|

ধর্মযুদ্ধ – অশোক মিত্র (পুনর্পাঠ)

শেয়ার করুন

যা বলার, অল্প কথাতেই বলা চলে। 

আমি ভারতীয়, তথা বাঙালি, রবীন্দ্রনাথের দেশের মানুষ আমি। আমার চেতনায় রবীন্দ্রনাথ, আমি যে ভাষায় ভাবনা ব্যক্ত করি, তা রবীন্দ্রনাথের একান্ত সৃষ্টি, যে-গান আমাকে উদ্বেলিত অনুপ্রাণিত করে, তা-ও । এখান-ওখান থেকে যত প্রলেপই পড়ুক, ধুলোর আস্তরণ সরালে, আমার সত্তার গভীরে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা প্রোথিত। যত অহংকারই করি, রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমার কোনো পরিচয় নেই, তিনি আমাকে লালন করেছেন!

তিনি আমাদের চেতনা, আমাদের প্রাণ, আমাদের নিঃশ্বাস, আমাদের অভয়। 

দু’দিন আগে যা অকল্পনীয় অভাবনীয় ছিল, তা-ই ঘটেছে আমাদের দেশে। রবীন্দ্রনাথ স্বৈরাচারের শিকার হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছাপানো নিষিদ্ধ হয়েছে এ-দেশে, ফতোয়া জারি হয়েছে বেতারে রবীন্দ্রনাথের অমুক-অমুক গান গাওয়া চলবে না। রাষ্ট্রাদেশ: রবীন্দ্রনাথের চেয়ে রাষ্ট্রাদেশ যেন বড়ো।

সুতরাং, যুদ্ধ আমাকে করতেই হবে। প্রাণের দায় এটা, বিবেকের দায়। যে স্বৈরাচার আমার নিঃশ্বাস বন্ধ ক’রে দিতে চায়, তার বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম। ঈষৎ বেকায়দায় প’ড়ে সে স্বৈরাচার হয়তো এখন ক্ষমাপ্রার্থী হবে, হয়তো এ-ও বলা হবে রবীন্দ্রনাথকে শৃঙ্খলিত করার প্রসঙ্গটি অনুমোদিত কর্মসূচীর ঠিক অন্তর্ভুক্ত ছিল না, অন্যমনস্কতাহেতু এই প্রমাদ ঘটেছে, ভবিষ্যতে আর ঘটবে না।

অবৈকল্যে স্থিত থাকতে হবে আমাকে। কোনো-কোনো অপরাধের ক্ষমা নেই, কোনো-কোনো অপরাধ সভ্যতার সংজ্ঞাকে স্তম্ভিত করে। পাশববৃত্তি পাশববৃত্তিই, অন্যমনস্কতাহেতু হ’লেও তাই। যে একবার পাশবতায় স্খলিত হয়েছে, প্রথাসিদ্ধ তার স্খলন-প্রবণতা।

আমি স্বাধীনতার স্বপক্ষে, জীবনের স্বপক্ষে, সভ্যতার স্বপক্ষে। অসুরবধ আমার ধর্মীয় কর্তব্য। যে অনৃতভাষিণী বলেন, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা বন্ধ ক’রে না দিলে দেশের সাধারণ লোক দু’বেলা দু’মুঠো খেতে-পরতে পাবে না, তাঁকে প্রতিহত করতেই হবে। তাঁর বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার বিবেক আছে, সেই যুদ্ধ আমাকে চালিয়ে যেতেই হবে, আমি যদি একা হই, প্রাবৃত আকাশের নীচে হু-হু উন্মুক্ত প্রান্তরে একা, তা’হলেও।


কলকাতা

দ্বিতীয় রাজনৈতিক সংখ্যা

মার্চ, ১৯৭৭

এই যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *