চাঁদের চোখের জল – অপর্ণা গাঙ্গুলী
চাঁদের চোখের জল দেখলে আমি কষ্টে থাকি |
কতবার দিদিমাকে বলতাম – ওই চাঁদের মধ্যে কালো কালো কী সব গো ? দিম্মা বলতেন ও সব নিয়ে ভেবো না | ওসব চাঁদের এলোমেলো মনখারাপি | ইস্কুলে বকুনি ঝকুনি খেলে তোমার যেমন মুখ কালো হয়ে থাকে আর কী ! আহা গো চাঁদ বকা খায়? কার কাছে, আকাশে ওকে কে বকে … আমার কেমন মনে হতো, দিম্মা বলছে বটে, তবে এ আরও শক্ত কিছু | কেমন জমাট বাঁধা চাপ চাপ দুঃখ যেন | সে সব ভারী ভয়ানক অ-সুখের কথা |
বড়ো হয়ে অনেক সময় শুনেছি ওই কালো দাগ, ওসব নাকি চাঁদের কলঙ্ক |
পাড়ার হীরক জেঠুর মেয়ে যেদিন ধর্ষিতা হয়ে বিবস্ত্রা রাস্তায় পড়ে ছিল, দিদিমার খাস ঝি মানদা মাসি এসে বলেছিলো – মে গে কি কলঙ্ক ছিঃ | অত্ত বড়ো মেয়েকে কিনা ন্যাংটা করে ফেলে রেখে গেলো গা | এখন ও কি করে মুখ দেখায় ! আমি ভেবে পাইনি এতে বিথী দিদির কি দোষ? ও কী বা করবে | বাড়িতে মা মাসি দিদা সবাই ওই ঘটনা নিয়ে ফিসফিস করেছিল অনেকদিন | বিথী দিদি তারপর কেমন চুপ হয়ে গিয়েছিলো | ওর মনে কী প্রবল ছাপ পড়েছিল কী বলবো | ওর আত্মার উপর গোটা কতক কালো কালো বিশ্রী দাগ ওর বেঁচে থাকাকে সঙ্গীন করে তুলেছিল |
মেয়ে আর বাবা এই দুজনের সংসার | মা ছোটবেলাতেই গেছে | মানদা মাসি খবর আনে | বাবাটা নাকি দিনরাত মেয়েকে বলে – মর মর, মরণ হয় না তোর | তোর জন্যে আমি রাস্তায় ঘাটে বেরুতে পারিনা আজকাল | মেয়েটার নৈঃশব্দ্য হাহাকার করে ফেরে ওদের সেই ছোট একতলার টালির ঘরে ঘরে | আগে আমাদের বাড়ি আসতো যেত | এখন সেটুকুও নেই l আমি একবার কথা বলতে গেলে বলেছিলো, আমার সাথে কথা বলিস না ফুলি l কে কমনে দেখে তোকে খারাপ বলবে | সেদিন দেখেছিলাম বীথি দি কাঁদছে |
যা হোক, তিন মাসের মাথায় বিথী দি আত্মহত্যা করলো |
তখন অনেককে বলতে শুনলাম – আহা অমন চাঁদের মতো মেয়েটা !
আজ হঠাৎ জানালা দিয়ে চাঁদের দিকে তাকালাম l দেখি চাঁদের চোখ ভরে এসেছে |
টলমল ছলছল | চাপা একটা কান্নার সুর ঘুরে ঘুরে ফিরতে লাগলো আমাদের ছাদে, দালানে, আশে পাশে, ঘরে, দুয়ারে, সব জায়গায় |
আর ঠিক তখন, বিথী দির জন্যে হঠাৎ এতদিন পরে মনটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো |
Khub sundar lekha