ছেঁড়া পাতা – মনীষ দেব

শেয়ার করুন

‘জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে’ ― কালো কালিতে দেয়ালে আঁচড় কেটে লেখা ছিল লাইনটা, ইস্কুলের জীর্ণ বিবর্ণ প্রাচীরের মলিন কয়েকটা অক্ষরের মালিকানা ছিল না কারও। তবুও এক-দেড় দশক লাইনটা ছিল মলিন থেকে মলিনতর হয়ে কত শীত গ্রীষ্ম বর্ষা পেরিয়ে। প্রাচীরটা নেই আজ, প্রাচীরের ওপারের ভটচাজের ফলসা পুকুর। সেই ফলসা পুকুরে এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে কংক্রিটের জঙ্গলের টাইলসে মোড়া প্রাচীরে ফুটে ওঠে অদৃশ্য শব্দরা সব আজ―
তবুও তোমার চাই চেতনা,
চেতনা থাকলে আজ দুর্দিন আশ্রয় পেত না…

কোনও ধ্রুবতারা নয় ধ্রুবব্রত, স্বচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্র। কখনও ক্লাসে দ্বিতীয় হয়নি, তবুও অদ্বিতীয় নয় সাদামাঠা ধ্রুব, ধ্রুবব্রত কবিতা বলত ইস্কুলে – পাড়ায় পাড়ায় – রবীন্দ্র জয়ন্তীতে। তবে সুকান্ত ছাড়া কারও কবিতা কখনও বলেনি। প্রথম শোনা― সে কবিতা পঁচিশে বৈশাখে―

‘মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে।
তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে,
গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে;
যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে
এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে।’

মণীষ দেবের তুলিতে সুকান্ত ভট্টাচার্য (১)

ধ্রুবব্রতর সুকান্ত-প্রীতি― সুকান্তর ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ অনুচ্চারিত রবীন্দ্রনাথ, অনুভবের রবীন্দ্রনাথ, না আজ আর রবীন্দ্রনাথ নয় শুধু সুকান্ত।
এবং সুকান্ত― পানওয়ালা রামদয়ালের সুকান্ত। ভিনদেশি ক-অক্ষর জ্ঞানের রামদয়াল সাউ, তারস্বরে রেডিও টেপ-রেকর্ডার বাজাত শেষ দিন পর্যন্ত। স্বাধীনতার ৫০ বছরে রামদয়াল বলেছিল― ওর স্বাধীনতা, ওর তেরঙ্গা, ওর ইন্ডিয়া―

‘রানার! রানার!
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?’

যে রামদয়াল সুকান্তকে জানে না, সেও সুকান্তেই খুঁজেছে মুক্তি। স্বাধীনতার পড়ন্ত এ বিকেলে আর একবার বলো তারজন্য কবি―
এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি―
এক কিশলয় শিশু সহজপাঠ ছোঁয়ার আগে, শরীরি ভাষায় বলেছিল―
এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম,
অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম!

সেই কিশলয় শিশু আজও তাজা যৌবন ছুঁয়ে শরীরি ভাষায় বলে যায়―
হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত―‘রক্ত খরচ’ তাতে;

আর, আরও একটা স্বাধীনতা দিবস নিঃশব্দে পেড়িয়ে যায়।
এবং এক কমিউনিস্ট জীবনের মধ্যাহ্নে খুঁজে ফেরে ছেঁড়া পাতা― ইস্কুলের সেই মলিন ধূসর প্রাচীর― না নেই। না নেই সেই রামদয়াল, আর বাজেনা―
মাভৈঃ, রানার! এখনো রাতের কালো’।
এখন সেই ধ্রুবব্রত ভুমিপূজা দেখে চ্যানেলে-চ্যানেলে। বাল্মীকির রাম থাক বা না থাক।
কৈশোরের অনুভবের ‘সুকান্ত’ তার, মধ্যাহ্নের শাখাপ্রশাখায় রোদ্দুর মেখে ধর্মতলার মোড়ে। ১৫০ বছর পেরিয়ে দাঁড়িয়ে লেনিন। ছেঁড়া পাতায় লেখা বিশ্বাস―

‘দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা।
পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে,
লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে।’

মণীষ দেবের তুলিতে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (২)
শেয়ার করুন

Similar Posts

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *