করোনাকালে গৃহসহায়িকাদের দুর্দশা চরমে – দীপক সাহা
তাপসী সরকার কাজ করেন ঢাকুরিয়ার এক আবাসনে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডবে রাজ্যে এখন কার্যত লকডাউন। সরকারের তরফে কাজকর্মে নানা বিধিনিষেধ আরোপ হতেই ফ্ল্যাটের মালিকরা তাপসীকে বকলমে আবাসনে আসতে নিষেধ করেছেন। গতবার লকডাউনের চরম দুর্দশার কথা মনে হতেই তাপসী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। গতবার কোনোরকমে টিকে ছিল, এবার কাজটা থাকবে তো? মে মাসে কাজে না গেলেও মালিক অর্ধেক টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এর পর কী হবে? অসুস্থ স্বামী আর একরত্তি মেয়েকে নিয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ঝাপটাকে সঙ্গী করে ব্রিজের নীচে ঝুপড়িতে রাত কাটে। এখন দুশ্চিন্তায় রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না তাপসী। ভোরের আলো ফুটলেই অনিশ্চয়তার হাতছানি।
দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে কাজ করতেন হাসিনা বিবি। কোনও বাড়িতে রান্নার কাজ, কোথাও বা ঘর পরিষ্কার। করোনার দ্বিতীয় ছোবলে পরিস্থিতি ঠিক কতটা জটিল হয়ে উঠতে পারে, ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি হাসিনা। হাসিনার স্বামী নির্মাণ শ্রমিক। তিনিও এখন কর্মহীন, হাতগুটিয়ে বসে। ঘরে বারো বছরের মেয়ে। দু-বছর আগে বড়ো মেয়ের বিয়েতে মাইক্রোফাইনান্স সংস্থা থেকে চড়া সুদে নেওয়া ধার মেটাচ্ছিলেন এতদিন কোনওরকমে। লকডাউনে ঋণের বোঝা বাড়ছে, জমানো পুঁজিও প্রায় শেষ। আয় অনিশ্চিত। ওদিকে পেটের তাগিদে রাস্তায় বেরোলেই পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে আসছে। দিল্লিতে হাসিনার মতোই প্রায় পনেরো লক্ষ পরিচারিকা রয়েছেন। সকাল থেকে হাপিত্যেশ বসে থাকেন হাসিনারা, কখন খাবারের প্যাকেট আসবে! বিলি করা খাবারই ওঁদের একমাত্র সহায় হয়ে উঠেছে।
গ্রাম বাংলায় ‘ঝি’, ‘কাজের মেয়ে’, শহুরে ভাষায় ‘কাজের মাসি’, ‘কাজের দিদি’। হালে ভাষার পরিমার্জনে তাঁদের জুটেছে গালভরা তকমা, ‘গৃহসহায়িকা’ বা ‘গৃহপরিচারিকা’। তবে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন তাঁদের আর্থসামাজিক কাঠামো সেই তলানিতেই। অথচ তাঁদের একবেলার অনুপস্থিতিতে বাবুদের বাড়ি চোখে সর্ষে ফুল দেখে। মফঃস্বল থেকে শহরে, মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত বেশিরভাগ পরিবারই এখন গৃহসহায়িকাদের বদান্যতা ছাড়া এক পা চলতে পারে না। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রোজ নিয়ম করে কাজে আসতে হয় তাপসী-হাসিনাদের। অসুস্থ শরীরেও মনের জোরে বাড়ি থেকে বের হতে হয়। এমনকি হঠাৎ করে ট্রেন বিভ্রাটেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও কাজের বাড়িতে যেতে বাধ্য হন তাঁরা। উপরি পাওনা গৃহকর্ত্রীর কটু কথার বাণ।
অন্তেবাসী এই নারীদের একটি বড়ো অংশ স্বামী পরিত্যক্তা, অনেকে আবার নেশাগ্রস্ত স্বামীর শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে কোনও মতে সংসারী। কেউ বিধবা, কেউ বা অবিবাহিতা। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ভ্যান চালিয়ে, আনাজ বিক্রি করে, কলের মিস্ত্রি বা রাজমিস্ত্রি প্রভৃতি অস্থায়ী কাজ করে যা রোজগার করেন, তা এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চালানো খুবই কঠিন। উপরন্তু তাঁদের উপার্জনের সিংহভাগই বরাদ্দ থাকে সস্তার মদ ও জুয়ার ঠেকের জন্য। ফলে রাজধানী দিল্লির যমুনাতীরবর্তী অঞ্চলই হোক, অথবা মুম্বাইয়ের বিশ্বখ্যাত ধারাভি বস্তি, কলকাতার শহরতলি অথবা জেলাশহরগুলির প্রান্তভাগ, অবহেলিত মানুষগুলি মূলত ঠিকে কাজ, রান্নার কাজ অথবা আয়ার কাজ করেন। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিকে সঙ্গী করে সুখ-দুঃখের বারমাস্যার ঝুলি নিয়ে তাঁরা সূর্যের প্রথম আলোকে সাক্ষী রেখে বেরিয়ে পড়েন নিজেদের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। ভোরের প্রথম লোকাল ট্রেনে বা বাসগুলিতে তাঁদের মুখরিত উপস্থিতি জানান দেয়। দিনভর বাবুদের বাড়িতে নানা ফাইফরমাশ খাটা তাঁদের রোজনামচা। ঘর পরিষ্কার, বাসন মাজা, জামাকাপড় পরিষ্কার করা, রান্নাঘরে সাহায্য করা, বাজার করা, বাচ্চাদের দেখভাল করা, বয়স্কদের সেবা করা অর্থাৎ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ প্রায় সব কিছুই করতে হয়। দু-হাত, দু-পা সমানে ব্যস্ত থাকে। বিনিময়ে না পায় সম্মান, না পায় স্বীকৃতি, না পায় ন্যায্য অধিকার।
অনেক ক্ষেত্রেই কাজের বাড়ির পরিবেশ গৃহসহায়িকাদের নিরাপত্তার পক্ষে অনুকূল হয় না। খবরে কাগজে বা টিভিতে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের শারীরিক বা মানসিক ভাবে হেনস্থা করার খবর প্রায়ই সামনে আসে। অভিযোগের সূচীপত্র দীর্ঘ। পুজোর বা ঈদের মুখে তাঁদের কাজ থেকে অনেক সময় ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন মেলে না বোনাস। গতবছর পুজোর শাড়ি বা বোনাস কিছু জোটেনি। এবারও আশার আলো নেই। অনেক সময় ‘চৈত্র সেল’ থেকে আনা পুরোনো জিনিস তাঁদের ধরিয়ে দেওয়া হয়। কাজের বাড়িতে বাথরুম ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। ফ্ল্যাট বাড়িতে লিফট থাকলেও সেটা তাঁদের ব্যবহারের অনুমতি নেই। সব সময়ের কাজের মেয়েরা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির (মিথ্যা চুরির অপবাদ, অধিক ভোজনের খোঁটা প্রভৃতি) শিকার হন, প্রাধান্যকামী শ্রেণির সংকীর্ণ রুচিবোধের দ্বারা। গৃহপরিচারিকাদের প্রতি বর্ণ ও শ্রেণিগত ছুঁৎমার্গের শিকড় গ্রামাঞ্চলে এখনও ভয়ংকরভাবে দৃঢ়।
আক্ষেপের কথা স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৭৩ বছর ডান ও বাম জমানা পেরিয়ে এসেও গৃহসহায়িকাদের এখনও পর্যন্ত সরকারি পরিচিতি জোটেনি। সরকারি খাতায় তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। এঁরা অসংগঠিত শ্রমিক না অন্যধারার কর্মী তা এখনও সমাজের কাছে ব্রাত্যই হয়ে রয়েছে। অথচ, সমাজে গৃহসহায়িকাদের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতি প্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও গৃহসহায়িকাদের না আছে সামাজিক স্বীকৃতি, না আছে কাজের নিশ্চয়তা, না আছে সবেতন ছুটির অধিকার। বিক্ষিপ্তভাবে গৃহসহায়িকাদের ইউনিয়ন আছে। তবে তার অস্তিত্ব দুর্বল। অন্য সংগঠিত শ্রেণির মতো এঁদের না আছে কোনও আর্নড লিভ, ক্যাজুয়াল লিভ বা মেডিক্যাল লিভ। বার্ধক্যে নেই কোনও পেনশন, গ্র্যাচুইটির মতো সামাজিক নিরাপত্তা। ভবিষ্যতের সঞ্চয় বলে কিছুই থাকে না এই হতভাগ্য নারীদের হাতে।
গৃহপরিচারিকারা শ্রম দিচ্ছেন। তাঁরাও শ্রমিক। শ্রমিকদের জন্য যদি আইন থাকে তাঁদের জন্যও আইন থাকবে না কেন? সামাজিক সুরক্ষা, ন্যূনতম মজুরি, কাজের নিশ্চয়তা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মক্ষমতা চলে যাওয়ার পর জীবন চালানোর জন্য পেনশন, এগুলোও শ্রমজীবী হিসাবে তাঁদের হক। তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার দাবিকে কেন সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে পূর্ণাঙ্গ আইন তৈরি করবে না? ২০১১ সালে The International Labour Organisation (আইএলও) গৃহীত কনভেনশনের অনুসরণে উপযুক্ত আইন আজও ভারতে প্রণীত হয়নি। ১৯৮৬ সালের ২০ দফা কর্মসূচিতেও অসংগঠিত গোষ্ঠী হিসাবে গৃহপরিচারক, পরিচারিকাদের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য কোনো সরকার উদ্যোগী হয়নি।
কিন্তু করোনার মতো বিশ্বব্যাপী মহামারীর দাপটে যখন সমস্ত মানুষ ঘরবন্দি হয়ে রয়েছেন তখন গণপরিবহণহীন রাস্তায় গৃহসহায়িকাদের কাজে বেরোনোর কোনও উপায় থাকে না। বেরোলেও নানা প্রতিবন্ধকতা। নিরুপায়, অসহায় বহু গৃহসহায়িকা আগামী মাস থেকে কাজ থাকবে কিনা সেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন। লকডাউনের কারণে গৃহসহায়িকারা আসতে পারছেন না। এটা তাঁদের দোষ নয়। এঁরাও তো সমাজের অংশ। তাঁদের চলমান জীবনযাপনে ছেদ পড়েছে। আর্থিক অনটন তার মধ্যে আরও সংকট তৈরি করেছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই গরিব, নিম্নবিত্ত ও দিন আনি দিন খাই মানুষের জীবনে। রেশনের চালই এখন তাঁদের ভরসা। সরকার গৃহসহায়িকাদের দুর্দশা লাঘবে এগিয়ে আসবেন, এ মুহূর্তে এই দাবি কি খুব অন্যায়?