একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ৫ )

শেয়ার করুন

আগের পর্ব
একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ১ )
একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ২ )
একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ৩)
একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ৪)

পাঁচ

মাঝে শেল অনেক কমে গেছিল। মানুষজন যেখানে পেত পিটিয়ে মেরে দিত। তাদের অত্যাচারে চাষিরাও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। গ্রামদেশ থেকে শেল হতেছিল লুপ্তপ্রায়। ডাকই শোনা যেত না আর। মাঠে-ঘাটের মানুষ আমরা— শেল, ভাম, কটাস, বেজি আর সাপ নিয়ে আমাদের কারবার। ওরাই আমাদের স্বজন–বন্ধু–আত্মীয়। সঙ্গে আছে জলপড়া-তেলপড়া-নুনপড়া-হাতচালা। এগুলি তোমার কাছে বুজরুকি বা প্রাচীনপ্রথা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এগুলি আমাদের জীবনাচরণের অঙ্গ। হ্যাঁ, তোমার মতোই আমি এগুলিকে তাই ভাবতাম। ঈশ্বরে ও ভূতে অবিশ্বাস—বিশ্বাস কেবল মানুষের প্রতি আর মেহনতের প্রতি। কিন্তু যখন বয়স হল, এইগুলিকে জীবনকেন্দ্রে যখন উপলব্ধি করতে শুরু করলাম, মনে হল, আমি অস্বীকার করলে কী হবে, এরা আছে। আর এদের নিয়েই বেঁচে আছে দেশে-গাঁয়ের হাজার হাজার মানুষ। তাই হয়তো কেবল মানুষ নিয়ে দেশ হয় না, এইসব নিয়েই একটা আস্ত দেশ গড়ে ওঠে। হয়তো তাই, মাননীয় বিধায়ক তারামা-র চরণে প্রণাম জানান, মন্দিরে পুজো দেন। বড়ো পুজোর কমিটিতে কমরেডরা থাকেন। হয়তো সেটা জনসংযোগের একটা মাধ্যম। এদেশে ধর্মের মাধ্যমেই যে বৃহৎ জনসংযোগ করা যায়—সেটা নিশ্চয় এখন আর অস্বীকার করা যায় না। ধর্মের আবেদন মানুষের কাছে আগে। যে দেশ ধর্ম আর জাতপাতের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, সেখানে এসব অস্বীকার করা মানে বকের ময়ূরপুচ্ছ লাগানো। আর ছিল ভূতের উৎপাত। আমি যদিও সেইসব ভূতের গল্পে বিশ্বেস যেতুম না কোনোদিন, কিন্তু অন্যরা যেত। কে কবে ভুত দেখেছে, কীভাবে ভূতের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসেছে—এইসব কাহিনি তাদের কাছে অনেক শুনেছি। তবে এখনকার চাষিদের, যারা নতুন-নতুন নেমেছে চাষে— এই জিনিসটার প্রতি ভয়ডর কম। অনেকে মাঝরাতে একাই চলে যায় মাঠে।

মাঝরাতে কেন?

শেলের হাত থেকে জলের ফসল বাঁচাতে।

মানে?

আরে, মাছ! অনেকে পুকুরে মাছ চাষ করে। গরমের চোটে জল কমে গেলে— শেলেরা দলবেঁধে পুকুরে নামে— জল গুলায়— মাছ ভাসে— খপ করে ধরে খায়। বলে, নিজের পায়ের চেটোয় আবার হাত বুলিয়ে নিল ভুলাই। বলল, এইসব নিয়ে আমাদের জীবন কেটে যায় বেশ, জানো। এখানে বিপ্লব আসে না। গ্রামের সাধারণ মানুষ, গরিব-গুর্বো, ভাগচাষি, খেটে-খাওয়া মানুষ এইসব নিয়েই বেঁচে আছে। খুব সামান্যতেই আমাদের চলে যায়। মোটা চালের ভাত, মানকচু সেদ্ধ বা এঁটে সেদ্ধ, আমড়ার টক, সঙ্গে খালে-বিলে খাপলা জাল ঘুরিয়ে ধরা।

চৌদ্দবনের কথা তোমার আর মনে থাকার কথা নয়। এসেছ যখন আর থাকবেও কদিন— তাহলে ঘুরে আসত পারো একবার। পুরানো বান্ধবান্ধব তো আছে নাকি?

তা আছে। কিঙ্কির এক কাকা আমাদের সঙ্গে পড়ত।

কোন্ কাকা? বলে এতক্ষণ পর কিঙ্কি তাকাল। শুভাশিস বলল, কারু।

ও! তুমি ছোটোকাকার সঙ্গে পড়তে? ছোটোকাকা বেশিদূর লেখাপড়া করেনি।

যতদূর করেছে, আমি ততদূর ছিলাম ওর সঙ্গে। একই ক্লাসে।

আচ্ছা! বলব গিয়ে তোমার কথা।

কারুদের অংশে আর থাকে না। সে মাঠের দিকের জমিটি ভাগ নিয়েছে, সেখানে দু-কামরা ঘর করে উঠে গেছে। এখনও ঢালাই দিয়ে পারেনি— তবে টালি চাপিয়েছে, টিন নয়। ও এখন জমিচাষ করে।

একটু অবাক হল শুভাশিস। তারা যখন শহরে চলে যায় কারুও তখন বম্বে চলে গেছিল জুয়েলারি কাজে। কলেজে পড়তে পড়তেই সে শুনেছে, ওখানে কারু প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। সেই হিসেবে কারুর টালির চালে বাস করার কথা নয়। রীতিমতো দোতলা হাঁকাতে পারে সে। কারু ফিরল কবে আর তাকে চাষই বা করতে হচ্ছে কেন?

প্রশ্নটা মনে এলেও সে করতে পারল না কারণ এখানে সেটা করা যায় না। কারুর সঙ্গে দেখা করতে হবে একবার।

ভুলাই তখন বলে চলেছে, তবে ওদিকে তোমাদের জমি ছিল— বললাম একবার— বারো কাঠার মতো। পরে তোমরা ওটা বিক্রি করে দাও সাহাদের। তুমি হয়তো তা জানো না, তবে তোমার বাবা-কাকারা জানে।

আচ্ছা।

তুমি জানো এখন তোমাদের জমির পরিমাণ কতটা?

না।

জমিতে গেছ কোনোদিন?

না।

জমিগুলি চেনো? বলে তাকিয়েই থাকল ভুলাই।

তাও না। বলে, এবার হেসে ফেলল শুভাশিস। বলল, তখন দাদু দেখভাল করত। পরে এক কাকা। ততদিনে আমি বাইরে চলে গেছি। আর গ্রামে ছোটোবেলা কাটলেও জীবনে কোনোদিন মাঠে যাইনি। বীজতলা কীভাবে বানায়, শিখিনি কখনও। বীজধান রোপণ করিনি, ধান এঁটুইনি। পাট কাটিনি। জানবো কীভাবে?

হ্যাঁ, কেবল বই মুখে দিয়েই কাটিয়ে দিয়েছ। পড়েছ অনেক তত্ত্বকথা। কিন্তু সেটা কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়, শেখোনি। নিজেদের যে তিরিশ বিঘা জমি এখনও আছে, সেটাও তোমার তাই অজানা। তোমরা এখন বাইরের লোক। শহরের লোক। উদ্বাস্তু। জমির খবর রাখো না। আর রেখেই বা কী হবে। তোমরা ওখানেই থেকে গেলে, ফেরার প্রশ্ন নেই। হবে এই, তোমার সন্তান বাপ-পিতিমের ভিটে চিনবে না, জমি জানবে না, গ্রামের স্পর্শ পাবে না—তাহলে তুমি কমিউনিস্ট নও।

এই কথাগুলো কড়া লাগলেও কিছু বলল না শুভাশিস। কেবল একটি কথাই সে বলল, হ্যাঁ, আমি তা নই।

তুমি তাহলে কী? বলে তার দিকে সোজা দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইল ভুলাই পাল। এমন চোখের সামনে গা ইশবিশ করে। শুভাশিস চুপ করে রইল।

তুমি কি দক্ষিণপন্থী?

না।

তবে কি তুমি ‘ওঁনার’ দল করো?

তাও না জেঠু।

তাহলে তুমি কী?

শুভাশিস আবারও চুপ করে রইল।

ভুলাই পাল বলতে লাগল, দেখো শুভ, রাজনীতিময় আমাদের এই দেশ। এখানে রাজনীতি-নিরপেক্ষ বলে কিছু হয় না। যেমন হয় না, ধর্মনিরপেক্ষ বলে কিছু। একথা কেন বলছি জানো? আমরা বলি, কমিউনিস্টদের ধর্ম নেই। আমরা মন্দিরে যাই না, মসজিদে যাই না— ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কথাটা কি ঠিক? ঠিক নয়। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো ধর্ম মানে; কোনো না কোনো ধর্মের পক্ষে সে বলে— সে যতই নিজেকে ধর্ম-নিরপেক্ষ বলে দাবি করুক না কেন। তেমনি কমিউনিস্টদেরও ধর্ম আছে। আর সেটা হল কমিউনিজম। হ্যাঁ, আধুনিক ধর্ম এটাই। এযুগে আর নতুন করে ‘ধর্ম’র উদ্ভব আর হবে না। ইতিহাস সেই সময়কে পেরিয়ে এসেছে। জন্মগত ধর্মকে মানুষ সঙ্গে রেখেছে বটে, কিন্তু সে পালন করে সেই ‘ধর্ম’, যা মানুষ শিখেছে তার ভালোলাগা রাজনৈতিক দল থেকে। আর তাই, আমি মনে করি, মানুষের বর্তমান ধর্ম এখন তার রাজনৈতিক চেতনা, রাজনৈতিক বিশ্বাস। এর জন্য জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মকে সে অস্বীকার করতেও রাজি। কমিউনিজম কেবল বিজ্ঞান নয়, তা মেনে যে ব্যক্তি জীবন পরিচলনা করে— সে-ই সে ধর্ম মেনে চলে। আমি ধর্মে হিন্দু নই, আমার ধর্ম হল কমিউনিজম। আমার ঘরে তুমি শ্রীকৃষ্ণের ক্যালেন্ডার দেখছ বটে, তবে সেটা শুধুই ক্যালেন্ডার। সেইজন্য তোমার কাকার মনে হয়েছে আমি একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট।

এই মহলা পেরিয়ে যে উঠোন, তার ওদিকে ভুলাই পালের ঘর। সেখানে, প্রাচীরের দেওয়াল ঘেঁষে একটি গাছের কাটা কাণ্ড। এদিক-ওদিক থেকে কিছু ফ্যাঁকড়া বেরিয়েছে। সেই পাতাগুলিকে দেখে ঠাওর করা যায়, সেটি ছিল একটা আমগাছ।

আর এই চালা? সে জানে, এই চালাই ছিল একদা অলিখিত বাম পার্টিঅফিস। এই এলাকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, বর্গার খতিয়ান এখানেই নেওয়া হয়েছে। তারপর সেখানে সিলমোহর পড়েছে জেলা নেতৃত্বর। সে চাষিদের উন্নয়নের জন্যই হোক বা খাস জমি বর্গা করা।

এবার মুখ খোলে শুভাশিস। বলে, আমি হলাম তারাই—যাদের জন্য ক্ষমতার চাকা ঘোরে। এক সরকার গিয়ে অন্য সরকার আসে।

তারপর একটু থেমে আবার শুরু করল ভুলাই পাল। বলল, এবার তোমাকে আমাদের ওই ডোবার কথা বলি।

ওখানে ছোটো-বড়ো নানা ডোবা আছে। সেসব ডোবার মালিক যেমন আমাদের গ্রামের লোক, তেমনি পাশের গ্রামের লোকও আছে। যেমন গণেশচক, বড়চৌহরা গ্রামের লোকজনদের। আমাদেরও আছে, ওর বাবাই সে-সব দেখভাল করে। আর ওসব ডোবার যা অবস্থা, মাছ চাষ করার প্রশ্নই নেই। গরমের দিনে জল নেমে যায়, বর্ষায় জল ঢোকে। তখন অন্য পুকুর থেকে, মাঠবাহিত কিছু কিছু মাছ ঢোকে, বড়ো হয়। কৃষকেরা এইসব খরব রাখে, যেমন একসময় আমি রাখতুম। ওরাই ছোটো জালটাল ফেলে মাছ তুলে নেয়। তবে এইসব ডোবায় একটি জিনিস খুব ভালো মেলে। তা হল কচ্ছপ। কচ্ছপ ধরা বা মারা নিষিদ্ধ জানি, কিন্তু গ্রামের দিকে ও-সব কে আর মানে বলো। লোকে খেতেই পায় না, যা হাতে পায় তাই ধরে নেয়— আগে তো পেট, নাকি? আর অনেকে জানেই না, এইসব জীবকে মারা বা খাওয়া নিষিদ্ধ।

শুভাশিস চুপ করে রইল। এর কাছে সে নিজের ভাষণ শোনাতে আসেনি, শুনতে এসেছে। এই এলাকায় এক সময়ে প্রবল দাপট ছিল লোকটার। কিন্তু সময় মানুষকে শুইয়ে দেয়। এর দল যেমন সারা দেশে শুয়ে পড়েছে, বড়ো নেতারা শীতঘুমে গিয়েছে; তেমনি সেই দাপুটে লোকই কত অসহায় সময়ের কাছে! একসময় যার কাছে লোকে দাঁড়াতে পারত না, আজ সে কত অসহায়!

কিঙ্কি তখন সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তোমার মেয়েটা নয়, গেঁড়ি-চচ্চড়ি বানিয়েছে এই মেয়েটা, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল নিজের মেয়ের নামে প্রশংসা করলে হবে? নাতনিটার কথাও তো ভাবতে হবে নাকি? সেও যে কিছুকিছু কাজটাজ, রান্নাবান্না পারে— সেটা দেখতে হবে তো!

শুনে ভুলাই পাল খুব খুশি হয়ে নাতনিকে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, ও এবার শহরবাসী হবে, জানো শুভ। এবারে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। আমাদের এদিকেও একটা কলেজ হয়েছে, আমাদের যখন রমরমা ছিল— তখনই হয়েছে। তবে এই কলেজে পড়ার ইচ্ছে নেই ওর। ও শহরের কলেজে পড়তে যেতে চায়। যদি তুমি একটু সাহায্য করো, বেশ হয়। বুঝতেই পারছ, শহরে আমাদের চেনাজানা বা জানাশোনা নেই। কলকাতায় আগে মিটিং করতে যেতুম— সে-ও বছর কুড়ি আগে শেষ গেছি, আর যাইনি। ব্রিগেড বাঁধা ছিল। এই এলাকার মানুষদের সংগঠিত করে নিয়ে যাবার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। তাই করে গেছি। লোকজনকে কেবল নিয়ে গেলেই হল না, কলকাতা যাওয়া অব্যেস নেই, কে কোথায় ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় ছিটকে যায়— তাদের একত্রে জড়ো করে আনতে হবে। সে এক মহা ঝক্কির ব্যাপার! হাজার হাজার বাস, লক্ষ লোকের জনসমাগম— এখনকার মতো হাতে-হাতে ফোন নেই— সে যে কী সমস্যার কথা, কীভাবে বলব। যদি একজন কেউ বাসে না ওঠে— মেলার মাঠে রয়ে যায়— মেলাই বটে— মানুষের মেলা, মত বিনিময়ের মেলা— আদর্শের মেলা ছিল। তবে একটা আনন্দ ছিল, জানো। একটা সুখ হত। বাসে সিট হত না, পাদানিতে দাঁড়িয়ে বা বসে ফিরতুম। লেকচার শুনব কী, ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক রাখতেই দিন কেটে যেত। তাদের খাবারের খোঁজখবর রাখতে হত। এটা না করলে পরেরবার তারা আর মিটিংয়ে আসবে কেন? তাদের কাছে কলকাতার নানা গল্প শুনে বাকিরাই বা পরেরবার আসতে আগ্রহী হবে কেন? হ্যাঁ, তাই বলে আমাদের ওখানে ডিম্ভাতের ব্যবস্থা ছিল না।

বলে ভুলাই মুচকি হাসল। এবার কিঙ্কি নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল, যাই, চা-টা করে আনি।

কিঙ্কি চলে যেতে ভুলাই পাল বলে, নিজের নাতনি বলে বলছি না, ও কিন্তু এখনকার মেয়েদের মতো নয়। ও এইসব গল্প খুব শুনতে চায়। তুমি ডায়ারি লেখার কথা বলছিলে না? ওকে বলব ’খন, ও যদি লেখে, বেশ হবে। ও এক অদ্ভুত মেয়ে। ও চাষের সব কাজ জানে। তবে অন্য মেয়েদের থেকে ওর বড়ো পার্থক্য হল, ও এই বয়সেও মাঠে গিয়ে কাজ করে, ওর কোনো গুমোর নেই। ও পড়াশুনোয় ভালো, দেখতেও সুন্দরী— তাই নিয়ে ওর মনে কোনো অহংকার নেই। আমার কী মনে হয় জানো, ও কিছু খোঁজে। সেটা আমার ভেতর হতে পারে, রাজনীতির ভেতর হতে পারে, আবার এই মাঠ-ঘাট-প্রকৃতির মধ্যেও সেই খোঁজ জারি থাকা সম্ভব। তবে শহরের কলেজে পড়তে গিয়ে ফিরে এসে আর করবে কিনা, সময়ই সে-কথা বলবে। নিখাদ কৃষক পরিবারের মেয়েও এখন চাষের কাজ করতে চায় না। ধান ঝাড়ার কথা আমি বাদ-ই দিচ্ছি; কৃষকের বাড়ি আরও অনেক কাজ থাকে। বাড়ির উঠোনে ফসল ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজটা সাধারণত বাড়ির মেয়ে-বউরাই করে, সেই ফসল কেটে আনার দায়িত্ব বাড়ির পুরুষদের। সেটা যে খুব সহজ কাজ, এমনি ভেবে বোসো না। খুব পরিশ্রমের কাজ ও দীর্ঘ সময় লাগে। কিন্তু এখনকার কৃষক পরিবারের অনেক মেয়েই আর এই কাজ করতে চায় না। তারা ইস্কুল যায়, পড়াশুনো করে— কাদামাঠে কাজ করা, ফসলের ধুলোয়, তুষের সামনে পড়তে চায় না। পড়াশুনোর বাইরে সবসময় হাতে মোবাইল নামক যন্ত্রটি নিয়ে বসে থাকে। ফলে অনেক চাষি করে কী, মাঠ থেকেই ফসল বেচে দেয়। ঝামেলা রইল না, সঙ্গে-সঙ্গে নগদ টাকাও হাতে এসে গেল। ধান, আলু, পাট, কচু, বিড়ি-কড়াইডাল— এখন চলে এভাবেই।


শুভাশিস বলল, শুনি যে তুমি আর পার্টি করো না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভুলাই পাল বলে, ঠিকই শুনেছ। করি না। শরীর দেয় না। আবার বলতে পারো, মনও সাথ দেয় না। মানুষের জন্য যে কাজ আমরা সেই ছয়-সাতের দশকে শুরু করেছিলাম, সেইদিন আর নেই। মানুষ বদলে গেছে। নেতারাও পালটেছে। আমার খুব ভয় হয়, বামপন্থা আর খেটে খাওয়া মানুষদের দল কিনা! তুমি ঠিকই বলেছিলে, বামমনস্ক বা পার্টি করলে সকলেই কমিউনিস্ট হয় না, কেউ কেউ কমিউনিস্ট হয়। আমি জানি, এ-কথা প্রকাশ্যে বললে, দল হয়তো আমাকে বহিষ্কার করবে, কিন্তু আমার মনের কথাই বললাম। আমাদের দল ভেতরে ভেতরে হয়তো ‘কংগ্রেস’ হয়ে যাচ্ছে। লেনিন বিপ্লব করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণিকে সামনে রেখে। কিন্তু এখন, অনন্ত এই দেশে আমরা সেইসব মেহনতি মানুষদের কাছ থেকে সরে এসেছি, এটা পরিষ্কার— ভোটের ফল সেই কথা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় বটে, কিন্তু আমরা হয়তো তা মনে রাখতে চাই না। শ্রমিকের পক্ষ নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আমরা নানা আন্দোলন করে গেছি, কিন্তু কখনও ভাবিনি উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায়। আমরা ভেবেছি, আটঘন্টা কাজ করে যে লভ্যাংশ মালিকের হাতে তুলে দিচ্ছেন একজন শ্রমিক, তিনি তার থেকে মিনিমাম একটা ভাগ পাচ্ছেন মাহিনা হিসেবে। আমরা ভেবেছি, সেই ভাগ কেবল আরও বেশি হবে না। আমরা সেভাবে ভাবিনি, কী করলে তাঁর সেই কাজ বজায় থাকবে, যাতে তিনি তাঁর পরিবার চালাতে পারেন। শ্রমিকের কিছুই ছিল না তখন, আজও আছে কি? কতটা আছে? কাজের ক্ষেত্রে, চাকরি যাবে না— এই নিশ্চয়তা কি আমরা তাঁদের দিতে পেরেছি? আমি এইসব ভাবি। আর ভাবি বলেই আমি একলা হয়ে যাই। মুখে বলি, আমরা নিরপেক্ষ নই, আমরা মেহনতি মানুষদের পক্ষে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আর সেটা কি আছে?

যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে হয়তো এটা প্রয়োজন। লেনিন ও হো চি মিন— এঁরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মার্কসবাদ এনেছিলেন। তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা হচ্ছিল তো…

সেই অনুযায়ী নেতার খুব অভাব বুঝলে। তাল মেলাতে গেলে তালজ্ঞানটাও থাকতে হবে। কেবল সাধ থাকলে হবে না, সাধ্যটাও থাকা প্রয়োজন। সেটাই তো কারও মধ্যে দেখলাম না! বিশ্বাস মারা যেতেই কত সহজে আমরা ধ্বসে গেলাম! এটা কিন্তু হবার ছিল না।

তার মানে তুমি হারটা মানছ না?

মানছি। কিন্তু হারের কারণগুলি মানতে পারি না। যখন পিছনের দিকে তাকাই, মনে হয়— সব নিয়ে কি আমরা খারাপ ছিলাম? নিজেদের উন্নততর করতে গিয়ে আমরা কি নিজেদের পতন তরান্বিত করলাম? আমাদের দেহের আগাপাশতলা কি ঔদ্ধত্য ছিল না? আমরা সকলেই কি সোচ্চারে বা মনে মনে বলিনি, ওরা মাত্র তিরিশ! আর আমরা? হা-হা-হা।

তার হাসি থামলে শুভাশিস বলে, তোমার শরীরের কথা বলছিলে যে? কী অসুবিধে?

হার্ট তো ছিলই, সঙ্গে যোগ হয়েছে চোখ আর কান। কিছুই যেন ঠিকঠাক আর কাজ করছে না। এই দেখো না, চোখে চশমা উঠেছে আমার অনেকদিন, সেদিন কাঁচও পালটালুম; তবু দৃষ্টি যেন স্বচ্ছ হয় না, আগের মতন। কানের ভেতরও মাঝে-মাঝে নতুন নতুম সব শব্দ শুনি, ঝিঁঝিঁ ডাক শুনি। মনে হয়, ওগুলি আসলে কানে ভুল শোনা নয়। কঙ্গোর বিদ্রোহীরা পশ্চিমের পুতুল শাসক মোবুটুর পরিচালনায় শ্বেতসেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। আর সেই বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে সেখানে হাজির চে গেভারা! মনে হল, কানে সেই অভিযানের সুর বাজে।

বলে হাঁপাতে লাগল ভুলাই। আর শুভাশিসের মনে হতে লাগল, একটা মিশনে সে আজ এখানে। কিন্তু এখন যা শুনছে ভুলাই পালের মুখ থেকে, মনে হচ্ছে একটা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে বা একটা বিশাল গরিমা ভরা অতীতের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে। যে অতীত নিরন্তর কথা বলে অতীত হয়ে যাওয়া পার্টি-দরদি সেইসব মানুষদের সঙ্গে।

ভুলাই জল খায়। তার সামনে যে কুলুঙ্গি, সেখানে একটি গ্লাস রাখা। তার ঢাকনা সরিয়ে ভুলাই পাল জল খায়। ঠোঁটে লেগে থাকা জল হাতের আগায় মুছে নিয়ে বলে, আমি তাই আর পার্টিতে যাই না। পার্টি-অপিসে গিয়ে বসি না। এখন নতুনরা আছে। তারাই সামলাচ্ছে। তারা সব প্যান্ট-পরা বাবু। জামা গুঁজে, ঘাড়ে গলায় পাউডার মেখে পার্টি করতে আসে। হয়তো এটাই এখন যুগ। তবে কী জানো ভায়া, আমার মনে হয়, সেই যে ধুতি-পরা প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টার, সাধারণ মলিন পোশাক, পান্তাভাত খাওয়া আমাদের কমরেডগণ— যদি ফিরে আসে, আমরা আবার ক্ষমতায় আসতে পারি। তবে তা অতীত।

আর দক্ষিণপন্থী দল? তারা?

বড় ফুলের কথা বলছ? ওদের সংগঠন জোতদার আছে। ওরা একটা রুট ভেবে এগোয় আর সেটা অনেক আগে থেকেই ঠিক করা আছে। সঙ্গে ধর্মের সুড়সুড়ি আছে। অবশ্যি ধর্মের সুড়সুড়িতে এখন আর কেউ কম যায় না— এটা আমাদের দেশের রাজনীতিতে একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্যি আমাদের দেশ ও সমাজ গড়ে উঠেছে জাত ও ধর্ম নিয়ে— এর কোনো মার নেই। তাই যে দল যেমন করে পারে তার ফায়দা নিচ্ছে। আমাদের নেতারাও শেষদিকে পুজো কমিটিতে জড়িয়েছে, মা তারার কাছে পুজো দিয়ে এসেছেন। এই নিয়ে বিতর্কের কথা সবাই জানে। হয়তো উপরতলা বুঝতে পেরেছিল, এদেশে ধর্মবান হওয়াটাই রাজনীতিতে টিকে থাকতে গেলে খুব দরকার। আবার হয়তো, এটাও আমাদের পতনের অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ। আমি এখানে, এই একাকী ঘরে বসে-বসে এইসব ভাবি। আর ভাবি, ওই চলেছে মহামতী লেনিনের জাহাজ। পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন অত্যাচারী জার। লেনিন চলেছেন যুদ্ধে! আহা!

ভুলাই থামে। দম নেয়। মুখটা পাশে রাখা গামছায় মুছে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ওরা রাজনীতিটা বোঝে। হাওয়ায় ভাসে না। এবং সাফল্যে তারা মাথা ঘুরিয়ে ফেলে না। ওরা মাটিতেই পা রেখে চলে। যেমন আমাদের ছিল, আশির দশকের শেষ অবদি। নব্বইয়ের পর আমাদের দলের ক্ষয় শুরু হয়। তবে সেটা ধরা যায়নি বা ধরতে দেওয়া হয়নি। তখন ক্ষমতা হাতে ছিল, দিল্লিতে আমাদের সমর্থনে সরকার— কে আর পায় আমাদের! চরম ঔদ্ধত্য চেপে বসল আমাদের। অলসতা গ্রাস করল। আর এই উদ্ধত মনোভাবই আমাদের পায়েরতলা থেকে মাটি সরিয়ে দিল একটু একটু করে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *