একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ৩ )
একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ১ )
একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ২ )
তিন
শুভাশিস ওর চলে যাবার শেষটা দেখে বলল, আমি সেদিন আমার পুরোনো বইপত্র গুছাচ্ছিলাম। বইয়ের তাকটা অবশ্যি আমার নয়, আমার কাকার। ওখানে কাকার যেমন গল্পর বই থাকত, আমার থাকত পড়ার বইখাতা। সেগুলি ঘাঁটতে-ঘাঁটতে একটা ডায়েরি খুঁজে পাই। সেটা হাতে নিয়ে তোমার কথা মনে পড়ল। তাই ভাবলাম ডায়েরি হাতে নিয়েই তোমার সঙ্গে একটু দেখা করে যাই, দেখি চিনতে পারো কিনা।
বলে স্মিত হাসল সে।
ভুলাই পাল খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বলল, বেশ করেছ এসেছ। আমি খুব খুশি হয়েছি। এই দেখাসাক্ষাৎ, একসঙ্গে বসে গল্পগুজব—উঠেই গেছে প্রায়। শহরে চলে গেছ তোমরা, তোমার বাবা-মা’কেও আজকাল আর আসতে দেখি না। তারা সব ঠিক আছে তো?
ভালো আছে। তবে ঐ—বয়স হলে যা-হয়… নানা রোগ…
হ্যাঁ। বয়স হলে ব্যামো-ব্যামো করে মানুষ শেষ।
তোমরা তো দুই ভাই, না? বড়োজন বোধহয় মামাবাড়িতে মানুষ?
মনে আছে তোমার?
হা হা করে হাসে ভুলাই। বলে, দাদা করে কি?
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
বাঃ। বিদেশ-টিদেশ যায়?
তা যায়।
আর দাদার ছেলে-মেয়ে? বিয়ে হয়ে গেছে নিশ্চয় এতদিনে?
হ্যাঁ। দাদার এক ছেলে, এক মেয়ে। ইস্কুলে পড়ে।
তবে তো বড়ো হয়ে গেল। আর তোমার?
একটু ইতস্তত করল শুভাশিস। বিয়ে তার হয়েছিল একবার। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। এখনও মামলা চলছে। সে-কথা এখানে, এই পরিবেশে বলা খুব মুশকিল। সে চুপ করে রইল।
ভুলাই বিচক্ষণ লোক। এই নীরবতার ভাষা সে বোঝে। গলা খাঁকরি দিয়ে ভুলাই প্রসঙ্গ ঘোরায়। বলে, তবে তুমি যদি শহরের কোনো খবরের কাগজে কাজ করতে, সেখান থেকে আমাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা লেখার জন্য আসতে—খুব ভালো লাগত। আমাদের কথা আজকাল আর বলে না কেউ। কৃষকের কথা লেখার কেউ নেই। কৃষকের জন্য এত লড়ে গেলুম, আজও তারা ফসলের দাম ঠিকঠাক পায় না। কবে থেকে বলে আসছি, কৃষক তার ফসল সে নিজে গিয়ে মানুষের মাঝে বেচবে, কোনো মিডলম্যান থাকবে না। কিন্তু সেটা হবার নয়, বুঝে গেছি। আর কৃষকেরাও অত ঝামেলা দিয়ে যেতে চায় না। মাঠ থেকেই ফসল বেচে দেয়। ফড়েরা আজও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে!
একটু হেসে শুভাশিস প্যাকেট খুলে ডায়ারিটা বের করে। বলে, এটা আমার নয়, কাকার। এটার কথাই তখন বলার চেষ্টা করছিলাম তোমায়। পুরোনো বইটই খুঁজতে গিয়ে যে এই ডায়ারি আবিষ্কার করব, জানতেই পারিনি। এ-বাড়ির কেউ যেমন এই তাকগুলিতে হাত দেয়নি, আমার বইটই-এর জন্য বলে তারা এখানটায় আর গুছায়নি—আমিও আর ঘাঁটিনি। এখন ফিরে মনে হল, দেখি এখানে তো কাকার নানা ধরনের বই থাকত, তার এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা। এই ভেবে তাকগুলো গুছাতে গিয়ে এই ডায়ারিটা হাতে এল। খুললাম। দেখি কাকার হাতের লেখা। মিসেস গান্ধি যেদিন নিহত হলেন, সেইদিন থেকে এই ডায়ারি লেখার শুরু। আর শেষ হচ্ছে যেদিন কাকা রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে—সেদিন।
শুভাশিস থামল। তাকাল ভুলাইয়ের মুখের দিকে। ভুলাই কিছু বলল না। ভাষাহীন মুখে তাকিয়ে রইল।
শুভাশিস আবার তার বক্তব্যে মন দেয়। বলে, সেই শেষ পাতাটা আমি পড়ে শোনাব—সেখানে খোদাই আছে একটি লাইন।
এদিকে ডায়ারিটা শুরু হচ্ছে একটিমাত্র বাক্য দিয়ে—
এক মহীরূহের পতন। আগে শুরুটা বলে নিই। সেখানে পরের পাতায় লেখা আছে, আমার নেত্রী। আগ্রহ জন্মাল। ভাবলাম পড়ি। পরের পাতা ওলটাই। কাকা রোজ যে লিখেছে তা নয়। মাঝে মাঝে কলম চালিয়েছে। অনেকটি করে যে লেখা আছে, তাও নয়। কোনো পাতায় দুই লাইন, কোনোটিতে চারটি বাক্য; মোটকথা মনের ভাব প্রকাশ করে গেছে কাকা। আর এই মোটা ডায়ারি, এই যে— ।
তার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে ভুলাই পাল বলে, সে ডায়েরি নিয়ে তুমি ঘুরছ কেন? ভুলাইয়ের গলায় অপ্রসন্নতার সুর। বলল, নানা, এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। সে আমার শত্রু ছিল একসময়, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গেছে মাঝের কয়েক দশক, তাই বলে তুমি তার ব্যক্তিগত ডায়ারির পাতা পড়বে, এ আমি মেনে নিতে পারছি না। এটা তোমার একটি ভুল কাজ। বিরক্ত ভুলাই মাথা নড়তে লাগল।
একটু থেমে গেল শুভাশিস। এই ডায়েরি সে এখানে এনেছে একটাই কারণে, তা হল ভুলাইকে খুশি করা। যে মিশনে সে এখানে এসেছে, তাতে ভুলাইকে দরকার। দরকার আরও অনেককে। কিন্তু তাদের মূল শিকড় ভুলাই। এই এলাকার অনেক ছেলেই তার হাত ধরে রাজনীতি শিখেছে।
ভুলাই বলল, কারও ব্যক্তিগত জিনিস এভাবে খুলে পড়া উচিৎ নয়, তাহলে মানুষটাকে একেবারে উলঙ্গ করে দেওয়া হয়। তা সে তোমার যতই নিজের লোক হোক। তোমার কাজটা মোটেই করা উচিত নয়।
নিজের ঠোঁট একবার চেটে নিয়ে শুভাশিস বলে, অতটা তলিয়ে ভাবিনি জেঠু। মনে হল—আসলে এখানে তোমার বিষয়ে অনেক কথাই লেখা আছে—তাই…
আমার বিষয়ে? সোনা লিখেছে? ভুলাই অবাক। সে চেপে ধরে বিছানার কোণা।
গোটা এই ডায়ারি জুড়ে রাজনীতির অনেক কথাই লেখা আছে। আর তুমি আছো অনেকটা জায়গা নিয়ে। এটা তোমাদের সময়ের একটি রাজনৈতিক দলিল।
তুমি আমাকে অবাক করলে, হে!
এবার একটু যেন সহজ হল শুভাশিস। বলল, শেষে একটিই বাক্য খরচ করেছে কাকা, তোমার জন্য। ডায়ারির প্রথম পাতা যেমন লেখা হচ্ছে একটি লাইন দিয়ে, শেষও হচ্ছে একইভাবে—সেখানেও একটিমাত্র লাইন। আর সে লাইন তোমাকে নিয়ে। এর পরেই রাজনীতি ছেড়ে দেয় কাকা।
আমার কথা কী লিখেছে সোনা?
সেটা এই যে, তুমি একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট।
ভুলাইয়ের গোটা শরীরকে একবার কেঁপে উঠতে দেখল শুভাশিস। অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে আঁকড়ে ধরল চৌকির কোণা। খানিক পর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, এ-যে আমার দলের লোকেরাও বলে না। আমাদের দলের সদস্যপদ অনেকেই পায়, তারা নিয়মমতো লেভি দেয়, কিন্তু এই ‘সাচ্চা কমিউনিস্ট’ তকমা— না হে ছোকরা, খুব কম মানুষের কপালেই জোটে। আমার শত্রুর কাছ থেকে এই সম্মান—আমার বড়ো পুরস্কার। বলো, আর কী লিখেছে তোমার কাকা? কী ইতিহাস সে রচনা করেছে আমাদের সময়ের সেই রাজনীতির? তার রাজনৈতিক দর্শন কী ছিল তখন?
গা-টা ঝাড়া দিয়ে যেন বসল শুভাশিস। সে বসে আছে একটি পুরোনো দিনের চেয়ারে। নিজের বসার পজিশন বদলে সে বলল, অনেক কথাই লেখা আছে এতে। সবটা এখনও পড়ে উঠতে পারিনি। তবে শেষ পাতায় লেখা আছে ওই একটা বাক্য। ভুলাই পাল একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট।
এর পর ডায়ারি শেষ! আর ব্যাপারটা অবাক করার মতো। কারণ কীসের ভিত্তিতে ভুলাই পাল একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট হয়ে উঠল—তার কোনো ব্যাখ্যা লিখে যায়নি সেজোকাকা। ডায়ারি জুড়ে যে-লোকের বিরুদ্ধে নানা জায়গায় বিষোদ্গার করা আছে, সে হঠাৎ করে কেন সাচ্চা হয়ে গেল, এই তকমা দেবার প্রয়োজনই বা পড়ল কেন, তা রহস্য! যদিও ডায়ারিটা এই কয়দিনে যে সব পড়ে ফেলেছে সে, তা নয়। তবু…
ভুলাই পাল উদাস হয়ে চুপ করে রইল। বিড়বিড় করে বলল, সে কত মহান! একসময় কত দ্বৈরথ ছিল আমাদের। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। গালাগালি, মারপিট। আর আজ? সব ফক্কা, সব শূন্য, সব ধুলো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেছে! আমাদের আসল শাসক কে জানো? সময়! তার কাছে সবাই জব্দ। কিন্তু নিজের নিজের সময়ে আমরা সেই সময়ের কথা ভাবি না। ভাবি আমি রাজা! আমি বস! আমার কথাই শেষ কথা। তার পর? খেলা যখন শেষ হয়? দুনিয়ায় কে-কার! সময়ের চাকা ঘুরে গেছে, সে তোমাকে পিষে দিয়ে ধীর গতিতে চলে যাচ্ছে সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের জন্য, তাকে পিষে ধুলো করে দিতে, ছাই করে দিতে।
[ ক্রমশঃ ]