একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি – জিললুর‌ রহমান ( পর্ব ২ )

একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি – জিললুর‌ রহমান ( পর্ব ২ )

শেয়ার করুন

আগের পর্ব
একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি – জিললুর‌ রহমান ( পর্ব ১ )


প্রথম আসমানে


১৫.
প্রথম আসমানে থেমেছে বোররাক
দেখছি বুড়ো এক দিচ্ছে জোরে হাঁক

বলল আদিপিতা ‘করিনি কোনো পাপ
ওসব গুল মারা কবির অপলাপ’

বলেছি, তবে ওই স্বর্গ থেকে তাড়া?
‘ওসব কিছু নয়, মনের কড়া নাড়া’

সব তো ঘুঁটে গেল, আপেল খেল কাক!

১৬.
ডেরাটা গমগমে লালন ফকিরের
প্রথম আসমান ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার

প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই ‘ধাঁধায় কাব্যের
মেয়ের গর্ভেতে মাতার জন্মের

তত্ত্ববোধনের উপায় বাতলান’
“জানেন রব্বানা জানেন রহমান

জন্ম চক্রতে নানান কথা ঢের”

১৭.
বলছি, ও লালন, যাবে না ছেঁউড়িয়া?
অমনি সুর করে কাঁদে সে ডুকরিয়া

বলে ‘সে দিন ছিল গান ও গঞ্জিকা
সুরেতে ফানা ফানা ভুলেছি পঞ্জিকা’

‘তিন সে পাগলের তত্ত্ব বলো গুরু
সৃষ্টিতত্ত্বের যেখানে হল শুরু’

লালন হেসে কহে, ‘মনুষ্য ভজে যা’

১৮.
সিরাজ সাঁই ডাকে ‘শোন্ রে, ও লালন,
একটু ধর্ গান, উঠুক ভরে মন’

চক্ষু মুদে গাহে ‘দরজা সাড়ে নয়,
সাঁইজি, ঈশ্বর-মিলন কোথা হয়?’

‘এমন ঘরে থাকে শূন্যের মাঝার
কুঠরি মূলাধার ভাসছে খুঁটি তার’

হামানদিস্তায় বিশাখা দুকে পান…

১৯.
ডাকার মতো যদি ডাকটা পারিতাম
স্বরের আপশোশে নিচ্ছে হরিনাম

প্রথম আসমানে বিষাদ কাঙালে
বলছে ‘দিন গেল এ কোন্ পার দিলে

কত যে সন্ধ্যায় পারের গাই গান
অপার হয়ে আজ পেয়েছি আসমান’

পাগল, সুখ নেই, গাইছে হরিনাথ

২০.
হাছন রাজা দেখি হন্যে হয়ে খোঁজে
পেয়ারি প্রেমে মজে কানে কি তুলা গুঁজে

এ খাঁখাঁ ময়দানে হাছন বসে রয়
কী ‘নেশা লাগিল রে’ চোখেও নেশা হয়

কাপনি নদী তীরে মরণ হয়ে গেছে
মুনিয়া মন কোথা পিঞ্জরায় থাকে?

উড়েছে শুয়া পাখি সে কত যুগ ধরে!


দ্বিতীয় আসমানে


২১.
যখন বোররাকে উড়েছি কোণেকানে
মুসার দেখা মেলে দ্বিতীয় আসমানে

বলল, ‘ভালো হল, লাঠিটা নিয়ে যাও,
তোমার দেশে নেমে মাটিতে ছেড়ে দাও

যেভাবে দুর্নীতি কাছারি দরগায়
যেন এ আজদাহা সকলে গিলে খায়’

আসাটা হাতে আছে আশাটা কোন্‌খানে?!

২২.
কুষ্ঠ রোগী দল যিশুকে ঘিরে ধরে
ব্যথায় কাতরায় আর্তনাদ স্বরে

ঈশ্বর পুত্র স্বর্গে অসহায়
অসুখ ভালো করে নেই তো সে উপায়

মলম হাত-পা’য় লাগায় প্রভু যিশু
রোমান ক্যাথলিকে বকছে মাথাপিছু

বলে সঠিক নয়, চলা তো ধামা ধরে

২৩.
বলো তো ঘটনাটা ক্রুশের, হে যেসাস,
পিত্ত মেশানো সে আঙুর বাটা রস

কেমন তেতো ছিল? চাবুক মেরেছিল?
উড়েছো আসমানে? কেউ তো বলে গেল।

যোহান বলেছিল, মরেও জেগে ওঠা—
জানতে চায় মন, বলো না সত্যিটা?

বলল যিশু কানে, “বলতে আছে মানা”!!!

২৪.
লূতের কওমেরা নবিকে ঘিরে আছে
যতটা অভিশাপ পেয়েছে দুনিয়াতে

এখন তবে আর বিচার কেন হবে?
আপনি বললেই স্বর্গে দিয়ে দেবে।

আমাকে বলে লূত ‘কমেনি সমকাম;
আমার কওমেতে কেন যে বিধি বাম?

পৃথিবী কেঁপে ওঠা নেচারে ঘটে গেছে!’

২৫.
পেশল বাহু নূহ বৈঠা হাতে নিয়ে
বিশাল নৌকাটা আলতো ছুঁয়ে-ছুঁয়ে

জগত জুড়ে এই জীবন স্রোতটার
সেই তো কারিগর বন্যা এড়াবার

এখনও ঝড় হয় ঘূর্ণি জলডোবা
দ্বিতীয় আসমানে বেহুদা বসে থাকা

বিশাল নৌকায় আঙুল চুষে কাটে

২৬.
দ্বিতীয় আসমানে একটি দিকে ভেজা
দেখি কি মিকাইল ঝড়ের মেঘ-রাজা

কোথাও বরিষন, কোথায় ঝড় হবে,
ভীষণ খরা কোথা, কাগজে টুকে রাখে

মুখটা কানে নিয়ে বলেছি ‘শোনো ভাই
বাংলা মুল্লুকে দিও না ঝড় ছাই

কদম ফুটলেই খিচুড়ি হবে ভাজা’

২৭.
কোথাও গৌতম করছে বসে ধ্যান
দেখার কুতূহলে দ্বিতীয় আসমান

নানান দিকে চেয়ে অশত্থের তলে
বুদ্ধ চোখ বুজে কী সব বাণী বলে

সারিপুত্ত নেই, নেই তো সঞ্জয়
সকলে নির্বাণে হয়েছে অক্ষয়

কে শুনে বুদ্ধকে কী বাণী করে দান!

২৮.
একটু কাছে গিয়ে শুধানু বুদ্ধকে
‘সে কোন বোধ এল এভাবে চলে গেলে

বধূটি শুয়েছিল ঘুমের শিশুটিও
সকলি ফেলে গেলে কিসের টানে প্রিয়’

মুচকি হাসিমুখ, বলল ‘জরা ক্ষয়
মৃত্যু জয়লাভ করার সে নেশায়’

সময় হলে সবে একাই চলে যায়!

২৯.
শুধাই বুদ্ধকে নেহাৎ একা পেয়ে
পালিয়ে সংসার কী লাভ নির্বাণে?

বলে, “সে বুঝবে না, প্রাণের গূঢ় কথা
জীবন থেকে ধেয়ে কাটেনি যথাতথা

থেকেছি উপবাস ভেঙেছি সেই ব্রত
এভাবে পালটেছি মনের অভিমতও

কী ধন পেয়েছিনু জানিনে দিন শেষে”


তৃতীয় আসমানে


৩০.
তৃতীয় আসমানে দেখেছি বাল্মীকি
মুকুটে মণি তার জ্বলছে ঝিকিমিকি

বলে অযোধ্যায় রামকে কোথা পাবে
সে ছিল কবি-মনে ছিল না ধরাধামে

তোমরা তাকে নিয়ে অযথা মরো লড়ে
এখন বিভীষণ, সীতাও ঘরে ঘরে

অথচ ভূভারত জ্বলছে ধিকিধিকি

৩১.
কত যে ইতিকথা হাঁসুলি বাঁকে বাঁকে
গণদেবতা ঘোরে আরোগ নিকেতনে

সকলি উবে গেছে, সে আজ কত যুগ
ও তারাশঙ্কর, পঞ্চগ্রাম চুপ

বসন্তরাগের সপ্তপদী সুর
রাইকমল কাঁদে কবির কাঁপে বুক

কবিই থেকে যায়, কবিরা মরে নারে!

৩২.
কবিই জানে শুধু কবিরা জাদুকর
কখন মুগ্ধতা হারায় কবিস্বর

যখন শিল্পের চরম শিথিলতা
ছন্দ ছেড়ে কয় ছন্নছাড়া কথা

থাকে না মাদকতা তখন কবিতায়
স্বপ্নগুলো পথ হারিয়ে ফেলে তাই

হারায় মুগ্ধতা স্বপ্নহীন স্বর

৩৩.
খোঁজেন নীপবনে রবীন্দ্র ঠাকুর
শান্তি নিকেতন কে জানে কতদূর

প্রশ্ন কত করি জীবনদেবতাকে
সময় কেটে গেল অযথা ডেকে ডেকে

মেলেনি উত্তর প্রথম সূর্যের
উপেন বুঝবে কি বেদনা কর্ণের

কে গান গেয়ে চলে? মর্মে গাঁথে সুর!

৩৪.
এতটা অভিমান কেন রে ভাই কবি
গরিমা গৌরব সকল ফেলে যাবি

এই যে সিঁড়ি ধাপ উপরে উঠবার
সুযোগ মিলবে না সময়ে নামবার

হাতার ভাঁজে ভাঁজে কত মনস্তাপ
এসব ভুলে গিয়ে লাগাও ফুলগাছ

এখানে অভিমানে কাঁদে না কোনো কবি!

৩৫.
‘সোনারতরী ধায় কবিকে একা ফেলে’
দাড়িটা চুলকায় নীরবে দুলে দুলে

বলো তো কবিগুরু ‘কী পেলে এত লিখে
রাজ পুরস্কার গলায় পরেছিলে?

নাকি সে অমিটের মতন চটুলতা
নিজেকে জাহিরের নানান গূঢ়কথা’

‘শতবর্ষ গেল’— ঈষৎ শ্লেষে বলে…

৩৬.
আত্মা যত জড়ো তৃতীয় আসমান
এটা কি আত্মার ডাম্পিং স্টেশান

কখন রায় দেবে কোথা সে ভগবান
তার কি ভগ আছে কেউ কি দেখা পান

আত্মা শক্তির আরেক নাম ভাই
তবে কি আত্মার লাগে না জায়গাই

আত্মা কীভাবে নরকে ব্যথা পান!


চতুর্থ আসমানে


৩৭.
চতুর্থ আকাশে চারটে আলো খেলে
লাগেনি বিস্ময় হোমার দেখা দিলে

কী লাভ হল দশ বছর ধরে লিখে
একটি দিনে যেটা জয়েস নিল গিলে

দেখি ওডিসিয়ুস গ্রিসের বন্দরে
ওদিকে উলিসিস শহর ডাবলিনে

অচেনা দুইজন কাহিনি খায় গিলে।

৩৮.
চতুর্থ আকাশ আজকে মেঘে ঢাকা
শুনেছি এখানেই দুঃখগুলো রাখা

যখন দেবদূত ছিটিয়ে দিয়ে আসে
বিশ্বে জনপদ হাজারো দুখে ভাসে

এখানে ঋত্বিক আর্তনাদ করে
এখানে দেবদাস অযথা ঢলে পড়ে

সুবর্ণরেখার পাইনি তবু দেখা…

৩৯.
এরিস্টটলের দেখাও মিলে গেল
তখনও ঘাড় গুঁজে কী জানি লিখছিল

কাব্যতত্ত্ব তো লিখেছ ভালো দাদা
ঘুরিয়ে সূর্যকে বাধালে ঝামেলাটা।

ধকল গেল কত ব্রুনো গ্যালিলিওর
এখনও পৃথিবীতে মিথ্যা তোলে শোর!

যিশু কি সূর্যকে ঘুরতে বলেছিল?

[ক্রমশ]

[শীর্ষচিত্র: ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ]

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

4 Comments

  1. কবিতার বোরাক বাহন মনে হয় সপ্ত আসমান পর্যন্ত পৌঁছাবে। পাঠকের জন্য আর কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে কে জানে! ক্ষণে ক্ষণে প্রাচীন বাংলা পুঁথি পাঠের গন্ধ পাচ্ছি। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে।তাইএমুহুর্তে মনে করি মতামত লটকনোর চাইতে কবিতা পাঠে গভীর নিবিষ্ট হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

    1. যাবে যাবে সপ্ত আসমান স্বর্গ নরক দেখে নেবে ঘোর স্বপ্নে

  2. মেরাজকে উপজীব্য করে লেখা এই সিরিজ কবিতাগুচ্ছ এক ভিন্ন মেজাজ নিয়ে আমাদের দোলা দিয়েছে। কবিতা চিরকালীন আর কবির মৃত্যু নেই… এই পথ ধরেই আমাদের সামনে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়েছে মেরাজের রাত্রিতে আসমান পরিভ্রমণে কবির সত্য আর কবিতার সত্য। স্বপ্ন আর বাস্তবতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন আমাদের মুগ্ধ করছে… প্রাচীন মিথের সাথে বর্তমান সময়ের সাযুজ্য খুঁজে নিয়েছেন কবি। ধর্মীয় বিশ্বাস আর অধর্মের নাগপাশ পাশাপাশি উপস্থাপন করে কবি সমকালে তার চিরকালীন অবস্থান তুলে ধরেছেন। মুক্তি, মোক্ষ, নির্বানের যে প্রচেষ্টা মানবজাতির তার সমান্তরালেই হাঁটছেন কবি জিললুর। এই নিদ্রা জাগরণের অধিক! কবিকে অভিনন্দন আমাদের এই আসমানী ভ্রমণে সাথী করার জন্য।

    1. প্আরিয় বন্ধু, আশা করছি এর মধ্যে শেষ পর্ব পর্যন্ত পড়ে ফেলেছ। তোমার একটা পূর্ণাঙ্গ অভিমত প্রত্যাশা করছি। অনুপ্রেরণার জন্যে ধন্যবাদ। 😍😍😍😍😍

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২