ঢেঁকি আছে স্বর্গে ভানে ধান
তক্তা গড়ে নিতে কতটা লাগে ধান
ভানতে ধানগুলো কে গায় শিবগীত
যে যুগ চলে আজ বুঝি না হিতাহিত
আমাকে দাও ধান আমাকে দাও প্রাণ।
১২৪.
কাগজে লেখা প্রেম পোকায় খেয়ে যায়
আমরা মেতে তবু নানান ধান্দায়
ভোরের সূর্যকে দেখেছি মনোরম
দুপুরে সে-ই দেখো সেজেছে যেন যম
আহারে বাঁশি বাজে রাধাও ছুটে যায়
কৃষ্ণ নিধুবনে মেতেছে কী লীলায়
বিলাবে সেই প্রেম কোথায় সে নিমাই
১২৫.
সন্ধ্যা নেমে এলে কে আছে পাশে দেখো
প্রখর দেখলেই বন্ধু ভেবো নাকো
প্রেম কি করা যায় করব বলে বলে
প্রেম তো আসে হায় বানের ঢলে ঢলে
মর্ত্যে জীবনের নিত্য গতিধারা
নদীর কলতান ছোটে পাগলপারা
সন্ধ্যা হলে প্রেম ধরতে তারে শেখো
১২৬.
তখনও মরেছিল এখনও মরে যায়
লক্ষ বছরের মানব যাত্রায়
নিজের কর্মটা গুছিয়ে সেরে রাখি
কখন কেবা জানে নিয়েই যাবে ডাকি
এভাবে মানুষের সৃষ্টির মর্মে
জীবন জেগে থাকে পরের প্রজন্মে
ব্যক্তি মরে বটে মানুষ মরে নাই…
সমাপ্ত
শেষ পর্বটি পড়া হ’ল। রাশিয়ার কারখানা শ্রমিক পাভেল, চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, লেনিন, গোর্কি, মায়াকোভস্কি কাউকেই এই সাত আসমানের স্বর্গ ও নরক, কোথাও খুঁজে পেলেন না কবি। বেশ উপভোগ করলাম এটা ! সাত আসমান ভ্রমণ শেষে পৃথিবীতেই স্বর্গ খুঁজে পাবার কথা বলেছেন যা খুবই মানবিক ও হৃদয়গ্রাহী :
“এই যে পৃথিবীর আলো হাওয়া জল
এখানে নদী বহে ভীষণ কলকল
এমন কোথাও কি মিলবে আসমানে
এমন ভরে মন পক্ষীদের গানে”
কবি জিললুরকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা এমন সুন্দর একটি সিরিজ কবিতা উপহার দেয়ার জন্য ! কবিতাটি সুন্দরভাবে প্রকাশ করার জন্য ‘আপনপাঠ’-কেও অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
সাত আসমান তো টলেমির মডেল যা এরিস্টটলের সম্মতি পেয়ে গ্রিস থেকে ব্যাবিলন এসিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে আমাদের সংস্কারে ঢুকে গেছে। আমাদের বাঙালি কবিকেই স্মরণ করা দরকার——
“মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর”
পুরো যাত্রাটায় আমার সাথে থাকার জন্যে ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু কবি তুষার গায়েন
Tushar has quoted the area of this part , to me, unerringly. From 117 onwards it was getting incandescent, and in 119, from where he quotes, it is ‘a joy for ever’. Love you, Zillur.
পড়ে ভালো লেগেছে। ।
Painting টা কার করা একটু জানাবেন ? খুব সুন্দর ।
পেন্টিংটা বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের। ছবিটির নাম ‘স্টারি নাইট’।
‘পৃথিবী স্বর্গের চেয়েও সুন্দর’, পুরো কবিতা জুড়ে এই আবহটাই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পৃথিবী থেকে স্ব্বর্গ, স্বর্গ থেকে আবার পৃথিবী, কবিতায় এই যে পরিভ্রমণ যেখানে ‘পৃথিবী’ই জাগ্রত হয়েছে বেশি। হিমালয়ের আলো, পাহাড়ের ঝর্ণা, এসব দৃশ্য আমাকে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। বেশ লাগলো পড়তে। অসাধারণ!