বিশ্বাস আমাকে দিয়ে লেখায় – রিজিয়া রহমানের সাক্ষাৎকার
[বাংলাদেশের কথাশিল্পের অগ্রগামী ও প্রতিনিধিত্বশীল কথাশিল্পীদের অন্যতম একজন রিজিয়া রহমান। জন্ম ১৯৩৯ সালে, কলকাতায়। প্রতিভাময়ী ও পরিশ্রমী এই কথাশিল্পীর উপন্যাস ও গল্প বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস থেকে আধুনিক বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাস, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বাস্তবতা, পতিতাপল্লীর নিষিদ্ধ-জীবন, চা-শ্রমিক-সাঁওতাল-হাঙর শিকারির জীবন-লড়াই, সুখ-সমৃদ্ধির তাড়নায় দেশছাড়া প্রবাসীদের অস্তিত্বের সংকট বা মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধা এবং প্রেম বা মানবজীবনের চিরায়ত অনুভবকে তিনি গল্প-উপন্যাসের বিষয় করেছেন আশ্চর্য নির্লিপ্ততায়, কঠিন শ্রম ও সাধনায়, নিপুণ শিল্পকৌশলে। ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্যপুরস্কার প্রাপ্ত এই লেখক গত ১৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।এই আলাপচারিতায় তাঁর সাহিত্য, সমাজ ও জীবনভাবনার কিছু অংশ উঠেছে এসেছে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন প্রাবন্ধিক চন্দন আনোয়ার। তাঁকে সহযোগিতা করেছেন কথাশিল্পী মোজাফ্ফর হোসেন।]
প্র: আপনার জন্ম পশ্চিমবাংলায়। দেশত্যাগের কারণে বাংলাদেশে চলে আসা। ভারতীয় ইতিহাসের এই পর্বটাকে কিভাবে দেখেন?
রি.র : দেশত্যাগ বলতে যা বোঝায় শৈশবে যখন জন্মস্থান ছেড়েছিলাম, খুব একটা প্রভাবিত আমাকে করেনি। আমার পৈতৃক ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার এক গ্রামে।কলকাতার খুব কাছেই। দেশের বাড়ি বলতে সেই নিস্তরঙ্গ সবুজ গ্রামটিকেই বুঝতাম, যদিও আমার কাছে কলকাতাই ছিল আমার দেশ। তবে আমার মামাবাড়ি বাংলাদেশের ঢাকা জেলায় হওয়াতে, পশ্চিম ও পূর্ব দুই বাংলাই ছিল আমার দেশ। বাবা ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের’ চিকিৎসক হিসেবে অবিভক্ত বাংলার বহু হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর ছিল বদলির চাকরি। সাতচল্লিশের দেশভাগের অল্প কিছু আগেই তাঁকে বদলি করা হয় পূর্ব বাংলার ফরিদপুরে। তখনই শুরু হয়েছিল বিভাগ-পূর্ব সময়ের হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, যার মুখোমুখি হয়ে প্রাণ ভয়ে আমার বাবার দিকের অনেক আত্মীয়-স্বজনকে কলকাতা ছাড়তে হয়েছে। ‘দাঙ্গা’র দুর্ভোগ আমার পরিবারকে পোহাতে হয়নি। আত্মীয়-স্বজন যারা প্রাণ বাঁচাতে ফরিদপুরে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিলেন তাদের মুখে সেই ভয়ঙ্কর খুনোখুনির গল্প শুনেছি।দেশভাগের পরে বাবা সরকারি কর্মচারি হিসেবে ‘অপশনে’ পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। তখনও আমার দাদার দেশটি আমার দেশই ছিল। দেশের বাড়িটি অখণ্ডই ছিল। স্কুলের প্রতি গ্রীষ্মের ছুটিতে আমের দিনে কলকাতায় এবং বাবার জন্মস্থানের গ্রামে বেড়াতে যাওয়া বন্ধ হয়নি বেশ অনেক দিন পর্যন্ত।তারপরই এল বাধা—বিদেশি নাগরিকের জন্য ভিসা-পাসপোর্ট ইত্যাদির প্রতিবন্ধকতা। তথাপি অনুভব করতে শুরু করলাম-পৈতৃক সূত্রে পাওয়া আমার স্থায়ী ঠিকানাটি হয়ে গেছে বিদেশ। এ বোধটি দিনে দিনে আরো গভীর ও দুঃখবহ হয়েছে। বাবা মারা যাওয়া পর এই দেশে, যেখানে বাবার কেনা একটি বাড়ি ছাড়া আমাদের আর কিছুই ছিল না, সেখানে যথেষ্ট সংগ্রাম করেই আমাদের প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আমরা আর ফিরে যেতে পারিনি। তবু বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে ফেলে আসা সেই গ্রামটি, আর আমার প্রিয় জন্মস্থান কলকাতা শহর। এরপর দাদার দেশের সম্পত্তি (যার মালিক আমিও) দখল হয়ে গেলে মনে হয়, দেশভাগ কি সত্যিই অনিবার্য ছিল?
প্র: লেখালেখিতে কারও প্রভাব পড়েছে কি?
রি.র : এতদিন পরে এসে নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না যে লেখালেখিতে কার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম। সম্ভবত মায়ের পাঠ-অভ্যাস এবং বিশেষ করে আমার মায়ের বড়বোন-আমার একমাত্র খালার বইপড়ার অভ্যাসটি আমাকে সেই ছোটবেলা থেকেই আকৃষ্ট করেছিল। তিনি ছিলেন বই অন্তপ্রাণ। ছোট্ট বয়সে আমার কবি হয়ে ওঠায় গর্বিতই হতেন তিনি। নতুন কিছু লিখলেই তাকে পড়ে শোনাতে হত। এ ছাড়া আমার মামাবাড়ির পরিবেশটিও প্রভাবিত করবার জন্য যথেষ্ট ছিল। সে বাড়িতে প্রতি বছর কবিগান, জারিগান, শারীগান, যাত্রাপালা ইত্যাদির আয়োজন করা হত। হাতে লেখা একটি ঢাউস আকৃতির পত্রিকাও বের করা হত মামাবাড়ি থেকে। সেখানেই আমরা ভাইবোনরা লেখার শিক্ষানবীশ ছিলাম। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার এই পরিমন্ডলটি আমাকে প্রভাবিত করছিল লেখক হতে। তবে, নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমার আশৈশব পড়ার প্রতি আকর্ষণই আমার লেখাকে প্রাথমিকভাবে প্রভাবিত করেছে। এই বই পড়ার মধ্য দিয়ে প্রথমে আমাকে প্রভাবিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপরে যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি তারা হলেন—বুদ্ধদেব বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশেষ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাস দুটি, ইংরেজি সাহিত্যের কবিতাগুলো আমাকে মুগ্ধ করলেও ফরাসি এবং রুশ সাহিত্য ছিল আমার ব্যাপকভাবে পড়া। বিশ্বসাহিত্য পাঠ থেকেও আমি যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। তবে সাহিত্যজীবনে প্রকৃতি ও মানুষ আমার কলমে স্থান করে নেওয়ার নেপথ্যে শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটির। সেই কৈশোরকাল থেকে আজ পর্যন্ত এ উপন্যাস আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
প্র: নারী লেখক হিসেবে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?
রি.র : আমি বেগম রোকেয়া বা বেগম সুফিয়া কামালের যুগের নারী লেখক নই যে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার জন্যে সমাজের অনুশাসনের চোখ রাঙানি বা পারিবারিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, কিংবা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি মিলবে।আমি ষাটের দশকের লেখক। পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশে) যে শিক্ষিত নব্য মধ্যবিত্তের উত্থান ঘটেছিল তাদের চেতনায়, মননে, জীবনচর্চায় নারী স্বাধীনতা আধুনিক পৃথিবীর আলোকেই স্থান পেয়েছিল। ষাটের দশকের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক চেতনায় এদেশের নারী ছিল যথেষ্ট অগ্রগামী। সুতরাং নারী হিসেবে সাহিত্যচর্চায় আমাকে বিশেষ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি—না পরিবারে, না সমাজে। তবে প্রতিবন্ধকতা যা হয়েছিল সেটা ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসটি লেখবার সময়। পাঠকেরা জানেন, এটি নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েদের জীবন নিয়ে লেখা। পতিতাবৃত্তি সমাজে ঘৃণ্য হলেও আজও যে আইনত নিষিদ্ধ নয় সবারই সেটা জানা। যেখানে ‘বেশ্যা’ শব্দটি উচ্চারণ করা বা ‘বেশ্যা’ গালি দেওয়া একটি নিষিদ্ধ ঘৃণ্য ব্যাপার মনে করা হত, সেখানে তাদের নিয়ে উপন্যাস লেখাটা বৈধ ভেবে নেওয়াটা তখন কঠিনই ছিল, আর বেশ্যাপল্লীতে গিয়ে তাদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করাও ছিল দুরূহ। অনেক চেষ্টা করেও একজন ‘ভদ্রঘরের’ মেয়ে হিসেবে বেশ্যাপাড়ায় যেতে পারিনি আমি। বইটির প্রকাশ যদিও আমাকে প্রচুর খ্যাতি এনে দিয়েছিল, দুর্ভোগও পোহাতে হয়েছে যথেষ্ট। আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশীদের অনেকে পেছনে ধিক্কার দিয়েছে। এ ছাড়া ছিল রাতে পুরুষকণ্ঠে অশ্লীল ফোনের উৎপাত। সত্তরের দশকে নারী-লেখকের মূল্যায়নে ‘মেইল ইগো’-জনিত একটি প্রবণতা নারী সাহিত্যিকদের বিভ্রান্ত করবার জন্য বেশ সরব হয়েছিল। বলা হয়েছিল—নারীদের লেখা নারীবৃত্তির কারণে ‘ফেমিনাইন’ দুর্বলতায় আক্রান্ত। এই পশ্চাদমুখীনতাকে আমি কখনই গুরুত্ব দিই নাই। তাছাড়া ‘শ্লোগানটি’ খুব একটা ধোপে টেকেনি। আর এখন তো নারীবাদের যুগ। ফেমিনাইন দুর্বলতাই এখন হয়তো নারীবাদ শ্লোগানে শক্তি সঞ্চয় করেছে।
প্র: রাজনীতি তো আপনার লেখালেখির প্রিয় বিষয়?রি.র : আমি রাজনীতি সচেতন মানুষ, তবে সক্রিয়ভাবে জাতীয় রাজনীতিতে কখনো সম্পৃক্ত না হলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতিতে অংশ নিয়েছি। ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ইডেন মহিলা কলেজে নির্বাচনে জিতে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেও ছাত্র-ইউনিয়নে ছিলাম। সেসময়ে আমাদের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে পরপর দু’বার নির্বাচিত হয়েছি। তখন মোস্তফা জামাল হায়দার, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন (বর্তমানে মন্ত্রী) এঁরাই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের বিশিষ্ট নেতা।
প্র: উপন্যাস ‘উত্তরপুরুষ’। পতুর্গিজ জলদস্যুদের কাহিনির পাশাপাশি ভয়ানক নারী নির্যাতন, কুমারী মায়ের ওপরে নেমে আসা নিপীড়ন এবং এক পুরুষের চারজন নারীকে বিয়ে করার মর্মান্তিক কাহিনি আছে।
রি.র : ‘উত্তরপুরুষ’ আমার একেবারে প্রথম দিকে লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস। ‘৬৯ সালে সম্ভবত। আমার প্রথম উপন্যাসটি তখন সবে লিখে শেষ করেছি। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে শুরু করেছে তখনকার জনপ্রিয় পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক ললনা’য়। উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা তখন নেই বললেই চলে, একটি মাত্র উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতাই সম্বল, লেখার প্রকরণ, প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান নেই, তবুও শুরু করলাম লেখা। প্লটও খুঁজে পেলাম।চট্টগ্রাম সেই ষাটের দশকে ছিল ছিমছাম ফাঁকা ফাঁকা পাহাড়-সমুদ্রঘেরা চমৎকার একটি আধুনিক শহর। প্রায় ঘুরে বেড়াতাম শহরের এখানে সেখানে। প্রায় চার’শ বছরের পুরনো সেন্ট প্লাসিড র্গিজা, ফিরিঙ্গি বাজার, পাথরঘাটা ও শহরের অন্যান্য প্রাচীন স্থানগুলো আমাকে কৌতূহলী করত। প্রায় যেতাম কর্ণফুলী নদীর পাড়ে, পতেঙ্গার সমুদ্রের ধারে। নেভাল- বেইজের সামনের রাস্তা পোর্ট ট্রাস্টের এলাকা ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট ফেলে একেবারে শেষ মাথায়—যেখানে কর্ণফুলী নদী পৌঁছেছে মোহনায়, মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। নদী, সমুদ্র, আউটার অ্যাংকরে থেমে থাকা জাহাজের সারি, কর্ণফুলী নদীর বুকে আলোড়ন তুলে বন্দরে বিদেশি জাহাজের আসা-যাওয়া আর পতেঙ্গার সীমেন্স হোস্টেলের সামনে বিভিন্ন দেশি বিভিন্ন ভাষী নাবিকদের আনাগোনা ভীষণ আকৃষ্ট করত আমাকে। চট্টগ্রামের প্রাচীন সমুদ্র-বন্দর – সাড়ে চার’শ বছর আগে এদেশে আসা পর্তুগিজরা যার নাম দিয়েছিল ‘পোর্ট গ্র্যান্ডী’, তাকে ঘিরেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছিল কলঙ্কিত পর্তুগিজ অধ্যায়। সেই দুর্ধর্ষ জলদস্যু আর পর্তুগিজদের উত্তরপুরুষ ফিরিঙ্গি বাজারের আধুনিক ফিরিঙ্গিদের জীবনযাপন নিয়ে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে লিখলাম দ্বিতীয় উপন্যাস ‘উত্তরপুরুষ’। উপন্যাসটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৮৪-তে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো’র সাউথ এশিয়ান কালচার লিটারেচার এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বিভাগের ডিন প্রফেসর চিমুকের তত্ত্বাবধানে ‘উত্তরপুরষ’ উপন্যাসটির ওপরে একটি পেপার উপস্থাপিত হয় আমেরিকার সেলসবেরিতে এক সেমিনারে। এর বেশ অনেকদিন পরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. বি. ক্লিনটন সীলি তাঁর একটি বইতে ‘উত্তরপুরুষ’ উপন্যাসের ওপরে নিজের লেখা দীর্ঘ একটি নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করেন।
প্র: আপনি কি সচেতনভাবে নারীবাদী লেখক?
রি.র : আমি নিজেকে কখনও কোনো তত্ত্ব বা এজেন্ডার শ্লোগানের বেড়াজালে আবদ্ধ করিনি। লেখাকে তো নয়-ই। তাছাড়া নারীকে আমি মানুষ হিসেবে দেখতে পছন্দ করি, শুধু নারী হিসেবে নয়। আমি মনে করি জন্মগতভাবে এ পৃথিবীতে সবকিছুতেই মানুষমাত্রই রয়েছে অধিকার। তিনি নারী বা পুরুষ যিনিই হোন। বিশ্বাস আমাকে দিয়ে লেখায়, আমি সেই ধারারই লেখক। এতে নারীবাদ, মানবতাবাদ, প্রকৃতিবাদ সবই থাকতে পারে। আসলে আমি লিখি সব মানুষের কথা, মানুষেরই জন্য।
প্র: বহুল আলোচিত ও পঠিত উপন্যাস ‘রক্তের অক্ষর’ নিয়ে আপনার অভিজজ্ঞতার কথা জানতে চাইবো।
রি.র : ‘রক্তের অক্ষর’ আমার জনপ্রিয়তম উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৭৭ সালে লিখেছিলাম, প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সেই বছরেরই ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য়। বই আকারে মুক্তধারা প্রকাশ করে (১৯৭৮)। ‘রক্তের অক্ষর’ আমার জন্য প্রচুর খ্যাতি বয়ে আনে। সম্ভবত বিষয়বস্তুই ‘রক্তের অক্ষর’-এর অভাবনীয় জনপ্রিয়তার কারণ। নিষিদ্ধ জগতের অপমান, নির্যাতন, লাঞ্ছনা ও নির্মমতা সয়ে যারা নিরুপায় জীবিকা অর্জন করে, তাদের কথাই আমি লিখেছি। পতিতাপল্লীর নারীদের নিয়ে উপন্যাস লেখা বেশ দুরূহই ছিল। বিশেষ করে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে একজন মহিলা যদি সেটা লেখেন তবে তা ব্যতিক্রমী ঘটনাই হয়ে যায়। এমন একটি বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখবার কথা মনেও আসেনি কখনও আমার। বেশ কাকতালীয়ভাবেই সেটা ঘটল। সে সময়ে ‘ঢাকার পতিতালয়’ শিরোনামে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় একটি প্রচ্ছদ কাহিনি করেছিল। পতিতাদের নিয়ে বিস্তৃত চিত্র প্রতিবেদন ছিল সেই সংখ্যায়। পতিতাদের একদিকের খবর জানা ছিল, অপর দিকটি কখনও জানা হয়নি। সে-ই প্রথম জানলাম। মনে আছে, পরে ‘বিচিত্রা’ পড়ে স্তম্ভিত হয়েছিলাম, ঘুমোতে পারিনি সে রাতে। সেই আঘাতের বেদনাই আমাকে ‘রক্তের অক্ষর’ লিখতে বাধ্য করেছিল। সমাজে উপেক্ষিত, ঘৃণিত এইসব নারীদের জীবনের কথা আমার মতো আমার পাঠকদেরও স্তম্ভিত করেছিল হয়তো। সেই প্রথম সচেতন মানুষেরা ভাবতে পেরেছিল, নিষিদ্ধ জগতের দেহব্যবসায় নির্বাসিত পতিতারাও মানুষ। মানবাধিকারের এমন নির্লজ্জ উদগ্র লঙ্ঘন বিবেকসম্পন্ন মানুষকে বিচলিত করেছিল বলেই হয়তো ‘রক্তের অক্ষর’ পাঠক সমাজে গুরুত্ব অর্জন করতে পেরেছে।
বিশ্বাস আমাকে দিয়ে লেখায়, আমি সেই ধারারই লেখক। এতে নারীবাদ, মানবতাবাদ, প্রকৃতিবাদ সবই থাকতে পারে। আসলে আমি লিখি সব মানুষের কথা, মানুষেরই জন্য।
প্র: ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলো নিয়ে জানতে চাই।
রি.র : ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছি আমি এখনও পর্যন্ত ৩টি—‘অলিখিত উপাখ্যান’, ‘আবে-রওয়াঁ’, ও ‘আল বুর্জের বাজ’। ‘অলিখিত উপাখ্যান’ সর্ম্পকে একটু আগেই বলেছি। ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠা ও শায়েস্তা খানের পরাজয়কে নিয়ে আমার ‘আবে-রওয়াঁ’ উপন্যাসটি লেখা। আসলে লিখতে চেয়েছিলাম ঢাকা শহরের প্রাচীন ইতিহাস-ভিত্তিক একটি উপন্যাস, কিন্তু তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখলাম, ঢাকা নগরীর বিকাশ প্রধানত মসলিনকেন্দ্রিক। মসলিনকে কেন্দ্র করেই এর উত্থান। উপন্যাসটি মসলিনকে কেন্দ্রে রেখেই তাই লিখতে হয়েছে। ঢাকাই মসলিনের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকও মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। বিশেষ এক ধরনের অভিজাত সূক্ষ্ম মসলিন ছিল নূরজাহানের প্রিয়। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘আবে-রওয়াঁ’ অর্থাৎ আব-ই-রওয়ান। ফার্সি ভাষায় এর অর্থ চলমান জল (নদী)। আমি এই ‘আবে-রওয়াঁ’ নামটিকে চলমান সময়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছি আমার উপন্যাসে।‘আল বুর্জের বাজ’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণই ভিন্ন। ইসলামের নামে ধর্মীয় সন্ত্রাস অর্থাৎ ধর্মের গুপ্তহত্যা ও আত্মঘাত প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহারের ইতিহাস নিয়েই এই উপন্যাস। ইসমাইলী শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ইরানে জন্মগ্রহণকারী হাসান বিন সাব্বাহ একদল স্বাস্থ্যবান যুবক ও কিশোরদের নিয়ে আত্মগোপনকারী গুপ্তঘাতক একটি দল গড়ে তোলেন। ১০৯০ খিস্টাব্দে তিনি উত্তর ইরানের আলবুর্জ পর্বতের গিরিসংকটে গুপ্তঘাতক প্রশিক্ষণের ঘাঁটি নির্মাণ করেন। সাব্বাহ তার অনুসারীদের হাশিশ মাদকাসক্ত করে ধর্মের নামে যে সন্ত্রাসী দল সৃষ্টি করেন তারা ইতিহাসে হাশাশী সন্ত্রাসী নামে অভিহিত হয়। বিরুদ্ধবাদীকে হত্যা করার জন্য এদের কঠোর প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র চালনার শিক্ষা দেওয়া হত। তাদের বলা হত, ধর্মগুরুর আদেশে বিরুদ্ধ শত্রুকে হত্যা করতে পারলে মৃত্যুর পরে তারা বেহেস্তে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করবে। বস্তুত শিয়া-সুন্নির সংঘাত থেকেই এই গুপ্তঘাতক হাশাশী সম্প্রদায়ের উত্থান। তুর্কী সেলজুক সম্রাটদের রাজত্বকালেই এই কথিত ধমীর্য় সন্ত্রাসের প্রসার ঘটে। এবং তা প্রায় সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। মার্কোপোলোর ভ্রমণকাহিনি পড়েই আমি এদের সম্পর্কে জানতে পারি। তারপরেই ইসলামের ইতিহাসে এদের খোঁজ করি। তখনই এদের নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করি। ইসলামের দোহাই দিয়ে আধুনিক পৃথিবীতে ইদানিং যে সন্ত্রাস ঘটছে তার সঙ্গে বহু বছর আগে হাসান বিন সাব্বাহ অনুসৃত হাশাশী সন্ত্রাসের বিশেষ পার্থক্য ছিল না। তারাও শহিদ ও জিহাদ ধারণা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল।এমন একটি ঐতিহাসিক এবং স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখাটা আমার জন্য অত্যন্ত পরিশ্রম সাপেক্ষই ছিল। যে দেশ আমি চিনি না, যে দেশের মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষা সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত, সে দেশের অতীত নিয়ে লেখা উপন্যাস পাঠকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সমর্থ হবে কিনা, এ সংশয়ও ছিল। তবু আমার একান্ত ইচ্ছা, প্রচণ্ড লেখাপড়া, শান্তির ধর্ম ও সন্ত্রাস আক্রান্ত পৃথিবী এবং নিরাপরাধ মানুষদের শান্তির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই উপন্যাসটি লিখে শেষ করতে পেরেছিলাম।
প্র: মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস নিয়ে আপনার কাছে জানতে চাইবো।রি.র : বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গণে আমরা যারা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি আমরা অবশ্যই স্বীকার করি জাতীয় এই দুটি মহান ঘটনা আমাদের চিন্তা চেতনায়, সাহিত্যসাধনায় আমূল পরিবর্তন এনেছিল। সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ভাষার ঠিকানা ধরে আমরা আমাদের আত্মপরিচয় নির্ধারণের কাজটি সম্পন্ন করেছিলাম এবং সাহিত্যের নতুন পথ নির্দেশিত হয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড ও স্বাধীন জাতির গৌরব দান করেছে। এই গৌরবের আবেগই আমাদের নিজস্ব সাহিত্য নির্মাণের প্রেরণা দিয়েছে। জাতীয় জীবনে মহান এই ঘটনা আধুনিক সাহিত্যচর্চার নতুন বাঁক নির্মাণ করে আমাদের প্রেরণার মূল উৎস হয়ে উঠেছে। এই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই স্বাধীনতা লাভের দু’বছর পরেই লিখতে শুরু করেছিলাম আমার গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘বং থেকে বাংলা’। অনেকে এটিকে ঐতিহাসিক উপন্যাস আখ্যা দিলেও বাংলা, বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা বিবর্তনের শেষে দীর্ঘদিনে একটি জাতির পূর্ণতা প্রাপ্তি ও স্বাধীন জাতি হিসেবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবার ইতিহাস। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিজয় গৌরব অর্জন পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরব্যাপী প্রবাহমান ইতিহাসবর্ণিত এই উপন্যাসে রয়েছে একটি বিবর্জিত মানবগোষ্ঠীর জাগরণ ও উত্থানের কাহিনি। এই বইটি লিখতে সময় লেগেছিল প্রায় চার বছর- ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫। লেখা শেষ হওয়ার পর প্রকাশকের অভাবে ফাইলবন্দি হয়ে পড়েছিল অনেকদিন। ততদিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে, দেশ তখন সামরিক শাসনের অধীনে, এবং শুরু হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাসের বিকৃতি। বইটির প্রকাশ প্রায় দুঃসাধ্যই হয়ে পড়েছিল। অবশেষে মুক্তধারা’র চিত্তবাবু ‘বং থেকে বাংলা’ প্রকাশ করতে রাজি হয়েছিলেন, শর্ত ছিল বইটির স্বাধীনতাযুদ্ধের অধ্যায় থেকে বেশ কিছু অংশ কেটে বাদ দিতে হবে। শর্তটি পূরণ করতে হয়েছিল আমাকে। চিত্তবাবু ছিলেন নিরুপায়। মাত্র কয়দিন আগেই সামরিক সরকারের জেলখানার বন্দিত্ব থেকে ছাড়া পেয়েছেন, তবু ‘বং থেকে বাংলা’র অঙ্গহানির দুঃখ আজও রয়ে গেছে আমার। এরপরেই ১৯৭৯-তে লিখেছিলাম ‘একটি ফুলের জন্য’ উপন্যাস। অবহেলিত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল অদ্ভুত এক সময়। সামরিক শাসক দেশদ্রোহী স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, স্বাধনিতাবিরোধী রাজাকার শাহ আজিজকে দেওয়া হয়েছে প্রধান মন্ত্রিত্ব। এই শাহ আজিজ এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তখন চরম দুর্দিন, অনেকেই আত্মগোপন করেছেন। অবিশ্বাস্য এই সময়টিকেই আমি ধারণ করতে চেষ্টা করেছি ‘একটি ফুলের জন্য’ উপন্যাসে। পরবর্তী দুটি উপন্যাস—‘কাছেই সাগর’ ও ‘উৎসে ফেরা’। এসময় স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলেও সামরিক সরকারের আদলে চলছে দেশ পরিচালনা। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীরা মন্ত্রিত্ব পেয়েছে। তাদের সরকারি গাড়িতে রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা উড়ছে। সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় মাথা তুলেছে চরমপন্থী কথিত ইসলাম অনুসারী জঙ্গিবাদ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলবার অপচেষ্টা চলেছে জাতীয় জীবন থেকে। র্যাপিড একশন বাহিনী দিয়ে কথিত ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।এই সময়ে লেখা আমার ‘উৎসে ফেরা’ উপন্যাসটি। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের প্রসঙ্গই এই উপন্যাসের প্রধান বক্তব্য।‘কাছেই সাগর’ ভিন্ন স্বাদের একটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস। একটি স্বল্পশিক্ষিত কেরানির স্ত্রী গ্রাম থেকে আসা তরুণীর দৃষ্টিতে দেখা উনসত্তরের আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র, শেখ মুজিবের মুক্তি, অতঃপর উত্তাল একাত্তর, অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের প্রারম্ভে মার্চেই স্বামী-সন্তানসহ নিখোঁজ হয়। এর আগে সে একটি নকশিকাঁথা সেলাই করত। সে কাঁথায় সে প্রতিটি ঘটনার ছবি সূচ-সুতোয় মূর্ত করে রাখত। কাঁথা সেলাই শেষ করেছিল একাত্তরের পঁচিশে মার্চের আগে। কাঁথার মাঝখানে সে তৈরি করেছিল একটি সূর্য, নিচে লিখে দিয়েছিল ‘বাংলাদেশ’। একটি অতি সাধারণ পরিবারের গৃহবধূর স্বাধীনতার আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া আর শহিদ হয়ে যাওয়াই এ উপন্যাসের মূল কাহিনি হলেও তাঁর সাগরে যাওয়ার স্বপ্ন সফল হয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য এক সাগর রক্তের মাঝে পৌঁছে গিয়েছিল সে। যার ছিল দীর্ঘদিন ধরে সাগর দেখার ইচ্ছা।
One Comment