এক মুখ দাড়ি ও চার পোয়া গোস্ত – সৌরভ হোসেন
“কী জাব্বারভাই কেমন আছেন?” বেঁটে লোকটার ঠেস মারা কথাটা শুনে মিচকি হাসল লম্বা ঠ্যাঙঠেঙে লোকটি। সূচালো চাপ দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে ঠোঁট চিপে বলল, “খোদা যেমন রেখেছেন।” তারপর দুজনে দাঁত কেলিয়ে খি খি করে হেসে উঠল। বেঁটে লোকটি মুখের জর্দাটা খচমচ করে চিবিয়ে ভ্রূ টান করল, “দাড়িটা যা করেছিস না, মাইরি, ফাট্টাফাট্টি!” “ভালো করে সেঁচ-নিড়ান দিয়ে বাতাল করতে হয়েছে, এমনি এমনি ঝোপ বেঁধেছে?”, ফিক করে হাসল লম্বা লোকটি। হাসিটায় যেন কিছু একটার বিদ্রুপ ফুটে উঠল। দাড়িটায় আবারও বার কয়েক হাত বোলালো লোকটি। তারপর আচমকা কণ্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “যোগী অম্বরনাথজি কবে আসছেন?” “পরশু মিটিং আছে। সেদিনই জানা যাবে।”, গলা আরও দেড় কাঠি নামিয়ে ফ্যাসফ্যাস করল ঘাড় বসা পটল ফিগারের চোখ মোটা লোকটি। তারপর নিজের ফাড়া গাবগাছের গুঁড়ির মতো ঢ্যাবঢেবে শরীরটাকে বাতিস্তম্ভের আড়ালে ঢেকে ঘাড়ের ব্যাগ থেকে খামে ভরা কিছু একটা বের করে “এই নে, মিটিংএর চিঠি” বলে লম্বু লোকটির হাতে দিল। তারপর এদিক-ওদিক ঘুলঘুল করে জরিপ করে খুঁটল চোখ নাচিয়ে বলল, “বুদ্ধিটা কিন্তু জবর। যাকে বলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।” “একেই বলে দাবার মোক্ষম চাল। এক চালেই সব কুপোকাৎ।” চোখ পাকিয়ে হো হো করে আবারও দাঁত কেলিয়ে উঠল বেঁটে লোকটি। লম্বা ঠ্যাঙা লোকটিও তার দাঁত কেলানিতে সঙ্গত দিল। বাতিস্তম্ভের লম্বা ছায়াটা হুট করে আবছা হয়ে গেল। যেন এই লোকদুটোর দাঁত কেলানো হাসি তার আর সহ্য হল না। ফিসফিস ফুসুরফুসুরে ঘেন্না ধরে গেছে। নিজের ছায়া নিজের গায়ে শুষে নিচ্ছে। আসলে অপরাহ্ণের তামাটে সূর্যটা দেবদারু গাছটার ফাংড়ি ডালটার আড়ালে গা ঢাকা দিল। গাছ চুঁইয়ে হুট করে নেমে এল লম্বা সতরের ছায়া। সে ছায়ায় গা লুকাল বাতিস্তম্ভের লিকলিকে ছায়াটা। একটা ছায়া এভাবেই তো আরেকটা ছায়াকে ঢেকে দেয়। বড়ো ছায়া ছোটো ছায়াকে গিলে খায়। জায়গাটা একটা ঘিঞ্জি গলি বেয়ে সদর রাস্তার কাছে এসে মিশেছে। একেবারে গা লেগে দাঁড়িয়ে আছে পোস্ট অফিস। যাকে বলে পায়ের গুল্লে ছুঁয়ে ঘাড় টান করে উঠে যাওয়া। ফুটপাথ উঁচিয়ে হাঁক পারছে সার বেঁধে থাকা ফুটপাথি দোকান। রেডিমেড মালের পসরা। দোকানগুলো উপচে উঁকি মারলেই চতুষ্কোণ মাঠটা চোখে পড়বে। সারাদিনের ব্যস্ততায় হাঁপিয়ে ওঠা মাঠ। রাস্তাঘাটে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততাও তুঙ্গে। গাড়ি-ঘোড়ার প্যা-পু-ভু-ভা, পথচলতি মানুষের ক্যাঁচরম্যাচর একেবারে দপদপ করছে। কথায় কথা মিশে যাচ্ছে। তবুও লোকদুটো অপরাধীর মতো কণ্ঠ নামিয়ে ঘুচুরমুচুর করছে! বেঁটে লোকটি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেউ কিচ্ছু টের পাচ্ছে না তো?”
“আরে না না, আমি অত জালি মাল নই।”, খুঁট করে ছাটা গোঁফটাকে নাচিয়ে চোখে-মুখে মুড়োলি ভাব এনে ফরফর করে বলল লম্বা লোকটি। হাবভাবখানা এমন করল যেন সে বিরাট বড়ো মাতব্বর! তারপর হেয় করে বলল, “আজকাল এসবে কে আর পাত্তা দেয়। ঠাটবাট আর কাটছাটের তো যুগ। মানুষ ফ্যাসানে মজে আছে। আমি তো ব্যাপক এনজয় করছি।”
“সবকিছু অত হালকা করে নিলে হবে না। মনে রাখতে হবে, দেওয়ালেরও কান আছে।”, চোখ পিটপিট করে বলল বেঁটে লোকটি। তারপর গোঁফে হাসি চিবিয়ে নিজেকে ঠাট্টা করে বলল, “আমি খাটো লোক বলে আমার কথাগুলোকে কিন্তু খাটো করে দেখিস ন্যা।”
“কী যে বল না তুমি। তোমার কথাতেই তো এতদূর পর্যন্ত উঠে এসেছি। একেবারে বুথ কমিটি থেকে আজ একধাপে জেলাকমিটিতে! তা নাহলে আজ কোথায় নীচুতলায় পড়ে থাকতাম। কানাকড়ি আসা তো দূরের কথা কেউ চিনতও না, জানতও না।”
“না না আমি আর কী করেছি। তুই নিজেই তোর বুদ্ধির জোরে আজ এই জায়গায়। তোর বুদ্ধির কিন্তু তারিপ করতেই হয়। এই যেমন তিন তালাক বিল পাশের সময় যে কর্মকাণ্ডটা করলি, ওহ, কেউ আন্দাজই লাগাতে পারেনি যে এটাও সম্ভব! তুই সকলকে একেবারে তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিস! আর হ্যাঁ, বুকের আস্পদ্দা থাকাটাও একটা ব্যাপার। সে কিন্তু তোর ষোলোর ওপর আঠারো আনা আছে। ওপর মহল তো চমকে উঠেছিল! আরে তোর জন্যেই তো আজ আমি রাজ্যকমিটির মেম্বার। আমার পদন্নতি। তোর কাজের জন্যেই কিন্তু আমার এই পুরস্কার।”
“আইডিয়াটা হঠাৎ করেই এসেছিল। আসলে অনেকদিন আগে মেয়েদের একটা তাবলীগ জামাত দেখেছিলাম। থরে থরে মেয়েরা বোরখা পরে হাঁটছিল। আর হিজাবের ভেতর থেকে আউড়িবাউড়ি খেয়ে ভেসে আসছিল স্লোগান। বলতে গেলে ভাবনাটা সেখান থেকেই ধার করা। ভেবেছিলাম, এর চেয়ে ভালো ওষুধ আর হয় না। আইডিয়াটা ওপর মহল লুফেও নিয়েছিল।”
“কেন লুফে নেবে না? একেবারে দেশ কাঁপানো আইডিয়া যে। স্ব-গোত্রে স্ব-ঘাত। নিজের বিষে নিজে মরা। এমন আঘাত লেগেছিল, সবাই একেবারে চিড়বিড় করে উঠেছিল। দেশ-দুনিয়া তোলপাড়। তোর কিন্তু এবার এমএলএ টিকিট পাক্কা। রেডি থাক।”
“ওসব এমএলএ টেমএলএ হবার লোভ আমার নেই। তবে একান্তই জোরাজুরি করলে, তখন ভেবে দেখব।”, বেঁটে লোকটির টোপটা সম্পূর্ণ না গিললেও গিলব গিলব করে গলায় আটকে রেখে দিল লম্বা লোকটি। আসলে এতদিন ধরে ভেতরে ভেতরে পুষে রাখা ইচ্ছেটাকে হুট করে হাট করতে চাইল না সে। সুযোগ বুঝে ঠিকই ঝাঁপ মারবে। আগে কোপ মারার সময়। ঝোপ কাটার সময়। এক এক করে বাধাগুলোকে সরিয়ে আগে পথ নিষ্কণ্টক করতে হবে। তারপরে কবজি উঁচিয়ে রাজত্ব কায়েম। কারবার কবজা করে জাঁকিয়ে বসা। এলাকায় যে কটা কাটা বাংলাদেশি আছে, ঝেঁটিয়ে বিদায় করা। আরে বাবা, রাজনীতির চেয়ে বড়ো ব্যবসা এ দেশে আর কী আছে!
“এবার কিন্তু আরও সাবধান! প্রত্যেক কদম হিসেব করে ফেলতে হবে। ধরা পড়ে গেলে কিন্তু মাঠে ডাহা মারা পড়ব। সব প্ল্যানিং ভেস্তে যাবে। তখন মাথা ঢাকতে গিয়ে যেন পাছা উদেম না হয়ে যায়! রাজনীতি কিন্তু এক ঘটনার মারপ্যাঁচ। এক ভুলেই সব ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে! বিপক্ষের লোক কিন্তু ছোঁ মেরে আছে।”, মিনমিন করে বলল বেঁটে লোকটি। তারপর রিং বাজা ফোনটা কেটে দিয়ে বলল, “তুই না হয় সাবধানে কাজ করছিস, বাকিরা সব ঠিক আছে তো! কোনো গড়বড়!”
“হু, একদম।”, ঘাড় হেলাল লম্বা লোকটি। বেঁটে লোকটি চোখ ছোট্ট করে ফিসফিস করল, “তোরা না হয় এই ক’দিন অন্য কোথাও আত্মগোপন করে থাক। যাকে বলে লোকচক্ষুর আড়ালে। লোককে মুখ দেখাতে গিয়ে যেন খিটকেল না বেঁধে যায়!”
“কিচ্ছু হবে না। আমি ওদেরকে আপাতত ক’দিন বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি একটু ব্যবস্থা করে দিও। ওই জান-মালের ইন্তেজাম আর কি।”
“সেসব হয়ে যাবে। তুই কলকাতায় পাঠিয়ে দে। সন্দেহ তো দূরের ব্যাপার, কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না। শহরে এক দেওয়াল আরেক দেওয়ালকে চেনে না। একমানুষ আরেক মানুষকে চেনা তো দূরের কথা। শহরে শুধু পথ পথকে জড়িয়ে থাকে। মানুষকে নয়। শহরের মানুষের একটা জন্মগত গুণ আছে, অনেক কিছু দেখেও দেখে না। চেনা শহরে সব অচেনা মুখ। সুতরাং আত্মগোপনের জন্যে শহরই বেটার। তুই সব ঠিকঠাক করে আমাকে বলিস, আমি তো এই ক’দিন কলকাতাতেই থাকছি। কোনও প্রবলেম হবে না। থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, রমেনদা, মাংস ছড়ানোর প্ল্যানিংটা কেমন ছিল বলো? আমি কিন্তু সব গুঠি মেপেই ফেলেছিলাম। এবং একেবারে নিখুঁত শট। যাকে বলে মাস্টার স্ট্রোক। এক ঘায়েই কত ভোট ঝুলিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম! কিন্তু কাজটা বহুত রিস্কের ছিল!”
“দেখ, যতীন, ওপর মহলের মাথা কিন্তু আমাদের মতো অত কাঁচা বুদ্ধির নয়। তাঁদেরকে সাতপাঁচ অনেক ভাবনাচিন্তা করতে হয়। ঢিল তো অনেকই থাকে। কিন্তু কোন ঢিলটা মারলে বেশি পাখি মরবে সেসবও তো ভাবতে হয়। মনে রাখতে হবে এ জেলায় জাতিগত ভোট প্রায় সমান সমান। ভোটব্যাঙ্ক কারও খুব বেশি নয়। তাছাড়া একটা বিরাট অংশের মানুষ আছে ওসব গোস্ত-মাংসের ছুঁতমার্গকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। ধর্মের আলাম-কলাম ভাবে। তাদেরকে এই মাংসের ডোজ দেওয়াটা বড্ড দরকার ছিল। ধর্মের সুড়সুড়ি ছাড়া আমাদের জাতধর্মের ভোট অন্য কোনো উপায়ে এত সহজে ক্যাপচার করা যেত না। তারফলেই কিন্তু গো-গোস্ত প্ল্যানিংটা এত সাকসেস হয়েছিল। দলের কোল ভরে গেছিল।”
“ও কাজটা করতে গিয়ে কিন্তু আমার জাত যাওয়ার উপক্রম হয়ে যাচ্ছিল। যদি ছোঁয়া লেগে যেত, রাম রাম রাম!”, ঠোঁট বেঁকে কথাটা বলে ঠাট্টার হাসি হাসল যতীন। হেস মেরে রমেন বলল, “জাত কি আর হাতের মোয়া, ধুলেই চলে যাবে।”, বলে দুজনেই হো হো করে দাঁত কেলানি হাসি হেসে উঠল।
জাত না গেলেও জাত যাওয়ার কাজ করেছিল বকখিলে গলার যতীন। গোটা এলাকায় একেবারে হুলুস্থূল বাঁধিয়ে দিয়েছিল। দাঙ্গা হাঙ্গামা। খুন, হত্যা, আগুন, মারপিঠ ধরপাকড় একেবারে জমে ক্ষীর। সে এক জমজমাট খেলা। ধর্মের খেলা। জাতের খেলা। রক্তের খেলা। মানুষের আজরাইল মানুষ। মানুষের যম মানুষ। দাউ দাউ করে জ্বলেছিল বাড়ি। ঘর। বাস্তুভিটে। দোকানপাট। রাস্তা আগুন হয়ে উঠেছিল। উঠোন হয়ে উঠেছিল নরক। আর তার অন্তরালে রমেনরা নিখুঁত ভাবে কষেছিল ভোটের অঙ্ক। জাতপাতের ভোট। ধর্মের ভোট। মেরুকরণের ভোট। পাই টু পাই মিলিয়ে নিয়েছিল লাভের হিসেব। লাভে লাভে ভরে উঠেছিল ঝুলি। ভোটের ঝুলি। নোংরা রাজনীতির ঝুলি। জিভ বার করে চেটে নিত ক্ষমতার স্বাদ। এতদিন বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকায় এই ফন্দি খাটেনি। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে সেসব চক্রান্ত। মানুষ এত সহজে ওসব গায়ে মাখত না। এখন সেসব অতীত। মানুষের মননে গেঁড়ে বসেছে ধর্মের গোঁড়ামি। মন্দির মসজিদই এখন ‘কি ফ্যাক্টর’। কী গেরুয়া কী নীল সবাই ধর্মের উগ্রতায় মজছে। আর তার ফলেই রমেন সিনহাদের ধর্ম-ধর্ম জাত-জাত খেলাটা খেলতে সুবিধা হচ্ছে। মানুষও খুব সহজে গলে যাচ্ছে সে খেলায়। মত্ত হয়ে উঠছে উগ্র উন্নাসিকতায়।
দাঁত চিবিয়ে জাবর কাটল যতীন। একেবারে মাথা খেটে কাজটা করতে হয়েছিল। ওহ! যা গা ছমছম করছিল না! যেন মনে হচ্ছিল গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে উঠছে! মাংসটা জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে গেছিল। ভাগ্যিস, সেখপাড়ার কাজেম ছুঁড়া হেল্প করেছিল। সে কি আর এমনি এমনি রাজি হয়েছিল। অনেক কলা করতে হয়েছিল। অনেক হেচিয়ে-পেঁচিয়ে হ্যাঁ করানো গেছিল। বাপ রে বাপ! সেও এক ঠ্যালা! কাজেমকে যখন ঘেঙিয়ে ঘেঙিয়ে বললাম, আমার যখন খেতে ইচ্ছে করছে তখন তোর আপত্তির কী আছে? লুকিয়ে লুকিয়ে আজকাল কত হিন্দুই তো খায়। আমি খেলেই দোষ নাকি? আরে, সব কিছুর স্বাদ নিতে হয়। তাছাড়া তোরও তো নাকি পুণ্য হবে। ওই যে তোরা যাকে ‘নেকি’ বলিস। কোনো অমুসলিমকে নাকি গো-মাংস খাওয়ালে নেকি হয়। সুতরাং তোর তো ভালো। আরও জাতে উঠবি। পরকালে স্বর্গে যাবি। অনেক কথা খরচ করার পর শেষমেশ রাজি হয়েছিল কাজেম সেখ। একটা কালো রঙের পলিথিন ব্যাগে ভরে কেজি খানেক গো-মাংস এনে দিয়েছিল। আর মালটা হাতে পেয়েই আমি ভেবেছিলাম, এ কোনো পশুর দেহের মাংস নয়, এ হল সমাজ দেশ দাউ দাউ করে জ্বালানো বারুদ। থলেটা হাতে পেয়ে আর একদণ্ডও দাঁড়াইনি। লুকিয়ে ছুপিয়ে হনহন করে বটতলার দিকে রওনা দিয়েছিলাম। বেলা তখন সবে বাছুর হয়ে উঠছে। ড্যাং ড্যাং করে দৌড়চ্ছে। শিবমন্দিরটা ফাঁকাই ছিল। পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছিল ভৈরব। বুকে তার কালো মিশমিশে জল। বটগাছের ঝুরি নেমে জায়গাটা বেশ আন্ধার আন্ধার। গাছের ডালপালা হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রোদকে খেয়ে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে কিচির মিচির করে পাখি ডাকছে। হনুমানের এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফানোর ঝপাং ঝপাং শব্দ নির্জন মন্দিরতলাটাকে কেমন বেমানান করে দিচ্ছে। একজন জনমানবও ছিল না। যেন গাছ আর গাছের ছায়ার দেশ। আর একমুহূর্ত দেরি করিনি। আগের প্ল্যানিং মতো ছুপছুপ করে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে নাক এঁটে ধরে থলে থেকে গো-মাংসগুলো বের করে ছিটিয়ে দিলাম সিঁড়ির আশপাশ। তারপর দ্রুত পা চালিয়ে মন্দিরতলা থেকে বেরিয়ে এসে নদীর ধার ধার গিয়ে মেইন রাস্তায় উঠলাম। বাপ রে, বুকের ধড়ফড়ানি একেবারে আকাশ ছুঁয়ে চলছিল! রাস্তায় উঠতেই কিছুটা ধুকপুকানি কমল। আর পেছন ফিরে তাকানো নয়। ধেড়ে দৌড় দিয়েছিলাম। তারপর হুলুস্থূলটা বাঁধতে আর দেরি হয়নি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘোট পেকে গেছিল। হু-হু করে পুরো ঘাটপাড়া রটে গেছিল, শিবমন্দিরে গো-মাংস পাওয়া গেছে। ব্যস, মানুষের মনে জ্বলে উঠল হিংসার আগুন। আর আগুনটা দাবানলের মতো দাউদাউ করে উঠল চটজলদি। আর আমরা সেই ঘোলাজলে নেমে পড়েছিলাম মাছ ধরতে। ভোটের মাছ। জাতপাতের মাছ।
যতীন জাত কম্যুউনিয়াল। বেজাতের লোককে একেবারে চোখের কোণায় সহ্য করতে পারে না। যতীনরা উদ্বাস্তু। ওপার বাংলার কুমিল্লার লোক। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের অত্যাচারে শূন্য হাতে এপার বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। সেই থেকেই নাকি মুসলমানদের প্রতি একটা বিষাক্ত ঘৃণা মনে ঢুকে গেছিল। আর এতদিন ধিকধিক করতে থাকা সেই ঘৃণা উগ্র গেরুয়া হাওয়া পেয়ে দপ্ করে জ্বলে উঠেছে। যতীনের আফসোস, অযোধ্যায় গিয়ে ভব্য রামমন্দিরের জন্যে একটা ইট রেখে আসতে পারেনি! তবে তার প্রতিজ্ঞা আছে, সেখানে গিয়ে একবার না একবার মাথা ঠুকবেই। এর আগেও যতীন বেধর্মীদের অন্দরে ঢুকে বেশ কয়েকবার ছোবল মেরে এসেছে। একবার সে তার বৌকে দিয়ে দাঙ্গা বাঁধানো কাজ করেছিল। মুসলমানদের বোরখার বদনাম করার জন্যে তার বৌকে বোরখা পরিয়ে লটরপুর বাজারে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় মদের দোকানে পাঠিয়ে মদ কিনিয়েছিল। কিন্তু সে খ্যাপে আর পার পায়নি। হাতেনাতে ধরা পরে গেছিল তার বৌ। ব্যাচারির সে কি নাকানিচোবানি অবস্থা। লোকের ধমকানি আর শাসানিতে সব কবলে দিয়েছিল এক ছেলের মা বাসন্তী। ভাগ্যিস কাছে পিঠে পুলিশ ছিল। তা নাহলে হয়তো গণপিটুনিতে মারাই পড়ত! তবুও শিক্ষা হয়নি যতীনের। তার বৌকে গালমন্দ করায় নাকি উলটে তার ঘৃণা দ্বিগুন হয়ে গেছিল। সে আরও বজরঙ্গি হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ হাড় থেকে মজ্জায় ঢুকে গেছিল। মাথা খুঁটেছিল, এর বদলা নেবেই।
“আমাদের উৎসব পার্বণগুলো দেখছ, এখন কেমন হৈ-হুল্লোর করে হচ্ছে। এসব কিন্তু আমাদের অবদান।”, কথাটা বলতে বলতে যতীনের বুকের ছাতি যেন চার ইঞ্চি বেড়ে গেল। গলার কলারটাকে হাত দিয়ে হালকা করে টান দিল। যেন কেল্লাফতে! যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে। রমেন আরও আড়াল হল। শরীরটাকে ল্যাম্পপোস্টের আরও ঘেঁষে দাঁড় করাল। কণ্ঠ ফিসফিস করে বলল, “এটাই তো দরকার। দল তো এতদিন ধরে এটাই চাইছিল। মানুষকে যত পারো ধর্মের গুলি খাইয়ে দাও। মানুষকে যত বেশি ধর্মের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে আমাদের কাজ তত সহজ হয়ে যাবে। মানুষ ধর্মের মোহে আচ্ছন্ন হলে ঘরে ফসল তুলতে আমাদের আরও ইজি হয়ে যাবে। মানুষকে ধর্মের গোড়ায় যত ঠেসে দেওয়া যাবে, গলা অবধি থুতনি অবধি যত ডুবিয়ে দেওয়া যাবে, মানুষ তত পরধর্মী-বিদ্বেষী হবে। তত বেশি বে-জাতকে ঘৃণা করতে শিখবে। আরে বাবা, ধর্ম তো আফিমের মতোই নাকি!”, হো হো করে বদমাইশি হাসি হেসে উঠল রমেন। শেষ কথাটা শুনে যতীনও দুষ্টু হাসি হাসল। কার্ল মার্ক্সকে টেনে এনে মশকরা করল।
এসবে অবশ্য যতীনের পকেট ভালোই ভরে উঠছে। যেকোনো ধর্মীয় উৎসব-পার্বণ, সে বড়োই হোক আর ছোটখাটোই হোক, জাঁকজমক হৈ-হুল্লোর করে পালন করার জন্যে ওপর মহল থেকে তলে তলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসে। সেসব টাকার সবটা খরচ হয় না। গুচ্চের যতীনদের পকেটে ঢুকে যায়। টাকা আর ধর্মের কী মোহ, সেদিনকার দলবদলি বামনেতাকেও দেখা যাচ্ছে খোল-করতাল হাতে রাস্তায় বাসন্তীপুজার বিসর্জনে নৃত্য করতে! হনুমানের মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা করতে!
একমুখ দাড়ির যতীন যেই বাতিস্তম্ভের আড়াল বে-আড়াল হয়েছে অমনি পাশ দিয়ে গডগড করে হেঁটে চলা একজন ফেজ টুপি পরা মুসলমান মুরুব্বি মানুষ ‘সালাম’ দিলেন তাকে। আগপাশ না ভেবে উঠেই ‘সালামের’ ‘প্রতিসালাম’ দিল যতীন। রমেন ফিক করে গোঁফের তলে হাসল। জোব্বা পরা মুরুব্বি লোকটা পাশ কাটতেই রমেন এবার ঠোঁট খুলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে দাঁতলা হাসি হাসতে হাসতে বলল, “তুই পরীক্ষায় পাশ করে গেছিস যতীন। একেবারে ফুল মার্কস।” তারপর ঠেস মেরে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “সেলাম, জাব্বারভাই।”
দুই
সরাসরি রাজ্য অফিসে প্রেসমিটটা ডাকা হয়েছে। ঘরটা চৌকো আকারের। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বেশ বড়োসড়ো পরিসর। দেওয়াল জুড়ে উপচে পড়ছে গেরুয়া রং। যেখানে নেতারা বসবেন তার পিছনে একেবারে ছাদ ছুঁয়ে দামি ব্র্যান্ডের গেরুয়া কুর্তি পরে ‘ভি’ ইঙ্গিতে আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নেতা। যিনি বর্তমানে দলের ব্রান্ডনেম। দেশের ক্ষমতা যাঁর কুক্ষিগত। ছবিটা আড়েবহরে এতই বড়ো যে তাঁর মুখের লম্বা দাড়ির এক একটা চুল যেন ব্রিটিশ আমলের বড়ো বড়ো ইমারতের এক একটা পিলার! যেন নেতা নন কোনো সাধুসন্ত! কানের ফুটো দুটো কুয়োর মতো হাঁ করে আছে! ইটসুড়কির দেওয়াল তো নয় যেন মুখের দেওয়াল! ছবিটার তেজদীপ্ত চোখদুটো এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছে যেন মনে হচ্ছে তিনি সব তীক্ষ্ণ নজরে রাখছেন! একচুলও তাঁর বাইরে গিয়ে কারও কিছু করার হিম্মত নেই! সাংবাদিকদের মধ্যে কানাঘুষো, আজ কী এমন চমক আছে যে এত্ত বেশি ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে! দলবদল তো হামেশাই হচ্ছে। আজকাল তো এসব জলভাত। আজ এ দলে তো কাল ও দলে। এ তো লেগেই রয়েছে। এতে নতুন আর কী চমক আছে। এরা বলছে পচা আলু, ওরা বলছে দলের সম্পদ। ওরা বলছে ভুষি মাল, এরা বলছে জননেতা। ওরা বলছে, আমরা আগেই দলবিরোধী কাজের জন্যে দল থেকে বহিষ্কার করেছি তো এরা বলছে, দলে গণতন্ত্র নেই, একনায়কতন্ত্র চলছে, দলে কাজ করতে পারছিলেন না তাই দল ছেড়েছেন। এসব ঢিল পাটকেল খেলা তো হামেশাই চলছে। একজন স্যুইশক্যাপ পরা মাঝবয়সি ছিপছিপে গড়নের রিপোর্টার ফিসফিস করে পাশের ফ্রেঞ্চকাটের চাবুক ফিগারের সিনিয়র পত্রসাংবাদিককে জিজ্ঞেস করল, “মন্ত্রীটন্ত্রী কি?” দ্বিতীয়জন গলা আরও নামিয়ে আলগোছে বলল, “কী জানি কিছুই বুঝতে পারছি ন্যা!” সামনের সিটে বসে থাকা একজন ওয়েব জার্নালের রিপোর্টার ঘাড় বেঁকে বলল, “সিনেমার নায়ক নায়িকাও হতে পারে।” ব্যাপারটা লুফে নিল পাশের সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকা টিভি চ্যানেলের ব্রাউন চুলো মেয়েটি। ঠেস মেরে বলল, “এতই যখন চাপা দেওয়া ব্যাপার নিশ্চয় বলিউডের কেউ গ্ল্যামার ক্যুইন হবেন!” ক্যামেরা হাতে খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে থাকা হালফিলের বয়সি ছোকরা ছেলেটি ঠোঁট চিপে বলল, “আমার মনে হয় কোনো ক্রিকেটার টিকেটার হবেন!” বুম হাতে থাকা শরীরের সঙ্গে টান টান করে লেগে থাকা জিন্স টি-সার্ট পরা তন্বী মেয়েটি কৌতূহল বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “প্রাক্তন না বর্তমান?” পেছনের সিটে পিঠ টান করে বসে থাকা রিপোর্টার লোকটি, যে কিছুক্ষণ আগেই জিজ্ঞেস করছিল মন্ত্রীটন্ত্রী কি না, সে লোকটি ফুট কাটল, “কী আর করবেন, ওদিকে এখন বাজার নেই। মার্কেটে আর চলছে না। তাই এদিকেই ঝুঁকে পড়া। রাজনীতিতে যে টাকা এবং ক্ষমতা দুটোই আছে। হালফিলে তো দেখছি, ভোটারদেরকে রূপে মজানো যে খুবই সহজ।” ফট করে রিপোর্টার মেয়েটি ফোড়ন কাটল, “আপনিই ভোটে দাঁড়িয়ে যান। যা বক্তব্য দিতে পারছেন তাতে প্রায় ফুলনেতা হয়ে উঠেছেন।” সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
দলের অনেকে বলছে, এটা তো জেলা ম্যাটার। জেলাতেই করতে পারত। এত দূর টেনে আনার কী দরকার ছিল? কিন্তু রমেনরা কোনো রকমের রিস্ক নেয়নি। তারা আশঙ্কা করেছিল, বাইচান্স যদি কেউ চিনে ফেলে! তাহলে তো লজ্জায় মুখ থাকবে না। সমস্ত পরিকল্পনা মাঠে মারা পড়বে। জেলাকমিটির পাছা উদেম হয়ে যাবে। সুতরাং একেবারে ওপরতলা। রাজ্যঅফিস। ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘরে পৌঁছতেই হুড়মুড় করে একদল নেতা ঘরে ঢুকলেন। একেবারে টাইমে টাইমে হাজির! চারজনের টিম। নেতৃত্বে রাজ্যের দায়িত্বে থাকা দলের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক। সঙ্গে দলের রাজ্য সভাপতি। বাকি দুজনের একজন যতীনদের জেলা সভাপতি। অন্যজন দলের মিডিয়া উপদেষ্টা। যাকে বলে আঁটসাঁট বেঁধে বসা।
মাইক্রোফোনটা মুখের কাছে আলতো করে টেনে দু একবার মিহি করে ফুঁ দিয়ে দু-একবার সরু করে খক খক করে গলা ঝেড়ে গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা মোটা নাক আর ড্যাবডেবে চোখের রাজ্যসভাপতি সবাইকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে প্রেসমিট শুরু করলেন। তারপর আসন্ন ভোটের দিকে আলোকপাত করে বিরোধীদের দিকে গুচ্চের ঢিল-কাদা ছুঁড়ে, গালমন্দ ঝেড়ে, হুমকি, ধমকানি, শাসানি-চাবকানি দিয়ে শেষে ইনিয়ে বিনিয়ে “আজ বাংলার রাজনীতিতে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটতে চলেছে। আমাদের দলে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যোগ দেবেন, যা আগে কখনও আমাদের রাজ্যে ঘটেনি। এই প্রথম ঘটতে চলেছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন আমাদের দলের কেন্দ্রীয় পাধারি” বলে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকের দিকে মাইক্রোফোনটা ঠেলে দিলেন। কোর্টটাই পরা ধবধবে ফর্সা চেহারার ফ্রেঞ্চকাট জাঠ নেতা ঠোঁটে চটুল হাসি মাখিয়ে ভারি গলায় বললেন, “লোকে প্রচার করেন, আমরা নাকি মুসলিম বিরোধী দল। আমরা নাকি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করি। কিন্তু সে প্রচার যে মিথ্যা, বিরোধীদের করা সে বদনাম যে মিথ্যা তা আজ আপনাদের চোখের সামনে প্রমাণ হয়ে যাবে। আজ আমাদের দলে একদল গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু মুসলিম যোগদান করবেন। আমি তাদেরকে একে একে আপনাদের সামনে ডেকে নেব।“ বলেই কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক, একে একে নাম ধরে ডাকতে লাগলেন—রফিক উল ইসলাম, আব্দুস সামাদ সেখ, সাইদুল খান, সৈয়দ কাদের নূর, রহমত মণ্ডল, আলি বক্স, রসুল মোল্লা। সবাই একে একে গডগড করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে দেওয়ালের ছাদ ছোঁয়া ছবিটার সামনে মুখ তুলে সার বেঁধে দাঁড়াল। এরপর কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক চোখমুখ নাচিয়ে ঘোষণা দিলেন, “এবারে যিনি আপনাদের সম্মুখে আসছেন তিনি একজন অন্য জগতের মানুষ।” উপস্থিত সবাই থ হয়ে তাকাল। সবার মনে উশখুশ উশখুশ, কে? নায়ক? নায়িকা? গায়ক? গায়িকা? ক্রিকেটার? অন্যদলের মন্ত্রী? না কোনো হেভিওয়েট নেতা? সবাই একেবারে গলা তুলে পেছনের দরজার দিকে ছোঁ মেরে তাকাল। সমস্ত ক্যামেরার চোখও সেইদিকে তাক করে আছে। পর্যবেক্ষক গলা তুলে তড়বড় করে বলে উঠলেন, “ইনি একজন মৌলানা।” উপস্থিত সাংবাদিকদের চরমে ওঠা আগ্রহ আর কৌতূহলের পারদ হুবুহু না মিললেও তারা ঘুষুরমুসুর করতে লাগল, মৌলানা! মৌলানা মানুষ গেরুয়া শিবিরে! ভোটের আগে গেরুয়া শিবিরের এ তো দারুণ চমকদারি চাল! একেবারে সবার ভাবনার বাইরে! দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল রমেন সিনহা। মৌলানা লোকটিকে থপ থপ করে সম্মুখে এগিয়ে আসতে দেখে চোখ বাঁকিয়ে ঠোঁটে রসিকতার হাসি চেপে রেখে দুই হাত বাড়িয়ে সালাম দিল, “সালাম, জাব্বারভাই।”